আমরা দেখলাম যে, মথি, মার্ক ও লূক তিনজনই একমত হচ্ছেন যে, যীশু নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র, আল্লাহর পুত্র বা ‘ইবনুল্লাহ’ বলে স্বীকার করাতেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইঞ্জিল লেখকের ধারণায় নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করা ইহুদি ধর্মবিশ্বাস অনুসারে বস্নাসফেমি বা কুফরী বলে গণ্য ছিল, আর এজন্যই ইহুদিরা তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু বাইবেল প্রমাণ করে যে, নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহ বলে দাবি করা ইহুদি ধর্মবিশ্বাসে কুফরী নয়; বরং ঈমানের দাবি ও প্রশংসনীয় কর্ম।
উল্লেখ্য যে, ইংরেজি ‘সান অব গড’ (the Son of God) বা আরবি ‘ইবনুল্লাহ’ (ابن الله) বাক্যাংশ বাইবেলের মধ্যে একবচন ও বহুবচনে প্রায় ৭০ বার ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী বাইবেলে সকল ক্ষেত্রেই ‘the Son of God’ অর্থ (ابن الله) ‘ইবনুল্লাহ’ লেখা হয়েছে। কেরির বঙ্গানুবাদে সর্বত্র ‘the Son of God’-এর অনুবাদে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বা ‘দেবপুত্র’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বাংলা কিতাবুল মোকাদ্দসে যীশুর দেবত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘the Son of God’ অর্থ লেখা হয়েছে ‘ইবনুল্লাহ’ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে ‘আল্লাহর পুত্র’। বাহ্যত যীশুর ঈশ্বরত্ব বিষয়ে একটা দুর্বোধ্য আরবি পরিভাষা সৃষ্টির করার জন্যই এরূপ করা হয়েছে। পাঠক নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(ক) যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে একজন সেনাপতি বা শতপতি যীশুকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ঈশ্বরের পুত্র (the Son of God) বলে আখ্যায়িত করেন। মার্ক লেখেছেন, উক্ত শতপতি যীশুকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে বলেন: “Truly this man was the Son of God.”: ‘‘সত্যিই এ ব্যক্তি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন।’’। কেরির অনুবাদ: সত্যই ইনি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন।’’ জুবিলী বাইবেল: ‘‘ইনি সত্যিই ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস: ‘‘সত্যিই ইনি আল্লাহর পুত্র ছিলেন।’’ (মার্ক: ১৫/৩৯)
একই ঘটনায় লূক (২৩/৪৭) লেখেছেন, উক্ত শতপতি বলেন: “Certainly this was a righteous man”। কেরি: সত্য, এই ব্যক্তি ধার্মিক ছিলেন।’’ জুবিলী: ‘‘ইনি সত্যিই ধার্মিক ছিলেন।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস: ‘‘সত্যিই লোকটি ধার্মিক ছিল।’’
এভাবে আমরা দেখছি যে, মার্ক যেখানে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বা ‘ইবনুল্লাহ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন সেখানে লূক ‘ইবনুল্লাহ’-এর পরিবর্তে ‘ধার্মিক’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। এ থেকে সুনিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, যীশু ও যীশুর যুগের মানুষদের ভাষায় ‘ঈশ্বরের পুত্র’ কথাটার অর্থ ছিল ‘ধার্মিক মানুষ (righteous man)’।
ইশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহ বিষয়ে বাইবেলের কয়েকটা বক্তব্য দেখুন:
(১) আদম ইবনুল্লাহ। লূক ৩/৩৮: “Adam, which was the son of God” ‘‘আদম যিনি ঈশ্বরের পুত্র’’। কি. মো.: ‘‘আদম আল্লাহর ছেলে (ইবনুল্লাহ)।’’ আরবি বাইবেল: ‘آدم ابن الله’: আদম ইবনুল্লাহ।
(২) সকল আদম সন্তানই ঈশ্বরের পুত্র। ‘‘তখন আল্লাহর পুত্রেরা (the sons of God) মনুষ্যদের কন্যাদের সুন্দরী দেখে যার যাকে ইচ্ছা, তাকে বিয়ে করতে লাগল।’’ (পয়দায়েশ/ আদিপুস্তকের ৬/২, মো.-১৩)
(৩) ইসরাইল বা ইয়াকুব (আ.) ঈশ্বরের পুত্র এবং প্রথম পুত্র: ‘‘ইসরাইল আমার পুত্র, আমার প্রথমজাত (my son, even my firstborn)।’’ (যাত্রাপুস্তক ৪/২২, মো.-১৩)
(৪) সকল বনি-ইসরাইলই ঈশ্বরের পুত্র ও সন্তান। বাইবেলের অনেক স্থানে সকল বনি-ইসরাইলকেই ঈশ্বরের পুত্র (the sons of God) বা ঈশ্বরের সন্তান (the children of the LORD your God:) বলা হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৪/১, ৩২/১৯; যিশাইয় ১/২, ৩০/১, ৬৩/৮; ৬৩/১৬; ৬৪/৮; হোশেয় ১/১০, ইত্যাদি)
(৫) ইয়াকুব বা ইসরাইল ঈশ্বরের পুত্র এবং তাঁর পৌত্র- ইউসুফের দ্বিতীয় পুত্র- আফরাহীম ঈশ্বরের প্রথম পুত্র: ‘‘আমি ইসরাইলের পিতা, এবং আফরাহীম (ইফ্রয়িম: Ephraim) আমার প্রথমজাত পুত্র।’’ (ইয়ারমিয়া/ যিরমিয় ৩১/৯)
(৬) দাউদ ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহ: ‘‘Thou art my Son; this day have I begotten thee: তুমি আমার পুত্র, আজ আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি।’’ (গীতসংহিতা/ জবুর শরীফ ২/৭)। উপরন্তু দাউদ ঈশ্বরের প্রথমপুত্র (firstborn) (জবুর/ গীতসংহিতা ৮৯/২৭)
(৭) শলেমান ইবনুল্লাহ বা ঈশ্বরের পুত্র: ‘‘আমি তার পিতা হব, ও সে আমার পুত্র হবে’’। (২ শমূয়েল ৭/১৪)
(৮) ফেরেশতারা ইবনুল্লাহ বা ঈশ্বরের পুত্র। ইয়োব/ আইউব ১/৬: “Now there was a day when the sons of God came to present themselves before the LORD, and Satan came also among them.” কেরি ‘‘এক দিন ঈশ্বরের পুত্রেরা সদাপ্রভুর সম্মুখে দ-ায়মান হইবার জন্য উপস্থিত হন, তাঁহাদের মধ্যে শয়তানও উপস্থিত হইল।’’ কি. মো.-০৬: ‘‘একদিন ফেরেশতারা মাবুদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন আর শয়তানও তাঁদের সংগে উপস্থিত হল।’’
(৯) ইহুদিরা নিজেদেরকে ইবনুল্লাহ বা ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করতেন। ইহুদিরা যীশুকে বলেন: ‘‘আমরা ব্যভিচারজাত নহি; আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি ঈশ্বর (we have one Father, even God.)।’’ ( যোহন ৮/৪১)
(১০) পবিত্র বাইবেলে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকল ধার্মিক মানুষই ইবনুল্লাহ বা ঈশ্বরের পুত্র। যেমন: ‘‘ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা আল্লাহর পুত্র বলে আখ্যায়িত হবে (the children of God)’’ (মথি ৫/৯)। ‘‘কেননা যত লোক আল্লাহর রূহ দ্বারা চালিত হয়, তারাই আল্লাহর সন্তান (কেরি: ঈশ্বরের পুত্র: ইংরেজি: sons of God)’’ (রোমীয়/ রোমান ৮/১৪)। আরো দেখুন: রোমীয় ৮/১৯; ফিলিপীয় ২/১৪-১৫; ১ যোহন/ ইউহোন্না ৩/১; ৩/২; ৩/৮-১০; ৪/৭; ৫/১-২; ...)
এভাবে পবিত্র বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের বহু স্থানে সকল মানুষ, বিশেষত ধার্মিক মানুষ এবং ইসরাইল বংশের মানুষদেরকে ইবনুল্লাহ, ঈশ্বরের পুত্র বা ঈশ্বরের সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বনি-ইসরাইলরা বা ইহুদিরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস ও দাবি করতেন যে, তারা ঈশ্বরের পুত্র বা ইবনুল্লাহ। এ থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, যীশুর কোনো সাহাবী/ শিষ্য বা যীশুর সমসাময়িক কোনো ইহুদি এ সকল ইঞ্জিল লেখেননি। কারণ তারা জানতেন যে, ঈশ্বরের পুত্র দাবি করা কোনোই অপরাধ নয়; বরং সেটাই ঈমানের দাবি। এ সকল ইঞ্জিল যীশুর তিরোধানের অনেক পরে অ-ইহুদি গ্রিকভাষী পৌত্তলিক থেকে খ্রিষ্টধর্মগ্রহণকারী রোমানদের লেখা। রোমান ধর্মে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ কথাটা দেবত্ব অর্থে ব্যবহৃত হত। এ অর্থে কাউকে ঈশ্বরের পুত্র বলা ইহুদিদের দৃষ্টিতে ‘ঈশ্বর-অবমাননা’ (blasphemy) বা কুফরী বলে গণ্য। তবে যে ইহুদি সমাজে যীশু তাঁর ধর্ম প্রচার করেন সে সমাজে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বলে নিজেকে দাবি করা কোনোরূপ অপরাধ বলে গণ্য করা হত না বলে আমরা দেখলাম। কাজেই নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবি করার কারণে ইহুদিরা তাঁকে ঈশ্বরের অপমানকারী বলে মনে করেছে বলে কল্পনা করা যায় না। বিষয়টা একান্তই অ-ইহুদি রোমান লেখকদের কল্পনা বা তাদের মধ্যে প্রচলিত গল্প বলেই প্রতীয়মান হয়।
পাশাপাশি আরেকটা বিষয় প্রমাণ করে যে, এ কাহিনীগুলো অ-ইহুদি রোমানদের রচিত। তা হল ‘মসীহ’ ও ‘ঈশ্বর-পুত্র’ বা ‘ইবনুল্লাহ’ সমার্থক বলে মনে করা। পুরাতন নিয়ম ও মাসীহ বিষয়ে ইহুদি জাতির বিশ্বাস ও বিবরণগুলো সম্পর্কে যার ন্যূনতম ধারণা আছে তিনি স্বীকার করবেন যে, ‘মসীহ’ ও ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘ঈশ্বরের পুত্র’ কখনোই এক বিষয় নয়। ইহুদিদের পরিভাষায় সকল ধার্মিক মানুষ, সকল ইহুদি, এমনকি সকল মানুষই ‘ঈশ্বরের পুত্র’ বা ‘ইবনুল্লাহ’। পক্ষান্তরে ‘মসীহ’ ইহুদি জাতির প্রতিশ্রত রাজা, ইহুদি রাষ্ট্রের পুনপ্রতিষ্ঠাকারী এবং ইহুদিদের রাজনৈতিক নেতা। নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র দাবি করা তৎকালীন সমাজে কোনো অপরাধই ছিল না। কিন্তু নিজেকে প্রতিশ্রুত মসীহ বলে দাবি করা তৎকালীন সময়ে ভয়ের বিষয় ছিল। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে সকলেরই আশঙ্কা ছিল যে, রাজ্যহারা ইহুদি জাতি এরূপ দাবিদারের নেতৃত্বে দখলদার রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এবং ইহুদিদের উপর রোমানদের জুলুম নিপীড়ন জোরদার হবে।
মূলত এ কারণেই ইহুদি নেতারা যীশুকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। যখন যীশু বহু অলৌকিক কর্ম করলেন এবং ইহুদিরা তাঁকে প্রতিশ্রুত মসীহ বলে বিশ্বাস করতে লাগল তখন জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে তারা এ সিদ্ধান্ত নেন। যোহন লেখেছেন: ‘‘অতএব প্রধান ইমামেরা ও ফরীশীরা সভ্য করে বলতে লাগল, আমরা কি করি? এই ব্যক্তি তো অনেক চিহ্ন-কাজ করছে। আমরা যদি এক এরকম চলতে দিই, তবে সকলে এর উপর ঈমান আনবে; আর রোমীয়েরা এসে আমাদের স্থান ও জাতি উভয় কেড়ে নেবে (take away both our place and nation)। কিন্তু তাদের মধ্যে এক জন, কাইয়াফা (Caiaphas), সেই বছরের মহা-ইমাম, তাদেরকে বললেন, তোমরা কিছুই বোঝ না! তোমরা বিবেচনাও কর না যে, তোমাদের পক্ষে এটা ভাল, যেন লোকদের জন্য এক ব্যক্তি মরে, আর সমস্ত জাতি বিনষ্ট না হয়। এই কথা যে তিনি নিজের থেকে বললেন, তা নয়, কিন্তু সেই বছরের মহা-ইমাম হওয়াতে তিনি এই ভবিষ্যদ্বাণী বললেন (prophesied কেরি: ভাববাণী বলিলেন:) যে, সেই জাতির জন্য ঈসা মরবেন। আর কেবল সেই জাতির জন্য নয়, কিন্তু আল্লাহর যেসব সন্তান চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সেই সকলকে একত্র করার জন্যও মরবেন। (যোহন ১১/৪৭-৫২, মো.-১৩)
যোহনের লেখক কাইয়াফার কথার ব্যাখ্যা করেছেন যে, কাইয়াফা মহাপুরোহিত হিসেবে নুবুওয়াত বা ভাববাদিত্ব লাভ করেন, যীশুকে মাসীহ হিসেবে চিনতে পারেন এবং তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে ইহুদি জাতির পারলৌকিক মুক্তি অর্জন হবে বলে এ কথা বলেন। তবে তার এ ব্যাখ্যা একেবারেই ভিত্তিহীন। কারণ আমরা দেখলাম যে, এ কাইয়াফাই কয়েকদিন পরে মাসীহত্ব ও ঈশ্বরের পুত্রত্ব দাবি করার কারণে কাফির হিসেবে যীশুর মৃত্যুদণ্ড-র ঘোষণা দেন। উপরন্তু কাইয়াফা যীশুকে অপমানও করেন। তাঁর সামনেই লোকেরা যীশুর মুখে থুতু দেয় এবং চড়-ঘুষি মারে। (মথি ২৬/৬৬-৬৮; মার্ক ১৪/৬৩-৬৫)। তিনি যীশুকে ঈশ্বর বা ঈশ্বর-পুত্র হিসেবে চিনেছিলেন বলে কল্পনা করাও ভিত্তিহীন। তিনি যীশুর মৃত্যুর মাধ্যমে ইহুদি জাতির পারলৌকিক মুক্তির কথা বলেননি; রোমানদের আক্রমণ থেকে ইহুদি-জাতির ইহলৌকিক রক্ষার কথা বলেছেন।