উপরের আলোচনা থেকে আমরা প্রচলিত চারটা ‘মতানুসারে ইঞ্জিল’-এর লেখক ও সময়কাল সম্পর্কে খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের মত জানতে পারলাম। এখানে দ্বিতীয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বৈপরীত্য ও ভিন্নতা। পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, এ চারটা ইঞ্জিলের তথ্যের মধ্যে অগণিত বৈপরীত্য বিদ্যমান। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় প্রথম তিন ইঞ্জিলের সাথে চতুর্থ ইঞ্জিলের বৈপরীত্য। এ বিষয়টা প্রাচীনকাল থেকেই খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের বিব্রত করেছে এবং তারা বিভিন্ন অজুহাত প্রদানের চেষ্টা করেছেন।
প্রথম তিনটাকে খ্রিষ্টান পণ্ডিত ও ধর্মগুরুরা Synoptic Gospels, অর্থাৎ ‘একমতীয়’ বা ‘সমমতীয় ইঞ্জিল’ বলে আখ্যায়িত করেন। যোহন বা ইউহোন্নার ইঞ্জিলটাকে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করেন। প্রথম তিনটার সাথে চতুর্থটার বৈপরীত্য অনেক। অধিকাংশ খ্রিষ্টান গবেষক একমত যে, মথি, মার্ক ও লূকের সুসমাচারের উৎস মূল একটা সংক্ষিপ্ত ‘ইঞ্জিল’। তাদের মতে, মার্কের ইঞ্জিল সবচেয়ে আগে রচিত। মথি ও লূক প্রথমত মার্কের পুস্তকটার উপর নির্ভর করেছেন। পাশাপাশি তারা অন্য একটা সংক্ষিপ্ত ইঞ্জিলের উপর নির্ভর করেছেন যেটা হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে যাওয়া ইঞ্জিলটাকে খ্রিষ্টান গবেষকরা ‘কিউ’ (Q) বলে অভিহিত করেন। জার্মান Quelle শব্দের অর্থ source বা উৎস। যেহেতু এতে শুধু যীশুর বচন সংকলন করা হয়েছিল এজন্য গবেষকরা একে Logia বলে অভিহিত করেন।[1]
খ্রিষ্টান বাইবেল গবেষকরা একমত যে, চতুর্থ ইঞ্জিলরা সবচেয়ে পরে, প্রথম খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বা দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে লেখা। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা। চতুর্থের সাথে প্রথম তিনটার বৈপরীত্য এত প্রকট যে, এর কোনো সমন্বয় সম্ভব নয়। উইকিপিডিয়ার Gospel of John প্রবন্ধের ভাষ্য নিম্নরূপ:
“According to the majority viewpoint for most of the 20th century, Jesus' teaching in John is largely irreconcilable with that found in the synoptics, and perhaps most scholars consider the Synoptic Gospels to be more accurate representations of the teaching of the historical Jesus... The teachings of Jesus in John are distinct from those found in the synoptic gospels. Thus, since the 19th century many Jesus scholars have argued that only one of the two traditions could be authentic. J. D. G. Dunn comments on historical Jesus scholarship, "Few scholars would regard John as a source for information regarding Jesus' life and ministry in any degree comparable to the synoptics.”
‘‘বিংশ শতকের অধিকাংশের মতে প্রথম তিন ‘সমমতীয়’ ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর শিক্ষার সাথে যোহনের পুস্তকের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর শিক্ষার কোনো সমন্বয় একেবারেই সম্ভব নয়। সম্ভবত অধিকাংশ গবেষক মনে করেন যে, ঐতিহাসিক বিচারে যীশুর শিক্ষা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রথম তিন ইঞ্জিল যে তথ্য প্রদান করে সেটাই অধিকতর সঠিক। যোহনের মধ্যে যীশুর যে শিক্ষা উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রথম তিন সমমতীয় ইঞ্জিল থেকে স্বতন্ত্র। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে অনেক যীশু বিশেষজ্ঞ দলিল পেশ করেছেন যে, এ দুটো স্বতন্ত্র বর্ণনার মধ্যে একটাই কেবল বিশুদ্ধ বলে গণ্য হতে পারে। ঐতিহাসিক যীশু বিষয়ক গবেষণায় জে. ডি. ডাম মন্তব্য করেন: ‘যীশুর জীবন ও ধর্মপ্রচার বিষয়ে যোহনের পুস্তককে কোনো গবেষকই তথ্যসূত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন না, সমমতীয় ইঞ্জিলগুলোর সাথে কোনো পর্যায়েই তা তুলনীয় নয়।’’[2]
প্রসিদ্ধ বাইবেল বিশেষজ্ঞ ই. পি. স্যান্ডার্স (Sanders, E. P.) লেখেছেন:
“It is impossible to think that Jesus spent his short ministry teaching in two such completely different ways, conveying such different contents ... Consequently, for the last 150 or so years scholars have had to choose. They have almost unanimously, and I think entirely correctly, concluded that the teaching of the historical Jesus is to be sought in the synoptic gospels and that John represents an advanced theological development, in which meditations on the person and work of Christ are presented in the first person, as if Jesus said them.”
‘‘এ কথা চিন্তা করা অসম্ভব যে, যীশু তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রচারকালে এরূপ সম্পূর্ণ পৃথক দুটো পদ্ধতিতে শিক্ষা দান করেছিলেন এবং এরূপ পরস্পর বিরোধী বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন ...। এজন্য বিগত ১৫০ বছর ধরে গবেষকদেরকে তিন সমমতীয় ইঞ্জিল ও যোহনের ইঞ্জিল দুটোর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হচ্ছে। আর প্রায় সকল গবেষক এ সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন - আর আমি মনে করি যে, তারা পুরোপুরি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- যে, ঐতিহাসিক যীশুর শিক্ষা জানার জন্য তিন সমমতীয় ইঞ্জিলের উপরে নির্ভর করতে হবে এবং যোহনের ইঞ্জিলটা পরবর্তী পর্যায়ের বিবর্তিত একটা ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসের প্রতিফলন মাত্র। ব্যক্তি যীশু এবং তাঁর কর্মের বিষয়ে ধ্যান করে যা মনে উদয় হয়েছে তাকেই তাঁর মুখে পেশ করা হয়েছে, যেন তিনিই বলছেন।’’[3]
প্রথম তিন ইঞ্জিল ও যোহনের ইঞ্জিলের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য প্রথম তিন ইঞ্জিলে যীশুকে একজন বিনয়ী ও বিনম্র মানুষ, নবী ও গুরু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে যোহনের ইঞ্জিলে প্রথম থেকেই যীশুকে ঐশ্বরিক (Divine), রাজকীয় (majestic) ও দুর্বোধ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মথি ও মার্ক উভয়েই লেখেছেন যে, এক ব্যক্তি যীশুকে বলেন, হে সৎ গুরু/ সৎ ওস্তাদ, অনন্ত জীবন পেতে আমি কি করব? তিনি লোকটিকে বলেন, তুমি আমাকে ভাল বলছ কেন? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ ভাল নন। ‘‘পরে তিনি বের হয়ে পথে যাচ্ছেন, এমন সময় এক জন দৌড়ে এসে তাঁর সম্মুখে হাঁটু পেতে জিজ্ঞাসা করলো, হে সৎ ওস্তাদ (Good Master), অনন্ত জীবনের অধিকারী হওয়ার জন্য আমি কি করবো? ঈসা তাকে বললেন, আমাকে সৎ কেন বলছো? একজন ছাড়া সৎ আর কেউ নেই, তিনি আল্লাহ (Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God)।’’ (মার্ক ১০/১৭-১৮, মো.-১৩। আরো দেখুন: মথি ১৯/১৬-১৭)
এখানে আমরা যীশুর বিনয় লক্ষ করছি। প্রথম তিন ইঞ্জিলে এ বিষয়টা লক্ষণীয়। এ তিন ইঞ্জিলে সাধারণভাবে যীশু মানুষদেরকে ঈশ্বর-মুখী করার চেষ্টা করেছেন। মানুষদেরকে বিশ্বাস ও কর্মের দিকে আহবান করেছেন এবং আন্তরিকতার সাথে তৌরাতের আজ্ঞাসমূহ বা বিধিবিধান পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর বিপরীতে যোহনের ইঞ্জিলে যীশু প্রথম থেকেই নিজেকে ঐশ্বরিক সত্ত্বা হিসেবে প্রকাশ করেছেন, নিজের গৌরবগাথা বর্ণনা করেছেন এবং মানুষরেদকে ‘যীশু-মুখী’ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর নিজের দিকে আহবান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বাইবেল গবেষক গ্যারি ডেভানি (Gary DeVaney) লেখেছেন:
“Mark 10:18 Jesus said: Why do you call Me good. No one is good but God alone. Is Jesus declaring that He is not perfect or good; that, He does sin and that He is not God? Doesn’t the character of John’s Jesus seem much different than those of the other Gospel writers? John’s Jesus is certainly not humble or meek. John seems to put a lot of emphasis on love, feelings, attachment, commitment and pleasuring God. Both Jesus and John sound to be men in love - with each other - wanting everyone to know of their love. Doesn’t John seem to emphasize relationships of eating bodies, drinking blood, and (sorry) male to male intimacy? Ethan Allen: That Jesus Christ was not God is evidence in His Own words, which I never disputed. Being conscious, I am no Christian. Thank you, Ethan Allen! You voiced my sentiments long before I was born and learned about Jesus Christ.”
‘‘মার্ক ১০/১৮ যীশু বলেন: তুমি আমাকে কেন ভাল বলছ? ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ ভাল নেই। যীশু কি ঘোষণা করছেন যে, তিনি নিখুঁত বা ভাল নন? অর্থাৎ, তিনি পাপ করেন এবং তিনি ঈশ্বর নন? যোহনের যীশুর চরিত্র অন্য তিন ইঞ্জিল লেখকদের যীশুর চেয়ে অনেক ভিন্ন নয় কি? যোহনের যীশু নিশ্চিতভাবেই বিনয়ী ও বিনম্র নন। দেখা যাচ্ছে যে, যোহন যে সকল বিষয়ের গুরুত্ব দিচ্ছেন সেগুলো হল প্রেম, অনুভূতি, সম্পর্ক, অঙ্গীকার এবং ঈশ্বরকে খুশি করা। যীশু ও যোহন উভয়েই একে অপরের সাথে প্রেমে নিপতিত মানুষ হিসেবে প্রতীয়মান। উভয়েই চাচ্ছেন যে, সকলেই তাঁদের প্রেমের কথা জানুক। যোহনের বক্তব্য থেকে কি এটাই প্রতীয়মান নয় যে, যোহন মূলত গুরুত্বারোপ করছেন নরমাংস ভক্ষণ, রক্ত পান এবং (দুঃখিত) পুরুষে পুরুষে ঘনিষ্টতার উপর? ইথান এলেন বলেন: যীশু যে ঈশ্বর নন তা তাঁর নিজের কথা থেকেই সুস্পষ্ট, এ বিষয়ে আমি কখনোই বিতর্ক করিনি। যেহেতু আমি সচেতন, সেহেতু আমি খ্রিষ্টান নই। ইথান এলেন, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার জন্মের অনেক আগেই আপনি আমার মনের কথাটাই বলেছেন।’’[4]
[2] উইকিপিডিয়া: Gospel of John.
[3] Sanders, The Historical Figure of Jesus (1995), Penguin Books, England, p 70-71. Cited by Louay Fatoohi, The Mystery of the Historical Jesus, p 18.
[4] Did Jesus Christ Lie? http://www.thegodmurders.com/id188.html