আমরা উল্লেখ করেছি যে, প্রাচীন ফিরকাগুলির মধ্য থেকে শীয়া ও খারিজী সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায় বাহ্যত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবে তাদের মতামতের কিছু দিক বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন দল-উপদলের মধ্যে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে রয়েছে:
৬. ৬. ৫. ১. মুরজিয়্যাহ[1]
মুরজিয়্যাহ (المرجئة) আরবী ‘আরজাআ’ (أرجأ) ফিল থেকে গৃহীত ‘ইসমু ফাইল’। মূল শব্দ বা ধাতুমূল রা, জীম ও হামযা: ‘রাজাআ (رجأ)। আরজাআ (أرجأ) অর্থ বিলম্বিত করা, পিছিয়ে দেওয়া, স্থগিত রাখা (To postpone, adjourn, defer, put off) ইত্যাদি। মুরজিউন (مرجئ) অর্থ বিলম্বিতকারী বা স্থগিতকারী। বহুবচন বা ফিরকা অথে মুরজিয়্যাহ বলা হয়, অর্থাৎ বিলম্বিতকারীগণ বা স্থগিতকারীগণ।
আমরা দেখেছি যে, খারিজীগণ পাপী মুসলিমকে কাফির এবং অনন্তকাল জাহান্নামী বলে বিশ্বাস করে। তাদের মতে ইসলামের বিধান পালন ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কর্মের ঘাটতি মানেই ঈমানের ঘাটতি। আর ঈমানের ঘাটতি অর্থই কুফর। এর বিপরীতে আরেক দলের উদ্ভব হয়। তারা বলে, ঈমানের সাথে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈমান বা বিশ্বাস থেকে আমল বা কর্ম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও পৃথক। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের ভক্তি বা বিশ্বাসই যথেষ্ট। ইসলামের কোনো বিধিবিধান পালন না করেও একব্যক্তি ঈমানের পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। আর এরূপ ঈমানদার ব্যক্তির কবীরা গোনাহ তার কোনো ক্ষতি করে না। যত গোনাহই করুক না কেন সে জান্নাতী হবে। এদের মূলনীতি হলো,
لا يَضُر مع الإيمان معصيةٌ كما أنه لا يَنفع مع الكُفر طاعةٌ
‘‘ঈমান থাকলে কোনো পাপই কোনো ক্ষতি করে না, যেমন কুফর থাকলে কোনো পুন্যই কাজে লাগে না।’’
দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম থেকেই এ মতটি বিশেষ প্রসার লাভ করে। এদেরকে মুরজিয়া কেন বলা হলো সে বিষয়ে দুটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইবনুল আসীর বলেন, এরা যেহেতু বিশ্বাস করে যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ শাস্তি দিবেন না বা তার শাস্তি স্থগিত রাখবেন সেহেতু তাদেরকে মুরজিয়্যাহ বলা হয়। আর আব্দুল কাহির বাগদাদী বলেন, এরা যেহেতু আমল বা কর্মকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে বা স্থগিত করেছে এজন্য এদেরকে মুরজিয়া বলা হয়।[2]
খারিজীগণ যেরূপ কুরআন ও হাদীসে কিছু বক্তব্য নিজেদের মতের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে এর বিপরীতে অন্য বক্তব্যগুলি ব্যাখ্যা করেছে, বা বাতিল করেছে, অনুরূপভাবে মুরজিয়াগণও তাদের বিপরীতে কুরআন ও হাদীসের ক্ষমা বিষয়ক ও তাওহীদের ফযীলত বিষয়ক বক্তব্যগুলিকে মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে বাকি আয়াত ও হাদীসগুলি ব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করেছে। সমন্বয় বা উভয় প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করতে তারা সচেষ্ট হয় নি।
এখানে লক্ষণীয় যে, খারিজী, মুতাযিলী এবং তাদের সংগে একমত বিভিন্ন ফিরকা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতকেও মুরজিয়াহ বলে আখ্যায়িত করে। কারণ এ সকল ফিরকা কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুসলিমের বিধান তাৎক্ষণিক বলে দেয় যে, সে অনন্তকাল জাহান্নামে বাস করবে। আর আহলুস সুন্নাত কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে অনন্ত জাহান্নামবাসী না বলে তার বিষয়টি আল্লাহর হাতে বলে বিশ্বাস করেন এবং আল্লাহ তাকে ইচ্ছা করলে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন। এভাবে তাঁরা পাপী মুসলিমের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি পিছিয়ে দেন।
[2] ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়া ১/৯৮; বাগদাদী, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ২০২।