মহান আল্লাহর কাছে দু‘আর সময় কোনো কিছুর ‘দোহাই’ দেওয়াকে ‘ওসীলা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দু‘আর মধ্যে ‘বা’ (الباء) অব্যয়টি ব্যবহার করে দু‘আ চাওয়া বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে। এ অব্যয়টির অর্থ দ্বারা, সাহায্যে বা কারণে। যেমন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দু‘আয় বলা হয়েছে: হে আল্লাহ, আপনার মহান নামগুলির দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন। আমি আপনার নামগুলি দ্বারা আপনার কাছে দু‘আ করছি। আমার অমুক কর্মের দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন... ইত্যাদি। তবে এ অর্থে ‘‘হে আল্লাহ, অমুকের ওসীলায় (بوسيلة) কথাটি কোনো হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। এ অর্থে আরবীতে ‘বিহাক্কি’ (بِحق) অর্থাৎ ‘‘অমুক কর্ম বা ব্যক্তির অধিকারের কারণে বা দ্বারা’ এবং ‘বিহুরমাতি’ অর্থাৎ ‘‘অমুকের সম্মানে’ কথাও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হিসেবে এক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় কোনো কিছুর দোহাই বা বা ওসীলা দেওয়া কয়েকভাবে হতে পারে:
(১) মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া।
(২) নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া।
(৩) কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া।
(৪) কারো ব্যক্তিগত মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া।
প্রথমত: মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া
যেমন বলা যে, হে আল্লাহ, আপনার রহমান নামের গুণে, বা গাফ্ফার নামের ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দোহাই দেওয়া কুরআন- হাদীসের নির্দেশ এবং দু‘আ কবুল হওয়ার কারণ। মহান আল্লাহ বলেন :
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
‘‘এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে।’’[1]
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘‘আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এই নামগুলি সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে (মুখস্থ রাখবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো মাসনূন দু‘আগুলি পাঠ করলে আমরা সেগুলির মধ্যে এরূপ অনেক দু‘আ পাই, যাতে আল্লাহর পবিত্র নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরূপ বিশেষ নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করলে দু‘আ কবুল হবে বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এরূপ একটি দু‘আয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিখিয়েছেন:
أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ ....
আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি যে,) ...। [3]
আমার লেখা ‘রাহে বেলায়ত’ পুস্তকে পাঠক এরূপ অনেক মাসনূন দু‘আ দেখতে পাবেন।
দ্বিতীয়ত, নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া
নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলে কবুল হয় বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অতীত যুগের তিনজন মানুষ বিজন পথে চলতে চলতে বৃষ্টির কারণে এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রবল বর্ষণে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে গুহাটি তাদের জীবন্ত কবরে পরিণত হয়। এ ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা দু‘আ করতে মনস্থ করেন। তারা একে অপরকে বলেন:
ادْعُوا اللَّهَ بِأَفْضَلِ عَمَلٍ عَمِلْتُمُوهُ
‘‘জীবনে সর্বশ্রেষ্ট যে আমল করেছ তদ্বারা (তার ওসীলা দিয়ে) আল্লাহর কাছে দু‘আ কর বা তার দোহাই দিয়ে আল্লাহকে ডাক।’’
তখন তাদের একজন তার জীবনে সন্তানদের কষ্ট উপেক্ষা করে পিতামাতার খেদমতের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন:
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ
‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে আপনি পাথরটি একটু সরিয়ে দেন যেন আমরা আকাশ দেখতে পাই।’’
মহান আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তার দু‘আ কবুল করে পাথরটি একটু সরিয়ে দেন। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর এক সুন্দরী প্রেমিকার সাথে ব্যভিচারের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে পাপ পরিত্যাগ করার একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন:
فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً
‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি আরেকটু সরিয়ে দিন।’’
মহান আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি দু-তৃতীয়াংশ সরে যায়। তখন তৃতীয় ব্যক্তি নিজের অসুবিধা ও স্বার্থ নষ্ট করে একজন শ্রমিকের বেতন ও আমানত পরিপূর্ণরূপে আদায়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا
‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি সরিয়ে দিন।’’
আল্লাহ তাদের দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি একেবারে সরে যায়।[4]
নিজের ঈমান, মহববত ইত্যাদির ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়াও এ প্রকারের ওসীলা প্রদান। বুরাইদাহ আসলামী (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় দু‘আ করছে নিম্নের কথা দিয়ে :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, এ ওসীলায় (এদ্বারা) যে, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আপনিই আল্লাহ, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনিই একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্মদান করেননি ও জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’’
তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন :
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ سَأَلَ اللَّهَ بِاسْمِهِ الأَعْظَمِ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ وَإِذَا سُئِلَ بِهِ أَعْطَى
‘‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, নিশ্চয় এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাঁর ইসমু আ’যম ধরে প্রার্থনা করেছে, যে নাম ধরে ডাকলে তিনি সাড়া দেন এবং যে নাম ধরে চাইলে তিনি প্রদান করেন।’’[5]
এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও শাহাদতের ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া হয়েছে। বিভিনণ ভাবে এরূপ দু‘আ করা যায়, যেমন: ‘‘হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমি অমুক কর্মটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, সেই ওসীলায় আমার প্রার্থনা কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমার কোনো উল্লেখযোগ্য নেক আমল নেই যে, যার ওসীলা দিয়ে আমি আপনার পবিত্র দরবারে দু‘আ চাইব। শুধুমাত্র আপনার হাবীব নবীয়ে মুসতাফা (ﷺ)-এর নামটি ঈমান নিয়ে মুখে নিয়েছি, এর ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমার কিছুই নেই, শুধুমাত্র আপনার নবীয়ে আকরাম (ﷺ)-এর সুন্নাতের মহববতটুকু হৃদয়ে আছে, সেই ওসীলায় আমাকে ক্ষমা করুন, আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি কিছুই আমল করতে পারিনি, তবে আপনার পথে অগ্রসর ও আমলকারী নেককার বান্দাদেরকে আপনারই ওয়াস্তে মহববত করি, তাদের পথে চলতে চাই, আপনি সেই ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন ...।’’ ইত্যাদি।
তৃতীয়ত: কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া
কারো দু‘আর ওসীলা দেওয়ার অর্থ এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, অমুক আমার জন্য দু‘আ করেছেন, আপনি আমার বিষয়ে তাঁর দু‘আ কবুল করে আমার হাজত পূরণ করে দিন। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নেককার মুত্তাকী মুমিনদের নিকট দু‘আ চাওয়া সুন্নাত সম্মত রীতি। এরূপ কারো নিকট দু‘আ চাওয়ার পরে মহান আল্লাহর দরবারে উক্ত নেককার ব্যক্তির দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার বিষয়টি একটি হাদীস থেকে জানা যায়। উসমান ইবনু হানীফ (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَجُلا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ (ﷺ) فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَنِي قَالَ إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ وَإِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ قَالَ فَادْعُهْ قَالَ فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ فَيُحْسِنَ وُضُوءَهُ (فيحسن ركعتين) وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ (ﷺ) نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، (يا محمد) إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ (يا محمد إني أَتَوَجَّهُ بِكَ إلى اللهِ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتِيْ) (فَيُجْلِيْ لِيْ عَنْ بَصَرِي) اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ (وشَفِّعْنِي فِيْهِ) (اللهم شَفِّعْهُ فِيَّ وَشَفِّعْنِيْ فِيْ نَفْسِيْ)
‘‘একজন অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমনে করে বলে, আমার জন্য দু‘আ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনি বলেন: তুমি যদি চাও আমি দু‘আ করব, আর যদি চাও তবে সবর কর, সেটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি বলে: আপনি দু‘আ করুন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দেন, সে যেন সুন্দর করে ওযূ করে (অন্য বর্ণনায়: এবং দু রাকাত সালাত আদায় করে) এবং এই দু‘আ করে: ‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার নবী মুহাম্মাদের দ্বারা, যিনি রহমতের নবী, হে মুহাম্মাদ, আমি মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার দ্বারা আমার প্রতিপালকের দিকে আমার এ প্রয়োজনটির বিষয়ে, যেন তা মেটানো হয়। (অন্য বর্ণনায়: যেন তিনি তা মিটিয়ে দেন, যেন তিনি আমার দৃষ্টি প্রদান করেন।) হে আল্লাহ আপনি আমার বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করুন (অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং আমার বিষয়ে আমার নিজের সুপারিশও কবুল করুন।)’’[6]
এ হাদীসে অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দু‘আ চেয়েছে। তিনি দু‘আ করেছেন এবং তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর দু‘আর ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে নিজে দু‘আ করতে। লোকটি সেভাবে দু‘আ করেছে। তিরমিযীর বর্ণনায় দু‘আর ফলাফল উল্লেখ করা হয় নি। তবে অন্যন্য সকল বর্ণনায় রাবী বলেন যে, দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন এবং লোকটি তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ ফিরে পায়, যেন সে কখনোই অন্ধ ছিল না।
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন:
إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا (ﷺ) فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ
‘‘উমার (রাঃ) যখন অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হতেন তখন আববাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে (রাঃ) দিয়ে বৃষ্টির দু‘আ করাতেন, অতঃপর বলতেন: হে আল্লাহ আমরা আমাদের নবী (ﷺ)-এর ওসীলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করতাম ফলে আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের নবী (ﷺ)-এর চাচার ওসীলায়, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন বৃষ্টিপাত হতো।’’[7]
আববাস (রাঃ) নিম্নের বাক্যগুলি বলে দু‘আ করলে আল্লাহ বৃষ্টি দিতেন:
اللهم إنه لم ينزل بلاء إلا بذنب ولم يكشف إلا بتوبة وقد توجه القوم بي إليك لمكانى من نبيك وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث
‘‘হে আল্লাহ, পাপের কারণ ছাড়া বালা-মুসিবত নাযিল হয় না এবং তাওবা ছাড়া তা অপসারিত হয় না। আপনার নবীর সাথে আমার সম্পর্কের কারণে মানুষেরা আমার মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এ আমাদের পাপময় হাতগুলি আপনার দিকে প্রসারিত এবং আমাদের ললাটগুলি তাওবায় আপনার নিকট সমর্পিত, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।’’[8]
এ হাদীসেও স্পষ্ট যে, আববাস (রাঃ) বৃষ্টির জন্য দু‘আ করেছেন উমার (রাঃ) আব্বাসের (রাঃ) দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন। তাঁর কথা থেকে বুঝা যায় যে, যতদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবিত ছিলেন, ততদিন খরা বা অনাবৃষ্টি হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে দু‘আ চাইতেন এবং সে দু‘আর ওসীলায় আল্লাহ তাদের বৃষ্টি দান করতেন। তাঁর ওফাতের পরে যেহেতু আর তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু তাঁর চাচা আববাসের (রাঃ) কাছে দু‘আ চাচ্ছেন এবং দু‘আর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।
চতুর্থত: কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া
আল্লাহর কাছে দু‘আ করার ক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ বা দোহাই দেওয়ার চতুর্ত পর্যায় হলো, কোনো ব্যক্তির, বা তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দেওয়া। যেমন জীবিত বা মৃত কোনো নবী-ওলীর নাম উল্লেখ করে বলা: হে আল্লাহ অমুকের ওসীলায়, বা অমুকের মর্যাদার ওসীলায় বা অমুকের অধিকারের অসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দু‘আ করার বৈধতার বিষয়ে আলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক আলিম এরূপ দু‘আ করা বৈধ বলেছেন। তাঁরা সাধারণভাবে উপরের দুটি হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। বিশেষত তাবারানী ও বাইহাকী অন্ধ ব্যক্তির হাদীসটির প্রসঙ্গে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাদের বর্ণনার সার-সংক্ষেপ যে, খলীফা উসমান (রাঃ)-এর সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে একটি প্রয়োজনে যায়। কিন্তু খলীফা তার প্রতি দৃকপাত করেন না। লোকটি উসমান ইবনু হানীফের (রাঃ) নিকট গমন করে তাকে খলীফা উসমানের নিকট তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। তখন উসমান ইবনু হানীফ লোকটিকে অন্ধ লোকটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দু‘আটি শিখিয়েছিলেন সে দু‘আটি শিখিয়ে দেন। লোকটি এভাবে দু‘আ করার পরে খলীফা উসমান (রাঃ) তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন।[9]
এ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দু‘আর ওসীলাই নয়, উপরন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া বৈধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, সাহাবী, তাবিয়ী বা ওলী-আল্লাহর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনো কথা কোনো হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। তবে এ মতের আলিমগণ সকলকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মত ও তাঁর সাথে তুলনীয় ধরে এরূপ যে কারো নামের ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া জায়েয বলেছেন।
কোনো কোনো আলিম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা জায়েয বলেছেন। অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া নাজায়েয বলেছেন। তাঁদের মতে, কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা জায়েয বলার পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বাদ দিয়ে অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়।
পক্ষান্তরে অন্য অনেক আলিম কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির, তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা অবৈধ ও নাজায়েয বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, এরূপ কোনো জীবিত বা মৃত কারো ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনোরূপ নযির কোনো সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া নবীগণ ও যাদের নাম মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কখনোই বলা যায় না যে, উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বা আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার আছে। সর্বোপরি তাঁরা উপরে উল্লেখিত উমার (রাঃ) কর্তৃক আববাসের ওসীলা প্রদানকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। যদি কারো দু‘আর ওসীলা না দিয়ে তাঁর সত্তার ওসীলা দেওয়া জায়েয হতো তবে উমার (রাঃ) ও সাহাবীগণ কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে বাদ দিয়ে আববাস (রাঃ)-এর ওসীলা পেশ করতেন না।
শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গন্থে উমার (রাঃ)-এর হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: ‘‘এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা শরীয়ত বিরোধী। যদি শরীয়ত সিদ্ধ হইত হযরত ওমর (রাঃ) হুযুর (ﷺ)-কে অসিলা করিয়াই দোআ করিতেন। কারণ, মৃত বা জীবিত যে কোন ব্যক্তির চেয়েই হুযুর (ﷺ)-এর ফযীলত সীমাহীন-অনন্ত। তাহই হযরত ওমর (রাঃ) এই কথা বলেন নাই যে, হে আল্লাহ, ইতি পূর্বে তো আমরা তোমার নবীকে অসীলা করিয়া দোআ করিতাম। কিন্তু এখন তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান নাই তাই আমরা তাঁহার রুহু মোবারককে অসিলা করিয়া তোমার কাছে আরযী বেশ করিতেছি। তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা মোটেই বৈধ নহে।’’[10]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহ) সকলেই একমত যে কারো অধিকার বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া মাকরূহ। আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন:
قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ وَصَاحِبَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ : يُكْرَهُ أَنْ يَقُولَ الدَّاعِي: أَسْأَلُكَ بِحَقِّ فُلانٍ، أَوْ بِحَقِّ أَنْبِيَائِكَ وَرُسُلِكَ ، وَبِحَقِّ الْبَيْتِ الْحَرَامِ ، وَالْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ، وَنَحْوِ ذَلِكَ
‘‘ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় বলেছেন: ‘আমি অমুকের অধিকার বা আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকার, বা বাইতুল হারামের অধিকার বা মাশ‘আরুল হারামের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বা প্রার্থনা করছি’ বলে দু‘আ করা মাকরূহ।’’[11]
আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (৫৮৭ হি) বলেন:
وَيُكْرَهُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَقُولَ فِي دُعَائِهِ أَسْأَلُك بِحَقِّ أَنْبِيَائِك وَرُسُلِك وَبِحَقِّ فُلانٍ لأنَّهُ لا حَقَّ لأحَدٍ عَلَى اللَّهِ...
‘‘‘আমি আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি এবং অমুকের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বলে দু‘আ করা মাকরূহ; কারণ মহান আল্লাহর উপরে কারো কোনো অধিকার নেই।’’[12]
কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা শিরক নয়; কারণ, এতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকা হয় না বা দু‘আ করা হয় না; একমাত্র আল্লাহকেই ডাকা হয়। এ বিষয়ক বিতর্ক জায়েয-নাজায়েযের মধ্যে সীমিত। কাজেই শিরক প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়ক বিতর্কের বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না।
পঞ্চমত: আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওসীলার কাছেই চাওয়া
ওসীলা বিষয়ক চূড়ান্ত শিরক হলো ওসীলার নামে ওসীলার কাছেই দু‘আ করা বা ত্রাণ, সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি প্রার্থনা করা। উপরে ওসীলা বলতে যা কিছু বলা হয়েছে তা হলো কারো ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। এর বিপরীতে আরেকটি কর্ম হলো, যাকে ওসীলা বলে মনে করা হচ্ছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি তাকেই ডাকা। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট শিরক। পরবর্তীতে আমরা তা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৮১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৬৩।
[3] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/২৫৩, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৯০, আহমদ, আল-মুসনাদ ১/৩৯১, ৪৫২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৬, ১৮৬।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮২১, ৩/১২৭৮, ৫/২২২৮; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৯৯।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫১৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/৭৯; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৭; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/১৭৪, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৮৩, ৬৮৪, আলবানী, সহীহ সুনানুত তিরমিযী ৩/১৬৩। হাদীসটি সহীহ।
[6] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৬৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৭০০, ১/৭০৭; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/১৬৮-১৬৯। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব। হাকিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৪২, ৩/১৩৬০।
[8] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৪৯৭।
[9] তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ৯/৩০; আল-মু‘জামুস সাগীর ১/৩০৬; বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ৬/৩৫৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৭৯। এ বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে আপত্তি ও মতপার্থক্য আছে।
[10] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩১।
[11] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২৩৭।
[12] কাসানী, বাদাইউস সানাইয় ৫/১২৬।