শীয়া সমাজগুলিতে এবং অন্যান্য সমাজে প্রচলিত শিরকী বিশ্বাস ও কর্ম সম্পর্কে শীয়া ইমাম ড. মূসা আল-মুসাবীর বক্তব্য আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। ‘সুন্নী’ সমাজগুলির মধ্যে প্রচলিত শিরকের উন্মেষ ও প্রচলন সম্পর্কে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর (রাহ) কিছু বক্তব্য আমরা আলোচনা করব।
তিনি তাঁরা ‘আল-ফাওযুল কাবীর’ গ্রন্থে তিনি আরবের মুশরিকদের শিরক বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘শিরক হলো আল্লাহর জন্য নির্ধরিত কোনো বিশেষণ বা গুণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করা। যেমন নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টিজগতের পরিচালনার ক্ষমতা, যে ক্ষমতাকে ‘হও বললে হয়ে যাওয়া’ বলা হয়, অথবা নিজস্ব ইলম বা জ্ঞান, যে জ্ঞান চেষ্টা করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্জিত নয়, জ্ঞানবুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত নয়, বা স্বপ্ন বা ইলহামের মাধ্যমেও প্রাপ্ত নয়, বা অনুরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা আত্মীক কোনো সূত্র বা মাধ্যম ছাড়া নিজস্ব সত্তাগত জ্ঞান, অথবা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার ক্ষমতা, অথবা কারো উপর অলৌকিক ক্রোধ বা অভিশাপের ক্ষমতা, যে ক্রোধ বা অভিশাপের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দরিদ্র, অসুস্থ বা হতভাগ্য হয়ে যাবে, অথবা কোনো ব্যক্তিকে করুণা করার বা তার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়ার ক্ষমতা যে করুণা বা সন্তুষ্টির কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধনী, সুস্থ বা সৌভাগ্যবান ও নিরাপদ হয়ে যাবে। এ সকল মুশরিক বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে এবং বিশ্বের বিৃহৎ বিষয়গুলি পরিচালনার ব্যপারে আল্লাহর কোনো শরীক আছে বলে বিশ্বাস করত না। তারা একথাও স্বীকার করত যে, আল্লাহ যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেন বা কোনো বিষয় নির্ধারণ করেন তবে তা পরিবর্তন বা রোধ করার ক্ষমতাও কারোরই নেই। তারা কেবলমাত্র বিশেষ কিছু বিষয়ে কিছু বান্দাকে শরীক করত। কারণ তারা মনে করত যে, একজন মহারাজ তার দাসদেরকে এবং তার নিকটবর্তী প্রিয় মানুষদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোটখাট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসকল ছোটখাট বিষয় নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করার ক্ষমতা তাদেরকে প্রদান করেন।
... এ জন্য তারা মনে করত যে, এ সকল নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের নৈকট্যলাভের চেষ্টা করা জরুরী, যেন তা প্রকৃত মহারাজের নিকট তাদের কবুলিয়্যাতের ওসীলা হতে পারে। আর হিসাব ও প্রতিফলের সময় এদের শাফা‘আত মহান আল্লাহর দরবারে কবুল্যিয়াত ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ..... হে পাঠক, মুশরিকদের আকীদা ও কর্ম সম্পর্কে এ সকল বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে যদি আপনি নিশ্চিত হতে চান তবে এ যুগের কুসংস্কারগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত মানুষদের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। বিশেষ করে যার মুসলিম দেশের প্রান্তে বা সীমান্তে বসবাস করে। লক্ষ্য করে দেখুন যে, ওলী বা বেলায়াত সম্পর্কে তাদের ধারণা কি? তারা প্রাচীন ওলীগণের বেলায়াতের স্বীকৃতি দেয় কিন্তু বর্তমানে আর এভাবে ওলী হওয়া তারা সম্ভব বলে মনে করে না। তারা কবর ও ওলীদের দরজায় যেয়ে পড়ে থাকে এবং বিভিন্ন প্রকারের শিরক, বিদ‘আত ও ভিত্তিহীন কুসংস্কারের মধ্যে তারা নিমগ্ন।
আরবের মুশরিকগণ যেভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দীনকে বিকৃত করেছিল এবং মহান আল্লাহকে মানুষের সাথে তুলনা করেছিল অনুরূপ বিকৃতি ও তুলনার মধ্যে এরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি অনুসরণ করবে।’’[1] এ হাদীসটি এদের বিষয়ে পুরোপুরিই খাটে। পূর্ববর্তী মুশরিকগণ যত প্রকারের বিভ্রান্তি বা ফিতনায় নিপতিত হয়েছিল সেগুলির সবই মুসলিম নামধারী কোনো না কোনা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান। তারা এসকল শিরকের গভীরে নিমজ্জিত রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।’’[2]
এরপর তিনি কুরআনের আলোকে ইহূদীদের বিভ্রান্তি আলোচনার পর বলেন: ‘‘সর্বাবস্থায়, পাঠক যদি ইহূদীদের এ সকল বিভ্রান্তির নমুনা মুসলিম উম্মাহর মধ্য দেখতে চান তবে অসৎ আলিমগণ এবং দুনিয়ার স্বার্থের অনুসন্ধানকারীদের দিকে তাকান। পিতা-পিতামহদের অন্ধ অনুকরণ এদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়কর্ম। মহান আল্লাহর কিতাব ও তাঁর মহান রাসূলের (ﷺ) সুন্নাত এরা ততটা গুরুত্ব দেয় না। আলিমগণ নিজস্ব মতামত, যুক্তিতর্ক, অকারণ বাড়াবাড়ি ও গভীরতার নামে সে সকল মতামত প্রকাশ করেছেন সেগুলিই তাদের দলিল, অথচ কুরআন ও সুন্নাতে এ সকল মতামতের কোনোরূপ সূত্র বা ভিত্তি পাওয়া যায় না। এরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রমাণিত ও সহীহ বাণী বাদ দিয়ে জাল, বানোয়াট বা মাউযূ হাদীসের উপর নির্ভর করে এবং ভিত্তিহীন বাজে ব্যাখ্যা ও তাফসীরের পিছনে দৌঁড়ায়।’’[3]
এরপর তিনি কুরআনের আলোকে খৃস্টানদের বিভ্রান্তি আলোচনা করে বলেন: ‘‘আপনি যদি এ সকল বিভ্রান্ত পথভ্রষ্টদের নমুনা নিজের কাওমের মধ্যে দেখতে চান তবে আপনার সমাজের ‘ওলী-আল্লাহ’দের সন্তানদের অনেকের দিকে তাকান। তাদের বিষয়ে এদের ধারণা ও আকীদা পর্যালোচনা করুন। তাহলে বুঝতে পারবেন যে, কোন্ পর্যায়ে এরা পৌঁছেছে। ‘আর অচিরেই জালিমগণ জানবে যে, তাদের কি পরিণতি হবে[4]।’’[5]
[2] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ২৪-২৬।
[3] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ৩৪।
[4] সূরা (২৬) শু‘আরা: ২২৭ আয়াত।
[5] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর, পৃ. ৩৬।