৫. ৩. ৩. ১. বিশেষ বান্দাগণের ভক্তি বিষয়ক বিভ্রান্তি
তাদের দাবি ছিল যে, এ সকল বান্দা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং এদের সাথে আল্লাহর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। যে সম্পর্কের কারণে তারাও বিশেষ ভক্তি বা ইবাদতের পাওনাদার হয়েছেন। এ সকল মানুষের মুজিযা, কারামত বা অলৌকিক কর্মকান্ডকে তারা তাদের উলূহিয়্যাত বা ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করত। তাদের মতে, মহান আল্লাহই এদেরকে সে মর্যাদা দিয়েছেন কাজেই এদের ইবাদত করলে স্বয়ং আল্লাহ খুশি হন এবং এদের ইবাদত করলে এরাই মানুষদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেন। তাদের এ দাবি বা ‘যুক্তির’ বিষয়ে আল্ললাহ বলেছেন:
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘‘আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আউলিয়া (অভিভাবক বা বন্ধু) গ্রহন করেছে তারা বলে, আমরা তো এদের শুধু এজন্যই ইবাদাত করি যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে। তারা যে বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত রয়েছে আল্লাহ তার ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’[1]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম তাবারী বলেন: ‘‘মহান আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদেরকে তারা ওলী হিসেবে গ্রহণ করেছে তারা আল্লাহ ছাড়া তাদেরকে ভালবাসে ও ইবাদত করে এবং বলে, হে আমাদের উপাস্যগণ, আমরা তো তোমাদের একমাত্র এজন্যই ইবাদত করছি যে, তোমরা আমাদেরকে আল্লাহর নিকট নৈকট্য ও মর্যাদা পাইয়ে দেবে এবং আমাদের হাজত প্রয়োজনের বিষয়ে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে।... প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির মুজাহিদ ইবনু জাব্র (১০৪ হি) বলেন: কুরাইশ তাদের মুর্তিগুলিকে এ কথা বলত এবং তাদের পূর্ববর্তীগণ ফিরিশতাগণকে তা বলত, ঈসা ইবনু মরিয়মকে (আঃ) তা বলত এবং উযাইর (আঃ)-কে তা বলত।’’[2]
আমরা দেখেছি যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) তাদের এ যুক্তির ব্যাখ্য করেছেন। তাদের এ দাবির সারমর্ম হলো, এ সকল বুজুর্গের ইবাদত না করে শুধু আল্লাহর ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। এ ছাড়া আল্লাহ অতি মহান ও অতি ঊর্ধ্বে। তার নৈকট্য লাভের জন্য সরাসরি তার ইবাদত কোনো কাজে আসবে না। বরং এ সকল বুজুর্গের ইবাদত করতে হবে যাতে তারা আল্লাহর নৈকট্য পাইয়ে দিতে পারেন।
৫. ৩. ৩. ২. বিশেষ বান্দাদের সুপারিশ বিষয়ক বিভ্রান্তি
মুশরিকদের দ্বিতীয় যুক্তি বা ‘দলিল’ ছিল সুপারিশের দলিল। তারা স্বীকার করত যে, সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই। তবে এ সকল বান্দাকে আল্লাহ বিশেষভাবে ভালবাসেন, কাজেই এদের সুপারিশ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন না। মহান আল্লাহ বলেন:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারে না উপকারও করতে পারে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী (শাফায়াতকারী)। বল, তোমরা কি আল্লাহকে এমন কিছু জানাচছ যা তিনি জানেন না আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে? সুবহানাল্লাহ! তিনি সুমহান, সুপবিত্র এবং তোমাদের শিরক থেকে তিনি উর্ধেব।’’[3]
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো , কাফিররা একথা অস্বীকার করত না যে, আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ সকল উপাস্যের কোন ক্ষমতা নেই। এরা শুধু সুপারিশ করতে পারে। আল্লাহ যদি কোন কল্যাণ অকল্যাণের সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তা রোধ করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘যদি এদেরকে জিজ্ঞাসা কর: আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃস্টি করেছেন? এরা উত্তরে অবশ্যই বলবে: আল্লাহ। বল: তোমরা বল তো, যদি আল্লাহ আামার কোনো অনিষ্ট করতে চান তাহলে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকছ তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি যদি আমাকে অনুগ্রহ করতে চান তাহলে কি তারা সে অনুগ্রহকে রোধ করতে পারবে? বল: আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট । নির্ভরকারীগণ তার উপরই নির্ভর করে।’’[4]
অর্থাৎ কাফিররা মেনে নিচ্ছে যে আল্লাহর ইচ্ছা রোধ করার ক্ষমতা এদের নেই। তার পরও তারা এদের ইবাদত করত, শুধুমাত্র এ যুক্তিতে যে, এরা আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে তাদের প্রয়োজন মেটাবে এবং এদের ইবাদত করলে আল্লাহ খুশি হবেন, কারণ এরা আল্লাহর প্রিয়। আল্লাহ এখানে এবং কুরআনের সর্বত্র এই অদ্ভূত যুক্তির অসারতা বর্ণনা করেছেন। এদের যখন কোন ক্ষমতাই নেই এবং সব ক্ষমতাই যখন আল্লাহর তখন আল্লাহকে না ডেকে এদেরকে ডাকার মত বোকামি আর কি হতে পারে।
তাদের এরূপ কর্মের অসারতা ও স্ববিরোধিতা ধরিয়ে দিলে সকল যুক্তিতে পরাস্ত হলে তারা প্রচলনের দোহায় দিত। সকল ধর্মে করছে, যুগ যুগ ধরে পূর্বপুরুষরা করে এসেছেন, তারা ইবরাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও অন্যান্য নবী থেকেই তো ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কাজেই তাদের কর্ম কিভাবে ভুল হতে পারে। একমাত্র আল্লাহর এবাদত করতে হবে এটা একটি অদ্ভূত নতুন কথা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে, যা আমরা আগে কখনো শুনিনি । এ বিষয়ক কিছু আয়াত আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি।
কুরআনের বর্ণনার আলোকে আমরা দেখি যে, শিরকের পথে তাদের পদক্ষেপগুলি ছিল নিম্নরূপ:
(১) তারা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা ও সকল ক্ষমতার মালিক। তাদের এ বিশ্বাস সঠিক ছিল।
(২) তারা বিশ্বাস করত যে, ফিরিশতাগণ নবীগণ ও অন্যান্য কিছু মানুষকে আল্লাহ বিশেষভাবে ভালবাসেন। ফিরিশতা ও নবীগণের বিষয়ে তাদের বিশ্বাস সঠিক ছিল, তবে অন্যান্যদের বিষয়ে তারা অনেক মনগড়া ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করেছিল।
(৩) তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারেন। তাদের এ বিশ্বাসটি ছিল সত্য ও মিথ্যার সমন্বিত রূপ। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন যে, ফিরিশতাগণ বা আল্লাহ প্রিয় বান্দাগণ সুপারিশ করবেন, তবে তা তাদের ইচ্ছামত নয়। বরং সুপারিশ বা শাফা‘আতের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ যাকে অনুমতি প্রদান করবেন তিনি সুপারিশ করবেন কেবলমাত্র তার জন্য যার বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন এবং যার উপরে আল্লাহ নিজে সন্তুষ্ট রয়েছেন। কাজেই সুপারিশের কল্পনা করে তাদের ইবাদত করা যাবে না। বরং আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, আল্লাহ যার উপর সন্তুষ্ট হবেন তার জন্য সুপারিশের অনুমতি প্রদান করবেন।
(৪) তারা বিশ্বাস করত যে, এদের ইবাদত করলে আল্লাহ খুশি হন এবং এরাও সুপারিশ করে তাদের প্রয়োজনগুলি আল্লাহর নিকট থেকে আদায় করে দেন। এ বিশ্বাসটি ভয়ঙ্কর মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
[2] তাবারী, তাফসীর (বায়ানুল কুরআন) ২৩/১৯১।
[3] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত।
[4] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৮ আয়াত।