উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সকল জ্ঞানের উৎস হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহী বা কুরআন ও সুন্নাহ। ইসলামী বিশ্বাস বা ‘আল-আকীদাহ আল-ইসলামিয়্যাহ’-র ভিত্তি ও উৎস কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান। পবিত্র কুরআনে ও সহীহ হাদীসে যা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে তাই বিশ্বাস করা এবং যেভাবে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে সেভাবেই বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার মূল ভিত্তি।
কুরআন ও হাদীসের বাণী অত্যান্ত সুস্পষ্ট ও পরিস্কার। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) শিক্ষার মধ্যে কোনো জটিলতা নেই, গোপনীয়তা, বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতা নেই। তারপরও কখনো জ্ঞানের দুর্বলতার কারণে কুরআনের বা হাদীসের বুঝার বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য বা দ্বিধা সৃষ্টি হলে রাসূলে আকরাম (ﷺ)-এর সাহাবীগণ এবং পরবর্তীয় দুই প্রজন্ম ‘তাবিয়ী’ ও ‘তাবি-তাবিয়ীগণের’ ব্যাখ্যা ও মতামতই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়।
সাহাবীগণ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর হাতে গড়া ছাত্র। তাঁরা তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহন করেছেন, তার সাহচর্যে থেকেছেন, জীবনের সবকিছর ঊর্ধ্বে তাঁকে ভালবেসেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁরা সদা উদগ্রীব ছিলেন। তাঁরা তাঁর মুখের বাণী সরাসরি শুনেছেন কুরআন নাযিল হওয়ার পটভুমি তাঁরা জেনেছেন, কুরআনের ও হাদীসের শিক্ষা সবচেয়ে ভাল বুঝেছেন ও জীবনে বাস্তাবায়িত করেছেন তাঁরাই। স্বভাবতই কুরআন ও সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে আমাদেরকে তাঁদের মতামতের উপর নির্ভর করতে হবে।
কুরআন করীমের বিভিন্ন আয়াতে সাহাবীগণের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁদের অতুলনীয় আদর্শস্থানীয় ঈমান, আমল, তাকওয়া, জিহাদ, স্বার্থ ত্যাগ, তাঁদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[1] এ সকল আয়াতের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ঈমান, তাকওয়া, বেলায়াত ও কামালাতে তাঁরাই শীর্ষে। তারা মুসলিম উম্মাহর আদর্শ। আল্লাহর অফুরন্ত রহমত তাঁরা পেয়েছেন। তাঁদেরককে ভালবাসা ও তাঁদের অনুকরণ- অনুসরণ পরবর্তী মুসলমানদের দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহবীদের জীবন-পদ্ধতি বা কর্মপন্থার (সুন্নাতের) বিরেধিতাকারীর ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ يُشَاقِقْ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
‘‘যদি কেউ তার কাছে হেদায়েত প্রকাশিত হওয়ার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং বিশ্বাসীদের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করে তাহলে আমি তাকে তার বেছে নেওয়া পথেই ছেড়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব, যা নিকৃষ্টতম গন্তব্যস্থল।’’[2]
এখানে ‘বিশ্বাসীদের পথ’ বলতে স্বভাবতই সাহাবীদের পথ বোঝান হয়েছে, কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়ের বিশ্বাসীগণ তাঁরাই। তাঁদেরকে নাজাত ও মুক্তির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ বলে উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:
وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘‘মুহাজির ও আনসারদিগের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। এ মহাসাফল্য।’’[3]
এখানে সাহাবীগণকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে: প্রথমত, প্রথম অগ্রগামী মুহাজিরগণ, দ্বিতীয়ত, প্রথম অগ্রগামী আনসারগণ এবং তৃতীয়ত তাঁদেরকে যারা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন। প্রথম দুই পর্যায়ের সাহাবীগণকে সফলতার মাপকাঠি ও অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে অন্যান্য অনেক স্থানে সকল মুহাজির ও আনসারকে ‘প্রকৃত মুমিন’ ও জান্নাতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[4]
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে তাঁর সাহাবীদের জীবন পদ্ধতি ও মতামতের উপর নির্ভর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে তোমাদের উপর দায়িত্ব হলো আমার সুন্নত ও সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা। তোমরা দৃঢ়ভাবে তা আঁকড়ে ধরবে, কোনো প্রকারেই তার বাইরে যাবে না। আর তোমরা (আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের বাইরে) নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয় সর্বতোভাবে পরিহার করবে; কারণ সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই বিদআত এবং সকল বিদআতই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা।’’[5]
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদেরকে ভবিষ্যতে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে মতবিরোধ সম্পর্কে সতর্ক করেন। সাহাবীদের প্রশ্ন করেন, এক্ষেত্রে কোন্ দল সঠিক বলে গণ্য হবে? তিনি বলেন:
مَا أَنَا عَلَيْهِ (الْيَوْمَ) وَأَصْحَابِىْ
‘‘আমি এবং আমার সাহাবী-সঙ্গীরা বর্তমানে যে মত ও পথের উপর আছি সেই মত ও পথের উপর যারা থাকবে তারাই সঠিক ও সুপথপ্রাপ্ত।’’[6]
এ সকল আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ ইসলামের সকল বিষয়ের মত আকীদার বিষয়েও সাহাবীগণের মতামত ও ব্যাখ্যাকে কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ‘সুন্নাতে সাহাবা’ কখন কিভাবে এবং কোন্ পর্যায়ে দলীলরূপে গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ইমাম আবু হানীফা (রাহ) উলেলখ করেছেন যে, কোনো বিষয়ে কুরআন বা সুন্নাতে রাসূলে (ﷺ) নির্দেশ না থাকলে সেক্ষেত্রে সাহাবীগণের মতামতের উপর নির্ভর করতে হবে। তিনি বলেন
آخذ بكتاب الله، فما لم أجد فبسنة رسول الله (ﷺ)، إذا لم يكن في كتاب الله ولا في سنة رسول الله (ﷺ)، نظرت إلى أقاويل أصحابه، ولا أخرج من قولهم إلى قول غيرهم.
‘‘আমি কুরআনের উপর নির্ভর করি। কুরআনে যা পাই না তার জন্য সুন্নাতে রাসূলে (ﷺ)-র উপর নির্ভর করি। যদি কোন বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলে (ﷺ) না পাই, তাহলে আমি সাহাবীদের মতামত ও শিক্ষার উপর নির্ভর করি, তাদের মতামত ও শিক্ষার বাইরে যাই না।’’[7]
সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী- এ তিন প্রজন্মের মানুষদের ধার্মিকতার প্রশংসা করেছেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। ইমরান ইবনু হুসাইয়িন (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
خَيْرُ أُمَّتِي قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ".
‘‘আমার উম্মতের সবচেয়ে ভালো যুগ হলো আমার যুগ, যে যুগের মানুষের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি (অর্থাৎ সাহাবীগণ), আর তাদের পরেই সবচেয়ে ভালো তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবিয়ীগন), আর এর পর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ (অর্থাৎ তাবি তাবিয়ীগণ)’’।[8]
এ অর্থে আবূ হুরাইরা (রা), বুরাইদা আসলামী (রা), নু’মান ইবনু বাশীর (রা) প্রমুখ সাহাবী থেকে পৃথক পৃথক সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখার ন্যায়, আকীদার বিষয়েও কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা ভালভাবে বুঝার জন্য ও সঠিক ব্যাখ্যা দান করার জন্য প্রথমত সাহাবীদের এবং এরপরে তাঁদের ছাত্রদের বা তাবেয়ীদের এবং তাদের ছাত্রদের বা তাবি- তাবেয়ীদের মতামতের সাহায্য গ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রেও অবশ্যই সহীহ সনদে বর্ণিত বিশুদ্ধ তথ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নামে যেমন মিথ্যা কথা বলা হয়েছে, তেমনি তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও পরবর্তী ইমামগণের মামেও অনেক মনগড়া কথা রটনা করা হয়েছে। এজন্য হাদীস সংকলনের সময়ে মুহাদ্দিসগণ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীরে বাণী ও শিক্ষাও সনদ-সহ সংকলিত করেছেন, যেন সনদের মাধ্যমে তাঁদের সঠিক শিক্ষা ও মতামত জানা যায় এবং তাদের নামে রটিত মিথ্যা কথা ধরা পড়ে।
[2] সূরা (৪) নিসা: ১১৫ আয়াত।
[3] সূরা (৯) তাওবা: ১০০ আয়াত।
[4] সূরা (৮) আনফাল: ৭২, ৭৪ আয়াত; সূরা (৫৯) হাশর: ৮, ৯, ১০ আয়াত।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৪৪; আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২০০; ইবনু মাজাহ ১/১৫। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি সহীহ হাসান।
[6] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮; মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারাহ ৭/২৭৮; আলবানী সহীহু সুনানিত তিরমিযী ৬/১৪১ নং ২৬৪১।
[7] ইবনু আব্দুল বার্র, আল ইন্তেকা, পৃ ১৪২, ১৪৩।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৩৫।