ইসলামী আকীদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ক আলোচনা বা গবেষণাকে অনেক সময় ‘ইলমুল কালাম’ (علم الكلام) বলা হয়। ইলমুল কালাম বলতে মূলত ধর্মবিশ্বাসের বিষয়ে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক আলোচনা বুঝানো হয়।
‘আল-কালাম’ (الكلام) শব্দের অর্থ কথা, বাক্য, বক্তব্য, বিতর্ক (word, speech, conversation, debate) ইত্যাদি। কেউ কেউ মনে করেন যে কালামুল্লাহ বা আল্লাহর কালাম (كلام الله) থেকে ইলমুল কালাম পরিভাষাটির উদ্ভব। কারণ ইলমুল কালামে আল্লাহর কালাম বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে যতটুকু বুঝা যায় গ্রীক লগস (logos) শব্দ থেকে ‘কালাম’ শব্দটি গৃহীত হয়েছে। লগস (logos) শব্দটির অর্থ বাক্য, যুক্তিবৃত্তি, বিচারবুদ্ধি, পরিকল্পনা (word, reason, plan) ইত্যাদি। এ লগস শব্দ থেকে লজিক (logic) শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ তর্কশাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা। সম্ভবত মূল গ্রীক অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হিজরী দ্বিতীয় শতকের আরবী পন্ডিতগণ লজিক অর্থ ইলমুল কালাম বা ‘কথা-শাস্ত্র’ বলেছিলেন। পরবর্তীকালে এ অর্থে ‘ইলমুল মানতিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থও ‘কথা-শাস্ত্র’।
সর্বাবস্থায় ইলমুল কালাম বলতে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যা ভিত্তিক ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা বা গবেষণা (speculative theology, scholastic theology) বুঝানো হয়।
প্রাচীন যুগ থেকে দার্শনিকগণ মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শনের মাধ্যমে মানবীয় ইন্দ্রিয়ের অজ্ঞাত বিষয় সমূহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্রষ্টা, সৃষ্টি, সৃষ্টির প্রকৃতি, স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তি তর্ক দিয়ে তাঁরা অনেক কথা বলেছেন। এ সকল বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্ক মানুষকে অত্যন্ত আকর্ষিত করলেও তা কোনো সত্যে পৌঁছাতে পারে না। কারণ আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, মানুষ যুক্তি, বুদ্ধি বা জ্ঞান দিয়ে স্রষ্ঠার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুভব করতে পারে বা নিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে পারে না। এজন্য কখনোই দার্শনিকগণ এ সকল বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তাদের গবেষণা ও বিতর্ক অন্ধের হাতি দেখার মতই হয়েছে।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিক দর্শন প্রচার ও প্রসার লাভ করে। সাহাবীগণের অনুসারী মূলধারার তাবিয়ীগণ ও তাঁদের অনুসারী আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলিমগণ ঈমান বা আকীদার বিষয়ে বা গাইবী বিষয়ে দার্শনিক বিতর্ক কঠিনভাবে অপছন্দ করতেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, গাইবী বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করা এবং ওহীর নির্দেশনাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়াই মুমিনের মুক্তির পথ। প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ইমাম সহ দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের সকল প্রসিদ্ধ আলিম, ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ইলমুল কালামের নিন্দা করেছেন।[1] যেমন ইমাম আবূ ইউসূফ রাহ. (১৮৯ হি) তাঁর ছাত্র ইলমুল কালামের পন্ডিত ও মু’তাযিলী আলিম বিশর আল-মারীসীকে বলেন:
العلم بالكلام هو الجهل والجهل بالكلام هو العلم، وإذا صار الرجل رأسا في الكلام قيل: زنديق.
‘‘কালামের জ্ঞানই হলো প্রকৃত অজ্ঞতা আর কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত জ্ঞান। ইলমুল কালামে সুখ্যাতির অর্থ তাকে যীনদীক বা অবিশ্বাসী-ধর্মত্যাগী বলা হবে।’’[2]
ইমাম আবূ ইউসুফ (রাহ) আরো বলেন:
من طلب العلم بالكلام تزندق
‘‘যে ব্যক্তি ইলমুল কালাম শিক্ষা করবে সে যিনদীক পরিণত হবে।’’[3]
ইমাম শাফিয়ী রাহ. (২০৪ হি) বলেন,
حكمي في أهل الكلام أن يضربوا بالجريد والنعال ويطاف بهم في العشائر والقبائل ويقال: هذا جزاء من ترك الكتاب والسنة وأقبل على الكلام.
‘‘যারা ইলমুল কালাম চর্চা করে তার বিষয়ে আমার বিধান এই যে, তাদেরকে খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটাতে হবে, এভাবে মহল্লায় মহল্লায় ও কবীলাসমূহের মধ্যে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে এবং বলতে হবে: যারা কিতাব ও সুন্নাত ছেড়ে ইলমুল কালামে মনোনিবেশ করে তাদের এ শাস্তি।’’[4]
৫ম হিজরী শতাব্দী থেকে আহলুস সুন্নাতের কোনো কোনো আলিম ইসলামী আকীদা বা আলহুস সুন্নাতের আকীদা ব্যাখ্যার জন্য ইলমুল কালামের পরিভাষা ও পদ্ধতি ব্যাবহার করেছেন এবং আকীদা শাস্ত্রকে ইলমুল কালাম নামে অভিহিত করেছেন। বিভ্রান্ত ফিরকাসমূহের বিভ্রান্তির উত্তর প্রদানের একান্ত প্রয়োজনেই তারা ইলমুল কালামের পরিভাষা ও পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।[5]
[2] ইবনু আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবীয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[3] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবীয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবীয়্যাহ, পৃ. ৭৫
[5] আবূ হামিদ গাযালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ১/৩৩, ৫২-৫৩; ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৭২-৭৭, ২০৪-২১০।