ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী الشرك الأصغر - বা ছোট শিরক শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
الصبر ومنزلته في العقيدة - আকীদার মধ্যে সবরের স্থান

ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম لو (যদি) শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। বিশেষ করে মানুষ যখন মুছীবতে আক্রান্ত হয়। মুছীবতের সময় মানুষের উপর আবশ্যক হলো সবর করা এবং এর বিনিময়ে ছাওয়াবের আশা করা। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের নববই স্থানে সবরের কথা উল্লেখ করেছেন। সহীহ হাদীছে এসেছে, الصَّبْرُ ضِيَاءٌ ‘‘সবর জ্যোতিস্বরূপ’’।[1]

উমার রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, وَجَدْنَا خَيْرَ عَيْشِنَا بِالصَّبِرِ ‘‘সবরের মাধ্যমেই আমরা সর্বোত্তম জীবন লাভ করেছি’’।[2]

আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, দেহের মধ্যে মাথার মর্যাদা যেমন, ঈমানের মধ্যে সবরের মর্যাদা ঠিক সেরকমই। অতঃপর তিনি আওয়াজ উঁচু করে বললেন, জেনে রাখো! যার সবর নেই, তার ঈমান নেই’’। ইমাম বুখারী ও মুসলিম মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন, সবরের চেয়ে উত্তম অনুদান কাউকে প্রদান করা হয়নি।

الصبر শব্দটি صَبَرَ থেকে গৃহীত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ বাধা প্রদান করা ও বিরত রাখা। যখন বাধা প্রদান করা হয় ও বিরত রাখা হয় তখন আরবীতে বলা হয় صبر। অধৈযর্তা-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা থেকে নফ্সকে বিরত রাখা, অভিযোগ পেশ করা, বিরক্তি প্রকাশ করা থেকে জবানকে বিরত রাখা এবং মুছীবতে পড়ে গালে চপেটাঘাত করা এবং জামা ছিড়ে ফেলা থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহকে বিরত রাখাকে الصبر বলা হয়। সুতরাং সবর তিন প্রকার। আল্লাহ তা‘আলা যা আদেশ করেছেন, তা পালন করতে গিয়ে সবর করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন তা বর্জন করার ক্ষেত্রে সবর করা এবং তাক্বদীর অনুযায়ী যেসব মুছীবত আসে তাতে সবর করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾

‘‘আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত’’। (সূরা তাগাবুন: ১১)

আলকামা রহিমাহুল্লাহ বলেন, আয়াতে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যে মুছীবতের সময় বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহর পক্ষ হতেই। অতঃপর তাতে সন্তুষ্ট থাকে এবং তাক্বদীরকে মেনে নেয়। অন্যরা আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মুছীবতে আক্রান্ত হয়ে যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, এটি আল্লাহ নির্ধারণ অনুযায়ী হয়েছে অতঃপর সে সবর করে, ছাওয়াব কামনা করে এবং আল্লাহর ফায়ছালার সামনে আত্মসমর্পন করে, আল্লাহ তার অন্তরকে হিদায়াত করেন। সেই সঙ্গে দুনিয়ার সম্পদ থেকে যা তার হাত ছাড়া হয়ে যায়, তার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তার অন্তরে হিদায়াত এবং সুদৃঢ় বিশ্বাস প্রদান করেন। কখনো কখনো তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া জিনিস ফেরত দেয়া হয়।

সাঈদ ইবনে জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথ প্রদর্শন করেন’’, এর অর্থ হলো হাতছাড়া হওয়া জিনিস কেবল সে আল্লাহ তা‘আলার কাছেই ফেরত চায় এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন পাঠ করে।

উপরোক্ত আয়াতে দলীল পাওয়া যায় যে, আমলসমূহ ঈমানের অন্তর্ভুক্ত এবং ধৈর্যধারণ করা অন্তরের হিদায়াত লাভের মাধ্যম। মুমিন ব্যক্তি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সবরের প্রতি মুহতাজ। আল্লাহর আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা এবং তার নিষেধগুলো থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে তার নফসকে ধৈর্যধারণ করার উপর বাধ্য করা আবশ্যক।

আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে বান্দা যেসব কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাতে সে সবরের প্রতি মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ (১২৬) وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللَّهِ﴾

‘‘হে নবী! প্রজ্ঞা এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তোমার রবের পথে মানুষকে দাওয়াত দাও এবং লোকদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। তোমার রবই অধিক জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং কারা সঠিক পথে রয়েছে, এ বিষয়ে তিনিই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। তোমরা যদি প্রতিশোধ গ্রহণ করো, তাহলে ঠিক ততটুকু গ্রহণ করবে যতটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। আর তোমরা যদি ধৈর্যধারণ করো, তাহলে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের জন্য সেটিই উত্তম। তুমি ধৈর্যধারণ করো। তোমার ধৈর্যধারণ তো হবে আল্লাহর সাহায্যেই’’। (সূরা আন নাহাল: ১২৫-১২৭)

সৎ কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষের তরফ থেকে যেসব যুলুম-নির্যাতন আসে তাতেও সবর করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা লুকমান আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন যে, তিনি তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন,

﴿يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ﴾

‘‘হে বৎস! যথারীতি সালাত কায়েম করো। সৎকাজের নির্দেষ দাও, অসৎকাজে বাধা দান করো এবং আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চয় এটি দৃঢ় সংকল্পের কাজ’’। (সূরা লুকমান: ১৭)

পার্থিব জগতে মুমিন বান্দা যেসব মুছীবতের সম্মুখীন হয়, তাতে সে সবরের মুখাপেক্ষী। এ ক্ষেত্রে তাকে জানতে হবে যে, এগুলো আল্লাহর পক্ষ হতেই। অতঃপর সে সন্তুষ্ট থাকবে ও তাক্বদীরকে মেনে নিবে। বিরক্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করা থেকে নিজের নফ্সকে বিরত রাখবে। বিশেষ করে যখন জবান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হওয়ার উপক্রম হবে, তখন জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

এটি আকীদার অন্যতম মূল বিষয়। তাক্বদীরের প্রতি বিশ্বাস করা ঈমানের ছয় রুকনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। আপদে-বিপদে ধৈর্যধারণ করা এর সুফল। মুছীবতে পড়ে বান্দার ধৈর্যধারণ করতে না পারা ঈমানের এ রুকনের প্রতি তার ঈমান না থাকার প্রমাণ কিংবা এর প্রতি তার ঈমানী দুর্বলতার পরিচয়। পরিণামে সে আপদে-বিপদে অধৈর্যতা, অস্থিরতা ও বিরক্তি প্রকাশ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, এটি এমন কুফুরী, যা ইসলামী আকীদাকে নষ্ট করে ফেলে।

সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

اِثْنَتَانِ فِيْ النَّاس هُمَا بِهِمْ كُفْرٌ الطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন দু’টি মন্দ স্বভাব রয়েছে যা দ্বারা তাদের কুফুরী প্রকাশ পায়। একটি হচ্ছে মানুষের বংশের মধ্যে দোষ লাগানো, অপরটি হচ্ছে মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা’’।[3]

এ দু’টি স্বভাব কুফুরীর অন্তর্ভুক্ত। কেননা তা জাহেলী যামানার লোকদের স্বভাব ছিল। তবে যার মধ্যে কুফুরীর কোনো স্বভাব পাওয়া যায় সে সম্পূর্ণরূপে কাফের হয়ে যায়না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী:ليس بين العبد وبين الكفر أوالشرك إلا ترك الصلاة এর মধ্যে আলিফ-লামযুক্ত মারেফা (নির্দিষ্ট)  الكفر শব্দটি এবং আলিফ-লাম ছাড়া নাকেরা (অনির্দিষ্ট) كفر শব্দটির মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেখানে كفر শব্দটির সাথে আলিফ-লাম যুক্ত হয়ে الكفر হবে, সেখানে উদ্দেশ্য হবে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে যাওয়া। আর আলিফ-লাম ছাড়া আসলে সেরকম অর্থ হবে না এবং সেই কুফুরী মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না।

বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ

‘‘যে ব্যক্তি মুছীবতে পড়ে স্বীয় গালে চপেটাঘাত করে, বুকের জামা ছিড়ে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’’।[4]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ  ‘‘জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার করে’’ এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন: জাহেলী যামানার চিৎকার বলতে এখানে জাতীয়তাবাদ এবং গোত্র প্রীতির দিকে আহবান করার কথা বলা হয়েছে। এমনি মাযহাব, দল এবং শাইখদের জন্য গোঁড়ামি করাও জাহেলিয়াতের আহবানের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ কোনো শাইখকে অন্য কারো উপর প্রাধান্য দিয়ে তার দিকে আহবান করা, এর উপর ভিত্তি করেই কাউকে বন্ধু বানানো, কাউকে শত্রু বানানো। এ সবগুলোই জাহেলিয়াতের দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ তা‘আলা এক মহান উদ্দেশ্যে তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন আপদ-বিপদ ও মুছীবত দ্বারা আক্রান্ত করে থাকেন।

(১) এর মাধ্যমে মানুষের গুনাহ-খাতা মাফ হয়। আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তার কোনো বান্দার মঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতেই তার অপরাধের শাস্তি দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে তিনি যখন তার কোনো বান্দার অমঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতে তার পাপের শাস্তি দেয়া হতে বিরত থাকেন, যেন কিয়ামতের দিন তাকে পূর্ণরূপে শাস্তি দেন’’।[5] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং হাকেম হাসান বলেছেন।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, বিপদ-আপদ এক প্রকার নিয়ামত। কেননা এটি বান্দার গুনাহসমূহ মোচন করে দেয়। আর এটি সবরের আহবান জানায়। সবর করলে ছাওয়াব প্রদান করা হয়। মুছীবত মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে, তার জন্য নতি স্বীকার করায় এবং সৃষ্টি থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ধাবিত করে। এ ছাড়াও মুছীবতের মাধ্যমে আরো অনেক স্বার্থ হাসিল হয়। সুতরাং বালা-মুছীবতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা গুনাহ-খাতা ও ভুল-ভ্রান্তি মিটিয়ে দেন। এটি একটি বিরাট নিয়ামত। সুতরাং মুছীবত সমস্ত সৃষ্টির জন্যই বিরাট একটি রহমত ও নিয়ামত। কিন্তু বিপদগ্রস্থ বান্দা বিপদে পড়ে পূর্বের চেয়ে বড় গুনাহয় লিপ্ত হলে বান্দা দীনের দিক থেকে যে ক্ষতির মধ্যে পড়ে, সে কারণে আপদ-বিপদ তার জন্য ক্ষতিকর হয়। কেননা কতক মানুষ বালা- মুছীবতে পড়ে যখন ফকীর হয় অথবা অসুস্থ হয় কিংবা ব্যথিত হয়, তখন সে মুনাফেকী করে, অধৈর্য হয়, তার অন্তর অসুস্থ হয় এবং তার থেকে প্রকাশ্য কুফুরী দেখা দেয়। সেই সঙ্গে সে বেশ কিছু ওয়াজিব আমলও ছেড়ে দেয় এবং এমন কিছু হারাম কাজে লিপ্ত হয়, যা তার দীনকে ক্ষতিগ্রস্থ করে দেয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে মুছীবতের কারণে যে ফলাফল অর্জিত হয়, তা বান্দার জন্য ভালো হয়। বিশেষ করে যখন সে দীনের ব্যাপারে ফিতনায় পড়া থেকে নিরাপদ থাকে। কিন্তু নিছক মুছীবত ভালো নয়; বরং ভালো ফলাফল অর্জিত হওয়ার দিক থেকে ভালো। যেমন মুছীবতে পড়ে কেউ ধৈর্যধারণ করতে পারলে ও আনুগত্যের পথে অগ্রসর হতে পারলে তার জন্য মুছীবত দীনি নেয়ামতে পরিণত হয়। সুতরাং মুছীবত সৃষ্টি করা যেহেতু আল্লাহর কাজ সে হিসাবে সেটা সমস্ত মাখলুকের জন্য রহমত স্বরূপ। এর কারণে আল্লাহ তা‘আলা প্রশংসিত হন। বালা- মুছীবতে পড়ে যে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, তার জন্য তা দীনি নেয়ামতে পরিণত হয়। বালা-মুছীবত তার গুনাহর কাফফারা হওয়ার সাথে সাথে সেটা রহমত স্বরূপ হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সে প্রশংসার পাত্র হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ﴾

 ‘‘তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হিদায়াতপ্রাপ্ত’’। (সূরা আল বাকারা: ১৫৭)

সুতরাং মুছীবত গুনাহ মাফের কারণ এবং বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যম। যেসব ক্ষেত্রে সবর করা ওয়াজিব সেসব ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে তার জন্য উপরোক্ত ফযীলত অর্জিত হয়। পৃথিবীতে বালা- মুছীবত ও আপদ-বিপদ প্রেরণের পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত হলো এগুলোর মাধ্যমে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। তিনি দেখতে চান কে সবর করে এবং সন্তুষ্ট থাকে আর কে অসন্তুষ্ট হয় এবং বিরক্তি প্রকাশ করে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاَءِ وَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ

‘‘পরীক্ষা যত কঠিন হয়, পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করেন। এতে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তার প্রতিও রয়েছে অসন্তুষ্টি’’।[6] ইমাম তিরমিযী রহি. হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং তিনি হাসান বলেছেন।

মুছীবতে পড়ে সন্তুষ্ট থাকার অর্থ হলো বান্দা তার ব্যাপারটি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করবে, আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করবে এবং তার নিকট ছাওয়াব কামনা করবে। আর তাতে অসন্তুষ্ট হওয়ার অর্থ হলো কোনো জিনিসকে অপছন্দ করা এবং তাতে সন্তুষ্ট না থাকা। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ব্যবস্থা ও পরিচালনাধীন কোনো জিনিষের প্রতি অসন্তুষ্ট হলো, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অসন্তুষ্টি রয়েছে।

এ হাদীছে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বান্দার কর্ম যেমন হয়, ফলাফল তেমনই হয়ে থাকে। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে অন্যান্য ছিফাতের মতই সন্তুষ্ট হওয়া বিশেষণ সাব্যস্ত। এখান থেকে বালা- মুছীবত ও আপদ-বিপদ আসার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত থাকার কথাও জানা গেল। সে সঙ্গে ক্বদ্বা ও ক্বদর তথা আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ এবং ফায়ছালার কথাও জানা গেলো। তার নির্ধারণ অনুপাতেই বিপদ-আপদ ও মুছীবত আসে। মুছীবতের সময় সবর করা, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, এবং তার উপর ভরসা করা আবশ্যক। মোটকথা সমস্ত বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও অপ্রীতিকর বিষয় প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহর উপরই ভরসা করা আবশ্যক। পার্থিব জীবনে মানুষ যেসব দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হয়, তাতে আল্লাহ তা‘আলা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করার আদেশ করেছেন। কেননা এর পিছনে শুভ পরিণাম রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি সাহায্য ও সমর্থনের মাধ্যমে ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা বাকারা: ১৫৩)

এ রকম আরো দলীল রয়েছে, যাতে সবরের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মুমিন বান্দার রয়েছে এর বিশেষ প্রয়োজন। কেননা সবর মুমিনের আকীদাকে শক্তিশালী করে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সবর করা এবং আখিরাতে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে আমল করার তাওফীক দেন।


[1]. মুসনাদে আহমাদ, সহীহ মুসলিম হা/২২৩।

[2]. সহীহ বুখারী, ৬৪৭০ নং হাদীছের অধ্যায়ে।

[3]. সহীহ মুসলিম হা/৬৭, অধ্যায়: বিলাপ করার ভয়াবহতা।

[4]. বুখারী, অধ্যায়: যে ব্যক্তি মুছীবতে পড়ে গাল চাপড়ায় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

[5] . তিরমিযী, ইমাম আলবানী (রহি.) এ হাদীছকে হাসান বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হা/১২২০।

[6]. তিরমিযী, হা/২৩৯৬। ইমাম আলবানী (রহি.) এ হাদীছকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হা/১৪৬।