ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
অভ্যাসগত শির্কের উদাহরণ (شرك العادات)

 উপরে উদাহরণস্বরূপ যে সব কর্মের বর্ণনা প্রদান করা হলো, এর দ্বারা স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশের অসংখ্য মুসলিম আল্লাহর উপাসনা তথা তাঁর উলূহিয়্যাতের ক্ষেত্রে শির্কে নিমজ্জিত রয়েছেন। এবার যদি আমরা তাদের অভ্যাস বা ব্যবহারিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য করি, তা হলে দেখতে পাব যে, মহান আল্লাহ মানুষের জীবনের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক হওয়া সত্ত্বেও অনেক মুসলিমদেরকে কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণার্থে এমন সব পন্থা অবলম্বনে অভ্যস্ত দেখা যায়, যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পরিবর্তে তাঁর সৃষ্টির নিকট কল্যাণার্জন ও অকল্যাণদূরীকরণ কামনা করার শামিল। নিম্নে এর কতিপয় উদাহরণ তুলে ধরা হলো:

১. রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ধাতব দ্রব্য দ্বারা নির্মিত আংটি বা বালা পরিধান করা :

আমাদের দেশের রাজধানীর ফুটপাতে এবং বড় বড় পাইকারী বাজারে এমন কিছু ব্যবসায়ের দোকান পাওয়া যায়, যারা ধাতব নির্মিত আংটি বা বালা বিক্রি করে থাকেন। অনেক লোকদেরকে তা বাত রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী বিশ্বাস করে আংগুলে ও হাতে ব্যবহার করতে দেখা যায়। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো বস্তুই নিজস্ব গুণে কোনো রোগের ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী হতে পারে না। তাই কোনো বস্তুকে কোনো ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী বলা বা এ ধারণা করে তা ব্যবহার করা শির্কে আসগার হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। আরব সমাজে এ-জাতীয় রোগে এ ধরনের বালা ব্যবহারের প্রচলন ছিল। এতে রোগীর অন্তরে ধাতব বস্তুর প্রতি উপকারী হওয়ার ধারণার সৃষ্টি হয় এবং রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর পরিবর্তে বস্তুর উপর ভরসা করা হয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ ধরনের বালা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। যার প্রমাণ প্রথম অধ্যায়ে আরব সমাজে প্রচলিত অভ্যাসগত শির্কের বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রদান করা হয়েছে।

২. জিন বা অপর কোনো রোগের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষার জন্য শরীরে তা‘বীজ ব্যবহার করা :

জিনের অশুভ দৃষ্টি এবং বিভিন্ন রোগের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমদের মাঝে তা‘বীজ ব্যবহার করা একটি সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। তারা এ-সব তা‘বীজ কোনো জিন সাধক বা পেশাদার কোনো পীর-ফকীর বা কবিরাজ, উলঙ্গ ও মাথায় জটধারী পাগল বা পাগলের ভানকারী লোকদের নিকট থেকে তাদেরকে ওলি বা দরবেশ জ্ঞান করে নিয়ে থাকেন। এদের চটকদার কোনো কোন কথাকে তারা তাদের কারামত মনে করে ধোকায় পড়ে যান। অথচ তারা জানেন না যে, এ-জাতীয় তা‘বীজদানকারী জিন সাধক, কবিরাজ ও পাগলেরা আসলে শয়তান। এভাবে যারা প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সম্পদ উপার্জন করতে চায় এদের সাথে যে শয়তানের গোপন সখ্যতা গড়ে উঠে, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন:

﴿ هَلۡ أُنَبِّئُكُمۡ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ ٱلشَّيَٰطِينُ ٢٢١ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٖ ٢٢٢ ﴾ [الشعراء: ٢٢١، ٢٢٢]

‘‘কাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হয়, সে সম্পর্কে আমি কি তোমাকে সংবাদ দেব? শয়তানতো প্রত্যেক মিথ্যুক ও পাপিষ্ঠ ব্যক্তির উপরেই অবতীর্ণ হয়ে থাকে’’।[1]

তা‘বীজ ব্যবসায় কোনো কোনো মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার কোনো কোনো শিক্ষকগণও পিছিয়ে নেই। তারা কুরআনের আয়াত অথবা তা‘বীজের কিতাব থেকে তা‘বীজ দিয়ে একদিকে কুরআনের আয়াত বিক্রি করে দুনিয়া হাসিল করছেন, অপরদিকে এর মাধ্যমে তারা জনগণকে শির্কে আসগারে নিমজ্জিত করছেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আয়াতসমূহ বিক্রি করতে নিষেধ করে বলেছেন:

﴿ وَءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلۡتُ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَكُمۡ وَلَا تَكُونُوٓاْ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ وَلَا تَشۡتَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا وَإِيَّٰيَ فَٱتَّقُونِ ٤١ ﴾ [البقرة: ٤١]

‘‘তোমরা আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে অল্পমূল্য অর্থাৎ দুনিয়া হাসিল করোনা’’।[2]

বাজারে তা‘বীজ দানের সহায়ক কিতাব অনেক রয়েছে। তন্মধ্যে নকশে সুলায়মানী ও চরমোনাই এর পীর মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক এর তা‘বীজের কিতাব উল্লেখযোগ্য। মানুষের জীবনের বিবিধ রোগ-ব্যাধি নিবারণের জন্য তাতে অনেক ধরনের পথ্য দেয়া রয়েছে। যার কোনোটি কুরআনের আয়াতের, কোনোটি ফেরেশতাদের নামের, কোনোটি আসহাবে কাহাফের নামের, কোনোটি খুলাফায়ে রাশেদার নামের, কোনোটি ফেরাউন, হামান, শয়তান ও ইবলিসের নামের। নিম্নে সর্বশেষটির চিত্র তুলে ধরা হলো:[3]

إبليس
    

هامان
    

شيطان
    

فرعون

شيطان
    

فرعون
    

إبليس
    

هامان

فرعون
    

شيطان
    

هامان
    

إبليس

هامان
    

إبليس
    

فرعون
    

شيطان

কুরআন ও হাদীস থেকে তা‘বীজ দিলে বা ব্যবহার করলে তা জায়েয বা না জায়েয, এ নিয়ে কিছু কথা থাকলেও উপরে চিত্রসহ যে তা‘বীজের বর্ণনা দেয়া হলো, তা মুসলিম মনীষীদের সর্ব সম্মতিক্রমে অবৈধ। কেননা, এমন তা‘বীজ গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে- গায়রুল্লাহের নিকট রোগ নিরাময়ের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করা যা প্রকাশ্য শির্ক। এ-ছাড়া এতে তা‘বীজ ব্যবহারকারীর ভরসা আল্লাহর উপর থাকার বদলে তার মনের অজান্তেই তা‘বীজের উপর নেমে আসে। সে-জন্য রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন:

«مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًاْ وُكِّلَ إِلَيْهِ»

‘‘যে ব্যক্তি কোনো কিছুকে (তা‘বীজ হিসেবে) শরীরে ঝুলালো, তার রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব তাকেই বুঝিয়ে দেয়া হয়’’।[4] এমতাবস্থায় সে আল্লাহর হেফাজতে না থেকে নিজের হেফাজতে চলে আসে। অপর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেন:

«مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ»

‘‘যে ব্যক্তি তা‘বীজ ঝুলালো সে শির্ক করলো’’।[5]

তা‘বীজের প্রকারভেদ: তা‘বীজ দু’প্রকার:

এক.এমন সব তা’বীজ যা কুরআন শরীফের আয়াত বা দো‘আয়ে মা’ছূরা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা প্রদান করা হয়। শর‘য়ী দৃষ্টিতে এ-জাতীয় তা‘বীজ প্রদান করা ও ব্যবহার করা উভয়টাই হারাম। এ-জাতীয় তা‘বীজ দানকারী বা ব্যবহারকারী যদি এ মনে করে যে, রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে এ-তা‘বীজ নিজেই কাজ করে এবং নিজেই রোগকে প্রভাবিত করে, তা হলে তা শির্কে আকবার হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি অনুরূপ ধারণা না করে আল্লাহর অনুগ্রহে উপকারী হয়ে থাকে এ-কথা অন্তরে রেখে মুখের দ্বারা শুধু তা‘বীজকে উপকারী বলে বা তা‘বীজের দ্বারা রোগের উপকার হয়েছে এমনটি বলে, তা হলে তা শির্কে আসগার হিসেবে গণ্য হবে।

এ-জাতীয় তা‘বীজ হারাম হওয়ার কারণ:

এতে গায়রুল্লাহের সাথে অন্তরের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আল্লাহর উপর ভরসা না থেকে গায়রুল্লাহের উপর ভরসা হয়। যাবতীয় উপকারের মালিক আল্লাহ হওয়া সত্ত্বেও এতে গায়রুল্লাহকে উপকারের মালিক বানিয়ে নেয়া হয়। আর যে বস্তু আল্লাহর উপর থেকে মানুষের ভরসাকে নষ্ট করে এবং গায়রুল্লাহকে উপকারী নির্দিষ্ট করে, তা শির্ক। এ-জন্যেই এ-জাতীয় তা‘বীজ ব্যবহার করা হারাম। এতে উপকার থাকলেও শর‘য়ী দৃষ্টিতে সে উপকার গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন জাদু আল্লাহর ইচ্ছায় উপকারী হলেও সে উপকার গ্রহণ করা হারাম ও শির্ক।

দুই. এমন সব তা‘বীজ যা কুরআনুল কারীমের আয়াত দ্বারা প্রদান করা হয়। এ-জাতীয় তা‘বীজের ব্যাপারে মুসলিম মনীষীদের মাঝে দু’টি মত পরিলক্ষিত হয়। কেউ এটাকে জায়েয বলেন, আবার কেউ এটাকে না জায়েয ও হারাম বলেন।

আমার মতে যারা এ-জাতীয় তা‘বীজকেও হারাম বলে মনে করেন, সত্য তাঁদের কথার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দলীল ও যুক্তি তাঁদের মতকেই সঠিক বলে প্রমাণ করে। কেননা;

ক) তা‘বীজ ব্যবহার করা শির্ক সম্বলিত যে সব হাদীস রয়েছে তা সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাতে কুরআন আর অ-কুরআনের তা‘বীজ বলে কোনো পার্থক্য করা হয় নি।

খ) এতে তা‘বীজ ব্যবহারকারীর ভরসা আল্লাহর উপর না থেকে তা‘বীজের উপরে নেমে যায়। তা‘বীজই তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে-এ ধরনের একটি ভাবধারা ব্যবহারকারীর অন্তরে তার অজান্তেই সৃষ্টি হয়ে যায়, যা সুস্পষ্ট শির্ক।

গ) তা‘বীজ ব্যবহার করে উপকার পেলে আল্লাহর পরিবর্তে তা‘বীজকেই উপকারী বলে মনে করা হয়। অথচ কোনো বস্তুর প্রতি অনুরূপ ধারণা করা শির্ক।

ঘ) এ ছাড়া কুরআনের আয়াত দ্বারা তা‘বীজ দেয়া জায়েয হলে অবৈধ তা‘বীজ ব্যবসায়ীরা এর দ্বারা আসকারা পাবে।

ঙ) অনুরূপভাবে এর দ্বারা অবৈধ তা‘বীজ ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্তির শিকার হবে। তারা এটাকে অবৈধ তা‘বীজের মতই মনে করবে। এটাকে ফকীর ও কবিরাজদের দেয়া তা‘বীজই মনে করবে।

চ) এছাড়া এতে কুরআনের অবমাননা করা হয়। কুরআন বিক্রি করে দুনিয়া উপার্জনের একটি হীন পন্থা উন্মোচিত হয়।

ছ) সর্বোপরি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী অনুযায়ী এতে মানুষের উপর আল্লাহর কোনো রক্ষণাবেক্ষণ থাকে না।

জ) তা‘বীজ ব্যবহারকারীর প্রতি রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বদ দো‘আ থাকায় তা‘বীজের দ্বারা মূলত কোনো উপকার পাবার কথা নয়।[6] তা‘বীজ ব্যবহার করার পর আল্লাহর ইচ্ছায় কোনো উপকার হয়ে থাকলেও এর মধ্যে তা‘বীজ ব্যবহারকারী ব্যক্তির ঈমানী পরীক্ষা নিহিত থাকবে। সুতরাং যা ব্যবহার করলে শির্ক সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

৩. দুধের গাভী ও নতুন বাচ্চার গলায় তা‘বীজ, জুতা ও জালের টুকরা ঝুলানো :

দেশের কৃষকগণ মানুষের চোখের অশুভ দৃষ্টি থেকে দুধের গাভী ও তার নবজাত বাচ্চাকে রক্ষা করার জন্য গাভী ও বাচ্চার গলায় তা‘বীজ ঝুলিয়ে রাখেন। অনেক সময় উক্ত উদ্দেশ্যে গলায় প্লাষ্টিকের সেন্ডেল ও জালের টুকরাও ঝুলিয়ে রাখেন। আরব সমাজে এ-জাতীয় উদ্দেশ্যে উটের গলায় তারের মালা ঝুলিয়ে রাখার প্রচলন ছিল। এতে ভরসাগত উপাসনায় শির্ক হয় বিধায়, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তা কেটে দিতে নির্দেশ করেছিলেন।[7]

৪. স্বামীকে বাধ্য করার জন্য গোপনে ঘরের চুলা, বিছানা, বালিশ বা অন্য কোথাও তা‘বীজ রাখা:

এ-জাতীয় কর্মকেও রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- শির্কের মধ্যে শামিল করে বলেছেন:

«إِنَّ الرُّقَى وَ التَّمَائِمَ وَ التِّوْلَةَ شِرْكٌ»

‘‘মন্ত্রের ঝাড়ফুঁক, তা‘বীজ ও তেওলা শির্ক।’’[8] ‘তেওলা’ হচ্ছে ঐজাতীয় জাদু-টোনা যা মহিলারা স্বামীকে বাধ্য করার জন্য করে থাকে। আমাদের দেশেও এর বহুল প্রচলন রয়েছে। মহিলারা হিন্দু জাদুকর, কবিরাজ ও জিন সাধকদের নিকট থেকে তা‘বীজ এনে এ জাতীয় কর্ম করে থাকেন।

৫. আগুন, রক্ত, খাদ্য দ্রব্য, সন্তান ও মাটি ইত্যাদির নামে বা তাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করা :

এ-জাতীয় কর্মের প্রচলনও সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে। অথচ শরী‘আতে এ জাতীয় শপথ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ»

‘‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহের নামে শপথ করলো, সে কুফরী অথবা শির্ক করলো।’’[9]

৬. ওলীদের কবরের মাটি ও সেখানে জালানো মোম বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী বলে মনে করা :

এ-জাতীয় কর্মও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অহরহ পরিলক্ষিত হয়। তারা বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে ওলীদের কবরের মাটি ও সেখানে জালানো মোমবাতি অনেক উপকারী মহৌষধ মনে করে অত্যন্ত যত্নের সাথে বাড়ীতে নিয়ে যেয়ে তা ব্যবহার করে থাকেন এবং এর দ্বারা কোনো রোগ মুক্তি হলে তা কবরস্থ ওলির দান বা তাঁর ফয়েয ব’লে মনে করে থাকেন, অথচ এমন মাটি ও মোমকে উপকারী মনে করা শির্ক।

৭. কোন ভাস্কর্য বা স্মৃতিসৌধকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা :

ভাস্কর্য বা স্মৃতিসৌধ মানুষ বা অপর কোনো প্রাণীর আকৃতিতে নির্মাণ করা এমনিতেই শরী‘আতে হারাম, কেননা এতে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে পাল্লা দেয়া ও সাদৃশ্য প্রকাশ করা হয়। যারা এমনটি করে হাদীসের বর্ণনানুযায়ী আখেরাতে তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।[10] কারো স্মরণার্থে কোনো প্রাণীর আকৃতি ব্যতীত অন্যভাবে কোনো উপায়ে ভাস্কর্য বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যেতে পারে, তবে এ শর্তে যে, সেখানে কোনো ফুল দিয়ে বা নীরবে দাঁড়িয়ে সেটাকে কোনো প্রকার সম্মান প্রদর্শন করা যাবে না। কেননা; এটি মানুষকে সম্মান প্রদর্শনের ইসলামী পদ্ধতি নয়। বরং এ-জাতীয় সম্মান প্রদর্শনকে ইসলাম বাড়াবাড়ি বলে মনে করে এবং এটাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূজা হিসেবে গণ্য করে। এ-ছাড়া এটি খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি, যা অনুসরণ করা থেকে রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-মুসলিমদেরকে নিষেধ করেছেন।

৮. শিখা অনির্বাণের পাশে দাঁড়িয়ে আগুনকে সম্মান প্রদর্শন করা:

মানুষের উপকারের জন্য আল্লাহ আগুনকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আগুনের কাজ হচ্ছে তা মানুষের উপকারে ও তাদের খেদমতে ব্যবহৃত হবে। মানুষ কোনো অবস্থাতেই আগুনের খাদেম হতে পারে না। এক সময় পারস্যে অগ্নিপূজা হতো। তাই তাদেরকে অগ্নিপূজক বলা হতো। তারা আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে সেটাকে সম্মান প্রদর্শন করতো। অগ্নিপূজারী না হয়েও যারা আগুনকে সম্মান প্রদর্শন করবে, তারা অগ্নিপূজারীদেরই একজন হিসেবে গণ্য হবে। অথচ এ-কাজটিও বর্তমানে আমাদের দেশের রাজধানীর সেনাকুঞ্জে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয়ে থাকে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশের রাজনীতিবিদগণ এমনকি অনেক সময় সেনাবাহিনীর উর্ধতন অফিসারগণ সেখানে অবস্থিত শিখা অনির্বাণে যেয়ে আগুনকে নির্দিষ্ট একটি কায়দায় সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।

৯. ‘গারোভাত তৈরী করে ভক্ষণ করা :

হিন্দুদের অনুসরণে দেশের গ্রামাঞ্চলের মুসলিম কৃষকদের মাঝে এ কর্মের প্রচলন রয়েছে। হিন্দুরা তাদের লক্ষ্মী (হিন্দুদের ধনসম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী) মা এর পূজার জন্য আশ্বিন মাসের শেষ দিনে এ ভাত তৈরী করে কার্তিক মাসের প্রথম দিনে তা ভক্ষণ করে। মুসলিমরা যেহেতু হিন্দুদের অনুসরণে তা করে, তাই উভয়ের উদ্দেশ্য ভিন্নতর হলেও তা মুসলিম কর্তৃক লক্ষ্মী মা এর পূজারই শামিল।

১০. কপালে টাকা স্পর্শ করে তা সম্মান করা:

টাকা-পয়সা মানুষের সম্পদ। তা মানুষের জীবনের প্রয়োজন মিটানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সে হিসেবে টাকা মানুষের খাদিম। মানুষ টাকার খাদিম বা গোলাম নয়। সম্পদের সম্মান হচ্ছে তাকে সংরক্ষণ করা, তাকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ জ্ঞান না করা। পায়ের নিচে ফেলে এটাকে দলিত-মথিত না করা। মাথা ও কপাল ঠেকিয়ে আল্লাহর উপাসনা ও তাঁকে সম্মান করতে হয়। তাই কপালে টাকা স্পর্শ করে টাকাকে সম্মান করা টাকাকে পূজা করারই শামিল। এ-কাজটিও অনেক মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। দোকান খোলার পর প্রথম বিক্রি হলেই তারা এ-কাজটি করে থাকেন।

১১. ‘মনসা পূজার জন্য ভাত ও টাকা দান করা:

এ-কাজটিও হিন্দুদের অনুসরণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে।

১২. ‘মনসা দেবীর ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছের নিচে খাদ্যদ্রব্য দান করা।

১৩. গাভীর গোবর অথবা নরম মাটিতে আঙ্গল দ্বারা সাতটি গর্ত করে নতুন গাভী থেকে আহরিত প্রথম দিনের দুধ দ্বারা সে গর্ত পূর্ণ করে এর উপর এক প্রকার ঘাস রেখে ‘মানিক’ নামের কোনো পীর অথবা দেবতাকে এই বলে সম্মোধন করা: ‘‘যেমন তোমাকে সাতটি গর্ত ভরে দুধ দিলাম, তেমনিভাবে তুমি আমাকে দুধ দান কর।’’ এই বলে সেই গোবর বা মাটি পানিতে নিক্ষেপ করা।

১৪. প্রচুর পরিমাণে দুধের গাভী প্রাপ্তির আশায় গোয়াল ঘরে পায়েশ তৈরী করে ‘মানিক’ পীর বা দেবতার নামে তা উপস্থিত জনতার মধ্যে বিলি করা।

১৫. খেজুর গাছের প্রথম রস দিয়ে গুড় তৈরী করে শেখ ফরীদ এর সন্তুষ্টি ও তাঁর বরকত প্রাপ্তির আশায় তাঁর নামে তা গরীবদের মধ্যে বন্টন করা।

১৬. লক্ষ্মী মা এর সন্তুষ্টি ও তার সুদৃষ্টিতে ভাল ফলন লাভের আশায় সোমবার ও শুক্রবারে চাষাবাদ আরম্ভ করা এবং তার ক্ষতির আশঙ্কায় অন্য দিনে চাষাবাদ আরম্ভ করা থেকে বিরত থাকা।

১৭. জঙ্গলের জিনের কাছে আশ্রয় চাওয়া: কাঠ বা গাছ কাটার জন্য জঙ্গলে যাওয়ার পূর্বে জঙ্গলের সরদারকে এই বলে আহ্বান করা : ‘‘মাগো! জঙ্গলে তোমার সন্তানরা এসেছে, মাগো! আশা করি তোমার অন্তরে দয়া থাকবে, হে জঙ্গলের সরদারিনী মা! তোমার সন্তানদের রক্ষা কর, তাদের তুমি ভুলে যেওনা। জঙ্গলের সিংহ, বাঘ ও জিনদের এক পাশে রেখে দিও।’’

১৮. খাওয়াজ খিযির ও পীর বদরকে আহ্বান করা : ভ্রমণে যাবার প্রাক্কালে নৌকায় আরোহণ করে পাঁচপীর, খাওয়াজ খিজির ও শেখ বদরকে আহ্বান করা। এ ধরনের আহ্বান দেশের সাধারণ মানুষদের মাঝে বহুল প্রচলিত রয়েছে। অনুরূপভাবে দুঃখজনকভাবে সাইমুম শিল্পীগোষ্টির শিশু-কিশোরদের গাওয়া একটি গানের কেসেটেও বদর বদর বলে বদর পীরকে আহ্বান সম্বলিত একটি গান রয়েছে।

১৯. জঙ্গলের কাঠ সরদারিনীকে ভয় করা : কাঠ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নৌকা যোগে বের হয়ে নৌকায় শয়নের সময় মুখ নিচের দিকে দিয়ে শয়ন করা থেকে বিরত থাকা, এই ভয়ে যে, এতে কাঠ সরদারিনী রাগান্বিত হবে এবং কাঠ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।

২০. মাটি ও গাছকে সালাম করা : কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে প্রবেশের সময় মাটি ও গাছকে সালাম করা, ললাট ও জিহ্বা দিয়ে মাটি স্পর্শ করা এবং মাগো মাগো বলে জঙ্গলে পদার্পণ করা।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন এলাকার মানুষের মাঝে এছাড়াও আরো অনেক শির্কী কর্মকাণ্ড বিদ্যমান রয়েছে। তা জানার জন্য প্রয়োজনে মো: বুরহানুদ্দিন রচিত ‘শেরেক বিনাশ বা বেহেস্তের চাবি’ ও মাওলানা সৈয়দ আহমদ রচিত ‘শিরেক বর্জন’ বই দু’টি দেখা যেতে পারে।[11]

সমাজে প্রচলিত শির্কে আসগার এর কতিপয় উদাহরণ

এ পর্যন্ত দেশে প্রচলিত যত শির্কের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, এর দু’একটি ব্যতীত অবশিষ্ট সবকয়টিই শির্কে আকবার এর অন্তর্গত। নিম্নে সমাজে প্রচলিত কতিপয় শির্কে আসগার এর উদাহরণ তুলে ধরা হলো :

১. কারো ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সমতুল্য করা। যেমন কাউকে এ-কথা বলা যে, ‘আল্লাহ এবং আপনি যা চান’। এ জাতীয় কথাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্ক হিসেবে গণ্য করেছেন। যার প্রমাণ আমরা প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি।

২. আল্লাহর নাম ব্যতীত পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও আগুন ইত্যাদির নামে শপথ গ্রহণ করা।

৩. আব্দুর রাসূল, আব্দুন্নবী, গোলাম রাসূল, গোলাম মুস্তফা ও গোলাম সাকলায়েন ইত্যাদি নাম রাখা।

৪. পত্র লেখার সময় আল্লাহর রহমত ও পত্র প্রাপকের দো‘আকে সম মর্যাদাবান করে এমনটি বলা যে, ‘আমি আল্লাহর রহমতে ও আপনার দো‘আয় ভাল আছি। কথাটি এভাবে না বলে যদি বলা হয় : আমি আল্লাহর রহমতে অতঃপর আপনার দো‘আয় ভাল আছি’, তা হলে তাতে শির্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

৫. চোখের অশুভ দৃষ্টি থেকে সন্তানকে রক্ষার জন্য সন্তানের ললাটে কালো টিপ বা দাগ দেয়া। এ-কাজটি আল্লাহর উপরে ভরসার পরিপন্থী বলে তা শির্কে আসগার।

৬. একই ভাবে চোখের কুদৃষ্টি থেকে ক্ষেতের ফসল রক্ষার জন্য মাটির পাত্রের পিঠে চুনা লেপ দিয়ে তা ক্ষেতে রেখে দেয়া। এ-কাজটিও আল্লাহর উপর ভরসার পরিপন্থী।

৭. লোক দেখানো ও তাদের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করা।

৮. ভ্রমণের প্রাক্কালে রাস্তায় খালি কলসি দেখলে এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা।

৯. কলেরা, দাদ, একজিমা, এইডস, প্লেগ ও যক্ষা ইত্যাদি রোগকে ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সংক্রামক রোগ’ হতে পারে এমনটি না বলে কথায় ও লেখনীতে এ-গুলোকে সংক্রামক রোগ বলা।

১০. কোনো বস্তুকে আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর রহমতে কোনো রোগের ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী এমনটি না বলে সরাসরি সে বস্তুকেই উপকারী বা অপকারী বলা। যেমন এমনটি বলা : নাপা ট্যাবলেট জ্বর সারানোর জন্য উপকারী।

১১. কোনো ঔষধ খেয়ে আল্লাহর রহমতে রোগ সেরেছে এমনটি না বলে অমুক ঔষধ খেয়ে রোগ সেরেছে এমনটি বলা। যেমন এমনটি বলা যে, নাপা খেয়ে আমার জ্বর সেরে গেছে।

১২. আল্লাহ অধিকাংশ জনগণের রায়ের মাধ্যমে ক্ষমতা দান ও তা ছিনিয়ে নেয়ার মালিক হওয়া সত্ত্বেও কথায় ও লেখনীতে দেশের জনগণকে ক্ষমতার মালিক ও উৎস বলে মনে করা।

কোনো কাজ সমাধা করার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা না করে কোনো মানুষের উপর ভরসা করে এমনটি বলা যে, ‘এ কাজে আপনি আমার একমাত্র ভরসা’।

[1]. আল-কুরআন, সূরা শুআরা: ২২২।

[2]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাঃ : ৪১।

[3] .সৈয়দ মোহাম্মদ এছহাক, তাবিজের কিতাব; (ঢাকা: আল-এছহাক প্রকাশনী, সংশোধিত সংস্করণ, ১৩৯৭ বাংলা), ৭ নং তদবীর, পৃ. ৩৮।

[4].তিরমিযী, প্রাগুক্ত;কিতাব নং-২৯, বাবনং-২৪, হাদীসনং ২০৭২, ৩/৪০৩; বায়হাক্বী.প্রাগুক্ত;২/৩০৭; হাকিম, প্রাগুক্ত;৪/৪৪১।

[5].আহমদ, প্রাগুক্ত;৪/১৫৬; আল-হাইছামী, মাজমাউয যাওয়াইদ; ৫/১০৩।

[6]. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَهً فَلاَ أَتَمَّ اللَّهُ لَهُ

‘‘যে তা’বীজ ব্যবহার করে আল্লাহ যেন তার উদ্দেশ্য পূর্ণ না করেন’’। ইবনে হিববান, প্রাগুক্ত; ১৩/৪৫০; বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত; ৯/৩৫০।

[7]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; ৩/৫২।

[8]. তদেব; ৪/২১২।

[9].হাদীসটি হাসান সনদে ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত। তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ৪/১১০; ইবনে হিববান, প্রাগুক্ত; ১০/২০০।

[10] হাদীসে এসেছে, ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেন :

«إِنَّ أِشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُوْنَ»

“কেয়ামতের দিন সবচেয়ে অধিক শাস্তি ভোগ করবে মূর্তি নির্মাণকারীগণ’’। বুখারী, প্রাগুক্ত; ৫/২২২০; মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৩/১৬৭০।

[11].‘শেরেক বিনাশ’ নামের বইটি ঢাকা থেকে আল-নাহদা প্রকাশনী কর্তৃক ১৩৯৫ বাংলা সনে এবং ‘শেরেক বর্জন’ বইটি সাতক্ষিরা থেকে হামিদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক ১৩৬৮ বাংলা সনে প্রকাশিত হয়েছে।