ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
শির্ক কী ও কেন? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
আদি মানুষেরা তাওহীদ পন্থী ছিল না শির্কপন্থী?

কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী ও নাস্তিক এই বলে আওয়াজ উঠিয়েছে যে, সকল ধর্মেই অংশীবাদী চিন্তাধারা একত্ববাদী চিন্তাধারার পূর্বে বিরাজমান ছিল। তাদের ধারণা মানুষের এ অংশীবাদী চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়ে একত্ববাদী চিন্তাধারায় পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি বিবর্তনের স্তর অতিক্রম করেই তা এ অবস্থায় উন্নীত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী জুলিয়ান হেক্সলীর চিন্তাধারায় উপর্যুক্ত বক্তব্য আমরা সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাই। তিনি বলেছেন,

‘‘আল্লাহ সম্পর্কিত বিশ্বাসটি উন্নতির শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছে। এ চিন্তাধারাটি এখন আর কোনো উন্নতি গ্রহণ করতে পারবে না। বস্তুত মানুষ ধর্মের বোঝা বহন করার জন্য প্রকৃতির বাইরে একটি শক্তিকে আবিষ্কার করেছে। সে ধর্ম প্রথমে নিয়ে এসেছে জাদু, এরপর নিয়ে এসেছে আধ্যাত্মিক কার্যক্রম, এরপর নিয়ে এসেছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। পরিশেষে আবিষ্কার করেছে এক আল্লাহর চিন্তাধারা। এ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধর্ম তার জীবনের শেষ স্তরে এসে পৌঁছেছে। নিঃসন্দেহে ধর্মের এ সকল বিশ্বাস এক সময় আমাদের সভ্যতার জন্য লাভজনক অংশ ছিল, তবে সভ্যতার এ অংশসমূহ বর্তমান আধুনিক উন্নত সমাজে এর উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে।’’[1]

তারা এ পর্যন্ত বলেই থেমে যান নি। তারা আরো অগ্রসর হয়ে বলেন: পৃথিবীতে যে সব নামাবলী ও গুণাবলী প্রচলিত ছিল তা থেকে গ্রহণ করেই নাকি ধার্মিকগণ তাদের আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলী প্রদান করেছেন।

পৃথিবীতে রাজাধিরাজ (الملك الأكبر) এ নামটি প্রচলিত ছিল, তাত্থেকেই তারা আল্লাহকে আকাশের রাজাধিরাজ নামকরণ করেছেন। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক বিশ্বকোষের লেখক ‘দ্বীন’ সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে বলেছেন :

‘‘অন্যান্য প্রভাব বলয়ের পাশাপাশি ধর্ম সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাদির অংশ গ্রহণও অধিক গুরুত্বের দাবী রাখে। আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলীসমূহ পৃথিবীর বুকে প্রচলিত অবস্থাদি থেকেই নির্গত হয়েছে। আল্লাহর রাজাধিরাজ (الملك الأكبر) হওয়ার এ বিশ্বাসটি মানুষের রাজাধিরাজ হওয়ারই অপর এক চিত্র। অনুরূপভাবে আকাশের রাজাধিরাজ পৃথিবীর রাজাধিরাজেরই অনুলিপি মাত্র। পৃথিবীর রাজা ছিলেন রাজাধিরাজ, ফলে এত্থেকে আল্লাহও এ সব গুণাবলী গ্রহণ করতে লাগলেন। আল্লাহকে সর্বশেষে বড় বিচারক (القاضي الأكبر الأخير) উপাধি

দান করা হয়, যিনি মানুষকে তার ভাল-মন্দ কর্মের প্রতিদান দান করেন। আল্লাহর হিসাব গ্রহণকারী ও প্রতিদানকারী হওয়ার বিচারগত এ বিশ্বাস শুধু যে ইয়াহূদী ধর্মেই পাওয়া যায় তা নয়; বরং খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসেও এ বিশ্বাসের মৌলিক অবস্থান রয়েছে।’’[2]

এ দু’জন লেখকের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা বলতে চান, বাস্তবে আদিতে মানুষের মাঝে ধর্ম ও আল্লাহর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এটি প্রাচীন কালের মানুষের তৈরী বৈ আর কিছুই নয়। তাদের ধারণা মতে, অতীতে মানুষেরা যখন ধর্ম ও আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করেছে, তখন তারা অসংখ্য আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল এবং এক আল্লাহের চিন্তাধারা হচ্ছে এ সম্পর্কিত চিন্তাধারার সর্বশেষ পরিণতি।এ দু’জন এবং অন্যান্য আরো যারা এ জাতীয় দাবী উত্থাপন করেছেন, তাদের এ দাবী নিতান্তই ভ্রান্ত, মূল্যহীন ও বাস্তবতা বিবর্জিত।

মুসলিমদের মাঝে যদি এ জাতীয় দাবীর অনুসারী কিছু মানুষ পাওয়া না যেতো এবং যে কোনো বিষয়ে মুক্ত চিন্তা প্রকাশের অধুনা স্বীকৃত অধিকারের দাবীতে এ জাতীয় দাবী যদি উত্থাপিত না হতো, তা হলে এ জাতীয় দাবী করার বিষয়টি আলোচনায় আনারই অযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। এ জাতীয় দাবী যেহেতু ধর্ম এবং আল্লাহর বাস্তবতাকে অস্বীকার করা থেকে উত্থাপিত হয়েছে, সেহেতু অংশীবাদের উপর একত্ববাদের অগ্রগণ্যতা নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে ধর্ম ও আল্লাহর বাস্তবতা সম্পর্কে অন্যান্য বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের কি চিন্তাধারা রয়েছে, সে সম্পর্কে নিম্নে সামান্য কিছু আলোচনা করা হলো।

>
[1].ওয়াহিদ উদ্দিন খান, আল-ইসলামু ইয়াতাহাদ্দা; (কায়রো : আল-মাকতাবুল ইসলামী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯৬ খ্রি.), পৃ. ৩৮, ৩৯। ওয়াহিদ উদ্দিন খান এ কথাগুলো জুলিয়ান হেক্সলি প্রণীত Man in the Modern world এর ১৩১ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।

[2].তদেব। তিনি এ বক্তব্যটি Encyclopedia of Social Sciences, ১৯৫৭, এর ১৩খন্ড পৃষ্ঠা ২৩৩ থেকে গ্রহণ করেছেন।