সলফ তথা সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এর কথা ও কর্ম আমভাবে দলীল নয়। বরং তাতে শর্ত রয়েছে। প্রথমতঃ তাদের বর্ণিত সে কথা বা আমলের সনদ সহীহ হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এমন নয় যে, যে কোন একজন সাহাবীর কথা বা আমলকে মেনে নিলেই হবে। যেহেতু হাদীসে এসেছে,
أصحابي كالنجوم بأيهم اقتديتم اهتديتم
“আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মতো। তাদের যার অনুসরণ করবে, সুপথ পাবে।”
কিন্তু এ হাদীস সহীহ নয়; বরং এটি জাল হাদীস। (সিঃ যয়ীফাহ ৫৮-৬২নং)
বিশেষ করে সাহাবীর কথা ও কাজ যদি কুরআন বা হাদীসের বিরোধী হয় অথবা অন্য সাহাবীর কথা বা কাজের বিপরীত হয়, তাহলে আমরা সে ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে সালাফী’ হব কীভাবে?
উদাহরণ স্বরূপ সাহাবী আবু তালহা রোযা অবস্থায় বরফ খেতেন এবং বলতেন, 'এটা বরকত; এটা খাদ্যও নয়, পানীয়ও নয়!’
মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, (আবু তালহার) এই মওকুফ হাদীসটি উক্ত (তারকারাজির মারফু) হাদীসটি বাতিল হওয়ার অন্যতম প্রমাণ। যেহেতু তা সহীহ হলে আবু তালহার অনুসরণ করে যে রমযানে (রোযা অবস্থায়) বরফ খাবে, তার রোযা নষ্ট হবে না। (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।) আর আমার বিশ্বাস, এ কথা আজ কোন মুসলিম বলবে না।' (ঐ ৬৩নং)
উলামাদের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে যে, কোন সাহাবীর উক্তি বা আমল শরয়ী দলীল কি না?
একদল উলামা মনে করেন, আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রসূল (সা.)-এর হাদীস ছাড়া অন্য কিছু শরয়ী দলীল নয়। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ
“তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন -- ওর মীমাংসা তো আল্লাহরই নিকট।” (সূরাঃ ১০)।
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ
“যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।” (নিসাঃ ৫৯)
এখানে তৃতীয় কোন এখতিয়ার (অপশন) এর কথা বলা হয়নি। সুতরাং সাহাবীর উক্তি অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের উক্তির মতোই, তা শরয়ী কোন দলীল নয়। কিন্তু উলামার অন্য দলটি বলেন, নিশ্চয় অন্যান্যের তুলনায় সাহাবাগণের অধিক মর্যাদা আছে এবং সাহাবাগণের উক্তি ও আমল পরবর্তীদের উক্তি ও আমল অপেক্ষা সঠিকতার বেশি কাছাকাছি।
তাছাড়া তৃতীয় অপশন না থাকলেও যেভাবে শরয়ী দলীল হিসাবে ইজমা-কিয়াসকে গ্রহণ করা হয়, সেইভাবে সাহাবীর উক্তি ও আমল শরয়ী দলীল বলে বিবেচিত হবে।
অবশ্য তাতে কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। যেমন সাহাবীকে ইলম ও ফিকহে সুপরিচিত হতে হবে। নচেৎ এমন বহু বেদুঈন সাহাবী আছেন, যারা ইসলাম গ্রহণের পর মরুবাসে ফিরে গেছেন এবং শরয়ী জ্ঞানের সাথে খুব একটা সম্পর্ক রাখেননি।
এ ছাড়া যেমন উল্লিখিত হয়েছে, সাহাবীর উক্তি বা আমল সহীহ সনদ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।
আমরা সংক্ষেপে এ ব্যাপারে পাঠককে অবহিত করব, যাতে সালাফী হওয়ার মৌলিক বুনিয়াদ সম্পর্কে অল্প হলেও সতর্ক থাকতে পারেন এবং মতভেদের সময় সঠিকটা বেছে নিতে পারেন। সাহাবীর উক্তি মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্তঃ
প্রথম ভাগ
এমন উক্তি, যা রায় বা ইজতিহাদ হতে পারে না। শোনা ও বর্ণনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। যেমন কোন অদৃশ্য বিষয়ক (গায়বী) খবর অথবা কোন ইতিহাস।
এমন উক্তি মারফু হাদীসের মান পায়। এমন উক্তিকে কিয়াসের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, এমন উক্তি দ্বারা কোন বাক্যের ব্যাখ্যা করা যায়। যেহেতু এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ -এর হাদীসের অর্থ নিজের ভাষায় বর্ণনা করছেন। বিশেষ করে কোন ফতোয়া বা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন ঘটতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হল, যেন উক্ত সাহাবী ইসরাঈলী বর্ণনা গ্রহণে বা বর্ণনে পরিচিত না হন (যেমন সাহাবী কা’ব আল-আহবার)। (মুযাক্কিরাতু উসূলিল ফিক্হ, শানীত্বী ২৫৬পৃঃ) প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ইসরাঈলী বর্ণনার ৩ অবস্থা হতে পারেঃ
একঃ সত্য বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার সত্যায়ন বর্তমান।
দুইঃ মিথ্যা বলে বিশ্বাস করা ওয়াজেব। কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার মিথ্যায়ন বর্তমান। তিন ঃ যা সত্য বলে বিশ্বাস করা যাবে না এবং মিথ্যাও বলা যাবে না।
কুরআন বা সহীহ সুন্নাহতে যে কথার সত্যায়ন বা মিথ্যায়ন কিছুই বর্তমান নেই। (আওয়াউল বায়ান ৪/২৩৮)
দ্বিতীয় ভাগ
সাহাবীর এমন উক্তি বা আমল, যা তার নিজস্ব রায় বা ইজতিহাদ হতে পারে। এমন উক্তি বা আমলের কয়েক অবস্থা হতে পারে।
একঃ যা কুরআন বা হাদীসের উক্তির বিরোধী। এক্ষেত্রে তার উক্তি বা আমল অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে।
সঙ্গে কুরবানী না থাকলে আবু বাকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) ইফরাদ হজ্জকে উত্তম মনে করতেন। পক্ষান্তরে সহীহ সুন্নাহতে তামাত্তু হজ্জ উত্তম হওয়ার ব্যাপারে বর্ণনা আছে। সেই ভিত্তিতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) তামাত্তু হজ্জ উত্তম বলে ফতোয়া দিতেন। কিন্তু কেউ কেউ আবু বাকর ও উমারের কথা বললে তিনি বলেছিলেন, “অতি সত্বর তোমাদের উপর পাথর বর্ষণ হবে। আমি বলছি, আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন। আর তোমরা বলছ, ‘আবু বাকর ও উমার বলেছেন।” (আহমাদ ১/৩৩৭, এর সনদটি দুর্বল। অবশ্য উক্ত অর্থেই সহীহ সনদে মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে একটি আসার বর্ণিত হয়েছে। দেখুনঃ যাদুল মাআদ ২/১৯৫, ২০৬)।
একই ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন উমারকে এক ব্যক্তি বলল, ‘আপনার আব্বা তো তামাত্তু হজ্জ করতে নিষেধ করেছেন। এ কথা শুনে তিনি তাকে বললেন, আল্লাহর রসূল (সা.)-এর আদেশ অধিক মানার যোগ্য, নাকি আমার আব্বার?’ (যাদুল মাআদ ২/১৯৫)
ক্বাতাদাহ বলেন, ইবনে সীরীন এক ব্যক্তিকে একটি হাদীস বয়ান করলেন। তা শুনে এক ব্যক্তি বলল, কিন্তু অমুক তো এই বলেন।
প্রত্যুত্তরে ইবনে সীরীন বললেন, 'আমি তোমাকে নবী (সা.)-এর হাদীস বয়ান করছি, আর তুমি বলছ, অমুক ও অমুক এই বলেছে?! আমি তোমার সাথে কোনদিন কথাই বলব না।' (দারেমী ৪৪১নং)
আবুস সায়েব বলেন, একদা আমরা অকী’র কাছে ছিলাম। তিনি তার কাছের একটি লোকের উদ্দেশ্যে বললেন, 'আল্লাহর রসূল কি (মক্কার হারামের জন্য প্রেরিত কুরবানীর উটের দেহ চিরে) চিহ্ন দিয়েছেন। আর আবু হানীফা বলেন, তা (নিষিদ্ধ) অঙ্গহানি করণের অন্তর্ভুক্ত!
ঐ লোকটি রায়-ওয়ালা ছিল। সে বলল, কিন্তু ইবরাহীম নাখয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, (ঐ ধরনের) চিহ্ন দেওয়া অঙ্গহানি করার পর্যায়ভুক্ত। এ কথা শোনার পর দেখলাম, অকী’ চরমভাবে রেগে উঠলেন। বললেন, আমি তোমাকে বলছি, আল্লাহর রসূল (সা.) করেছেন। আর তুমি বলছ, ইবরাহীম বলেছেন! তুমি এর উপযুক্ত যে, তোমাকে ততদিন পর্যন্ত জেলে বন্দী রাখা হবে; যতদিন না তুমি তোমার ঐ কথা। প্রত্যাহার করে নিয়েছ।' (তিরমিযী ৯০৬নং)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উক্তির উপর অন্য কোন সৃষ্টির উক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।
ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আমি সেই সম্প্রদায়ের জন্য অবাক হই, যারা (হাদীসের) সনদ ও তার শুদ্ধতা জানা সত্ত্বেও সুফিয়ানের রায় গ্রহণ করে! অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন,
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
“সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনা) অথবা কঠিন শাস্তি (আযাব) তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সূরা নূর ৬৩ আয়াত)
তুমি কি জানো, ফিতনা কী? ফিতনা হল শির্ক। সম্ভবতঃ কোন ব্যক্তি রসূল (সা.)-এর কোন উক্তিকে রদ্দ করবে, ফলে তার হৃদয়ে বক্রতা পতিত হবে এবং তার কারণে সে ধ্বংস হয়ে যাবে!’ (আলইবানাতুল কুবরা, ইবনে বাত্ত্বাহ ৯৭নং)। আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। বাকী থাকল, কোন সাহাবীর উক্তি বা আমল কি কোন আম নির্দেশকে খাস করতে পারে? এ নিয়েও উলামাদের মতভেদ রয়েছে।
দুইঃ যা অন্য কোন সাহাবীর উক্তির বিরোধী।
এ অবস্থায় কারো উক্তি দলীল রূপে গণ্য হবে না। বরং প্রাধান্য দেওয়ার সঙ্গত কারণসমূহ খুঁজে দেখতে হবে। যেমন চার খলীফার কথাকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেওয়া হবে। খলীফাদের মধ্যে হলে আবূ বাকর ও উমারের কথাকে প্রাধান্য দিতে হবে ইত্যাদি। (ই’লামুল মুওয়াক্কিঈন ৪/১৫৩)
তিনঃ কোনও একজন সাহাবীর প্রসিদ্ধ উক্তি, যার বিরুদ্ধে অন্য কোন সাহাবীর আপত্তি নেই বা বিরোধিতা নেই।
এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ উলামাগণের মতে তা দলীল। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২০/১৪) অনেকে বলেছেন, এটা মৌন ইজমা (সর্বসম্মতি)। (মুযাক্কিরাতু উসূলিল ফিকুহ, শানৰ্কীত্বী ২৫৬পৃঃ)
চারঃ কোন সাহাবীর অপ্রসিদ্ধ উক্তি, যার বিরুদ্ধে অন্য কোন সাহাবীর আপত্তি নেই বা বিরোধিতাও নেই।
এ ক্ষেত্রেও অধিকাংশ উলামাগণের মতে তা দলীল। (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২০/১৪)