নবী (সা.) এর উপর দরূদের বহু প্রকার বিদআতী (অভিনব) বাক্যসমষ্টি আমরা শুনে থাকি; যা রসূল (সা.), তার সাহাবা, তাবেয়ীন এবং আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনদের উক্তিতে উল্লেখ হয়নি (যেমন চেহেল কাফ ও বিভিন্ন চিশ্তিয়া দরূদ)। বরং তা পরবর্তীকালের কিছু শায়খ ও বুযুর্গদের গড়া ও রচনা মাত্র।
কিন্তু দরূদের ঐ বিদআতী শব্দ-বিন্যাসগুলি সাধারণ মানুষ এবং উলামা (?) দের মাঝেও প্রচলিত হয়ে পড়েছে। রসূল (সা.) হতে বর্ণিত দরূদের চেয়ে ঐ সমস্ত বিদআতী দরূদই তারা অধিক অধিক পাঠ করে থাকে। আবার অনেকে বিশুদ্ধ বর্ণিত দরূদ ত্যাগ করে তাদের শায়খ ও পীরদের প্রতি সম্পৃক্ত দরূদই প্রচার ও প্রচলন করে থাকে। অথচ এই সমস্ত দরূদ নিয়ে আমরা যদি গভীর চিন্তা করে দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, তাতে সেই রসূলের নিদের্শের পরিপন্থী বহু এমনও উক্তি রয়েছে যার উপর আমরা দরূদ পাঠ করে থাকি। ঐ সমস্ত বিদআতী দরূদের কিছু নিম্মরূপঃ
১। “আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ত্বিব্বিল কূলবি অ দাওয়া-ইহা, অ আ-ফিয়াতিল আবদা-নি অশিফা-ইহা, অনুরিল আবসা-রি অযিয়া-ইহা অ আলা আ-লিহি অসাল্লিম।”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি করুণা বর্ষণ কর মুহাম্মাদের উপর, যিনি অন্তরের চিকিৎসা ও ঔষধ, শরীরের নিরাপত্তা ও আরোগ্য এবং চোখের জ্যোতি ও দীপ্তি, এবং তার বংশধরের উপরেও (করুণা বর্ষণ কর) ও সকলের উপর শান্তি বর্ষণ কর।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, দেহ, হৃদয় ও চক্ষুর রোগ মুক্তিদাতা এবং নিরাপত্তাদানকারী একমাত্র আল্লাহ! রসূল তার নিজের জন্য এবং অপরের জন্যও ইষ্ট-অনিষ্ট্রের মালিক নন। সুতরাং দরূদের এই শব্দবিন্যাস আল্লাহ তাআলার এই বাণীর প্রতিকূলঃ
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ
অর্থাৎ, বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার ভালো-মন্দের উপর আমার কোন অধিকার নেই।' (সূরা ইউনুস ৪৯ আয়াত)
আর তা নবী (সা.) এর এই বাণীরও পরিপন্থী, “তোমরা আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন করো না যেমন খ্রিষ্টানরা মারয়্যাম-পুত্র (ঈসা)র প্রশংসায় করেছিল। আমি একজন দাস মাত্র। অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা (দাস) ও তাঁর রসূলই’ বল।” (বুখারী)
২। একজন লেবাননী সূফীপন্থী বড় শায়খের এক বই দেখেছি, তাতে দরূদের এই শব্দসমষ্টি সন্নিবিষ্ট হয়েছে ?
“আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন হাত্তা তাজআলা মিনহুল। আহাদিয়্যাতাল ক্বাইয়মিয়্যাহ।”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের উপর অনুগ্রহ বর্ষণ কর, যাতে তুমি তাঁকে একত্ব ও অবিনশ্বরতা দান কর।
অথচ একত্ব ও অবিনশ্বরতা কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর গুণাবলীর অন্যতম। কিন্তু এই শায়খ তা রসূল (সা.)-এর জন্যও নির্ধারণ করেছেন।
৩ সিরিয়াবাসী জনৈক বড় শায়খের ‘আদইয়াতুস সাবা-হি অল মাসা’ নামক পুস্তকে এই দরূদ দেখেছিঃ
“আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিল্লাযী খালাক্বতা মিন নূরিহী কুল্লা শাই।
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের উপর অনুগ্রহ বর্ষণ কর, যার জ্যোতি হতে তুমি প্রত্যেক বস্তুকে সৃষ্টি করেছ।
এখানে প্রত্যেক বস্তু’ বলতে আদম, ইবলীস, বানর, শূকর প্রভৃতিকে বুঝানো যায়। সুতরাং কোন জ্ঞানী বলবে কি যে, ওরা সবাই ‘নূরে মুহাম্মাদী’ (মুহাম্মাদের জ্যোতি) হতে সৃষ্ট?! পক্ষান্তরে শয়তানও জেনেছে যে, তাকে এবং আদমকে কি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তো সে আল্লাহকে বলেছিল; যেমন কুরআনে বর্ণিতঃ
أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থাৎ, আমি ওর (আদম) থেকে শ্রেষ্ঠ। (কারণ) আপনি আমাকে আগুন হতে সৃষ্টি করেছেন, আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে। (সূরা স্বাদ ৭৬ আয়াত)।
সুতরাং এই আয়াত শায়খের ওই দরূদকে মিথ্যা ও বাতিল বলে ঘোষণা করে।
৪ দরূদের বিদআতী শব্দবিন্যাসের একটি নিম্নরূপ:
“আসসালা-তু অসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! যা-ক্বাত হীলাতী ফাআদ্রিকনী ইয়া হাবীবাল্লা-হ!”
অর্থাৎ, আপনার উপর দরূদ ও সালাম হে আল্লাহর রসূল! আমি বেগতিক হয়ে পড়েছি, অতএব আমাকে রক্ষা করুন, হে আল্লাহর হাবীব!
এই দরূদের প্রথমাংশ সঠিক। কিন্তু আপদ ও শির্ক রয়েছে দ্বিতীয়াংশে যাতে বলা হয়েছে ‘আদরিক্নী ইয়া হাবীবাল্লাহ!’ যা আল্লাহর এই বাণীর পরিপন্থীঃ
أَمَّن يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ
অর্থাৎ, আর্তের আর্তনাদে কে সাড়া দেয় যখন সে তাকে ডাকে এবং বিপদ দূরীভূত করে? (অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কেউই নয়।) (সূরা নামল ৬২ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ
অর্থাৎ, আর আল্লাহ যদি তোমাকে ক্লেশ দান করেন তবে তিনি ভিন্ন তার মোচনকারী আর কেউ নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)
রসূল (সা.) যখন দুশ্চিন্তা বা দুর্দশাগ্রস্ত হতেন তখন বলতেন, “হে চিরঞ্জীব, হে অবিনশ্বর! আমি তোমার রহমতের অসীলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি।” (তিরমিযী)
সুতরাং আমাদের জন্য কি করে বৈধ হতে পারে যে, আমরা তাকে রক্ষা করুন, পরিত্রাণ দিন’ বলব?
আবার ঐ দরুদ তাঁর এই বাণীরও প্রতিকূল , “যখন কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
৫। ফাতেহী দরূদ এবং তার শব্দগুলি নিম্নরূপঃ
“আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিল ফাতিহি লিমা উগলিক্ব----।” অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি প্রত্যেক বন্ধন-উন্মােচনকারী মুহাম্মদের উপর করুণা বর্ষণ কর।
আবার এর রচয়িতা মনে করে যে, উক্ত দরূদ পাঠ করা ৬ হাজার বার কুরআন তেলাওয়াত করা অপেক্ষাও উত্তম! এ কথা তিজানিয়াহ-পন্থীদের গুরু শায়খ আহমাদ তিজানী হতে কথিত। নিঃসন্দেহে এটা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। একথা কোন মুসলিম তো দূরের কথা-কোন জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিও বিশ্বাস রাখতে পারে না যে, এই বিদআতী দরূদ পড়া আল্লাহর বাণী ৬ হাজার তো বহু দুরের কথা মাত্র একবার পড়া অপেক্ষাও উত্তম। সুতরাং এ কথা কোন মুসলিমের নয়।
পক্ষান্তরে রসূলকে সাধারণভাবে এবং আল্লাহর ইচ্ছার শর্ত আরোপ না করে হর-বন্ধন উন্মােচনকারী (বিজয়ী) বলে অভিহিত করাও মহাভুল। কারণ রসূল (সা.) আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে মক্কা জয় করেন নি। তদনুরূপ তিনি তার পিতৃব্যের অন্তরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান দ্বারা উদঘাটন করতে সক্ষম হননি। বরং তিনি শির্কের উপরেই মারা যান। কুরআন রসূলকে সম্বোধন করে বলে,
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ
অর্থাৎ, তুমি যাকে প্রিয় মনে কর তাকে সৎপথে আনতে পারবে না বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে সৎপথে আনয়ন করেন। (সূরা কাসাস ৫৬ আয়াত)
আল্লাহ আরো বলেন, إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا
অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি তোমার জন্য নিশ্চিত বিজয় অবধারিত করেছি। (সূরা ফাত্হ ১ আয়াত)
৬। দালায়েলু খাইরাত’-প্রণেতা সপ্তম হিযবে বলেন, “আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ, মা সাজাআতিল হামাইমু অ নাফাআতিত তামা-ইম।”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের উপর করুণা বর্ষণ কর, যত কবুতর ডাকে এবং যত কবচ উপকৃত করে তার সমপরিমাণ।
বদনজর ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য যে কবচ ও তাবীয বাচ্চাদের গলায় বা হাতে বাধা হয়, তা যে বাঁধে এবং যার জন্য বাঁধা হয় উভয়েরই কোন উপকার সাধন করে না। বরং কবচ ব্যবহার মুশরিকদের কর্ম। রসূল (সা.) বলেন, “যে কবচ লটকায় সে শির্ক করে।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ) সুতরাং ঐ দুরূদ এই হাদীসের পরিপন্থী। যেহেতু তা শির্ক ও কবচ বাধাকে। আল্লাহর সামীপ্য লাভের মাধ্যম নিরূপণ করে। সুতরাং আমরা আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা ও হেদায়াত প্রার্থনা করছি।
উক্ত পুস্তক দালায়েলুল খাইরাত’ এ নিম্নের দরূদও বর্ণিত হয়েছেঃ
“আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ, হাত্তা লা য়্যাবক্বা মিনাস সালা-তি শাই, অরহাম মুহাম্মাদা, হাত্তা লা য়্যাবকা মিনার রাহমাতি শাই!”
হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ কর -যাতে অনুগ্রহের কিছুও অবশিষ্ট না থাকে, এবং তুমি মুহাম্মাদের প্রতি করুণা কর, যাতে করুণার কিছুও অবশিষ্ট না থাকে।
অনুগ্রহ ও করুণা (সালাত ও রহমত) আল্লাহর ক্রিয়াগত গুণ। কিন্তু এই দরূদে তা নিঃশেষ ও অবসান হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ ওদের এই কথার খন্ডন করে বলেন,
قُل لَّوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِّكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَن تَنفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا
অর্থাৎ- বল, 'আমার প্রতিপালকের বাণী (গণাবলী) লিপিবদ্ধ করার জন্য যদি সমুদ্র কালি হয় তবে আমার প্রতিপালকের বাণী (গুণাবলী) শেষ হওয়ার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে যদিও অনুরূপ অতিরিক্ত আরো কালি আনয়ন করা হয়।' (সূরা কাহফ ১০৯ আয়াত)
৭। বাশীশী দরূদ। ইবনে বাশীশ ঐ দরূদে বলেন, “আল্লাহুম্মান শুলনী মিন আওহা-লিত তাওহীদ, অআগরিক্নী ফী আইনি বাহরিল অহদাহ। অযুজ্জাবী ফিল আহাদিয়্যাতি হাত্তা লা আরা অলা আসমাআ অলা আহুসসা ইল্লা বিহা!”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তওহীদের কদম থেকে সত্বর বাহির করে নাও এবং অদ্বৈতের সিন্ধু-প্রস্রবনে আমাকে নিমজ্জিত কর ও অদ্বৈতে আমাকে নিক্ষিপ্ত কর। যাতে আমি তার দ্বারাতেই দর্শন, শ্রবণ এবং অনুভব করি।
বলাই বাহুল্য যে, উক্ত মতবাদ সর্বেশ্বরবাদীদের; যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে অভিন্ন মনে করে। বক্তার মতে তওহীদে কাদা ও ময়লা আছে, তাই সে দুআ করছে যাতে তাকে সেখান হতে বের করে নিয়ে অভিন্নতা ও অদ্বৈতের সমুদ্রে নিমজ্জিত করা হয় এবং এখানে সে প্রত্যেক বস্তুতে তার মা'বুদকে দেখতে পায়। তাই তো ওদের গুরু বলে,
‘কুকুর ও শূকর আমাদের উপাস্য বই অন্য কিছু নয়।
গির্জায় সন্ন্যাসীই তো আল্লাহ।
সুতরাং খ্রিষ্টানরা ঈসাকে আল্লাহর পুত্র মেনে মুশরিক হল। কিন্তু ওরা সারা সৃষ্টিকে আল্লাহর শরীক করে বসল!! মুশরিকরা যা বলে তা হতে আল্লাহ কত ঊর্ধ্বে।
৮৷ অতএব হে ভাই মুসলিম। এ সমস্ত (এবং এই ধরনের যাবতীয়) দরূদ হতে সাবধান হন; যা আপনাকে শির্কে আপতিত করে। বরং আপনি রসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত ও নির্দেশিত দরূদেই সীমাবদ্ধ থাকুন; যে রসূল নিজের মন থেকে কিছু বলেন না, যার অনুসরণে সৎপথ ও পরিত্রাণ রয়েছে এবং যার বিরুদ্ধাচরণ। ও অন্যথাচরণে আমল ও কর্ম (আল্লাহর নিকট) প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। তিনি (সঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি এমন আমল করে যার উপর আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” (মুসলিম)