ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শির্কের বহু সংখ্যক বিপত্তি ও অপকারিতা রয়েছে। যার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিপত্তিগুলো নিম্নরূপঃ
১- শির্ক মানবতার অপমান। শির্ক মানুষের সম্মানহানি করে এবং তার কদর ও মর্যাদা অধঃপাতিত করে দেয়। যেহেতু আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ বা সৃষ্টি করেছেন, তাকে যথার্থ মর্যাদা দান করেছেন, যাবতীয় বিষয়ের নাম শিক্ষা। দিয়েছেন, তাঁর তরফ হতে তিনি তার জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল বস্তুকে অধীনস্থ করে দিয়েছেন এবং এ বিশ্বচরাচরের সকল কিছুর উপর তাকে কর্তৃত্ব দান করেছেন। কিন্তু সে আত্মমর্যাদা বিস্মৃত করে এই বিশ্বেরই কিছু
উপাদানকে নিজের পূজ্য উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে; যার সম্মুখে সে প্রণত ও অবনত হয়! এর চেয়ে মানুষের অধিক হীনতা আর কি হতে পারে যে, আজও পর্যন্ত কোটি-কোটি লোক গাভীর উপাসনা করে, যাকে আল্লাহ জীবিতাবস্থায় মানুষের সেবার জন্য এবং যবেহ করে তার মাংস ভক্ষণের জন্য সৃষ্টি করেছেন!
আবার কত শত মুসলিমকে আপনি দেখবেন তারা মৃতের কবরের উদ্দেশ্যে ধ্যানরত হয়। মূতের নিকট নিজেদের প্রয়োজন ভিক্ষা করে। অথচ তারাও তাদেরই মত আল্লাহর দাস, যারা নিজেদের মঙ্গলামঙ্গলের উপর কোন ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং হুসাইন (রাঃ) নিজের উপর থেকে হত্যা প্রতিহত করতে পারেন নি, অতএব অপরের নিকট থেকে বিপদ কিরূপে দূর করতে পারেন। এবং তার উপকার সাধন করতে পারেন?
পক্ষান্তরে পরলোকগত মানুষরা জীবিত মানুষদের দুআর মুখাপেক্ষী। সুতরাং আমরা তাদের জন্যই দুআ করব এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদের নিকটে দুআ (প্রার্থনা) করব না বা বিপদে তাদেরকে আহবান করব না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ * أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَاءٍ ۖ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
অর্থাৎ, ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে আহবান করে তারা কিছু সৃষ্টি করে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। তারা নিপ্রাণ এবং তাদেরকে কবে পুনরুত্থিত করা হবে সে বিষয়ে তাদের কোন চেতনা নেই। (সূরা নাহল ২০-২১ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ
অর্থাৎ, এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর অংশী স্থাপন করে সে যেন আকাশ হতে পড়ে, অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অথবা বায় তাকে উড়িয়ে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করে। (সূরা হজ্জ ৩১ আয়াত)
২ - শির্ক কুসংস্কার ও অমুলক বিশ্বাসের বাসা।
কারণ যে ব্যক্তি বিশ্বাস রাখে যে, এই বিশ্বে আল্লাহ ব্যতীত কোন নক্ষত্র, জিন, ব্যক্তিত্ব বা রূহেরও প্রভাব-ক্ষমতা আছে সে ব্যক্তির মন ও মস্তিষ্ক প্রত্যেক কুসংস্কারকে স্থান দেবার জন্য এবং প্রত্যেক দাজ্জাল ও প্রতারক ধর্মধজীকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকে। যার ফলে সমাজে শির্ক এবং আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানতে পারে না এমন গায়েবী (অদৃশ্য) খবরের দাবীদার গণক, ভবিষ্যদ্বক্তা, যাদুকর, জ্যোতিষী এবং অনুরূপ অন্যান্য মানুষদের বেসাতি বিস্তার লাভ করে। যেমন এই ধরনের পরিবেশে ঘটনার পশ্চাতে হেতু ও যুক্তি এবং সৃষ্টিগত নিয়মকে উপেক্ষা করার প্রবণতাও ব্যাপক আকার ধারণ করে।
৩ - শির্ক এক বড় অন্যায়। বাস্তবতা ও প্রকৃতত্বের প্রতি অন্যায়। যেহেতু সর্ববৃহৎ প্রকৃতত্ব এই যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি ব্যতীত কেউ প্রতিপালক ও প্রভু নেই এবং তিনি ছাড়া কেউ বিধানদাতা ও শাসক নেই। কিন্তু মুশরিক গায়রুল্লাহকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে এবং অপরকে বিধাতা মেনে থাকে।
শির্ক আত্মার প্রতি অন্যায়। যেহেতু মুশরিক নিজেকে তারই মত অথবা তার চেয়ে নিম্মমানের কোন সৃষ্টির দাস বানিয়ে দেয়। অথচ আল্লাহ তাকে স্বাধীনরূপে সৃষ্টি করেছেন। শির্ক অপরের প্রতি অন্যায়। যেহেতু যে ব্যক্তি আল্লাহর সহিত কাউকে অংশী স্থাপন করে, সে ব্যক্তি ঐ অংশীর প্রতি অন্যায় করে, কারণ সে তাকে সেই অধিকার দান করে যা তার প্রাপ্য নয়।
৪। শির্ক ভয় ও অমূলক ধারণা এবং সন্দেহের উৎপত্তিস্থল। যেহেতু যে ব্যক্তি বিভিন্ন কুসংস্কার গ্রহণ করবে এবং অদ্ভুত কর্মকান্ড বিশ্বাস করে নেবে সে নানান দিক থেকে ভীত-শঙ্কিত হবে। কারণ সে একাধিক উপাস্য ও প্রভুর উপর ভরসা রাখে, যাদের প্রত্যেকটাই নিজেদের স্বার্থেও মঙ্গল আনয়ন এবং অমঙ্গল দূরীকরণে অসমর্থ। যার কারণে শির্কী পরিবেশে বাহ্যিক কোন কারণ ব্যতিরেকেই অশুভ ধারণা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا ۖ وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ۚ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ, কাফেরদের অন্তরে আমি আতঙ্ক সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর সহিত শির্ক (অংশী স্থাপন করেছে যার সপক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। জাহান্নাম তাদের নিবাস এবং অনাচারীদের আবাসস্থল অতি নিকৃষ্ট। (সূরা আলে ইমরান ১৫১ আয়াত)।
৫৷ শির্ক ফলপ্রসূ আমল (কর্ম) ব্যাহত করে। যেহেতু শির্ক তার অনুসারীদেরকে মাধ্যম ও সুপারিশকারীদের উপর ভরসা ও নির্ভর করতে শিক্ষা দেয়। ফলে তারা সৎকর্ম ত্যাগ করে বসে এবং পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, আর বিশ্বাস এই রাখে যে, ওরা তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। এই বিশ্বাস ছিল ইসলামের পূর্বে আরবদের। যাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
অর্থাৎ, এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যার উপাসনা করে তা তাদের ক্ষতি করে না উপকারও করে না। (এই অন্যায় কাজের কৈফিয়ত হিসেবে) ওরা বলে, 'এগুলি আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।” বল, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান পবিত্র এবং ওদের শির্ক হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। (সূরা ইউনুস ১৮)
ঐ খ্রিষ্টানরা, যারা বিশ্বাস রাখে যে, মাসীহকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয় যেমন ওরা মনে করে তখন তিনি তাদের সমস্ত পাপ স্খলন বা ক্ষমা করে গেছেন। ফলে তারা বিভিন্ন অসৎ ও নোংরা কর্ম এই বিশ্বাসে করে থাকে। কিছু মুসলিমও আছে, যারা ওয়াজেব কর্মাদি ত্যাগ করে ও হারাম কর্মাদি করে থাকে আর জান্নাত প্রবেশের জন্য তাদের রসূলের ‘শাফাআত’ (সুপারিশের) উপর ভরসা রাখে। অথচ রসূল কারীম (সা.) তার কন্যা ফাতেমার উদ্দেশে বলেন, “হে মুহাম্মাদের বেটী ফাতেমা! আমার সম্পদ হতে যা তোমার ইচ্ছা চেয়ে নাও, আমি আল্লাহর দরবারে তোমার কোন উপকার করতে পারব না।” (বুখারী)
৬। শির্ক চিরকাল জাহান্নামে স্থায়ী হওয়ার কারণ। শির্ক পৃথিবীতে মানুষের ভ্রষ্ট হওয়ার এবং আখেরাতে চিরস্থায়ী আযাব উপভোগের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
অর্থাৎ, যে আল্লাহর সহিত শির্ক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করে দেবেন, তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম এবং অনাচারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদাহ ৭২ আয়াত)
রসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে (স্থাপিত) কোন শরীককে ডাকা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নাম প্রবেশ করবে।” (বুখারী) উক্ত হাদীসে নিদ্দ্ (সমকক্ষ) এর অর্থ ও সমতুল ও অংশী।
৭। শির্ক উম্মাহকে বিচ্ছিন্ন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
অর্থাৎ, তোমরা মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না; যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। (সূরা রূম ৩১ আয়াত)*
(সারকথা )
পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদগুলি একথাই সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ করে যে, শির্ক এমন এক ভয়ানক আপদ যা থেকে বাচা, সুদূরে থাকা এবং তাতে আপতিত হওয়ার ভয় করা ওয়াজেব। কারণ শির্ক সর্বাপেক্ষা বড় পাপ; যা বান্দার কৃত সমস্ত সৎকর্মকে পণ্ড ও ধ্বংস করে ফেলে -যে কর্ম জাতীয় কল্যাণ ও মানবিক সেবার উপযোগী হলেও হতে পারে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَدِمْنَا إِلَىٰ مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَّنثُورًا
অর্থাৎ, আমি ওদের (মুশরিকদের) কৃতকর্মের প্রতি অভিমুখ করে তা উড়ন্ত ধূলিকণার ন্যায় (নিষ্ফল) করে ফেলব। (সূরা ফুরকান ২৩ আয়াত)
(শায়খ আব্দুল্লাহ আব্দুল গনী খাইরাত্ব এর পুস্তক “দলীলুল মুসলিম ফিল ইতিকাদ’ হতে সমুদ্ভূত।)