বর্তমানে মুসলিম-বিশ্বে ব্যাপক আকারে প্রচলিত শির্কের সমারোহই মুসলিমদের দুর্দশা এবং ফিতনা ফাসাদ, ভূমিকম্প, যুদ্ধ প্রভৃতি আযাবে নিষ্পেষিত হওয়ার প্রধান কারণ। যা তাদের তওহীদ হতে বিমুখ এবং তাদের বিশ্বাস ও আচরণে শির্ক বহিঃপ্রকাশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অবতীর্ণ করেছেন। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে নানা প্রকার শির্কের ঘটা দেখা যায় যাকে বহু মুসলিম ইসলাম (বা ধর্ম) বলে মনে করে তা উক্ত কথারই প্রমাণ। আর তা ধর্ম মনে করে বলেই তারা তাকে মন্দ জানে না। অথচ তারা জানে যে, শিকী রীতি ও কর্মকে এবং শির্কের যাবতীয় অসীলা ও উপকরণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব।
প্রধান প্রধান প্রচলিত শির্ক যেমনঃ
১৷ গায়রুল্লাহকে ডাকা (তাদের নিকট কিছু চাওয়া)। এই শির্কের বহিঃপ্রকাশ সাধারণতঃ অধিকাংশ নাত, গজল-গীতি ও কাওয়ালী প্রভৃতিতে ঘটে থাকে; যা নবী (সা.) দিবস, উরস এবং ঐতিহাসিক কোন স্মরণীয় দিবস উপলক্ষে আবৃত্তি করা ও গাওয়া হয়। আমি স্বয়ং ওদেরকে গাইতে শুনেছি,
‘হে রসূলদের ইমাম, হে আমার অবলম্বন!
আপনি আল্লাহর দরজা ও আমার ভরসাস্থল।
আমার ইহকালে ও আমার পরকালে
হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আপনি আমার হাত ধরুন।
আমার কষ্টকে স্বস্তিতে আপনি ব্যতীত
আর কেউ পরিণত করতে পারে না, হে সম্মানের মুকুট!
এ ধরনের স্তুতিবাদ যদি রসূলও শুনতেন তবে নিশ্চয় তিনি এতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। যেহেতু একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কষ্টকে স্বস্তিতে পরিণত করতে (মুশকিল আসান করতে) কেউই পারে না।। তদনুরূপ সেই সমস্ত গজল ও কবিতা যা পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকে লিখা হয়, যাতে রসূল আওলিয়া এবং সালেহীনদের নিকট মদদ, সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করা হয় যা মঞ্জুর করতে তারা সক্ষম নন।
২। আওলিয়া ও সালেহীনদেরকে মসজিদে দাফন (সমাধিস্থ করা। সুতরাং অধিকাংশ মুসলিম দেশে আপনি প্রায় মসজিদে কবর দেখতে পাবেন, যার কিছুর উপরে কুব্বা, গম্বুজ বা মাযারও নির্মিত আছে। কিছু লোক আল্লাহকে ছেড়ে সে সমস্ত কবরের কাছে নিজেদের প্রয়োজন ভিক্ষা করে। অথচ রসূল (সা.) প্লঃ কবরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে অভিসম্পাত করুন; তারা তাদের আম্বিয়াদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম)
অতএব আম্বিয়াগণকে যদি মসজিদে দাফন করা অবিধেয় হয় তাহলে কোন পীর বা আলেমকে তাতে দাফন করা কি করে বৈধ হতে পারে? পরন্তু বিদিত। যে, ঐ সমাধিস্থ ব্যক্তিকে আল্লাহর পরিবর্তে ডাকাও হতে পারে। যা শির্ক সংঘটনের কারণ হয়ে বসবে। অথচ ইসলাম শির্ক এবং তার দিকে পৌছে দেয় এমন সমস্ত উপায়-উপকরণকে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
৩। আওলিয়াদের নামে নযর মানা। কিছু লোক আছে, যারা অমুক অলীর নামে কোন পশু (মুরগী, খাসি বা শিরনী মিঠাই) ইত্যাদির নযর (মানত বা মানসিক) মেনে থাকে। অথচ এইরূপ ন্যর মানা শির্ক, যা পুরণ করা হারাম।। যেহেতু ন্যর মানা এক ইবাদত। যা একমাত্র আল্লাহর জন্য ও উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا
অর্থাৎ, তারা তাদের ন্যর পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে যেদিনের ধ্বংসলীলা হবে ব্যাপক। (সূরা দাহর ৭ আয়াত)
৪। আম্বিয়া ও আওলিয়াদের কবর সমীপে পশু যবেহ করা যদিও নিয়ত আল্লাহর নামে ও উদ্দেশ্যেই যবেহ করা হয়। যেহেতু উক্ত কর্ম মুশরিকদের; যারা তাদের আওলিয়ারূপী মূর্তিসমূহের সন্নিকটে পশু যবেহ (বলিদান) করত।
রসূল ৪ বলেন, “আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেন, যে গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করে।” (মুসলিম)
৫৷ আম্বিয়া এবং আওলিয়া যেমন; জীলানী, রিফায়ী, বদবী, হুসাইন (নিযামুদ্দীন, মুঈনুদ্দীন চিশতী, শাহ জালাল, খান জাহান, দাতা সাহেব) বা
অন্য কারো কবরের তওয়াফ করা। যেহেতু তওয়াফ করা এক ইবাদত। যা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাবা শরীফকে কেন্দ্র করেই করা বিধেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ)। অর্থাৎ, এবং তারা যেন প্রাচীন গৃহের তওয়াফ করে।” (সূরা হজ্জ ২৯ আয়াত)
৬। কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়া। এরূপ অবৈধ। মহানবী (সা.) & বলেন, “তোমরা কবরের উপর বসো না এবং তার প্রতি সম্মুখ করে। নামায পড়ো না।”
৭। কবর দ্বারা বৰ্কত অর্জনের (তাবারুকের) উদ্দেশ্যে অথবা তার নিকট নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সফর (তীর্থযাত্রা) করা। এটাও বৈধ নয়। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের প্রতি সফর করা হবে না; মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ (নববী) এবং মসজিদে আকসা।”
সুতরাং আমরা মদীনা নববিয়্যা যাবার ইচ্ছা করলে বলব, মসজিদে নববীর যিয়ারত ও নবী (সা.) এর প্রতি সালাম পড়তে মদীনা যাব।”
৮। আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান দ্বারা জীবনও রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বিচার-আচার করা। যেমন মানুষের মনগড়া কানুন দ্বারা বিচার করা যা কুরআন কারীম এবং সহীহ সুন্নাহর পরিপন্থী। যদি ঐ সমস্ত কানুন মান্য ও কার্যকর করা বৈধ মনে করে (তবে তা এক প্রকার কুফরী)।
তদনুরূপ সেই সমস্ত ফতোয়া যা কিছু উলামা প্রকাশ করে থাকেন অথচ তা ইসলামের স্পষ্ট উক্তির পরিপন্থী। যেমন (ইচ্ছাকৃত কোন ব্যাখ্যা না থাকা সত্ত্বেও) সুদ হালালের ফতোয়া। অথচ আল্লাহ সুদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
৯। কুরআন অথবা সহীহ সুন্নাহর স্পষ্ট উক্তির পরিপন্থী বিষয়ে শাসক, রাষ্ট্রনেতা উলামা ও বুযুর্গদের আনুগত্য। যাকে ‘শিকুতু-ত্বাআহ’ (আনুগত্যের শির্ক) বলা হয়।* নবী (সা.) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির জন্য আনুগত্য নেই।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
অর্থাৎ, ওরা ওদের পন্ডিতগণকে, সংসারবিরাগীদেরকে এবং মারয়্যাম তনয় মাসীহকেও আল্লাহর পরিবর্তে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ ওরা কেবল একই উপাস্যের উপাসনা করতে আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই। ওদের শির্ক হতে তিনি পবিত্র। (সূরা তাওবাহ ৩১ আয়াত)।
উক্ত আয়াতে ইবাদত (উপাসনা)র ব্যাখ্যায় হুযাইফাহ (রাঃ) বলেন, “তা হল ইয়াহুদদের উলামারা যা তাদের জন্য হালাল করেছে অথবা হারাম করেছে। তাতে ওদের আনুগত্য করা।