আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ وَمَا مِنَّا إِلاَّ وَلَكِنَّ اللَّهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ»
‘তিয়ারাহ’ তথা পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা শির্ক, পাখি উড়িয়ে লক্ষণ নির্ধারণ করা শির্ক। আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে এ প্রকার ধারণার উদ্রেক হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করার মাধ্যমে তিনি উহাকে মুসলিমের অন্তর থেকে দূর করে দেন। হাদীছটি ইমাম আবু দাউদ এবং তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীছের শেষাংশকে অর্থাৎ কিন্তু আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করার মাধ্যমে তিনি উহাকে মুসলিমের অন্তর থেকে দূর করে দেন’’ -এ অংশকে ইবনে মাসউদের উক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন।
ব্যাখ্যাঃ আর আবু দাউদের বর্ণনায় ‘‘তিয়ারাহ তথা পাখি উড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা শির্ক’’ -এই কথাটি তিনবার এসেছে। এই হাদীছ তিয়ারাহ হারাম হওয়ার একটি সুস্পষ্ট দলীল এবং ইহা শির্কের অন্তর্ভূক্ত। কেননা এতে অন্তরকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য বস্ত্তর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়।
ইবনুল মুফলিহ বলেনঃ তিয়ারাহকে হারাম বলে অকাট্য হুকুম লাগানোই উত্তম। কেননা ইহা শির্ক। সুতরাং পারিভাষিক অর্থে শির্ক কিভাবে মাকরুহ হতে পারে?
وَمَا مِنَّا إِلاَّ আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে এ প্রকার ধারণার উদ্রেক হয়ঃ আবুল কাসেম ইস্পাহানী এবং ইমাম মুনযেরী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছের কিছু বাক্য উহ্য রয়েছে। এখানে উহ্য বাক্যটি এরূপঃ «وَمَا مِنَّا إِلَّا وَقَدْ وَقَعَ فِي قَلْبِهِ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ» আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার অন্তরে উপরোক্ত ধারণা অর্থাৎ কোন না কোন বস্ত্ততে কুলক্ষণ থাকার ধারণা সৃষ্টি হয়না। সকলের মনেই ঐ রকম ধারণার উদয় হয়। কিন্তু আমরা যখন কল্যাণ অর্জন কিংবা অকল্যাণ দূর করার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করবো, তখন একমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের বদৌলতে তা অপসারিত হয়।
ইমাম তিরমিযী হাদীছের শেষাংশকে অর্থাৎ কিন্তু আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করার মাধ্যমে তিনি উহাকে মুসলিমের অন্তর থেকে দূর করে দেন- এ অংশকে ইবনে মাসউদের উক্তি বলে চিহ্নিত করেছেনঃ আর এটিই সঠিক। কেননা তিয়ারাহ এক প্রকার শির্ক।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন,
«مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ»
‘‘কুলক্ষণের ধারণা যাকে প্রয়োজন পুরণে বের হতে বাধা দিল সে শির্ক করল। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেনঃ এর কাফ্ফারা কী? উত্তরে তিনি বললেনঃ তোমরা এ দুআ পড়বে,
«اللَّهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُك وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُك وَلَا إِلَهَ غَيْرُك»
‘‘হে আল্লাহ! তোমার কল্যাণ ব্যতীত অন্য কোনো কল্যাণ নেই। তোমার অমঙ্গল ছাড়া অন্য কোনো অমঙ্গল নেই।[9] আর তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’।[10]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল এবং ইমাম তাবারানী আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদে রয়েছে যঈফ রাবী আব্দুল্লাহ ইবনে লাহীআ। এ ছাড়া অন্যান্য রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।
হাদীছের রাবী হলেন আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস বিন ওয়ায়েল ছিলেন আস্ সুহামী। তার উপনাম ছিল আবু মুহাম্মাদ। কেউ কেউ বলেছেনঃ তার উপনাম আবু আব্দুর রাহমান। তিনি ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারীদের মধ্যে অন্যতম এবং সাহাবীদের মধ্যে যারা ইসলামের সূচনাতেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের একজন। যে সমস্ত জ্ঞানী সাহাবীর নাম ছিল আব্দুল্লাহ তিনি তাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বিশুদ্ধ মতে যুল হাজ্জ মাসে হাররার[11] রাত্রিসমূহের কোনো এক রাতে তিনি তায়েফে মৃত্যু বরণ করেন।
مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ কুলক্ষণের ধারণা যাকে প্রয়োজন পূরণে বাধা দিল সে শির্ক করলঃ কেননা কোনো কিছু দেখে বা শুনে কুলক্ষণ বা অশুভ অথবা অকল্যাণ হবে মনে করাকে ‘তিয়ারা’ বলা হয়। তিয়ারা যখন কাউকে সফর হতে অথবা অন্য কোনো কাজ হতে কিংবা কোন প্রয়োজন পূরণ করার জন্য বের হতে বাধা দিবে, তখন সে শির্কে লিপ্ত হবে। কেননা এর মাধ্যমে তার অন্তরে ভয় লেগে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দ্বারা এমনটি হতে পারে এ রকম ভাব অন্তরে উদয় হয় এবং ভয় সৃষ্টি হয়। এ দৃষ্টি কোন থেকে সে ভয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শির্ক করে।
সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, এর কাফফারা কী? তিনি বললেনঃ তোমরা এ দুআ পাঠ করবে,
«اللَّهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُك وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُك وَلَا إِلَهَ غَيْرُك»
‘‘হে আল্লাহ! তোমার মঙ্গল ব্যতীত অন্য কোনো মঙ্গল নেই। তোমার অমঙ্গল ছাড়া অন্য কোনো অমঙ্গল নেই। আর তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’
এখানে বান্দার সকল বিষয়কে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহই সকল বিষয় নির্ধারণ করেন, তিনিই সকল বস্ত্ত পরিচালনা করেন এবং তিনিই সকল বস্ত্তর একমাত্র স্রষ্টা। সেই সঙ্গে এখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা করা হয়েছে। সে যত বড়ই হোক না কেন।
وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ ‘‘এবং তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’। তুমি ছাড়া এবাদতের হকদার অন্য কেউ নেই। বান্দা যখন এ ঘোষণা দিবে এবং তার অন্তরে প্রবেশকারী কুলক্ষণের ধারণার দিকে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ করবেনা এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে ও তাঁর কাছে ফলাফলের বিষয়টি সোপর্দ করে দিয়ে দৃঢ় ইচ্ছার সাথে স্বীয় ইচ্ছা ও কর্ম বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হবে, তখন আল্লাহ তাআলা সেই বান্দার অন্তরে কুলক্ষণের ধারণা প্রসূত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) ফযল বিন আববাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, طيرة হচ্ছে এমন অশুভ ধারণা, যা তোমাকে কোনো কাজের দিকে ধাবিত করে অথবা কোনো কাজ থেকে তোমাকে বিরত রাখে’’।
ব্যাখ্যাঃ মুসনাদে আহমাদে এ হাদীছটি ফযল বিন আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। ফযল বিন আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ
«خَرَجْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْماً فَبَرِحَ ظَبْىٌ فَمَالَ فِى شِقِّهِ فَاحْتَضَنْتُهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَطَيَّرْتَ قَالَ إِنَّمَا الطِّيَرَةُ مَا أَمْضَاكَ أَوْ رَدَّكَ»
একদা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বের হলাম। তখন একটি হরিণ স্থান ত্যাগ করল। অতঃপর সেটি ফিরে আসল। আমি হরিণটিকে আশ্রয় দিলাম এবং বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি কুলক্ষণ মনে করছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ কুলক্ষণ হচ্ছে, যা তোমাকে কোনো কাজ করতে উৎসাহ দেয় অথবা কাজ করা হতে বিরত রাখে।[12]
হাদীছের রাবী হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই ফযল বিন আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। ইবনু মাঈন বলেনঃ ইয়ারমুকের যুদ্ধে ফযল শাহাদাত বরণ করেন। অন্যরা বলেনঃ তিনি হিজরী ১৩ সালে ‘মারজুস সুফুর’-এর যুদ্ধে নিহত হন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২২ বছর। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ তিনি দামেস্কে নিহত হন। তখন তাঁর শরীরে ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধের পোষাক।[13]
إِنَّمَا الطِّيَرَةُ مَا أَمْضَاكَ أَوْ رَدَّكَ কুলক্ষণ হচ্ছে, যা তোমাকে কোন কাজ করতে উৎসাহ দেয় অথবা কাজ হতে বিরত রাখেঃ এটিই হচ্ছে নিষিদ্ধ তিয়ারার পরিচয়। মানুষ যে কাজের ইচ্ছা করে, এটি তা বাস্তবায়নের জন্য ধাবিত ও পরিচালিত করে অথবা তাকে কাজ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু যে ফাল বা ভালো নাম শুনে ভালো কিছু কামনা করাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করতেন, তাতে এক প্রকার সুসংবাদ থাকে। এতে মানুষ খুশী হয়। কিন্তু তার উপর ভরসা করে বসে থাকা ঠিক নয়। তিয়ারার সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং বদ কুলক্ষণ ও শুভ লক্ষণের মধ্যকার পার্থক্য ভালোভাবে বুঝা উচিৎ। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) ألا إنما طائرهم عند الله ‘‘জেনে রেখো তাদের অমঙ্গল আল্লাহর কাছেই’’ এবংطائركم معكم ‘‘তোমাদের অমঙ্গল তোমাদের সাথেই’’ এ আয়াত দু’টির ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
২) একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে রোগ স্থানান্তর হয়, -এই ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
৩) তিয়ারা তথা কোনো বস্ত্ততে কুলক্ষণ থাকার ধারণাকেও অস্বীকার করা হয়েছে।
৪) হুতুঁম পেঁচা বা অন্যান্য পাখির ডাকেও কুলক্ষণ নেই।
৫) সফর মাসেও কোনো অশুভ নেই। অর্থাৎ কুলক্ষণের ‘সফর মাস’ বলতে কিছুই নেই। জাহেলী যুগে সফর মাসকে কুলক্ষণ মনে করা হত, ইসলাম এ ধারণাকে বাতিল করেছে।
৬) ‘ফাল’ উপরোক্ত নিষিদ্ধ বা অপছন্দনীয় জিনিষের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং এটা মুস্তাহাব।
৭) ‘ফাল’এর ব্যাখ্যা জানা গেল। অর্থাৎ ভালো ও সুন্দর নাম শুনে খুশী হওয়া।
৮) অন্তরে কুলক্ষণের ধারণা জাগ্রত হলেই তা ক্ষতিকর নয়। বিশেষ করে যখন বান্দা তাকে অপছন্দ করবে। শুধু তাই নয়; আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি অন্তর থেকে তা দূর করে দেন।
৯) যার অন্তরে কুলক্ষণের ধারণা সৃষ্টি হবে, সে কী বলবে- এই অধ্যায় থেকে তাও জানা গেল।
১০) সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, তিয়ারা শির্কের অন্তর্ভূক্ত।
১১) নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয় তিয়ারার ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ কুলক্ষণ মনে করে কাজে অগ্রসর না হওয়া অথবা কোনো বস্ত্তকে শুভ লক্ষণ মনে করে কাজে অগ্রসর হওয়া নিষিদ্ধ তিয়ারার অন্তর্ভূক্ত।
[10] - মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ হাদীছ নং- ১০৬৫।
[11] - হাররার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। ৬৩ হিজরীতে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার সেনাপতি মুসলিম বিন উকবাহ মদীনা আক্রমণ করে এবং তিন দিন পর্যন্ত মদীনায় হত্যাযঙ্ঘ চালায়। এতে অনেক সাহাবী প্রাণ হারান। এই ঘটনাকে ইসলামের ইতিহাসে হাররার ঘটনা বলা হয়।
[12] - মুসনাদে আহমাদ। তবে এই হাদীছের সনদে দুর্বলতা রয়েছে। দেখুনঃ কুররাতুল উয়ূন, পৃষ্ঠা নং- ২৫৯।
[13] - ফযল বিন আববাসের মৃত্যুর তারিখ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। উপরোক্ত মতামত ছাড়াও আরও যে সমস্ত মত পাওয়া যায়, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, তিনি আবু বকর (রাঃ)এর খেলাফতকালে ১১ হিজরীতে ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেনঃ তিনি উমার(রাঃ)এর শাসনামলে ১৮ হিজরীতে আমওয়াসের মহামারিতে মৃত্যু বরণ করেন। (আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন)