ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের পূর্বে যা বলেছেন, তা হচ্ছে,
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ
‘‘হে নবী! বলোঃ আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহবান কর। তারা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অণু পরিমাণ বস্ত্তরও মালিক নয়। এতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ্র সহায়কও নয়’’। (সূরা সাবাঃ ২২)
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ এখানে যাদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর করার কথা বলা হয়েছে, তারা হলেন ফেরেশতা। মুফাস্সিরগণ বলেনঃ অহীর মাধ্যমে যখন তারা আল্লাহর কালাম শুনতে পায়, তখন তাদের অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়।
ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ এটি সত্য কথা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ অনেক সহীহ হাদীছ ও আছার দ্বারা এটিই প্রমাণিত।
আবু হাইয়্যান বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলার বাণীঃ حَتَّى إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِم‘‘যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়’’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ফেরেশতা। ফেরেশতাগণ যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে জিবরীলের উপর অহী নাযিলের আওয়াজ শুনেন এবং এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কোনো আদেশ করেন, তখন শক্ত পাথরের উপর দিয়ে লোহার শিকল টেনে নিলে যে ধরণের আওয়াজ হয়, ঠিক সে রকম আওয়াজ হতে থাকে। এ সময় তারা সম্মান প্রদর্শনের জন্য ঘাবড়িয়ে যায়।
আবু হাইয়্যান আরও বলেনঃ পূর্বের আলোচনা অনুযায়ী এখানে ফেরেশতা উদ্দেশ্য হলে পূর্বের তথা ২২ নং ও ২৩ নং আয়াতের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। আর যারা বলে আল্লাহর বাণীঃقُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ ‘‘বলো, আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহবান করো’’-এর মধ্যে ফেরেশতাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি, তাদের কথা অনুপাতে ২৩ নং আয়াতের সাথে ২২নং আয়াতের মিল থাকেনা।
এ আয়াত চারভাবে শির্কের মূলোৎপাটন করেছেঃ
১) ফেরেশতারা আল্লাহর মুকাবেলায় একটি সরিষা দানারও মালিক নয়। সুতরাং যে আসমান-যমীনের কোন কিছুরই মালিক নয়, সে কারো উপকার ও অপকার করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ তাআলাই তাদের একমাত্র কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, তিনি একাই সকল সৃষ্টির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করেন।
২) ‘‘এতে তাদের কোনো অংশও নেই’’। অর্থাৎ আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে তাদের কোনো অংশ নেই। বরং আসমান-যমীন সৃষ্টিতে তাদের একটি সরিষা দানা পরিমাণ অংশও নেই।
৩) ‘‘এবং তাদের কেউ আল্লাহ্র সহায়কও নয়’’। অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্য হতে আল্লাহর কোন সাহায্যকারী নেই। বরং আল্লাহই তাদের কল্যাণকর বিষয়ে মদদ করেন এবং তাদের থেকে ক্ষতিকর বিষয় বিদূরীত করেন। তিনি মাখলুক থেকে সম্পূর্ণ অমূখাপেক্ষী। মানুষেরা তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার ছোট-বড় সকল কাজে তাদের প্রভুর মূখাপেক্ষী।
৪) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ ‘‘যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, সে ব্যতীত আল্লাহ্র কাছে অন্য কারো সুপারিশ ফলপ্রসু হয়না। জানা গেল যে, বিনা অনুমতিতে আল্লাহর নিকট কেউ সুপারিশ করবেনা। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ‘‘তার অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবেনা’’। সুতরাং আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন, কেউ যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী হিসাবে গ্রহণ করে, তাহলে সে সুপারিশকারীদের শাফাআত পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘আর তারা এবাদত করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা না তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে, না উপকার করতে পারে। তারা বলে, এরা তো আল্লাহ্র কাছে আমাদের সুপারিশকারী। তুমি বলো, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছো, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনে? তিনি পবিত্র ও মহান সেসব বিষয় থেকে, যেগুলোকে তোমরা তার শরীক সাব্যস্ত করছো’’। (সূরা ইউনূসঃ ১৮) সুতরাং জানা গেল যে, সুপারিশকারী গ্রহণ করা শির্ক। যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী মনে করে, তাদের ব্যাপারে তিনি বলেনঃ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ ‘‘তিনি তাদের শির্কী আমল থেকে পবিত্র’’। মুশরিকদের জন্য কোনো শাফাআতকারী থাকবেনা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ
‘‘অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের উপকারে আসবেনা’’। (সূরা মুদ্দাছছিরঃ ৪৮) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ وَمَا نَرَى مَعَكُمْ شُفَعَاءَكُمُ الَّذِينَ زَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيكُمْ شُرَكَاءُ لَقَدْ تَقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَا كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ
‘‘তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছো, যেমন আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদেরকে দেখছিনা, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, এরা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। অবশ্যই তোমাদের পরষ্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে’’। (সূরা আনআমঃ ৯৪) কেউ যদি নিজের জন্য কোন শাফাআতকারী গ্রহণ করে, সে অবশ্যই সুপারিশকারীর কাছে প্রয়োজন পূরণের আকাঙ্খা করে, তার কাছে দুআ করে, তার কাছে আশা-ভরসা করে, তাকে ভয় করে ও ভালবাসে। সে তার কাছে যা কামনা করে, তা পাওয়ার জন্যই উপরোক্ত কাজগুলো করে থাকে। এবাদতের উপরোক্ত প্রকারগুলো থেকে কোন কিছুই আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য পেশ করা জায়েয নয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য এবাদত করা হচ্ছে শির্ক এবং ইখলাসের পরিপন্থী।
সহীহ্ বুখারীতে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«إِذَا قَضَى اللَّهُ الأَمْرَ فِى السَّمَاءِ ضَرَبَتِ الْمَلاَئِكَةُ بِأَجْنِحَتِهَا خُضْعَانًا لِقَوْلِهِ كَأَنَّهُ سِلْسِلَةٌ عَلَى صَفْوَانٍ فَإِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا لِلَّذِى قَالَ الْحَقَّ وَهُوَ الْعَلِىُّ الْكَبِيرُ فَيَسْمَعُهَا مُسْتَرِقُ السَّمْعِ وَمُسْتَرِقُ السَّمْعِ هَكَذَا بَعْضُهُ فَوْقَ بَعْضٍ وَوَصَفَ سُفْيَانُ بِكَفِّهِ فَحَرَفَهَا وَبَدَّدَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ فَيَسْمَعُ الْكَلِمَةَ فَيُلْقِيهَا إِلَى مَنْ تَحْتَهُ ثُمَّ يُلْقِيهَا الآخَرُ إِلَى مَنْ تَحْتَهُ حَتَّى يُلْقِيَهَا عَلَى لِسَانِ السَّاحِرِ أَوِ الْكَاهِنِ فَرُبَّمَا أَدْرَكَ الشِّهَابُ قَبْلَ أَنْ يُلْقِيَهَا وَرُبَّمَا أَلْقَاهَا قَبْلَ أَنْ يُدْرِكَهُ فَيَكْذِبُ مَعَهَا مِائَةَ كَذْبَةٍ فَيُقَالُ أَلَيْسَ قَدْ قَالَ لَنَا يَوْمَ كَذَا وَكَذَا كَذَا وَكَذَا فَيُصَدَّقُ بِتِلْكَ الْكَلِمَةِ الَّتِى سَمِعَ مِنَ السَّمَاءِ»
‘‘আল্লাহ তাআলা যখন আকাশে কোনো বিষয়ের ফয়সালা করেন, তখন তাঁর কথার সমর্থনে বিনীত হয়ে ফেরেশতারা তাদের ডানাগুলো নাড়াতে থাকে। ডানা নাড়ানোর আওয়াজ যেন ঠিক পাথরের উপর শিকল পতিত হওয়ার আওয়াজের মতই। তাদের অবস্থা এভাবেই চলতে থাকে। যখন তাদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যায়, তখন তারা বলে, তোমাদের রব কী বলেছেন? তারা জবাবে বলে, আল্লাহ হক কথাই বলেছেন। বস্ত্ততঃ তিনিই হচ্ছেন মহান ও শ্রেষ্ঠ। এমতাবস্থায় চুরি করে কথা শ্রবণকারীরা উক্ত কথা শুনে ফেলে। আর এসব চোর এভাবে উপর নিচ হয়ে অবস্থান করতে থাকে। এ হাদীছের বর্ণনাকারী সুফিয়ান বিন উয়াইনা চুরি করে কথা শ্রবণকারীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে হাতের তালু দ্বারা এর ধরণ বর্ণনা করেছেন এবং হাতের আঙ্গুলসমূহ ফাঁক করে তাদের অবস্থা বুঝিয়েছেন। অতঃপর চুপিসারে শ্রবণকারী কথাগুলো তার নিচের চোরের কাছে পৌঁছে দেয়। অতঃপর সে তার নিচের চোরের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত এ কথা যমীনের একজন যাদুকর কিংবা গণকের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়। কোন কোন সময় গণক বা যাদুকরের কাছে উক্ত কথা আসার পূর্বেই শ্রবণকারীর উপর অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হয়। আবার কোন কোন সময় অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই কথাটি দুনিয়াতে পৌঁছে যায়। ঐ সত্য কথাটির সাথে একশত মিথ্যা যোগ করে। অতঃপর শত মিথ্যার সাথে মিশ্রিত সত্য কথাটি যখন সত্য হয় তখন বলা হয়, অমুক দিন কি গণক তোমাদেরকে এই কথা বলেন নি? মূলতঃ আকাশে শ্রুত একটি সত্য কথার কারণেই গণকের একশ মিথ্যা কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়।[1]
ব্যাখ্যাঃ এ হাদীছ থেকে জানা গেল, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হবে, সে সম্মান ও ভয়ভীতিসহ আল্লাহর সামনে অবনত হবে। বিশেষ করে যখন সে আল্লাহর কালাম শুনতে পাবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীঃ আল্লাহ তাআলা আকাশে কোনো বিষয়ের ফয়সালা করেন। অর্থাৎ স্বীয় কালাম এবং জিবরীলের নিকট প্রেরিত অহীর মাধ্যমে যখন কোন ফয়সালা করেন। وفي السماء (আকাশে), -এই কথাটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা উপরে। এই হাদীছ দ্বারা আরো প্রমাণ হল যে, আল্লাহ তাআলার কালাম রয়েছে অর্থাৎ তিনি কথা বলেন এবং তিনি সকল সৃষ্টির উপরে। তবে তাঁর শান ও বড়ত্বের জন্য যেমন কালাম ও উপরে হওয়া শোভা পায়, তিনি সেভাবেই এসব গুণাবলীতে গুণান্বিত। এর পদ্ধতি কারও জানা নেই। সৃষ্টির সাথে কোন উপমা না দিয়েই আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করতে হবে এবং কোন সিফাতকে বাতিল না করেই সৃষ্টির সিফাত থেকে আল্লাহকে পবিত্র সাব্যস্ত করতে হবে।
خُضْعَانًا لِقَوْلِهِ তাঁর কথার সমর্থনে বিনীত হয়ে ফেরেশতারা তাদের ডানাগুলো নাড়াতে থাকেঃ এ হাদীছ এবং অনুরূপ অন্যান্য হাদীছ দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমগণ জাহমীয়া, আশায়েরা, কুল্লাবীয়া এবং অন্যান্য যেসব বিদআতী সম্প্রদায় আল্লাহর অতিসুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলীকে অস্বীকার ও বাতিল করে তাদের প্রতিবাদ করেছেন।
এ হাদীছ থেকে আরো প্রমাণিত হলো যে, সকল ফেরেশতাই আল্লাহ তাআলার কালাম শুনেছিল। আল্লাহ তাআলার কালামের আওয়াজও ছিল।
فَيَسْمَعُهَا مُسْتَرِقُ السَّمْعِ চুরি করে কথা শ্রবণকারীরা উক্ত কথা শুনে ফেলেঃ অর্থাৎ ফেরেশতাগণ যেই কথাটি শুনে এবং তারা পরস্পর আলোচনা করে, শয়তানেরা চুরি করে সে কথা থেকে কিছু শুনে ফেলে। যে কথাটি শুনে সে তার নিচের চোরের কাছে কথাটি পৌঁছিয়ে দেয়। অতঃপর নিচের চোর পরবর্তী চোরের কাছে পাচার করে। এভাবে শেষ পর্যন্ত কথাটি দুনিয়ার কোন গণক অথবা যাদুকরের নিকট চলে আসে। আর এ দুষ্টরা আকাশ থেকে শ্রুত কথাটির সাথে আরো একশ মিথ্যা যোগ করে। মানুষের কাছে যখন সত্য কথাটির সাথে মিলিয়ে একশটি মিথ্যা কথা বলা হয় এবং শত মিথ্যার মধ্য হতে আকাশ থেকে শ্রুত একটি কথা সত্যে পরিণত হয়, তখন লোকেরা সবগুলোকেই বিশ্বাস করে। কারণ লোকদের মধ্যে বাতিল ও মিথ্যা সহজেই গ্রহণ করে নেওয়ার যথেষ্ট প্রবণতা রয়েছে।
নাওয়াস বিন সামআন রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
(إِذَا أَرَادَ اللَّه تعالى أَنْ يُوحِي بِأَمْرِهِ تَكَلَّمَ بِالْوَحْيِ وَإِذَا تَكَلَّمَ بِالْوَحْيِ أَخَذَتْ السَّمَاوَات رَجْفَة أَوْ قَالَ رَعْدَة شَدِيدَة خَوْفًا مِنْ اللَّه عَزَّ وَجَلَّ فَإِذَا سَمِعَ بِذَلِكَ أَهْل السَّمَاوَات صُعِقُوا وَخَرُّوا لِلَّهِ سُجَّدًا فَيَكُون أَوَّل مَنْ يَرْفَع رَأْسه جِبْرِيل فَيُكَلِّمهُ اللَّه مِنْ وَحْيه بِمَا أَرَادَ ثم يمر جِبْرِيل عَلَى الْمَلَائِكَة كُلَّمَا مَرَّ بِسَمَاءٍ سَأَلَهُ مَلَائِكَتهَا مَاذَا قَالَ رَبّنَا يَا جِبْرِيل فَيَقُول جِبْرِيل قَالَ الْحَقّ وَهُوَ الْعَلِيّ الْكَبِير قَالَ فَيَقُولُونَ كُلّهمْ مِثْل مَا قَالَ جِبْرِيل فَيَنْتَهِي جِبْرِيل بِالْوَحْيِ إلى حَيْثُ أَمَرَهُ اللَّه سُبْحَانه)
‘‘আল্লাহ তাআলা যখন কোন বিষয়ে অহী করতে চান এবং অহীর মাধ্যমে যখন কথা বলেন তখন আল্লাহ রাববুল ইজ্জতের ভয়ে সমস্ত আকাশ মন্ডলী কেঁপে উঠে অথবা বিকট আওয়াজ হয়। আকাশের ফেরেশতাগণ এ বিকট আওয়াজ শুনে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায় এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে সর্ব প্রথম জিবরীল মাথা উঠান। তারপর আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা করেন অহীর মাধ্যমে জিবরীলের সাথে সে ব্যাপারে কথা বলেন। এরপর জিবরীল অন্যান্য ফেরেশতাদের পাশ দিয়ে যেতে থাকেন। জিবরীল যতবারই কোনো আকাশ অতিক্রম করেন ততবারই উক্ত আকাশের ফেরেশতারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, ‘হে জিবরীল! আমাদের রব কি বলেছেন? জিবরীল উত্তরে বলেন, আল্লাহ হক কথাই বলেছেন, তিনিই সুউচ্চ ও সুমহান। এ কথা শুনে তারা সবাই জিবরীল যা বলেছেন, তাই বলে। তারপর আল্লাহ তাআলা জিবরীলকে যেখানে অহী নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি সেখানে চলে যান’’।[2]
ব্যাখ্যাঃ ইবনে আবী হাতিম স্বীয় সনদে নাওয়াস বিন সামআন থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। নাওয়াস বিন সামআন বিন খালেদ আলকুল্লাবী একজন আনসারী সাহাবী ছিলেন। বলা হয় যে, তার পিতাও সাহাবী ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ إِذَا أَرَادَ اللَّه تعالى আল্লাহ তাআলা যখন ইচ্ছা করেনঃ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে ইরাদা বা ইচ্ছা করা আল্লাহ তাআলার অন্যতম একটি সিফাত। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা দুই প্রকার। (১) ইরাদায়ে শরঈয়াহ তথা শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও হুকুম-আহকাম সম্পর্কিত ইচ্ছা ও (২) ইরাদায়ে কাদরীয়া তথা সৃষ্টি, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত ইচ্ছা। ইরাদায়ে কাদরীয়ার কতিপয় উদাহরণ হচ্ছে যেমন আল্লাহ তাআলার বাণীঃ
وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا
‘‘আমি যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার বিত্তশালী লোকদেরকে নির্দেশ দিয়ে থাকি। অতঃপর তারা পাপাচারে মেতে উঠে। তখন সে জনগোষ্ঠির উপর আমার আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তাকে ধ্বংস করে দেই’’।[3] (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
فَأَرَادَ رَبُّكَ أَنْ يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا
‘‘সুতরাং তোমার প্রতিপালক দয়াবশতঃ ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পন করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক’’। (সূরা কাহাফঃ ৮২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
‘‘তিনি যখন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেন, তখন কেবল বলেনঃ ‘হও’ তখনই তা হয়ে যায়’’।[4] (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২)
আল্লাহ তাআলা অহীর মাধ্যমে কথা বলেনঃ এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে জানা গেল যে, আল্লাহ তাআলা কথা বলেন। তিনি জিবরীল (আঃ)এর সাথে কথা বলেন। এতে আশায়েরা সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতিবাদ রয়েছে। তারা বলেন কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যা। তা সরাসরি আল্লাহর কালাম নয়।[5]
আল্লাহ রাববুল ইজ্জতের ভয়ে সমস্ত আকাশ মন্ডলী কেঁপে উঠে অথবা বিকট আওয়াজ করেঃ এ থেকে আল্লাহর বড়ত্বের পরিচয় পাওয়া গেল। সুতরাং বান্দার উপর আবশ্যক হচ্ছে, সে আল্লাহ তাআলাকে যথাযথ ভয় করবে। এতে আল্লাহ তাআলা উপরে সমুন্নত হওয়ার কথাও সাব্যস্ত হল।
আকাশবাসী ফেরেস্তাগণ এ বিকট আওয়াজ শুনে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায় এবং সেজদায় লুটিয়ে পড়েঃ আল্লাহ তাআলার কালাম শ্রবণ করে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এবং তাঁর ভয়েই তারা এ রকম করে থাকে।
এ অবস্থা থেকে সর্ব প্রথম জিবরীল মাথা উঠানঃ কেননা তিনি হচ্ছেন অহী বা আল্লাহর বার্তাবাহক ফেরেশতা।
জিবরীল যতবারই কোন আকাশ অতিক্রম করেন, ততবারই উক্ত আকাশের ফেরেশতারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেঃ এটিও আল্লাহ তাআলা উপরে সমুন্নত হওয়ার অন্যতম একটি দলীল।[6]
আকাশের ফেরেশতারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, হে জিবরীল! আমাদের রব কী বলেছেন? জিবরীল বলেন, আল্লাহ হক কথাই বলেছেনঃ হাদীছের এই অংশ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা কথা বলেছেন এবং তিনি সবসময় কথা বলার গুণে গুণান্বিত।
কিন্তু জাহমীয়া সম্প্রদায় এবং আশায়েরাসহ অন্যান্য যে সমস্ত বিদআতী জাহমীয়াদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে, কুরআন ও সহীহ হাদীছে বর্ণিত আল্লাহর সিফাতগুলো অস্বীকার করেছে। তারা সৃষ্টির উপর আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়ার সিফাত এবং কালাম বা আল্লাহর কথা বলার গুণটিকেও অস্বীকার করেছে। এ ছাড়া আল্লাহর আরো যে সমস্ত পূর্ণতার গুণাবলী আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহীহ সুন্নাতে যে সমস্ত গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন এবং যেগুলোকে সাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের পরবর্তী যুগের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমগণ সাব্যস্ত করেছেন, তাও তারা অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তাআলার শান ও বড়ত্বের জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এ সমস্ত সিফাত তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সাব্যস্ত হবে। বিদআতীরা নিজেদের পক্ষ হতে এমন কিছু বানোয়াট সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আল্লাহর সিফাতগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেন নি। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) সুরা সাবার ২৩ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।
২) সূরা সাবার ২৩ নং আয়াতে এমন অকাট্য দলীল রয়েছে, যা সকল প্রকার শির্ককে বাতিল করে দেয়। বিশেষ করে সৎ লোকদেরকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত শির্ক সংঘটিত হয়ে থাকে, এখানে সেসব শির্ককে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এটি সেই আয়াত, যাকে অন্তর থেকে শির্ক বৃক্ষের ‘শিকড় কর্তনকারী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
৩) আল্লাহ তাআলার বাণীঃ قَالُوا الْحَقَّ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ -এর তাফসীরও জানা গেল।
৪) হক সম্পর্কে ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসার কারণ।
৫) ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসার পর জিবরীল তাদের জবাব প্রদান করেন। তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এই এই কথা বলেছেন।
৬) সিজদারত অবস্থা থেকে সর্বপ্রথম জিবরীলই মাথা উঠান।
৭) সমস্ত আকাশবাসীর উদ্দেশ্যে জিবরীলই কথা বলেন। কারণ তাঁর কাছেই তারা কথা জিজ্ঞাসা করে।
৮) আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হওয়ার শব্দ শুনে সকল আকাশবাসীই বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
৯) আল্লাহর কালামের প্রভাবে সমস্ত আকাশ প্রকম্পিত হওয়া।
১০) জিবরীলকে আল্লাহ তাআলা যেখানে বা যার নিকট অহী নিয়ে যাওয়ার আদেশ করেন, তিনি সেখানেই নিয়ে যান।
১১) শয়তানেরা চুরি করে আকাশের কথা শ্রবণ করার বিষয় উল্লেখিত হয়েছে।
১২) শয়তানদের একজন অন্যজনের উপর আরোহন করার ধরণ জানা গেল।
১৩) শয়তানদের উপর অগ্নিশিখা নিক্ষেপিত হয়।
১৪) কখনো কখনো আকাশের কথা যমীন পর্যন্ত নিয়ে আসার আগেই অগ্নিশিখা শয়তানকে জ্বালিয়ে দেয়। আবার কখনও অগ্নিশিখা তাকে ধরে ফেলার পূর্বেই সে মানুষকে আকাশের কথা শুনাতে সক্ষম হয়ে যায়।
১৫) কখনো কখনো গণকের কথা সত্য হয়।
১৬) গণক একটি কথা ঠিক বললেও তার সাথে একশটি মিথ্যা কথা যোগ করে।
১৭) আকাশ থেকে একটি শ্রুত কথা সত্য হওয়ার কারণেই গণকের অন্যান্য মিথ্যা কথাকেও সত্য বলে বিশ্বাস করা হয়।
১৮) মনুষ্য প্রবৃত্তি দ্রুত বাতিল ও মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে নেয়। গণকের একটি কথা সত্য হওয়ার কারণে বিনা বিচারে কিভাবে তারা একশটি মিথ্যা কথাকে গ্রহণ করে? সত্যিই ভাবার বিষয়!
১৯) সেই একটি সত্য কথাকে শয়তানদের একজন অন্যজনের কাছ থেকে শিখে নেয় এবং মুখস্থ করে রাখে। এরপর তারা এটির দ্বারা শত মিথ্যাকে সত্য বানানোর চেষ্টা করে।
২০) এ অধ্যায় থেকে আল্লাহর সিফাত তথা গুণাবলী থাকার কথা জানা গেল। আশআরী সম্প্রদায় আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার বিরোধী।
২১) আল্লাহর ভয়েই আকাশ কেঁপে উঠে এবং ফেরেশতাগণ অচেতন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
২২) ফেরেশতারাও আল্লাহর সামনে সেজদাবনত হয়।
[2] - একদল মুহাদ্দিছ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে ইবনে খুযায়মা, ইবনে আবী আসেম, তাবারী এবং বায়হাকী অন্যতম। তবে মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ যিলালুল জান্নাত, (১/২৬৭)।
[3]- এই আয়াতে 'নির্দেশ' মানে প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত নির্দেশ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে সবসময় এমনটিই হয়ে থাকে। যখন কোন জাতির ধ্বংস হবার সময় এসে যায়, তার সমৃদ্ধিশালী লোকেরা ফাসেক হয়ে যায়। আর ধ্বংস করার সংকল্প মানে এ নয় যে আল্লাহ এমনিতেই বিনা কারণে কোন নিরপরাধ জনবসতি ধ্বংস করার সংকল্প করেন, বরং এর মানে হচ্ছে, যখন কোন জনবসতি অসৎকাজের পথে এগিয়ে যেতে থাকে এবং আল্লাহ তাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তখন এহেন সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশকে নির্দেশ দ্বারা আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যখন কোন জাতির ধ্বংস আসার সময় হয় তখন তার ধনাঢ্য ও ক্ষমতাশালী লোকেরা ফাসেকী ও নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা জুলুম-নির্যাতন ও দুষ্কর্ম-ব্যভিচারে গা ভাসিয়ে দেয়। আর শেষ পর্যন্ত এ বিপর্যয়টি সমগ্র জাতিকে ধবংস করে।
কেউ কেউ বলেছেন, এখানে উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আনুগত্যের আদেশ দেন। কিন্তু তারা আনুগত্য বর্জন করে পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের ধ্বংস অবধারিত হয়ে যায়। আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন।
[4]- ইরাদায়ে কাদরীয়া তথা আল্লাহর যেই ইচ্ছা কোন কিছু সৃষ্টি করার সাথে সম্পৃক্ত, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। ইরাদায়ে কাদরীয়ার অপর নাম ইরাদায়ে কাওনীয়া। এতে আল্লাহর পছন্দ ও ভালবাসার সম্পর্ক নেই। যেমন আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়ার দ্বারা তিনি কুফরী ও পাপাচার সৃষ্টি করেছেন। অথচ তিনি স্বীয় বান্দাদের জন্য এটি পছন্দ করেন না। অপর পক্ষে ইরাদায়ে শরঈয়ার সাথে পছন্দ ও ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর যেই ইচ্ছার দ্বারা শরীয়তের কোন আদেশ করেন, তার সাথে পছন্দ ও ভালবাসার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি যেই কাজকে ভালবাসেন ও পছন্দ করেন, স্বীয় বান্দাকে তাই আদেশ করেন। তবে ইরাদায়ে শরঈয়া কখনো বাস্তবায়িত হয় আবার কখনো তা বাস্তবায়িত হয়না। মুমিনের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়া ও শরঈয়া উভয়ই বাস্তবায়িত হয়েছে। অপর পক্ষে আল্লাহ তাআলা যেখানে কাফেরকে ঈমান আনয়নের আদেশ দিয়েছেন, কিন্তু কাফের ঈমান আনয়ন করেনি, সেখানে আল্লাহর ইরাদায়ে কাওনীয়ার বাস্তবায়ন হয়েছে, শরঈয়া বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও তিনি ঈমানকে পছন্দ করেন এবং কুফরীকে অপছন্দ করেন।
[5]- মূলতঃ কুরআন আল্লাহর কালাম। তিনি কুরআনের মাধ্যমে কথা বলেছেন। জিবরীল (আঃ) তা শুনেছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ)এর সাথেও কথা বলেছেন। সুতরাং আশআরীদের কথা সঠিক নয়।
[6] - জাহমীয়া এবং আরও অনেক বাতিল ফির্কার লোকেরা বলে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা সর্বত্র বিরাজমান। তারা আল্লাহ তাআলা আকাশের উপরে এবং আরশে আযীমে সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে। কুরআনের অনেক আয়াত এবং অনেক সহীহ হাদীছ দ্বারা তাদের এই ভ্রান্ত মতবাদ বাতিল প্রমাণিত হয়। নিম্নে আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে সমুন্নত হওয়ার বেশ কিছু দলীল উল্লেখ করা হল।
কুরআন থেকে কতিপয় দলীলঃ
আল্লাহ্ তাআলা যে আরশের উপর সমুন্নত, এ ব্যাপারে কুরআনের সুস্পষ্ট দলীলগুলো গণনা করে শেষ করা যাবে না। নিম্নে বর্ণিত আল্লাহর সিফাতগুলো এবং এ অর্থে বর্ণিত অন্যান্য সিফাত (গুণাবলী) থেকে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃالرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫) এ অর্থে কুরআন মজীদে মোট সাতটি আয়াত রয়েছে। নিম্নে এই আয়াতগুলো উল্লেখ করা হল।
(১) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘‘দয়াময় আল্লাহ্ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫)
(২) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
‘‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। (সূরা আরাফঃ ৫৪) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
‘‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা ইউনূসঃ ৩) (৩) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
‘‘আল্লাহই ঊর্ধবদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন বিনা স্তম্ভে। তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা রা’দঃ ২)
(৫) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَانُ‘‘অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’’। তিনি পরম দয়াময়। (সূরা ফুরকানঃ ৫৯) (৬) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
‘‘আল্লাহই আসমান-যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল বস্ত্ত ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা সাজদাহঃ ৫৪) (৭) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
هُوَ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
‘‘আল্লাহই আকাশ-যমিনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। (সূরা হাদীদঃ ৪)
এ ছাড়া আরো অনেক দলীল রয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। একই সাথে তিনি আকাশেরও উপরে। যেই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা আকাশের উপরে এখানে সেগুলোও উল্লেখ করা হলঃ
(১) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَأَمِنتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ الأَرْضَ
‘‘তোমরা কি নিরাপত্তা পেয়ে গেছো যে, আকাশে যিনি রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধ্বসিয়ে দিবেন না?। (সূরা মুল্কঃ ১৬)
(২) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ‘‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে’’। (সূরা নাহ্লঃ ৫০)
(৩) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ‘‘তাঁরই দিকে পবিত্র বাক্যসমূহ আরোহণ করে এবং সৎকর্মকে তিনি উপরে উঠান’’। (সূরা ফাতিরঃ ১০)
(৪) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ تَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ ‘‘ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরীল) তাঁর দিকে উর্ধ্বগামী হয়’’। (সূরা মাআরেজঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ يُدَبِّرُ الأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الأَرْضِ ‘‘আল্লাহ্ তাআলা আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সকল বিষয় পরিচালনা করেন’’। (সূরা সিজদাহঃ ৫) (৫) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ ‘‘যখন আল্লাহ বললেনঃ হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দান করব। অতঃপর তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নিবো’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৫) আল্লাহ্ তা’আলা উপরে আছেন- এ মর্মে আরো অনেক দলীল রয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা উপরে সমন্নত হয়েছেন- হাদীছ থেকে এ কথার দলীলঃ
আল্লাহ্ তাআলা উপরে আছেন-হাদীছ শরীফে এ ব্যাপারে অগণিত দলীল রয়েছে।
(১) আওআলের হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(والعرش فوق ذلك والله فوق العرش وَهُوَ يَعْلَمُ مَا أَنتُمْ عَليْهِ)
‘‘তার উপর আল্লাহর আরশ। আর আল্লাহ্ আরশের উপরে। তিনি তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন’’।
আওআলের হাদীছের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) বলেনঃ আমরা একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খোলা ময়দানে বসা ছিলাম। তখন আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটি মেঘখন্ড অতিক্রম করার সময় তিনি বললেনঃ তোমরা কি জান এটি কী? আমরা বললামঃ এটি একটি মেঘের খন্ড। অতঃপর তিনি বললেনঃ তোমরা কি জান আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের দূরত্ব কতটুকু? আমরা বললামঃ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ উভয়ের মধ্যে রয়েছে পাঁচশত বছরের দূরত্ব। এমনি প্রত্যেক আকাশ ও তার পরবর্তী আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশত বছরের পথ। এভাবে সপ্তম আকাশের উপর রয়েছে একটি সাগর। সাগরের গভীরতা হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যবতী দূরত্বের সমান। সাগরের উপরে রয়েছে আটটি জংলী বা পাহাড়ী পাঠা (পাঠার আকৃতিতে ফেরেশতা)। তাদের হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত দূরত্ব আকাশ ও যমীনের মধ্যবতী দূরত্বের সমান। তারা আল্লাহর আরশ পিঠে বহন করে আছে। আরশ এত বিশাল যে, তার উপরের অংশ থেকে নীচের অংশের দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যবতী দূরত্বের সমান। আর আল্লাহ্ তাআলা হচ্ছেন আরশের উপরে। তবে এই হাদীছটি সহীহ ও যঈফ হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।
(২) সা’দ বিন মুআয যখন বনী কুরায়যার ব্যাপারে ফয়সালা দান করলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ তুমি তাদের ব্যাপারে সেই ফয়সালা করেছ, যা সাত আসমানের উপর থেকে আল্লাহ্ তাআলা করেছেন’’।
(৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা জনৈক দাসীকে প্রশ্ন করলেনঃ আল্লাহ্ কোথায়? দাসী বললঃ আকাশে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাসীর মালিককে বললেনঃ তুমি তাকে মুক্ত করে দাও। কারণ সে মু’মিন’’।[6]
(৪) আল্লাহ্ তা’আলা আকাশের উপরে। মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীছগুলো তার সুস্পষ্ট দলীল।
(৫) পালাক্রমে ফেরেশতাদের দুনিয়াতে আগমণের হাদীছেও আল্লাহ্ তা’আলা আকাশের উপরে বিরাজমান হওয়ার দলীল রয়েছে। হাদীছের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ وَصَلَاةِ الْعَصْرِ ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ فَيَسْأَلُهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي فَيَقُولُونَ تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ)
‘‘তোমাদের নিকট রাতে একদল ফেরেশতা এবং দিনে একদল ফেরেশতা পালাক্রমে আগমণ করে থাকে। তারা ফজর ও আসরের নামাযের সময় একসাথে একত্রিত হয়। অতঃপর তোমাদের কাছে যে দলটি ছিল, তারা উপরে উঠে যায়। মহান আল্লাহ জানা সত্ত্বেও তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তাঁরা বলেনঃ আমরা তাদেরকে নামায অবস্থায় ছেড়ে এসেছি এবং যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখনো তারা নামাযেই ছিল।[6] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ
(مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلَا يَصْعَدُ إلَى اللَّهُ إِلَّا الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللَّهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ)
‘‘যে ব্যক্তি বৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ হতে একটি খেজুর পরিমাণ সম্পদ দান করে, আর আল্লাহর নিকট তো পবিত্র ব্যতীত কোন কিছুই উর্ধ্বমুখী হয় না, আল্লাহ্ ঐ দান স্বীয় ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তা দানকারীর জন্য প্রতিপালন করতে থাকেন। যেভাবে তোমাদের কেউ নিজের ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঐ দান পাহাড় সমুতল্য হয়ে যায়’’।[6] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
(إِذَا قَضَى اللَّهُ الأَمْرَ فِي السَّمَاءِ ضَرَبَتِ الْمَلاَئِكَةُ بِأَجْنِحَتِهَا خُضْعَانًا لِقَوْلِهِ كَالسِّلْسِلَةِ عَلَى صَفْوَانٍ)
‘‘আল্লাহ তা’আলা যখন আকাশে কোন বিষয়ে ফয়সালা করেন, তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর উক্ত ফয়সালার প্রতি অনুগত হয়ে তাদের পাখাসমূহ এমনভাবে নাড়াতে থাকেন যার ফলে শক্ত পাথরে শিকল দিয়ে প্রহার করলে যে ধরণের আওয়াজ হয় সে রকম আওয়াজ হতে থাকে’’। আল্লাহ তাআলা যে আকাশের উপরে- জাহমীয়া ফির্কা ব্যতীত অন্য কেউ তা অস্বীকার করেনি।