আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনূসের ১০৬ নং ১০৭ নং আয়াতে বলেনঃ
وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يُرِدْكَ بِخَيْرٍ فَلَا رَادَّ لِفَضْلِهِ يُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
‘‘আল্লাহ ছাড়া এমন মাবুদকে ডেকোনা, যে তোমার উপকার করতে পারবেনা এবং ক্ষতিও করতে পারবেনা। তুমি যদিএমন কর, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোন বিপদে ফেলেন, তাহলে একমাত্র তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আর তিনি যদি তোমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চান, তাহলে কেউ তাঁর অনুগ্রহকে প্রতিহত করতে পারেনা। স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান, তাকেই তিনি স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন; তিনিই ক্ষমাশীল, দয়ালু’’।
ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ الاستغاثة ইস্তেগাছাহ অর্থ হচ্ছে, গাউছ তলব করা। অর্থাৎ বিপদাপদ দূর করার জন্য সাহায্য চাওয়া ও ফরিয়াদ করা। আর الاستعانة ইস্তেআনাহ অর্থ হচ্ছে সাহায্য চাওয়া।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ ইস্তেগাছা এবং দুআর মধ্যে উমুম খুসুস মুতলাকের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ বিপদাপদে পতিত ব্যক্তি যখন ফরিয়াদ করে তখন, তাতে দুআ এবং ইস্তেগাছা উভয়টিই একত্রিত হয়। আর দুআ সাধারণতঃ প্রার্থনা ও চাওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ দুআ বিপদাপদে পতিত ব্যক্তি ছাড়া অন্যের কাছ থেকেও হয়ে থাকে। আর ইস্তেগাছার মধ্যে দুআর যে অর্থ রয়েছে তা শুধু বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যই হয়ে থাকে। সাধারণ দুআ এবং বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্যকে আহবান করতে নিষেধ করা হয়েছে। সামনে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসবে, ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا
‘‘মসজিদসমুহ আল্লাহর এবাদত করার জন্যই। অতএব তোমরা আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকে ডেকোনা’’। যে কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে এমন কিছু প্রার্থনা করবে, যার উপর তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ক্ষমতাবান নয়, যেমন বিপদে পড়ে মৃত ও অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকে আহবান করা। এটি সেই শির্কের অন্তর্ভূক্ত যা আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। কুরআন ও সুন্নায় এ ব্যাপারে অসংখ্য দলীল রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ আল্লাহ ছাড়া এমন মাবুদকে ডেকোনা, যে তোমার উপকার করতে পারবে না এবং ক্ষতিও করতে পারবে নাঃ এ আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ক্ষতি বা উপকারের মালিক নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তুমি যদি এমন কর, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবেঃ এ আয়াতে যুলুম বলতে শির্ক উদ্দেশ্য। লুকমান (আঃ) স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেনঃ
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ
‘‘হে বৎস! আল্লাহ্র সাথে শরীক করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র সাথে শরীক করা মহা যুলুম’’। (সূরা লুকমানঃ ১৩)
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর আল্লাহ যদি তোমাকে বিপদে ফেলেন, তাহলে একমাত্র তিনি ব্যতীত আর কেউ তা থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারবেনাঃ বিপদাপদে পতিত হয়ে ফরিয়াদকারী সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনিই একমাত্র বিপদাপদ দূর করেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা করতে পারেনা।
আর আল্লাহ যদি তোমার কল্যাণ করতে চান, তাহলে তাঁর কল্যাণকে প্রতিহত করার মত কেউ নেইঃ কল্যাণ প্রার্থী ও তা অর্জনে আগ্রহী প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এখানে খবর দিয়েছেন যে, তিনিই কেবল প্রার্থনাকারীদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ যার উপর অনুগ্রহ করেন, কেউ সে অনুগ্রহকে প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখেনা। তিনিই দানকারী এবং তিনিই প্রতিহতকারী। তিনি যা দেন কেউ তা বারণ করতে পারেনা। আর তিনি যা থেকে কাউকে বঞ্চিত করেন, কেউ তাকে তা দিতে পারেনা। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীছে এ বিষয়টিই বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে বলেছেনঃ
وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ
‘‘জেনে রাখ! দুনিয়ার সকল মানুষ মিলেও যদি তোমার উপকার করতে চায়, তথাপিও তারা শুধু তোমার ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে দিয়েছেন। আর যদি তারা মিলিত হয়ে তোমার ক্ষতি করতে চায়, তথাপি তারা শুধু সেই পরিমাণ ক্ষতিই করতে পারবে, যা আল্লাহ তাআলা তোমার উপর লিখে দিয়েছেন’’।[1]
এ অধ্যায়ের শুরুতে উল্লেখিত আয়াতটি এবং এ অর্থে অন্যান্য আয়াত নিয়ে যে ব্যক্তি চিন্তা-গবেষণা করবে, সে জানতে পারবে যে, অধিকাংশ বনী আদম আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দুআ করার যে ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে, তা হচ্ছে বড় যুলুম। এটি হচ্ছে সেই শির্ক, যা আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। কেননা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা এবাদতের ক্ষেত্রে যেই শির্ককে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তারা তাতেই লিপ্ত হয়েছে। আর লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা এবাদতের মধ্যে যে ইখলাসকে সাব্যস্ত করা হয়েছে, তারা তাই প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ
‘‘অতএব তুমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্র এবাদত করো। জেনে রাখো, নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদত একমাত্র আল্লাহ্র জন্যই’’। (সূরা যুমারঃ ৩) এ আয়াতে দ্বীন শব্দটি দ্বারা আল্লাহর আদেশ ও শরীয়তের হুকুম সমূহের আনুগত্য করা এবং নিষেধসমূহ থেকে বিরত থাকা উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা যেসমস্ত আদেশ করেছেন, তার মধ্যে সর্বাধিক বড় হচ্ছে ইখলাস ও এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। আর বান্দা স্বীয় সৎআমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছুই কামনা করবেনা। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ উদ্দেশ্যেই তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন ও কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন। যাতে করে রাসূল পাঠাবার পর লোকদের কাছে আল্লাহর সামনে কিয়ামতের দিন কোন অযুহাত না থাকে।[2]
আল্লাহ যেসমস্ত বস্ত্ত হারাম করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে আল্লাহর রুবুবীয়াত ও উলুহীয়াতে শির্ক করা।
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেনঃ
فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ
‘‘অতএব তোমরা আল্লাহর কাছে রিযিক চাও এবং তাঁরই এবাদত করো’’। (সূরা আনকাবুতঃ ১৭) আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে আল্লাহকে ছাড়া এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবেনা। তারা তো তাদের দুআ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আহকাফঃ ৫-৬)
ব্যাখ্যাঃ এ আয়তটি পূর্বের আয়াতের বিষয়কে ব্যাখ্যা করছে। আল্লাহ তাআলা এখানে সংবাদ দিচ্ছেন যে, ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কেউ নেই, যে আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে আহবান করে। সেই আহূত ব্যক্তি যেই হোক না কেন। আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেনঃ তাঁর পরিবর্তে যাকে আহবান করা হচ্ছে, সে আহবানকারীর কোন প্রয়োজন পূর্ণ করতে সক্ষম নয়। চাই মৃত অলী-আওলীয়া অথবা অনুপস্থিত কোনো ব্যক্তি কিংবা এমন কাউকে আহবান করা হোক, যে আহবানে সাড়া দিতে সক্ষম নয়। যেমন কেউ তাগুত এবং মূর্তিকে আহবান করল। সুতরাং জানা গেল, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে আহবান করবে, তার জন্য নিরাশা ও ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কিছু নেই।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যাদের কাছে তারা ফরিয়াদ করছে, তারা তাদের ফরিয়াদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনূসের ২৮-২৯ নং আয়াতে বলেনঃ
وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشْرَكُوا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَاؤُكُمْ فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ وَقَالَ شُرَكَاؤُهُمْ مَا كُنْتُمْ إِيَّانَا تَعْبُدُونَ فَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِنْ كُنَّا عَنْ عِبَادَتِكُمْ لَغَافِلِينَ
‘‘আর আমি তাদের সবাইকে সমবেত করবো। অতঃপর যারা শির্ক করতো তাদেরকে বলবোঃ তোমরা এবং তোমাদের শরীকরা নিজ নিজ জায়গায় দাড়িয়ে যাও। অতঃপর তাদের পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দেব। তখন তারা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের এবাদত করতেনা। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আমরা তোমাদের এবাদত সম্পর্কে কিছুই জানতাম না’’।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ أَشْرَكُوا شُرَكَاءَهُمْ قَالُوا رَبَّنَا هَؤُلَاءِ شُرَكَاؤُنَا الَّذِينَ كُنَّا نَدْعُوا مِنْ دُونِكَ فَأَلْقَوْا إِلَيْهِمُ الْقَوْلَ إِنَّكُمْ لَكَاذِبُونَ
‘‘আর দুনিয়ায় যারা শির্ক করেছিল তারা যখন নিজেদের তৈরি করা শরীকদেরকে দেখবে তখন বলবে, হে আমাদের রব! এরাই হচ্ছে আমাদের তৈরি করা শরীক, যাদেরকে আমরা তোমাকে বাদ দিয়ে ডাকতাম। এ কথায় তাদের ঐ মাবুদরা তাদের পরিষ্কার জবাব দিয়ে বলবে, তোমরা মিথ্যুক।[3] (সূরা নাহালঃ ৮৬) সুতরাং মুশরিকরা যে উদ্দেশ্যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যান্য মাবুদকে ডাকত, কিয়ামতের দিন তাদের উদ্দেশ্যের বিপরীত ফল পাবে। তারা যাদের এবাদত করত, তারা তাদের থেকে এবং তাদের এবাদত থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা দিবে এবং কঠোর ভাষায় তা অস্বীকার করবে। শুধু তাই নয়; আহূতরা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ‘‘তারা তাদের এবাদতকে অস্বীকার করবে’’-এর দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে দুআ করা আর অন্যের এবাদত করা একই কথা। যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করল, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করল। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দুআ করে, সে চরম গোমরাহীর মধ্যে রয়েছে।
এই প্রকারের শির্ক অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট দুআ করার ফিতনাটি এই উম্মতের পরবর্তী যামানার লোকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা এমন এক বান্দাকে (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবকে) প্রেরণ করলেন, যিনি উম্মতের সামনে শির্কের খোলাসা বিবরণ পেশ করেছেন। অথচ ইতিপূর্বে কতিপয় লোক ব্যতীত সকল মানুষের নিকট শির্কের বিষয়টি অপরিচিত ছিল। যদিও কুরআন ও সুন্নায় এ বিষয়টির বিশদ বিবরণ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের অন্তরসমূহ তা বাদ দিয়ে সর্বদা শয়তানের ফাঁদের দিকে ধাবিত হয়েছে। যেমন হয়েছিল পূর্বের নবী-রাসূলদের সাথে তাদের জাতির লোকদের অবস্থা। নবী-রাসূলগণ যখন তাদের জাতির লোকদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন, তখন তাদের কাওমের লোকেরা চরম শত্রুতা পোষণ করল। আল্লাহ তাআলা কুরআনে এর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেনঃ
كَذَلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ (52) أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ
‘‘এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রাসূল আগমন করেছে, তখন তারা প্রেরিত রাসূলকে যাদুকর না হয় পাগল বলেছে। তারা কি পরস্পর এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্তুত ওরা দুষ্ট সম্প্রদায়’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫২-৫৩) আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতিরের ১৩ ও ১৪ নং আয়াতে অনুরূপ কথাই বলেছেন। তিনি বলেনঃ
وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ (13) إِنْ تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ
‘‘তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা কিতমিরেরও[4] মালিক নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনেনা। শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ক অস্বীকার করবে। বস্তুতঃ আল্লাহ্র ন্যায় তোমাকে কেউ অবহিত করতে পারবেনা’’। (সূরা ফাতিরঃ ১৩-১৪)
এখানে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যকে ডাকা শির্ক। আর যারা তা করা অবস্থায় কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।
সুতরাং হে পাঠক! আপনি এ আয়াত এবং এ অর্থে অন্যান্য আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করুন। সূরা জিনের ১৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا
‘‘আর মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। তাই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকোনা’’।[5] আল্লাহ তাআলা এই সূরার ২০ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
قُلْ إِنَّمَا أَدْعُو رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِهِ أَحَدًا
‘‘বলো, আমি আমার পালনকর্তাকেই ডাকি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না’’।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেনঃ
أَمْ مَنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ أَمْ مَنْ يَهْدِيكُمْ فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَنْ يُرْسِلُ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ أإلَهٌ مَعَ اللَّهِ تَعَالَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘বলো, কে অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন ও তোমাদেরকে পৃথিবীতে পূর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন? সুতরাং আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহন কর। বলো, কে তোমাদেরকে জলে ও স্থলে অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি তাঁর অনুগ্রহের পূর্বে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন? অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ্ তার অনেক উর্ধ্বে’’। (সূরা নামলঃ ৬২)
ব্যাখ্যাঃ আইয়্যামে জাহেলীয়াতের আরব ও অনারব মুশরিকরা এই কথা স্বীকার করত যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ বিপদগ্রস্ত ও অসহায়ের ফরিয়াদ শুনেনা এবং তার ডাকে সাড়াও দেয়না। আল্লাহ তাআলা সূরা আনকাবুতের ৬৫ নং আয়াতে বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহন করে, তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কেই ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে’’। আল্লাহ তাআলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, মক্কার মুশরিকরা জলপথে ভ্রমণের সময় যখন বিপদে পড়ত, তখন আল্লাহর জন্য দ্বীনকে খালেস করে তাঁর নিকট দুআ করত। কিন্তু তিনি যখন তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে স্থলে উঠাতেন, তখন তারা দ্বিতীয়বার শির্কে লিপ্ত হত। মোটকথা মুশরিকদের উপর কোন মসীবত আসলে ইখলাসের সাথে তারা আল্লাহর কাছে দুআ করত। কিন্তু সুখ-শান্তিতে থাকার সময় আল্লাহর সাথে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করত।[6]
ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহর সাথে আরো এমন কোন মাবুদ আছে কি, যিনি এই কাজগুলো করেন এবং তোমাদেরকে এই নেয়ামতগুলো প্রদান করেন? অর্থাৎ তোমরা অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক নির্ধারণ করছ। অথচ তিনি তোমাদেরকে এ সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ দান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। অর্থাৎ তোমাদের নিকট আল্লাহ তাআলার বড়ত্বের বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং তোমাদের উপর তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ থাকার পরও তোমরা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে থাক এবং তোমরা আল্লাহ তাআলার একত্বের দলীলসমূহ থেকে খুব কমই উপকৃত হয়ে থাক। এ জন্যই তোমরা আল্লাহর এবাদতে অন্যকে শরীক করছো।
ইমাম তাবরানী বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এমন এক মুনাফিক ছিল, যে মুমিনদেরকে কষ্ট দিত। তখন সাহাবীদের কেউ কেউ বলতে লাগলেন, চল! আমরা এ মুনাফিকের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আশ্রয় চাই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ
«إنه لا يستغات بي وإنما يستغاث بالله»
‘‘আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা যাবেনা। একমাত্র আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে’’।[7]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম তাবরানীর পূর্ণ পরিচয় হচ্ছে তিনি হলেন হাফেয সুলায়মান বিন আহমাদ বিন আইয়্যুব আল-লাখমী আত্ তাবরানী। তিনি আল মু’জামুল কবীর, আল মু’জামুল আওসাত, আল মুজামুস সগীর এবং আরো অন্যান্য মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইমাম নাসায়ী, ইসহাক বিন ইবরাহীম আদ্ দাবরী এবং আরো অনেক মুহাদ্দিছ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি ৩৬০ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন উবাদাহ বিন সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে।
তখন সাহাবীদের কেউ কেউ বলতে লাগলেন, চলো আমরা এ মুনাফিকের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি....হাদীছের শেষ পর্যন্তঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কষ্ট থেকে সাহাবীদেরকে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখতেন।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু মুনাফিকদের গোত্রে যে সমস্ত মুমিন ছিলেন তাদের দ্বীন থেকে সরে যাওয়ার ভয়ে তিনি এ রকম করেন নি। হাদীছে এ বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং অন্যান্যদেরকে ফিতনার আশঙ্কায় শাস্তি দেয়া বর্জন করেছিলেন।
কেউ কেউ বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদের কষ্ট থেকে সাহাবীদেরকে উদ্বার করতে পারতেন। কিন্তু তাওহীদের হেফাযত করার জন্য এবং শির্কের দরজা বন্ধ করার জন্য তিনি তাঁর কাছে ফরিয়াদ করতে নিষেধ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে তাদের এ ফরিয়াদ ঐ কষ্ট থেকে উদ্ধারের ফরিয়াদের অন্তর্ভূক্ত ছিল, যা থেকে উদ্ধারের ক্ষমতা মাখলুকের রয়েছে। তারপরও তিনি এই আশঙ্কায় উম্মাতকে তা থেকে নিষেধ করেছেন যে, নিষেধ না করলে হয়ত তারা এমনসব বস্ত্তর কাছে ফরিয়াদ শুরু করত, যা কোন কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারেনা এবং কারো কথা শুনেনা এবং শুনলেও জবাব দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা। যেমন মৃত ব্যক্তিগণ, অনুপস্থিত ব্যক্তিগণ, তাগুত, শয়তান, মূর্তি এবং অন্যান্য বস্ত্ত।
পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, এই উম্মতের মধ্যে বড় বড় শির্ক প্রবেশ করেছে। এমন কি লোকেরা আল্লাহ তাআলার রুবুবীয়াত এবং সৃষ্টিজগতের কর্মসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সাথে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করেছে। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহ তাআলার এবাদত ও উলুহীয়াতেও তাঁর সাথে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করেছে। আর এ কথা সকলের জানা যে, হারাম বস্ত্ত অর্জন করার ও হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যম, পথ ও উপায়-উপকরণ অবলম্বন করাও হারাম। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) প্রথমে দুআ উল্লেখ করার পর ইস্তেগাছা উল্লেখ করা عام কে (সাধারণ বস্ত্তকে) خاص এর (নির্দিষ্ট বস্ত্তর) পূর্বে উল্লেখ করার অন্তর্ভূক্ত।
২)وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ‘‘আল্লাহ ছাড়া এমন কাউকে ডেকোনা, যে তোমার কোন উপকার করতে পারবেনা এবং ক্ষতিও করতে পারবেনা’’ -আল্লাহর এ বাণীর তাফসীর জানা গেল।
৩) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে ফরিয়াদ করা বা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ডাকা ‘শির্কে আকবার’।
৪) সবচেয়ে নেককার বান্দাও যদি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ কিংবা ফরিয়াদ করে, তাহলেও সে যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
৫) এর পরবর্তী আয়াত অর্থাৎ وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ এর তাফসীর জানা গেল।
৬( আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা কুফরী কাজ হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়াতে এর কোন উপকারিতা নেই। অর্থাৎ কুফরী কাজে কোন সময় দুনিয়াতে কিছু বৈষয়িক উপকারিতা পাওয়া যায়, কিন্তু গাইরুল্লাহর কাছে দুআ করার মধ্যে দুনিয়ার উপকারও নেই।
৭) ৩য় আয়াত অর্থাৎ فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ -এর তাফসীরও জানা গেল।
৮) আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে রিযিক চাওয়া উচিত নয়। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে জান্নাত চাওয়া উচিৎ নয়।
৯) আরো জানা গেল ৪র্থ আয়াত অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার বাণীঃ, وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ এর তাফসীর।
১০) যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কেউ নেই।
১১) আল্লাহ ব্যতীত যার কাছে দুআ করা হয়, সে দুআকারীর দুআ সম্পর্কে কোন খবরই রাখেনা।
১২) যাকে ডাকা হয় কিংবা যার কাছে দুআ করা হয়, সে দুআকারীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে এবং দুআকারীর জন্য শত্রুতে পরিণত হয়।
১৩) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা তার এবাদত করার নামান্তর।
১৪) যাকে আহবান করা হয় কিংবা যার কাছে দুআ করা হয়, কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি তার জন্য সম্পাদিত এবাদতকে অস্বীকার করবে।
১৫) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা দুআকারীর পথভ্রষ্ট হওয়ার সর্বাধিক বড় কারণ।
১৬) পঞ্চম আয়াত অর্থাৎ أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ এর তাফসীর জানা গেল।
১৭) বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, মূর্তি পূজারীরাও একথা স্বীকার করে যে, বিপদগ্রস্ত, ব্যক্তির ডাকে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাড়া দিতে পারেনা। এ কারণেই তারা যখন কঠিন মসীবতে পতিত হয় তখন ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকেই ডাকে।
১৮) এর মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক তাওহীদের হেফাযত, সংরক্ষণ এবং আল্লাহ তাআলার সাথে আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার বিষয়টি জানা গেল।
[1] - মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫৩০২।
[2] - অর্থাৎ এই সমস্ত রাসূল পাঠাবার একটিই উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো এই যে, আল্লাহ মানব জাতির কাছে নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করার প্রমাণ পেশ করতে চেয়েছেন। এর ফলে শেষ বিচারেরর দিনে কোন পথভ্রষ্ট অপরাধী তাঁর কাছে এই অযুহাত পেশ করতে পারবে না যে, সে জানেনা এবং আল্লাহ যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে তাকে অবহিত করার জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে রাসূল পাঠিয়েছেন এবং কিতাব নাযিল করেছেন। এ রাসূলগণ অসংখ্য লোকের নিকট সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন; কিন্তু এখানে রেখে গেছেন তাঁদের বিভিন্ন কিতাব। মানুষকে পথ দেখাবার জন্য প্রতি যুগে এ কিতাবগুলোর মধ্য থেকে কোন না কোন কিতাব দুনিয়ায় মওজুদ থেকেছে। এরপর যদি কোন ব্যক্তি গোমরাহ হয়, তাহলে সেজন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদেরকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে না। বরং এজন্য ঐ ব্যক্তি নিজেই অভিযুক্ত হবে। কারণ তার কাছে পয়গাম পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু সে তা গ্রহণ করেনি। অথবা সেই সব লোক অভিযুক্ত হবে যারা সত্য-সঠিক পথ সম্পর্কে অবগত ছিল; কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের গোমরাহীতে লিপ্ত দেখেও তাদেরকে সত্য পথের সন্ধান দেয়নি।
[3] - এর অর্থ এই নয় যে, তারা মূল ঘটনাটি অস্বীকার করবে এবং বলবে যে, মুশরিকরা তাদেরকে সংকটে উদ্বারকারী বলে ডাকত না। বরং তারা আসলে এ ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজেদের অবহিত থাকা ও সম্মতি থাকার কথা অস্বীকার করবে। তারা বলবে আমরা কখনো তোমাদের এ কথা বলিনি যে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের ডাকো এবং তোমাদের এ কাজের প্রতি আমরা কখনো সন্তুষ্ট ছিলাম না। বরং তোমরা যে আমাদের ডেকে চলছিলে তাতো আমরা জানতাম না। তোমরা যদি প্রার্থনা শ্রবণকারী, প্রার্থনা পূরণকারী ও সংকট নিরসনকারী বলে আমাদের মনে করে থাকো তাহলে তো এটা ছিল তোমাদের মনগড়া একটা মিথ্যা কথা। কাজেই এর সব দায়-দায়িত্ব তোমাদের। এখন এ দায়িত্বের বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছো কেন?
[4] - কিতমীর বলা হয় খেজুরের আঁটির গায়ে জড়ান পাতলা ঝিল্লি বা আবরণকে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বলা যে, মুশরিকদের মাবুদ ও উপাস্যরা কোন তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসেরও মালিক নয়।
[5]- মুফাসি্সরগণ মাসাজিদ শব্দটি সাধারণভাবে এবাদতখানা অর্থে গ্রহণ করেছেন। "মাসাজিদ" শব্দটি এ অর্থে গ্রহণ করলে আয়াতটির অর্থ হয় এসব এবাদতখানায় আল্লাহর এবাদতের সাথে সাথে যেন অন্য কারো এবাদত করা না হয়। হাসান বসরী বলেনঃ সমস্ত পৃথিবীটাই এবাদতখানা বা উপাসনালয়। তাই আয়াতটির মূল বক্তব্য হলো আল্লাহর এই পৃথিবীতে কোথাও যেন শির্ক করা না হয়। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বাণী থেকে প্রমাণ পেশ করেছেন আমার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে ইবাদতের স্থান এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় বানিয়ে দেয়া হয়েছে। সাঈদ ইবনে জুবাইর মসজিদ বলতে যেসব অংগ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ সাজদা করে সেগুলো অর্থাৎ হাত, হাঁটু, পা ও কপাল বুঝিয়েছেন। এ ব্যাখ্যা অনুসারে আয়াতটির অর্থ হলো, সমস্ত অংগ-প্রত্যংঙ্গ আল্লাহর তৈরী । এগুলোর সাহায্যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সাজদা করা যাবেনা। (ইবনে কাছীর)
[6] - সেকালের মুশরিকরা শুধু সুখ-শান্তি ও আমোদ-প্রমোদে থাকার সময়ই আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করত। আর তাদের উপর বিপদাপদ ও মসীবত আপতিত হলে তারা তাদের বাতিল মাবুদগুলোকে ভুলে যেত এবং খালেসভাবে আল্লাহকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ বিপদাপদ থেকে উদ্ধারের ক্ষমতা রাখেনা। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে, তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কেই ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে’’। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا غَشِيَهُمْ مَوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ فَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمَا يَجْحَدُ بِآَيَاتِنَا إِلَّا كُلُّ خَتَّارٍ كَفُورٍ
‘‘যখন তাদেরকে মেঘমালা সদৃশ তরঙ্গ আচ্ছাদিত করে নেয়, তখন তারা খাঁটি মনে আল্লাহ্কে ডাকতে থাকে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে স্থলভাগের দিকে উদ্ধার করে আনেন, তখন তাদের কেউ কেউ সরল পথে চলে। কেবল মিথ্যাচারী, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিই আমার নিদর্শনাবলি অস্বীকার করে’’। (সূরা লুকমানঃ ৩২)
কিন্তু আপনি যদি বর্তমান কালের এক শ্রেণীর নামধারী মুসলিম ও কবর পূজারীদের দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, তারা সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শরীক করে থাকে। বিপদে পড়েও তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কল্পিত অলী-আওলীয়াকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করে। অথচ মক্কার মুশরিকরা কখনই এ ধরণের কাজ করত না। এমন কি তারা বিশ্বাসও করত না যে, বিপদ হতে উদ্ধারের ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো আছে। শুধু তাই নয়, তারা একমাত্র আল্লাহকেই সৃষ্টি করা, রিযিক দেয়া বৃষ্টি বর্ষণ করা এবং জীবন-মরণের মালিক মনে করত। সুতরাং যেই মুশরিক শুধু সুখের সময় আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করত আর যেই নামধারী মুসলিম সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থায় আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদের উভয়ে মধ্যে নামধারী মুসলিমের শির্কটিই অধিক ভয়াবহ নয় কি? সুতরাং বিষয়টি ভালভাবে বুঝা উচিৎ।
[7] - ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) স্বীয় মুসনাদে এবং ইমাম তাবারানী (রঃ) আলমুজামুল কবীরে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদে ইবনে লাহীয়া থাকার কারণে মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।