ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি ৮ম অধ্যায় - যে ব্যক্তি গাছ, পাথর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল করল (باب من تبرك بشجر أو حجر أو نحوهما) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ)
যে ব্যক্তি গাছ, পাথর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল করল

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى

‘‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উযযা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?’’ (আন নাজমঃ ১৯-২০)

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো গাছ, পাথর, স্থান, কবর, মাজার বা অনুরূপ বস্ত্ত দ্বারা বরকত হাসিল করল, সে শির্ক করল।[1] লাত, মানাত এবং উয্যা এই তিনটি ছিল জাহেলী যুগের আরবদের সর্বাধিক বৃহৎ মূর্তি। লাত ছিল তায়েফের ছাকীফ এবং তার পার্শ্ববর্তী লোকদের মাবুদ, উয্যা ছিল কুরাইশ ও বনী কেনানার লোকদের এবং মানাত ছিল বনী হেলালের লোকদের। ইবনে হিশাম বলেনঃ মানাত ছিল হুযাইল এবং খুযাআ গোত্রের মূর্তি।

আমাশ বলেনঃ ইলাহ থেকে তারা লাত বের করেছে। আল্লাহ্ তাআলার অন্যতম নাম আযীয থেকে বের করেছে উয্যা।

আল্লামা হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ ‘লাত’ ছিল নকশাকৃত সাদা পাথরের একটি মূর্তি। তার উপর নির্মিত ছিল একটি ঘর। আর এটি ছিল তায়েফে অবস্থিত। তার উপর পর্দা ঝুলানো ছিল। এর অনেক খাদেমও ছিল। যে ঘরটির মধ্যে মূর্তিটি স্থাপিত ছিল, তার চারপাশে একটি খোলা ময়দান ছিল। তায়েফের ছাকীফ এবং পার্শ্ববর্তী লোকেরা এটিকে খুব সম্মান করত এবং কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য আরব গোত্রের উপর এটিকে নিয়ে তারা গর্ব করত। এটি হচ্ছে ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের অভিমত।

কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ ‘লাত’ ছিল এমন একজন সৎ লোক, যে হাজীদেরকে ছাতু খাওয়াত। সে যখন মারা গেল, তখন লোকেরা তার কবরের উপর অবস্থান করতে লাগল এবং তার পূজা শুরু করল। ইমাম বুখারী এভাবেই উল্লেখ করেছেন।

ইমাম বুখারীর বর্ণনা এবং অন্যান্য বর্ণনার মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই। অর্থাৎ লোকেরা ঐ পাথরেরই এবাদত করত, যার উপর লাত ছাতু গুলত এবং মানুষকে খাওয়াত। আর সে মারা যাওয়ার পর লোকেরা তার কবরের পূজা শুরু করেছিল।

উয্যার ব্যাপারে ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ এটি ছিল একটি পাথর। পাথরটির উপর ঘর নির্মিত হয়েছিল এবং এর উপর পর্দা ঝুলন্ত ছিল। মক্কা এবং তায়েফের মধ্যবর্তী স্থানে এটি অবস্থিত ছিল। কুরাইশ গোত্রের লোকেরা এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত। আবু সুফিয়ান উহুদ যুদ্ধের দিন বলেছিলঃ আমাদের রয়েছে উয্যা[2]। তোমাদের কোনো উয্যা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মুসলমানদেরকে বলেছিলেনঃ তোমরা বলোঃ اللَّهُ مَوْلاَنَا وَلاَ مَوْلَى لَكُمْ ‘‘আল্লাহ্ আমাদের অভিভাবক। তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই’’।

পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে, এ অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে, যে ব্যক্তি গাছ, পাথর ইত্যাদি দ্বারা বরকত গ্রহণ করল সে শির্ক করল। কিন্তু গ্রন্থকার দলীল গ্রহণ করেছেন সূরা নাজমের ১৯ নং আয়াত দিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে,

أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى

‘‘তোমরা কি ভেবে দেখছ লাত ও উযযা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?’’ সুতরাং শিরোনামের সাথে আয়াতে বর্ণিত লাত, মানাত ও উয্যার সম্পর্ক কী?

উত্তর হচ্ছে যেসব মুশরিক এবাদতের নিয়তে লাত, উয্যা এবং মানাতের দিকে মনোনিবেশ করত, তারা এগুলোর কাছে কল্যাণ ও বরকতের আশা করত, এগুলোর কাছে তারা কল্যাণ কামনা করত এবং অকল্যাণ প্রতিরোধের প্রার্থনা করত। মক্কার মুশরিকদের এ নিয়তের কারণেই লাত, মানাত এবং উয্যাসহ অন্যান্য বস্ত্তগুলো মূর্তিতে পরিণত হয়েছিল। এটিই ছিল মুশরিকদের গোমরাহীর বিরাট কারণ এবং তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেই এমন হয়েছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘আর তারা এবাদত করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্ত্তর, যা তাদের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারতোনা এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারতোনা। তারা বলে, এরা তো আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের সুপারিশকারী। তুমি বল, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে? তিনি পবিত্র ও মহান সেসব বস্ত্ত থেকে যাকে তোমরা শরীক করছো’’। (সূরা ইউনুসঃ ১৮) সুতরাং এক শ্রেণীর নামধারী মুসলিমের কবর পূজা, গাছ পূজা এবং পাথর পূজা জাহেলী সমাজের মুশরিকদের মূর্তি পূজা ও শির্কের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।[3] শুধু তাই নয়, পরবর্তী যুগসমূহের নামধারী মুসলিমদের শির্ক মক্কাবাসীদের শির্কের সীমা অতিক্রম করে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

আবু ওয়াকিদ আল-লাইছী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

«خَرَجَنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى حنين ونحن حدثاء عهد بكفر ولِلْمُشْرِكِينَ سدرة يعكفون عندها و يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ فَقلنا يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم « اللَّهُ أَكْبَرُ إنها السنن قلتم والذي نفسي بيده كما قالت بنوا إسرائيل لموسى (اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ) قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنن مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ»

‘‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হুনাইন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি। এক স্থানে মুশরিকদের একটি কুলগাছ ছিল। যার চারপাশে তারা বসতো এবং তাদের সমরাস্ত্র সেই গাছে ঝুলিয়ে রাখত। গাছটিকে তারা ذات أنواط যাত আনওয়াত বা বরকতময় গাছ বলত। আমরা একদিন একটি কুলগাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের যেমন যাতু আনওয়াত বা বরকত ওয়ালা গাছ আছে আমাদের জন্যও অনুরূপ যাতু আনওয়াত গাছ নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবার! এটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যার হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ! তোমরা এমন কথাই বলেছ, যা বনী ইসরাঈলের লোকেরা মুসা (আঃ)কে বলেছিল। তারা বলেছিল, হে মূসা! মুশরিকদের যেমন অনেক মাবুদ আছে আমাদের জন্য তেমন মাবুদ নির্ধারণ করে দাও। মুসা (আঃ) তখন বললেনঃ তোমরা একটি মূর্খ জাতি। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অবলম্বন করবে।[4]

ব্যাখ্যাঃ আবু ওয়াকেদ আল-লাইছী একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। তিনি ৮৫ বছর বয়সে ৬৮ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

আবু ওয়াকেদ লাইছী বলেনঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হুনাইনের পথে বের হলাম। এখানে মক্কাবাসীদের ঐ সমস্ত লোকের কথা বলা হয়েছে, যারা কয়েক দিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা নতুন মুসলিম ছিল বলেই শির্কের হাকীকত তাদের কাছে অস্পষ্ট ছিল। আর যারা প্রথমেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদের নিকট শির্কের পরিচয় অস্পষ্ট ছিলনা।

হুনাইন মক্কার পূর্ব দিকে একটি উপত্যকার নাম। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাওয়াযেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

لَقَدْ نَصَرَكُمُ اللَّهُ فِي مَوَاطِنَ كَثِيرَةٍ وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنْكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُمْ مُدْبِرِينَ (25) ثُمَّ أَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْزَلَ جُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَعَذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَذَلِكَ جَزَاءُ الْكَافِرِينَ

‘‘আল্লাহ্ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক স্থানে এবং হুনাইনের দিনে, যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের প্রফুল্ল করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেবও তোমাদের জন্য উহা সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। তারপর আল্লাহ্ নাযিল করেন নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি তাঁর রাসূল ও মুমিনদের প্রতি এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এ হল কাফেরদের কর্মফল। (সূরা তাওবাঃ ২৫-২৬)

হুনাইন যুদ্ধের ঘটনা সীরাত গ্রন্থ রচনাকারী, ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য লেখকদের নিকট একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। আল্লাহ্ তাআলা এ যুদ্ধে মুসলিমদেরকে বিজয় দান করেছিলেন। মুসলিমগণ মুশরিকদের মালামাল গণীমত হিসাবে কবজা করেছিলেন এবং তাদের নারী-শিশুদেরকে বন্দী করে দাস-দাসীতে পরিণত করেছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বরকত ওয়ালা গাছ নির্ধারণ করার আবেদন এ জন্য করেছিলেন যে, তারা মনে করেছিলেন, তিনি যদি তাদের জন্য তা নির্ধারণ করে দেন, তাহলেই মুশরিকদের মত তাদের জন্যও বরকতের নিয়তে ঐ গাছটি বেছে নেওয়া এবং তা থেকে বরকত হাসিল করা জায়েয হবে।

তাদের কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন। আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মান বর্ণনা করতে গিয়েই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আল্লাহু আকবার’ বলেছেন এবং এ কথা বুঝানোর জন্য যে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর এবাদতে কোনো শরীক নির্ধারণ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা কেবল তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। সুতরাং পাথর, গাছ এবং অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত থেকে বরকত গ্রহণ করা আল্লাহর সাথে শির্ক করার অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তাআলা সূরা রোমের ৩০ নং আয়াতে বলেনঃ

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

‘‘হে নবী! তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজের চেহারাকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো। এটাই আল্লাহ্‌র ফিতরাত[5], যার উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌র সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানেনা’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ

‘‘আর আমার প্রতি নির্দেশ হয়েছে যাতে আমি ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত থাকি। আর আমাকে বলা হয়েছে, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে ঠিকভাবে এ দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো এবং কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়োনা। আর নির্দেশ হয়েছে আল্লাহ্ ব্যতীত এমন কাউকে ডাকবে না, যে তোমার ভাল করতে সক্ষম নয় এবং তোমার মন্দ করারও কোন ক্ষমতা রাখেনা। তুমি যদি এমন কাজ কর, তাহলে তুমিও যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনূসঃ ১০৪-১০৬) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ الْقَيِّمِ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ يَوْمٌ لَّا مَرَدَّ لَهُ مِنَ اللَّهِ

‘‘যে দিবস আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে প্রত্যাহত হবার নয়, সে দিবসের পূর্বে তুমি এই সত্য দ্বীনে নিজের চেহারাকে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখো’’। (সূরা রোমঃ ৪৩) এখানে সত্য দ্বীন বলতে ইখলাস উদ্দেশ্য। আর শির্ক ইখলাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

হানীফের অর্থ ইতিপূর্বে অতিক্রম করেছে। হানীফ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে সম্পূর্ণরূপে শির্ক বর্জন করে, মুশরিকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল এবাদত কেবল আল্লাহ্ তাআলার জন্যই করে।

উপরোক্ত আয়াতগুলো এবং অনুরূপ অর্থে অন্যান্য আয়াত ঐ তাওহীদেরই প্রমাণ করে, যার বর্ণনা রয়েছে কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’এর মধ্যে। পূর্বে এর বিস্তারিত বিবরণ অতিক্রম করেছে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল, যে ব্যক্তি কল্যাণ অর্জনের আশায় অথবা অকল্যাণ দূর করার জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের দিকে মনোনিবেশ করল, সে শির্কে লিপ্ত হল। সমগ্র কুরআন এ মহান মূলনীতিটি বর্ণনা করার জন্যই নাযিল হয়েছে। এটিই হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মূলভিত্তি। এটিই হচ্ছে ইখলাসের সর্বোচ্চ পর্যায়, যা ব্যতীত আল্লাহ্ তাআলা কারও কাছ থেকে অন্য কিছু কবুল করেন না।

إنها السنن এটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়ঃ السنن শব্দটির ‘সীন’ বর্ণে পেশ দিয়ে পড়তে হবে। এর অর্থ হচ্ছে পথ, রাস্তা, রীতি-নীতি ইত্যাদি। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ সমস্ত পথ ও রীতিনীতির প্রতি ইংগিত করেছেন, যা মানব জাতির জন্য আল্লাহর নির্ধারিত দ্বীনের পরিপন্থী।

যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা এমন কথাই বলেছ, যা বনী ইসরাঈলের লোকেরা মুসা (আঃ)কে বলেছিল। তারা বলেছিল, হে মূসা! মুশরিকদের যেমন অনেক মাবুদ আছে আমাদের জন্যও তেমন মাবুদ নির্ধারণ করে দাওঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী ইসরাঈলের কথাটিকে জোর দিয়ে বলার জন্য এবং বিষয়টির ভয়াবহতা বর্ণনা করার জন্য শপথ করেছেন। অতঃপর তিনি সাহাবীদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, গাছ, পাথর, কবর, মাজার ইত্যাদি থেকে বরকতের আশা করা এগুলোকে মাবুদ বানিয়ে নেওয়ারই নামান্তর। মানুষ এগুলোকে মাবুদ বলুক আর নাই বলুক। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের কথাকে বনী ইসরাঈলের লোকদের কথার সাথে তুলনা করেছেন। বনী ইসরাঈলের লোকেরা মুসা (আঃ)এর কাছে আবেদন করেছিল, يَا مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آَلِهَةٌ ‘‘হে মূসা! আমাদের জন্য একটি মাবুদ নির্ধারণ করো। যেমন তাদের রয়েছে অনেক মাবুদ’’।

উপরোক্ত হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেল, গাছ, পাথর এবং অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত হতে বরকত অর্জন করা আর আল্লাহর এবাদতের মধ্যে গাইরুল্লাহকে শরীক বানানো একই কথা। এটি মূর্তিপূজকদের শির্কের মতই।[6]

তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি অবলম্বন করবেঃ অর্থাৎ তোমরা ইহুদী-খৃষ্টানদের অনুসরণ করবে। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সংবাদ দিয়েছেন, এই উম্মতের মধ্যে বাস্তবেও তাই হয়েছে। এই উম্মাতের লোকেরা ইহুদী-খৃষ্টানদের আচার-আচরণকে নিজেদের পথ বানিয়েছে। যেমন সহীহ হাদীছসমূহে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ حذو القذة بالقذة حَتَّى لَوْ دخلوا جُحْرَ ضَبٍّ لَدخلتتُمُوهُ قالوا: يَا رسول الله الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى. قَالَ: فَمَنْ؟»

‘‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের পদে পদে অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি দবব (সান্ডা)এর গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী উম্মত দ্বারা আপনি কি ইয়াহুদ-নাসারা বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেনঃ তবে আর কারা?

বুখারী ও মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে উক্ত হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। অপর বর্ণনায় আছে যে, তারা ব্যতীত আর কেউ হতে পারে কি?[7] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) সূরা নাজমের আয়াত أفرايتم اللات والعزى -এর তাফসীর জানা গেল।

২) সাহাবীগণ যে বিষয়টি প্রার্থনা করেছিলেন, তার প্রকৃত অবস্থা জানা গেল।

৩) আরো জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামগণ শির্ক করেন নি।

৪) সাহাবীগণ এ জন্য যাতু আনওয়াত বা বরকত ওয়ালা গাছ প্রার্থনা করেন নি যে, তারা এর এবাদত করবেন। বরং তাঁরা এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চেয়েছিলেন এ কথা ভেবে যে, আল্লাহ তা পছন্দ করেন।

৫) সাহাবায়ে কেরামগণই যদি এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকেন, তাহলে অন্য লোকেরা তো আরো বেশী অজ্ঞ থাকবে।

৬) সাহাবায়ে কেরামের জন্য যে অধিক ছাওয়াব দান ও গুনাহ মাফের ওয়াদা রয়েছে, অন্যদের ব্যাপারে তা নেই।

৭) শির্কের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করেন নি[8]। বরং তাঁদের কথার শক্ত জবাব এ কথার মাধ্যমে দিয়েছেনঃ

«اللَّهُ أَكْبَرُ إِنَّهَا السُّنَنُ لَتَتَّبِعُنَّ سُنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ»

‘‘আল্লাহু আকবার! নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি অনুসরণ করবে’’। উপরোক্ত তিনটি কথা দ্বারা বিষয়টি অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে।

৮) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, সাহাবায়ে কেরামের দাবী মূলতঃ মূসা আলাইহিস সালামের কাছে বনী ইসরাইলের লোকদের দাবীর মতই ছিল। বনী ইসরাঈলের লোকেরা মুসাকে বলেছিলঃ আমাদের জন্য একটি মাবুদ নির্ধারণ করে দাও।

৯) তাদের দাবি মোতাবেক বরকত গ্রহণের জন্য মাবুদ নির্ধারণ না করে দেয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র মর্মার্থের অন্তর্ভূক্ত। এ বিষয়টি অতিসুক্ষ্ম হওয়ার কারণে কতক সাহাবীর নিকট উহা অস্পষ্ট ছিল।

১০) বিনা প্রয়োজনে শপথ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অভ্যাসের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে শপথ করতেন। এখানে তিনি সাহাবীদের একটি আবেদনের জবাব দিতে গিয়ে শপথ করেছেন।

১১) শির্কের মধ্যে ‘আকবার’ ও ‘আসগার’ রয়েছে। হুনাইনের পথে সাহাবীগণ যে দাবি করেছিলেন, তা ছিল শির্কে আসগারের পর্যায়ভূক্ত। এ জন্যই তারা তাদের কথার কারণে মুরতাদ হয়ে যাননি।

১২) ‘‘আমরা কুফরী যমানার খুব কাছাকাছি ছিলাম’’ অর্থাৎ আমরা সবেমাত্র মুসলিম হয়েছিলাম, এ কথা দ্বারা বুঝা যায় যে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না।

১৩) আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা পছন্দ করেনা, এটা তাদের বিরুদ্ধে একটি দলীল।

১৪) শির্ক ও পাপাচারের পথ বন্ধ করার গুরুত্ব জানা গেল।

১৫) জাহেলী যুগের লোকদের অনুসরণ ও সাদৃশ্য করা নিষেধ।

১৬) শিক্ষাদানের সময় প্রয়োজন বোধে রাগ করা জায়েয।

১৭) إنها السنن ‘‘এটা একটা সাধারণ রীতি-নীতি ও পথ’’।

১৮) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সংবাদ দিয়েছেন, বাস্তবে তাই ঘটেছে। এটা নবুওয়াতের অন্যতম নিদর্শন।

১৯) কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইহুদী ও খৃষ্টানদের চারিত্রিক যেসব দোষ-ত্রুটির কথা বলেছেন, তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যই বলেছেন।

২০) সাহাবীদের কাছে এ কথা সুসাব্যস্ত ছিল যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই এবাদত করতে হবে। এখানে ঐ সমস্ত প্রশ্নের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা কবরের মধ্যে করা হবে। কবরে প্রশ্ন করা হবে, (ক) তোমার প্রভু কে? এটি একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন।[9] (খ) তোমার নবী কে? এ প্রশ্নগুলো ঐসব গায়েবের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে জানিয়েছেন। কেননা কবরে কী প্রশ্ন করা হবে এ কথা নবী ছাড়া কেউ বলতে পারেনা।[10]

(খ) তোমার দ্বীন কী ছিল? এ কথা তাদের إجعل لنا آلهة আমাদের জন্যও ইলাহ ঠিক করে দিন। এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হবে। অর্থাৎ তোমার দ্বীন তো শির্ক করার নির্দেশ দেয়নি তাহলে তোমাকে কোন্ দ্বীন শির্কের নির্দেশ দিল?

২১) মুশরিকদের রীতি-নীতির মত আহলে কিতাবের রীতি-নীতিও দোষনীয়।

২২) বাতিল আকীদাহ ছেড়ে দেয়ার পরও পূর্বের বাতিল ‘আকীদাহ’র কিছু ছাপ বাতিল পরিত্যাগকারীর অন্তরে থেকে যেতে পারে। ونحن حدثاء عهد بكفر ‘‘আমরা কুফরী যুগের খুব নিকটবর্তী ছিলাম বা নতুন মুসলিম ছিলাম, সাহাবীদের এ কথার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়।

[*] - البركة বরকত শব্দটির অর্থ হচ্ছে কল্যাণকর বস্ত্তসমূহ এক স্থানে একত্রিত ও স্থায়ী হওয়া এবং বৃদ্ধি হওয়া। আর التبرك তাবাররুক অর্থ হল প্রচুর কল্যাণ অনুসন্ধান করা এবং বরকত স্থায়ী হওয়ার প্রার্থনা করা। সে হিসাবে تبرك অর্থ হচ্ছে সে বরকত তালাশ করল।

কুরআন ও সহীহ হাদীছের অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, বরকত কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তাআলাই বরকত প্রদান করেন। কোন মানুষ অন্য কোন মানুষকে বরকত দান করার ক্ষমতা রাখেনা। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا

‘‘বরকতের অধিকারী তিনি (আল্লাহ্) যিনি তার বান্দার প্রতি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্যে সতর্ককারী হয়’’। (সূরা ফুরকানঃ ১) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘‘বরকতের মালিক তিনি (আল্লাহ্), যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’’। (সূরা মূলকঃ ১) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ

‘‘তাকে এবং ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের উপর স্পষ্ট জুলুমকারী’’। (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ১১৩) আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)এর উক্তি উদ্বৃত করে আরো বলেনঃ

قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا

‘‘সে বললঃ আমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে’’। (সূরা মারইয়ামঃ ৩০-৩১) সুতরাং বরকত দানকারী একমাত্র আল্লাহ। কোন সৃষ্টির জন্য জায়েয নয় যে, সে বলবে, আমি এই জিনিষকে বরকতময় করেছি কিংবা তাতে বরকত দিয়েছি। বরকত অর্থ হচ্ছে কল্যাণ ছড়িয়ে পড়া ও তা স্থায়ী হওয়া।

কুরআন মজীদ ও পবিত্র সুন্নাত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তাআলা বেশ কিছু বস্ত্তকে বরকতময় করেছেন। সেগুলো ব্যতীত বিনা দলীলে অন্য কোন বস্ত্তকে বরকতময় মনে করা অন্যায় এবং তা থেকে বরকত তালাশ করা অবৈধ। নিম্নে কতিপয় বরকতময় বিষয়ের বিবরণ পেশ করা হল।
(১) বরকতময় স্থানসমূহঃ বরকতময় স্থানসমূহের অন্যতম হলঃ মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদুল আকসা, মক্কা মুকাররামাহ, মদীনা মুনাওয়ারা, সিরিয়া, ইয়ামান এবং হজ্জের পবিত্র স্থান সমূহ- যেমন আরাফাহ্, মুযদালিফাহ্, মিনা ইত্যাদী। তা ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদই বরকতময়। এ সমস্ত স্থান থেকে শরীয়ত সম্মত পদ্ধতিতে বরকত হাসিলের চেষ্টা করতে হবে। খালেস নিয়তে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমেই এ সকল পবিত্র ও বরকতময় স্থান থেকে বরকত লাভের আশা করতে হবে। বরকতপূর্ণ স্থান দ্বারা শরীয়ত সম্মত নিয়মের পরিপন্থি পদ্ধতিতে বরকত হাসিলের চেষ্টা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। সুতরাং বরকতের আশায় মসজিদ সমূহের দরজা গুলোকে চুম্বন করা, উহার মাটি দ্বারা রোগ মুক্তির আশা করা, কাবা শরীফের দেয়াল অথবা মাকামে ইবরাহীম ইত্যাদীকে স্পর্শ করা নিষেধ।
(২) কতিপয় বরকতময় সময়ঃ আল্লাহ্ তাআলা যে সমস্ত স্থানকে বরকতময় করেছেন তার মধ্যে লাইলাতুল কদরসহ রামাযানের শেষ দিনগুলো, দশই যুল হাজ্জ জুমআর দিন, প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। এ সকল ক্ষেত্রে বরকতের অনুসন্ধান হতে হবে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত পন্থার অনুসরণ করে এবং তাতে এবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে। এ সমস্ত সময়ে এবাদত করে যে পরিমাণ ছাওয়াব পাওয়া যাবে, অন্যান্য সময়ে এবাদত করে তা পাওয়া যাবেনা।

(৩) বনী আদমের বরকতময় সন্তানসমূহঃ আল্লাহ্ তাআলা আদমের সন্তানদের থেকে মুমিনদেরকে বরকত দান করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুমিনদের সরদার নবী-রাসূলগণ সকলের উর্দ্ধে। তাদের শরীর বরকতময়। আল্লাহ্ তাআলা আদমের শরীরকে বরকতময় করেছেন এবং ইবরাহীম (আঃ)এর শরীরে বরকত দান করেছেন। এমনিভাবে নূহ, ঈসা, মূসা এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের দেহকে বরকতময় করেছেন। সুতরাং নবী-রাসূলদের সম্প্রদায়ের কোন লোক কিংবা তাদের কোন অনুসারী যদি তাদের শরীর থেকে বরকত হাসিল করে তাহলে তা জায়েয হবে। তাদের শরীর স্পর্শ করা, শরীরের ঘাম সংগ্রহ করা, তাদের চুল অথবা তাদের ব্যবহৃত অন্য যে কোন জিনিষ দিয়ে বরকত গ্রহণ করা জায়েয। কেননা আল্লাহ্ তাআলা তাদের শরীরকে বরকতময় করেছেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর পবিত্র শরীরও বরকতময়। সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবীগণ তাঁর শরীরের ঘাম ও তাঁর মাথার চুল দিয়ে বরকত গ্রহণ করতেন। তিনি যখন অযু করতেন, তখন অযুর অতিরিক্ত পানি নিয়ে তারা কাড়াকাড়ি শুরু করতেন। এমনটি আরো অনেক কথাই সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার কারণ এই যে, আল্লাহ্ তাআলা নবীদের শরীরে এমন বরকত দান করেছেন, যার প্রভাব অন্যদের প্রতিও স্থানান্তরিত হয়। আর এটি নবী-রাসূলদের সাথেই নির্দিষ্ট। নবী-রাসূলদের ব্যক্তিসত্তাই বরকতময়।

নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্য কারো ব্যক্তিসত্তা বরকতময় নয়। নবী-রাসূলদের কোন সাথীর ব্যক্তিগত বরকত ছিল বলে কোন দলীল পাওয়া যায়না। এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর ও উমারের বেলায়ও এমনটি বর্ণিত হয়নি। তাদের ব্যক্তিসত্তাও বরকতময় ছিল বলে কোন দলীল পাওয়া যায়না। এ বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, সাহাবী ও তাবেঈগণ আবু বকর, উমার, উছমান আলী (রাঃ) কিংবা অন্য কোন সাহাবী থেকে বরকত গ্রহণ করতেন না। অথচ তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুল, অযুর পানি, থুথু, ঘাম, ব্যবহৃত পোষাক এবং অন্যান্য বস্ত্ত দিয়ে বরকত গ্রহণ করতেন। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, সাহাবীদের বরকত ছিল আমলের বরকত। তাদের ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পৃক্ত কোন বরকত ছিলনা, যা অন্যের প্রতি স্থানান্তরিত হতে পারে। যেমন ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকত। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«إِنَّ مِنَ الشَّجَرِ لَمَا بَرَكَتُهُ كَبَرَكَةِ الْمُسْلِمِ»

‘‘একটি বৃক্ষ এমন রয়েছে, যার বরকত মুসলিমের বরকতের মতই’’। এই হাদীছ থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক মুসলিমের মধ্যেই বরকত রয়েছে। বুখারীতে বর্ণিত উসাইদ বিন হুযায়ের (রাঃ)এর কথাও তাই প্রমাণ করে। তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ

«مَا هِىَ بِأَوَّلِ بَرَكَتِكُمْ يَا آلَ أَبِى بَكْرٍ»

‘‘হে আবু বকরের বংশধর! এটি তোমাদের প্রথম বরকত নয়’’। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি কোন এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম। আমরা যখন ‘বায়দা’ অথবা ‘যাতুল জায়শ নামক স্থানে পৌঁছলাম তখন আমার গলার হার ছিড়ে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহা তালাশ করার জন্য তথায় অপেক্ষা করলেন। লোকেরাও অপেক্ষা করল। সেখানে পানির কোন ব্যবস্থা ছিলনা। লোকেরা আবু বকর (রাঃ)এর নিকট এসে বলতে লাগলঃ আপনি কি দেখছেন না আয়েশা কি করলেন? আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত লোককে এমন স্থানে আটকিয়ে দিলেন যেখানে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাঁদের সাথেও পানি নেই। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আবু বকর (রাঃ) আমার নিকট আগমণ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আমার রানের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত লোককে এমন স্থানে আটকিয়ে দিয়েছ যেখানে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাঁদের সাথেও কোন পানি নেই। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আবু বকর আমাকে দোষারোপ করলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি এ ধরণের আরো অনেক কথা বললেন। অতঃপর তিনি আমার কোমরে আঘাত করতে লাগলেন। আঘাত করা সত্ত্বেও আমি নড়াচড়া করতে পারলামনা। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার রানের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। প্রাতঃকালে যখন তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখন সেখানে কোন পানি ছিলনা। এখানেই আল্লাহ তা’আলা তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন। উসায়েদ ইবনে হুযায়ের (রাঃ) বলেনঃ হে আবু বকরের বংশধর! এটি তোমাদের প্রথম বরকত নয়। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি যে উটে আরোহন করেছিলাম সেটি যখন উঠালাম তখন দেখতে পেলাম হারটি তার নিচে পড়ে আছে।

সুতরাং এটি হচ্ছে, সেই বরকত, যা প্রত্যেক মুমিনকেই দেয়া হয়েছে। আবু বকরের পরিবারকেও তা দেয়া হয়েছে। এটি হচ্ছে আমলের বরকত। তারা যেই সৎ আমল করেছেন, তার কারণেই এটি তারা পেয়েছেন। নবী-রাসূলদের বরকতের ন্যায় এটি তাদের সত্তাগত নয়। ঈমান-ইল্ম অর্জন, তার প্রচার এবং তদোনুযায়ী আমল করার কারণেই তারা বরকতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের মধ্যেই কম বা বেশী বরকত রয়েছে। আর এই বরকত তার ব্যক্তিগত ও নিজস্ব বরকত নয়। এটি হচ্ছে সৎ আমলের বরকত। তার মধ্যে যে পরিমাণ ঈমান ও ইসলাম রয়েছে এবং তার অন্তরে যে পরিমাণ ইয়াকীন, আল্লাহর ভালবাসা, সম্মান এবং তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে, তার মধ্যে সে পরিমাণ বরকতই রয়েছে। সুতরাং বান্দার ইলম, ঈমান ও সৎ আমলের মধ্যে যেই বরকত রয়েছে, তা একজন থেকে অন্যজনের কাছে স্থানান্তর হয়না।

সুতরাং আলেম ও পরহেজগার লোকদের থেকে বরকত নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাদের ইল্ম থেকে উপকৃত হওয়া, তাদের থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা এবং তাদের পথ অনুসরণ করা। কিন্তু তাদের দ্বারা বরকত গ্রহণ করা ঠিক নয়। অর্থাৎ তাদের শরীর স্পর্শ করে, তাদের থুথু কিংবা অযুর পানি বা তাদের উচ্ছিষ্ট অন্যান্য বস্ত্ত দ্বারা বরকত গ্রহণ করা হারাম। এ ব্যাপারে সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এই উম্মাতের আবু বকর উমার, উছমান ও আলী সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য সাহাবী ও তাবেঈগণ তাদের দ্বারা বরকত গ্রহণ করার চেষ্টা করেন নি।

সুতরাং বর্তমান যুগের যে সমস্ত লোক দাবী করে যে, সৎ লোকদের আছার তথা ব্যবহৃত ও উচ্ছিষ্ট বস্ত্ত দ্বারা বরকত হাসিল করা জায়েয, একাধিক কারণে তা সঠিক নয়।

(১) ইসলামের প্রথম যুগের সৎকাজে অগ্রগামী সাহাবী ও তাবেঈগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো আছার দ্বারা বরকত গ্রহণ করেন নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবদ্দশাতেও না, তাঁর মৃত্যুর পরেও না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা বরকত গ্রহণ করা জায়েয হলে এবং তা কল্যাণের কাজ হলে অবশ্যই তারা তা করতেন। সাহাবীদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন আবু বকর, উমার, উছমান ও আলী (রাঃ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। কোন সাহাবী অথবা কোন তাবেঈ এই সমস্ত নের্তৃস্থানীয় সাহাবী থেকে বরকত গ্রহণ করার চেষ্টা করেন নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে কাউকে তুলনা করা বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকা কালে তাঁর অনেক বৈশিষ্ট ছিল। এতে অন্য কারো শরীক হওয়া শোভনীয় ও বৈধ নয়।

(২) শির্কের দরজা বন্ধ করার জন্য সৎ লোকের উচ্ছিষ্ট বস্ত্ত দ্বারা বরকত হাসিল করা নিষিদ্ধ হওয়া বাঞ্চণীয়।

[1] - কিতাবুত তাওহীদের অন্যতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফতহুল মাজীদের লেখক বলেনঃ যে ব্যক্তি উপরোক্ত বস্ত্তগুলো দ্বারা বরকত গ্রহণ করবে সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে।

[2] - একাধিক মুহাদ্দিছ উয্যা সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে ইমাম বায়হাকী (রঃ) সুনানে কুবরায় আবু তুফাইল (রাঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা জয় করলেন, তখন খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)কে নাখলা নামক স্থানে পাঠালেন। সেখানে উয্যা নামক মূর্তিটি রাখা ছিল। খালেদ (রাঃ) সেখানে গেলেন। সেখানে ছিল তিনটি বাবলা গাছ। বাবলা গাছগুলো তিনি কেটে ফেললেন। আর যেই ঘরের মধ্যে উয্যাকে রাখা হয়েছিল তাও ভেঙ্গে ফেললেন। অতঃপর খালেদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফেরত আসলেন এবং উয্যার আস্তানা ধ্বংস করার সংবাদ দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তুমি পুনরায় ফেরত যাও। কেননা তুমি কিছুই করতে পার নি। অর্থাৎ তাকে ধ্বংস করতে পার নি। খালেদ পুনরায় সেখানে গেলেন। সেখানকার খাদেম ও ভক্তরা যখন খালেদকে দেখল, তখন পাহাড়ের উপর দৃষ্টি দিয়ে বলতে লাগলঃ হে উয্যা! এ কথা শুনে খালেদ (রাঃ) সেই দিকে গেলেন। তিনি সেখানে একটি উলঙ্গ মহিলা দেখতে পেলেন। তার মাথার চুলগুলো খোলা অবস্থায় ছিল। আর সে মুষ্ঠি ভর্তি করে স্বীয় মাথায় মাটি নিক্ষেপ করছিল। খালেদ (রাঃ) তলোয়ারের এক প্রচন্ড আঘাত করে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেললেন। অতঃপর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফেরত এসে ঘটনা সম্পর্কে সংবাদ দিলেন। তখন তিনি বললেনঃ সেটিই ছিল উয্যা। দেখুনঃ মুসনাদে আবু ইয়ালা, (২/১৯২) দুররুল মানসুর, (৭/৬৫৭) সুনানে কুবরা, (৬/৪৭৪)। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মাকদেসী বলেনঃ মুতাবাআতের তথা অন্যান্য বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত হওয়ার কারণে হাদীছটি সহীহ। দেখুনঃ আলমুখতারাতঃ (৮/২১৯)

আল্লাহ্ তাআলা এই জিনকে (শয়তানকে) হত্যা করার জন্য খালেদ (রাঃ)কে শক্তিশালী করেছিলেন। কারণ এই শয়তান উয্যা নাম ধারণ করে মানুষকে গোমরাহ করে আসছিল। জিন ও শয়তানেরা মানুষের আকৃতি ধরে মানুষকে গোমরাহ করে। আবু হুরায়রা (রাঃ)কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যাকাতের মাল পাহারা দেয়ার জন্য নিযুক্ত করলেন, তখন শয়তান মানুষের আকৃতি ধরে যাকাতের মাল চুরি করতে লাগল।

[3] - মোট কথা মুশরিকরা লাত, মানাত এবং উয্যার নিকট যা করত, বর্তমান সময়ের নামধারী মুসলিমরাও গাছ, পাথর ও কবরের কাছে তাই করছে। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ)এর দাওয়াত ও সংস্কার আন্দোলনের পূর্বে যে ব্যক্তি আরব উপদ্বীপের ইতিহাস পড়বে, সে জানতে পারবে যে আরব অঞ্চলের লোকেরা ছিল ভয়াবহ শির্কের মধ্যে লিপ্ত। আরব উপদ্বীপের বাইরের দেশগুলোর প্রতি যদি আপনি এখনও দৃষ্টি দেন, তাহলে দেখতে পাবেন লোকেরা কবর, মাজার, গাছ ও পাথরকে জাহেলী যামানার মুশরিকদের মতই মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিৎ।

[4] - ইমাম তিরমিজী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন।

[5] - মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভকারী প্রত্যেকটি শিশু আসলে মানবিক প্রকৃতির উপরই জন্ম লাভ করে। তাঁরপর তাঁর মা-বাপই তাকে পরবর্তীকালে ইহুদী, খৃষ্টান ও অগ্নিপূজারী হিসেবে গড়ে তোলে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন প্রত্যেকটি পশুর পেট থেকে পুরোপুরি নিখুঁত ও সুস্থ পশুই বের হয়ে আসে। কোন একটা বাচ্চাও কান কাটা অবস্থায় বের হয়ে আসে না। পরে মুশরিকরা নিজেদের জাহিলী কুসংস্কারের কারণে এর কান কেটে দেয়। প্রত্যেক সন্তানই প্রকৃতির উপর জন্ম নেয়। যখন কথা বলতে শেখে তখন তাঁর বাপ- মা তাকে ইহুদী খৃষ্টানে পরিণত করে। অন্য একটি হাদীসে ইমাম আহমাদ (রঃ) ঈযায ইবনে হিমার আল মুজাশি'য়ী থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ভাষণের মাঝখানে বলেনঃ আমার রব বলেন, আমার সমস্ত বান্দাদেরকে আমি একনিষ্ঠ সত্যপথাশ্রয়ী করে সৃষ্টি করেছিলাম, তাঁরপর শয়তানরা এসে তাদেরকে দ্বীন থেকে বিপথগামী করে এবং তাদের জন্য আমি যা কিছু হালাল করে দিয়েছিলাম সেগুলোকে হারাম করে নেয় এবং তাদেরকে হুকুম দেয়, আমার সাথে এমন বস্ত্তকে শরীক গণ্য করতে, যেগুলোকে শরীক করার জন্য আমি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করিনি।


[6] - গাছ, মাছ, পাথর, কবর, মাজার, যমীন ইত্যাদির দ্বারা বরকত গ্রহণ করা কখনো বড় শির্ক আবার কখনো ছোট শির্ক হয়ে থাকে। এগুলো থেকে যখন এই বিশ্বাসে বরকত তলব করা হবে যে, এই গাছ অথবা এই পাথর স্পর্শ করলে অথবা এই কবর স্পর্শ করলে কিংবা তার উপর গড়াগড়ি করলে অথবা এতে বুক লাগালে এটি আল্লাহর নিকট তার জন্য মধ্যস্থতা (সুপারিশ) করবে অথবা যখন এগুলোর ব্যাপারে এই বিশ্বাস করা হবে যে, এগুলো হচ্ছে আল্লাহর সান্যিধ্যে যাওয়ার মাধ্যম, তাহলে এটি আল্লাহ্ তাআলার সাথে অন্যকে মাবুদ বানিয়ে নেওয়ার মতই হবে। এটি বড় শির্ক, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। জাহেলী যামানার মুশরিকরা এই বিশ্বাসেই পাথর ও গাছের পূজা (এবাদত) করত।

কবরপূজারীরাও একই বিশ্বাসে কবর দ্বারা বরকত গ্রহণ করে, তারা যদি বিশ্বাস করে যে, কবরের পাশে অবস্থান করলে, কবর স্পর্শ করলে, কবরের মাটিকে পবিত্র মনে করে অথবা কবরবাসীকে সৎ লোক ও আল্লাহর অলী মনে করে মাথায় ও শরীরে কবরের মাটি মাখালে এ বস্ত্তগুলো তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে, তাহলে এই কাজটি আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করার মতই হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى

‘‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে রেখেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের এবাদত এ জন্যেই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী করে দেয়’’। (সূরা যুমারঃ ৩)

আর এই নিয়তে যদি কবর, গাছ, পাথর এবং অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত দ্বারা বরকত গ্রহণ করা হয় যে, এগুলো শুধু বরকত লাভের মাধ্যম, এই বিশ্বাসে নয় যে, এগুলো তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছিয়ে দিবে, যেমনটি করে থাকে তাবীজ, কবজ, সুতা এবং তাগা পরিধানকারীগণ, তাহলে তা শির্কে আসগারের অন্তর্ভূক্ত হবে। কবর, গাছ, ও পাথর দিয়ে বরকত গ্রহণকারীরও একই অবস্থা। সে এগুলোকে শুধু বরকত লাভের মাধ্যম মনে করে। সে যদি এই বিশ্বাসে কবর থেকে মাটি গ্রহণ করে এবং তা শরীরে মাখায় কিংবা কবরের উপর গড়াগড়ি করে যে, এখানকার মাটি পবিত্র, এতে শরীর লাগালে তা শরীরে বরকত নিয়ে আসার মাধ্যম হবে, তাহলে এটি ছোট শির্ক হবে। এটি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত হিসাবে গণ্য হবেনা। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[7] - আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বুখারীর অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ قُلْنَا: يَا رسول الله، الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى. قَالَ: فَمَنْ؟»

তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের পদে পদে অনুসরণ করে চলবে। এক বিঘত যেমন অন্য বিঘতের সমান হয় এবং এক হাত যেমন অন্য হাতের সমান হয় তোমরাও হুবহু সেরকম পূর্ববর্তী উম্মতদের অনুসরণ করে চলবে। এমনকি তারা যদি দবব-এর গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে। সাহাবীগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী উম্মত দ্বারা আপনি কি ইয়াহুদ ও নাসারা বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেনঃ তবে আর কারা?

[8] - শির্কের ব্যাপারে অজ্ঞতার অযুহাত তথা না জেনে না বুঝে কেউ শির্কে লিপ্ত হলে অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করা হবে কি না? এ ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। গ্রন্থকারের বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, শির্কের ব্যাপারে অজ্ঞতার কোন অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। অপর পক্ষে সুবিখ্যাত আলেমে দ্বীন মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উছাইমীনসহ অন্যান্য আলেমের মতে অন্যান্য পাপ কাজের মতই শির্কের ব্যাপারে অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ না জেনে না বুঝে কেউ শির্কে লিপ্ত হলে সে ক্ষমা পাওয়ার উপযুক্ত। তারা এই অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করেছেন এবং তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যদি তাদের অযুহাত গ্রহণ না করতেন, তাহলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতেন এবং মুরতাদ হিসাবে সাব্যস্ত করে তাওবা করার নির্দেশ দিতেন ও কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে নতুনভাবে ইসলামে প্রবেশ করার হুকুম করতেন।

তবে বিনা শর্তে এই বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। যেই সমাজে তাওহীদের শিক্ষা বিদ্যমান এবং যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে, তারা যদি শির্ক করে, তাহলে তাদের কোন রক্ষা নেই। তাদের অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। আর এই হাদীছে সে সমস্ত সাহাবীর কথা বলা হয়েছে, তারা ছিলেন নতুন মুসলিম। তাই সম্ভবতঃ তাদের অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করা হয়েছে। তা ছাড়া তারা কেবল বরকত ওয়ালা গাছ নির্ধারণ করার আবেদন করেছিলেন। তা থেকে বরকত গ্রহণ করেছেন- এমনটি প্রমাণিত নয়।

[9] - এটি একটি সুস্পষ্ট প্রশ্ন। এর দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে তা অতি সুস্পষ্ট। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা শির্ক হতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি শির্ক করেছ। তাহলে তোমার রব কে যার হুকুমে তুমি শির্ক করেছ?

[10]- এখানে এ কথা দ্বারা বুঝানো হচ্ছে কে তোমার নবী? তিনি তো শির্ক করার কথা বলেন নি। তারপরও তুমি শির্ক করেছ। তাহলে তোমাকে শির্ক করার নির্দেশ দাতা নবী কে?