বিদ‘আত শব্দের শাব্দিক অর্থ নব উদ্ভাবন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ইবনু মানযুর লিখেন : ‘‘বিদ‘আত অর্থ : নতুন সৃষ্ট এবং দীনের পূর্ণতার পর যা উদ্ভাবন করা হয়েছে’’।[1]দ্বিতীয় অর্থটি মূলত পরিভাষিক। ইবনু ফারিস[2] বিদ‘আতের অর্থ লিখেন : পূর্ব নমুনা ব্যতিরেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা, শুরু করা বা প্রচলন করা।[3]
লিসানুল আরব অভিধান থেকে আমরা শাব্দিক অর্থের সাথে সাথে বিদআতের পরিভাষিক অর্থ জানতে পেরেছি। আরেকটু স্পষ্ট হওয়ার জন্য ফিক্বহী পরিভাষায় বিদ‘আতের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা উল্লেখ করা হল :
"البدعة طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشرعية يقصد بالسلوك عليها ما يقصد بالطريقة الشرعية".(الاعتصام، الباب الأول في تعريف البدع وبيان معناها...،1-26)
‘‘বিদ‘আত হচ্ছে, দীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতি, যা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্য, এই পদ্ধতির উপর চলার সেই উদ্দেশ্য যা শরয়ী পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য।’’[4]
কেউ কেউ বলেন :
‘‘দীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতি, যা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্য, এই পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য হলো : আল্লাহ সুব্হানাহুর ইবাদতের মধ্যে বৃদ্ধি করা।’’[5]
শরয়ী পদ্ধতি বলতে ইবাদতের সুন্নাত পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। কেননা সুন্নাত পদ্ধতি বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত জাতীয় যে বিষয়ে তিনি যে পদ্ধতি উম্মতকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তাই শরয়ী পদ্ধতি। এর বাইরে কোনো শরয়ী পদ্ধতি নেই। এই অর্থেই আহলুস্সুন্নাহ শব্দের বিপরীতে আহলুল বিদ‘আহ শব্দটি উলামায়ে কেরাম প্রয়োগ করে থাকেন বলে আমরা ইতোপূর্বে দেখে এসেছি।
বিভিন্ন হাদীসে বিদ‘আত বা নব উদ্ভাবিত বিষয় বুঝাতে ‘মুহ্দাসাত’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটু পরেই আমরা দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ। বিদ‘আত বা মুহদাসাতের শরয়ী সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত শুধুমাত্র ইবাদত কেন্দ্রিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে। যে কোনো নব অবিস্কৃত জিনিসের উপর শাব্দিক অর্থে বিদআতের প্রয়োগ করা গেলেও শরয়ী অর্থে তার উপর বিদ‘আত শব্দ প্রয়োগ হবে না এবং তা বিদ‘আত ও মুহদাসাত সংক্রান্ত হাদীসের আওতাধীন হবে না। যেমন ধরুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে সফর করেছেন, যানবাহনের আবিষ্কার আজ আপনাকে বিমান আরোহন করাচ্ছে, আপনি বিমান আরোহন করে সফর করছেন। বিমান নব আবিষ্কার। উটের পরিবর্তে আপনি বিমান আরোহন করছেন। এটাকে শরয়ী বিদ‘আত বলা যাবে না। কেননা উট বিমান কোনোটি ইবাদত নয়। এটি একটি বাহন মাত্র। তবে বাহনে সওয়ার হতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দো‘আ পড়তেন, তিনি সফরের যে দো‘আ পড়তেন তা ইবাদত। এই দো‘আর মধ্যে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ নেই। এই দো‘আ তিনি যে পদ্ধতিতে পড়তেন আমাকেও সেই পদ্ধতিতেই পড়তে হবে। যুক্তির আলোকে এখানে কোনো পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। যেমন, উট একটি সাধারণ জন্তু, সে মাটিতে চলে, নবীজী উটে উঠতে এই দো‘আ পড়তেন। আমি আজ আকাশে চড়ছি, এই নেয়ামত অনেক বড়, সুতরাং দো‘আকে একটু বৃদ্ধি করতে হবে। অথবা নবীজী স্বাভাবিকভাবে দো‘আ পড়তেন, কেননা নেয়ামতটি স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আমার নেয়ামতটি অসাধারণ, তাই বিমানে উঠেই সেজদায় পড়ে এই দো‘আ করতে হবে, অথবা সেজদায় পড়ে দো‘আটি পড়লে ছওয়াব বেশি হবে, এজাতীয় চিন্তাধারা সবই ভ্রান্ত। কেননা দো‘আ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গেলেই তা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। মোটকথা : বিদ‘আতের সম্পর্ক ইবাদতের বিষয় ও তার পদ্ধতির সাথে। বস্তুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
জনৈক ব্যক্তি একবার এক বিদ‘আত বিরোধী আলেমকে গিয়ে বললেন : আপনারা সবকিছুই শুধু বিদ‘আত বিদ‘আত করেন, তবে আপনি চশমা পরেছেন কেন? আল্লাহর রাসূল কি জীবনে কখনো চশমা পরেছেন? চশমা তো নবীজীর সময়ে ছিল না, তাহলে এটা কি বিদ‘আত নয়? আলেম বললেন : ভাই, তাহলে তো আপনি নিজেই বিদ‘আত। আপনিও তো নবীজীর সময়ে ছিলেন না। বিদ‘আত না বোঝার কারণেই মাঝে মাঝে এমন কৌতুকের সৃষ্টি হয়। চশমা কোনো ইবাদত নয়। তাই এর সাথে বিদআতের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন লোকটি নিজে কোনো ইবাদত নয়, তাই সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় না থাকা, আবার এখন থাকা বিদ‘আতের বিষয় নয়। যে ইবাদত বা তার পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রমাণিত নয় একমাত্র তার আবিষ্কার শরয়ী পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
[2] আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ইমাম আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস ইবন যাকারিয়া আল-কাযবীনি আর-রাযি, ৩২৯-৩৯৫ হিজরী, ৯৪১-১০০৪ ঈসায়ী।
[3] ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাক্বায়িসিল লুগাহ, মাদ্দাহ ‘ بدع ’, ১/২০৭, লিসানুল আরব, প্রাগুক্ত।
[4] আবু ইসহাক্ব ইবরাহিম ইবনু মুসা আশ-শাত্বিবী আল-মালিকী, ৭৯০ হিজরী, আল-ই‘তিসাম, প্রথম অনুচ্ছেদ, বিদআতের সংজ্ঞা ও তার অর্থ..., ১/২৬।
[5] প্রাগুক্ত।