পূর্ববর্তী উম্মাতের মাঝেও ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ এর কারণেই রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। আর এর কারণেই কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন। আর ন্যায়ের মূল হলো আল্লাহর তাওহীদ বা একত্বতার কথা ঘোষণা করা, আর তাঁর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া। পক্ষান্তরে অন্যায়ের মূল হলো আল্লাহর সাথে শরীক করা ও তাঁকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করা।
আল্লাহর একত্বতা ঘোষণা করা, যা সব চেয়ে বড় ন্যায় কাজ, এর দিকে মানুষকে আহ্বান করার জন্যে, আর আল্লাহর সাথে শির্ক করা যা জঘন্যতম অন্যায় কাজ, তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্যে সকল রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছে। বণী ইসরাঈল, যারা এ ব্যাপারে শীথিলতা করেছিল ও একে বাস্তবায়ন করে নি, তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন:
﴿لُعِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۢ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٧٨﴾ [المائدة: ٧٨]
“বাণী ইসরাঈলের কাফিরদের ওপর দাঊদ ও ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় লা‘নত করা হয়েছে। কারণ তারা নাফরমানী করেছিল ও সীমালঙ্গন করেছিল।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৭৮]
তারপর আল্লাহ এ নাফরমানীর ব্যাখ্যা করেছেন এ বলে যে,
﴿كَانُواْ لَا يَتَنَاهَوۡنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَفۡعَلُونَ ٧٩﴾ [المائدة: ٧٩]
“যে খারাপ কাজ তারা করতো তা থেকে পরস্পর পরস্পরকে বাধা প্রদান করতো না, এরা যাই করতো তা নিশ্চয় খুব খারাপ ছিল।” [সূরা আল-মায়িদা: আয়াত: ৭৯]
এভাবে পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত ‘কারণ তারা নাফরমানী করেছিল ও সীমালঙ্ঘন করেছিল।’ এর ব্যাখ্যা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা পরবর্তী উল্লেখ করলেন যে, “তারা যে সব খারাপ কাজ করতো তা থেকে পরস্পর পরস্পরকে বাধা প্রদান করতো না এরা যাই করতো তা নিশ্চয় খুব খারাপ ছিল।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৭৯] বস্তুত এ ওয়াজিব কাজটি ছেড়ে দেওয়ার পিছনে মহাবিপদ থাকায় এরূপ করা হয়েছে।
অথচ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ যারা করত বনী ইসরাঈলের এক দলের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা সূরা আলে ইমরানে বলেছেন:
﴿لَيۡسُواْ سَوَآءٗۗ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ أُمَّةٞ قَآئِمَةٞ يَتۡلُونَ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ ءَانَآءَ ٱلَّيۡلِ وَهُمۡ يَسۡجُدُونَ ١١٣ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١١٤ وَمَا يَفۡعَلُواْ مِنۡ خَيۡرٖ فَلَن يُكۡفَرُوهُۗ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلۡمُتَّقِينَ ١١٥﴾ [ال عمران: ١١٣، ١١٥]
“আহলে কিতাবের এক দল (হক্বের ওপর) প্রতিষ্ঠিত ছিল যারা রাতের সময়েও আল্লাহ বাণী তিলাওয়াত করতো এবং সাজদাহতেও করতো। আল্লাহ ও কিয়ামতের দিনের ওপর ঈমানও রাখতো, ভালো কাজের হুকুম দিতো আর মন্দ কাজ হতে (মানুষকে) বিরত রাখতো, ভালো কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করতো। আর এরাই সৎ লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের কৃত কোনো ভাল কাজই অস্বীকার করা হবে না আর আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে খুব ভাল জানেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৩-১১৫]
আহলে কিতাবের যারা এটি বাস্তবায়ন করেনি তাদের ওপর যে আযাব এসেছিল সে আযাব এ দলের ওপর আসে নি, তাই আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে তাদের প্রশংসা করেছেন।
আল্লাহর কিতাবের সূরা আত-তাওবার অপর এক আয়াতে আল্লাহ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করাকে সালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত আদায় করার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এটির গুরুত্বের কারণেই এরূপ করা হয়েছে। বস্তুত ন্যায়ের আদেশ করা ও অন্যায়ের নিষেধ করা ফরযে কিফায়াহ, তা সত্বেও এটিকে এ আয়াতে সালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত আদায় করার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন ও বলেছেন:
﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٧١﴾ [التوبة: ٧١]
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তারাই, যাদেরকে আল্লাহ্ অচিরেই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭১]
আল্লাহ এখানে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করাকে সালাত প্রতিষ্ঠা করার আগে উল্লেখ করেছেন যে সালাত ইসলামের স্তম্ভ ও সাক্ষ্যদানদ্বয়ের পর সবচেয়ে বড় রুকন। তারপরও কোন অর্থের কারণে এ ওয়াজিবটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে?
নিঃসন্দেহে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের খুব প্রয়োজন ও তা বাস্তাবয়ন করা খুব বেশি জরুরি, তাই এটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে উম্মাত দুরস্ত ও সঠিক হবে এবং তাদের মাঝে কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে, তাদের মাঝে মর্যাদা প্রকাশ পাবে, তাদের কাছ থেকে হীনতা চলে যাবে, জনগণ কল্যাণ সম্পাদনে সহযোগিতা করবে, পরস্পর উপদেশ দিবে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে, সকল কল্যাণ সম্পাদন করবে, আর সকল অকল্যাণ বর্জন করবে।
ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ ছেড়ে দিলে ও তার ব্যাপারে উদাসীন হলে মহাবিপদ আসবে ও সীমাহীন অকল্যাণ প্রকাশ পাবে, আর উম্মাত বিভক্ত হবে, হৃদয় কঠোর হবে বা মরে যাবে হীনতা প্রকাশ পাবে ও প্রচার হবে এবং মর্যাদা বিলোপ পাবে, আর যে গ্রামে, শহরে, দেশে ও যে স্থানে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করা হবে না সেখানে এটি অবশ্যই পতিত হবে। অবশ্যই সেখানে খারাপ প্রচার হবে, অন্যায়সমূহ প্রকাশ পাবে, বিপদ আপদ ছেয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আল্লাহর উপরই আমাদের ভরসা ও তাঁর কাছেই আমাদের শক্তি।