জাদুকর্ম, জ্যোতিষ ও দৈবকর্ম এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে ইসলামের বিধান - ৩

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত:

«من قرأ آية الكرسي في ليلة لم يزل عليه من الله حافظ ولا يقربه شيطان حتى يصبح»

“যে ব্যক্তি রাতে আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, ভোর হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে তার উপর একজন হেফাযতকারী নিয়োজিত থাকে এবং শয়তান তার নিকটবর্তী হয় না।’’

সহীহ সূত্রে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এও বর্ণিত যে, তিনি বলেন:

»من قرأ الآيتين من آخر سورة البقرة في ليلة كفتاه»

“যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল-বাকারাহ-এর শেষের দু’টি আয়াত পাঠ করবে, ওটাই তার জন্য যথেষ্ট।’’

হাদীসটির মর্মার্থ হলো: “সকল অনিষ্ট হতে তার রক্ষা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট’’।

জাদুর ক্ষতি হতে রক্ষা পাওয়ার দো‘আর মধ্যে আরও রয়েছে- রাতদিন এবং কোনো বসতবাড়ি কিংবা মরুভূমিতে অথবা জলে কিংবা অন্তরীক্ষে অবস্থানের সময় নীচের দো‘আটি বেশি বেশি পাঠ করবে:

«أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ»

“আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ বাণী দ্বারা তাঁর নিকট আমি সৃষ্টির যাবতীয় অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’’।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«من نزل منزلا فقال : أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ لم يضره شيء حتى يرتحل من منزله ذلك»

“যে ব্যক্তি কোনো স্থানে অবতরণ করার পর বলে: ‘আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ বাণী দ্বারা তাঁর নিকট আমি সৃষ্টির যাবতীয় অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’- সে ঐ স্থান থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত কোনো কিছুই তার ক্ষতি কারতে পারবে না’’।

এসব দো‘আর মধ্যে আরও রয়েছে দিবসের প্রথম ভাগে ও রজনীর শুরুতে নীচের দো‘আটি তিনবার পাঠ করা:

«بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ»

“আমি সেই আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যার নামে শুরু করলে আকাশ ও পৃথিবীর কোনো বস্তুই কোনোরূপ অনিষ্ট সাধন করতে পারেনা। বস্তুত তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা’’।

কেননা সহীহ সূত্রানুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং এটাই প্রত্যেক মন্দ থেকে নিরাপদ থাকার কারণ।

এ সকল যিকির ও দো‘আ জাদু ও অনুরূপ অপকর্মের অমঙ্গল থেকে পরিত্রাণ পাবার সর্বোত্তম পন্থা তাদের জন্য যারা সততা, ঈমান, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা সহকারে এবং এসব দো‘আর অর্থের প্রতি আন্তরিকতা রেখে এগুলো চর্চা করে। এ একই দো‘আসমূহ জাদু সংঘটিত হবার পরও জাদুর ক্রিয়া দূর করার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। অবশ্য পাশাপাশি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি বিনয় প্রকাশ এবং বিপদ ও ক্ষতি দূর করার জন্য প্রার্থনা করতে হবে।

আর জাদু ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায়, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত বিশুদ্ধ দো‘আর মধ্যে আরও রয়েছে নিচের দো‘আটি তিনবার পাঠ করা। এটি দ্বারা তিনি তাঁর সাহাবিদেরকে ঝাড়ফুঁক করতেন। দো‘আটি হল:

«اللّٰهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبِ البَأسَ وَاشْفِ أَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا»

“হে আল্লাহ! যিনি মানুষের পালন কর্তা ! বিপদ দূর করে দাও এবং আরোগ্য দান কর। তুমিই আরোগ্য-দাতা। তোমার আরোগ্য দান ছাড়া কোনো আরোগ্য লাভই সম্ভব নয়। এমন আরোগ্য দাও যার পরে আর কোনো রোগ-ব্যাধি থাকবে না’’।

এছাড়া জিবরীল আলাইহিস সালাম যে দো‘আ পাঠ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঝেড়েছিলেন, তা হলো:

«بِسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، وَمِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنٍ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ، بِسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ»

“আল্লাহ্‌র নামে আমি আপনাকে ঝাড়ছি, এমন সকল বস্তু থেকে যা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর প্রত্যেক প্রাণীর অমঙ্গল হতে ও ঈর্ষাকারীর বদ নজর থেকে আল্লাহ আপনাকে শিফা দান করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ছি’’।

এ দো‘আটিও তিনবার পাঠ করতে হবে।

জাদু-ক্রিয়া সংঘটিত হবার পর জাদুর কারণে স্ত্রী সহবাস থেকে বাধাগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য খুবই উপকারী চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে সাতটি সবুজ বরই পাতা নিয়ে পাথর বা অনুরূপ কিছু দিয়ে তা ঘষে কোনো পাত্রে রাখা এবং গোসলের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পানি এতে ঢেলে তাতে আয়াতুল কুরসী, সূরা আল-কাফিরূন, সূরা কুল হুয়াল্লাহু আহাদ, সূরা কুল আ‘উযু বিরাব্বিল ফালাক্ব এবং সূরা ক্বুল আ‘উযু বিরাব্বিন নাস পড়বে। এর সাথে সূরা আল-আ‘রাফ-এর জাদুর আয়াতগুলোও পাঠ করবে। সে আয়াতগুলো হলো:

﴿وَأَوۡحَيۡنَآ إِلَىٰ مُوسَىٰٓ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِيَ تَلۡقَفُ مَا يَأۡفِكُونَ ١١٧ فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١١٨ فَغُلِبُواْ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُواْ صَٰغِرِينَ ١١٩﴾ [الاعراف: ١١٧، ١١٩]

“আর আমি মূসার প্রতি ওহী পাঠালাম, “এবার নিক্ষেপ কর তোমার লাঠিখানা’’। সঙ্গে সঙ্গে তা সে সমুদয়কে গিলতে লাগল যা তারা বনিয়েছিল জাদু বলে। ফলে সত্য প্রমাণিত হলো এবং বাতিল হয়ে গেল তারা যা কিছু করছিল। সুতরাং তারা সেখানে পরাভূত হলো ও লাঞ্ছিত হয়ে ফিরল’’। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১১৭-১১৯]

অনুরূপভাবে সূরা ইউনুস-এর নিম্নলিখিত আয়াতগুলোও পড়বে:

﴿وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ٱئۡتُونِي بِكُلِّ سَٰحِرٍ عَلِيمٖ ٧٩ فَلَمَّا جَآءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰٓ أَلۡقُواْ مَآ أَنتُم مُّلۡقُونَ ٨٠ فَلَمَّآ أَلۡقَوۡاْ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئۡتُم بِهِ ٱلسِّحۡرُۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَيُبۡطِلُهُۥٓ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُصۡلِحُ عَمَلَ ٱلۡمُفۡسِدِينَ ٨١ وَيُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَٰتِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ ٨٢﴾ [يونس: ٧٩، ٨٢]

“আর ফির‘আউন বলল, আমার কাছে নিয়ে এস সুদক্ষ জাদুকরদেরকে। তারপর যখন জাদুকররা এলো, মূসা তাদেরকে বলল: তোমাদের যা কিছু নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা নিক্ষেপ করল, মূসা বলল: যা কিছু তোমরা এনেছ তা সবই জাদু- নিশ্চয় আল্লাহ এসব ভণ্ডুল করে দিবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কাজকে সংশোধন করেন না। আল্লাহ সত্যকে সত্যে পরিণত করেন, যদিও পাপীদের তা মনঃপুত নয়’’। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৭৯-৮২]

পরিশেষে সূরা ত্বাহা-এর নিম্নের আয়াতগুলো পড়বে:

﴿قَالُواْ يَٰمُوسَىٰٓ إِمَّآ أَن تُلۡقِيَ وَإِمَّآ أَن نَّكُونَ أَوَّلَ مَنۡ أَلۡقَىٰ ٦٥ قَالَ بَلۡ أَلۡقُواْۖ فَإِذَا حِبَالُهُمۡ وَعِصِيُّهُمۡ يُخَيَّلُ إِلَيۡهِ مِن سِحۡرِهِمۡ أَنَّهَا تَسۡعَىٰ ٦٦ فَأَوۡجَسَ فِي نَفۡسِهِۦ خِيفَةٗ مُّوسَىٰ ٦٧ قُلۡنَا لَا تَخَفۡ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡأَعۡلَىٰ ٦٨ وَأَلۡقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلۡقَفۡ مَا صَنَعُوٓاْۖ إِنَّمَا صَنَعُواْ كَيۡدُ سَٰحِرٖۖ وَلَا يُفۡلِحُ ٱلسَّاحِرُ حَيۡثُ أَتَىٰ ٦٩﴾ [طه: ٦٥، ٦٩]

“তারা বলল, হে মূসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর, না হয় আমরাই প্রথমে নিক্ষেপ করি। মূসা বলল: বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর। তাদের জাদুর প্রভাবে হঠাৎ তাঁর মনে হলো, যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে। এতে মূসা মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন। আমি বললাম, ভয় পেয়ো না, তুমি বিজয়ী হবে। তোমার ডান হাতে যা আছে তা তুমি নিক্ষেপ কর। তারা যা কিছু করেছে এটা তা গ্রাস করে ফেলবে। তারা যা করেছে তাতো কেবল জাদুকরের কলাকৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না’’। [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৬৫-৬৯]

উপরোক্ত আয়াতসমূহ পানিতে পাঠ করার পর তা থেকে তিন কোষ পরিমাণ পান করবে এবং অবশিষ্টাংশ দিয়ে গোসল করবে। আল্লাহ চাহে-তো এর দ্বারা রোগ দূর হবে। প্রয়োজনে রোগের উপসম হওয়া পর্যন্ত দুই বা ততোধিকবার এ চিকিৎসা গ্রহণ করা যাবে।

জাদুর সর্বোত্তম চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ভূমি, পাহাড় কিংবা অন্য কোথাও জাদুর স্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা। তা জানতে পারলে এবং বের করে নষ্ট করে ফেললে জাদু নিষ্ফল হয়ে যাবে।

জাদু হতে রক্ষা পাওয়ার এবং এর চিকিৎসার এই বিষয়গুলো এখানে বর্ণনা করা হলো। আল্লাহ তাওফিক ও সামর্থ্য দেওয়ার মালিক।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, জাদু-ক্রিয়ার মাধ্যমে জাদুর চিকিৎসা যা কিনা যবেহ কিংবা তদনুরূপ কোনো ইবাদাতের মাধ্যমে জিন্নের নৈকট্য হাসিলেরই নামান্তর- তা কোনোক্রমেই জায়েয নয়। কেননা তা হচ্ছে মূলতঃ শয়তানের কাজ। বরং তা শিরকে আকবার তথা বড় শিরকের অন্তর্গত। অতএব, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

অনুরূপভাবে গণক, দৈব জ্ঞানের দাবিদার ও বাজীকরদেরকে প্রশ্ন করে তাদের বাতিয়ে দেওয়া পদ্ধতি ব্যবহার করার মাধ্যমে জাদুর চিকিৎসা গ্রহণও জায়েজ নাই। কেননা তারা গায়েবী জ্ঞানের দাবি করে এবং মানুষের কাছে তা হেঁয়ালিপূর্ণ করে তুলে ধরে। শুরুতেই বলা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে আসতে, তাদের কাছে কোনো কিছু চাইতে ও তাদেরকে সত্য বলে মানতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত- তাঁকে “নাশরা’’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এটা শয়তানের কাজ। ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ উত্তম সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

‘নাশরা’ হচ্ছে জাদুকৃত ব্যক্তি থেকে জাদুর ক্রিয়া দূর করা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর একথার অর্থ হল জাহেলী যুগের সে ‘নাশরা’ যা লোকজনের মধ্যে প্রচলিত ছিল। আর তা হল— জাদুকরকে জাদু দূর করার জন্য অনুরোধ করা কিংবা অন্য জাদুকরের কাছে গিয়ে অনুরূপ জাদু দিয়ে জাদুর ক্রিয়া নষ্ট করা।

আর শর‘ঈ যিকির ও দো‘আ এবং মুবাহ ঔষধ-পত্র দ্বারা জাদু দূর করায় কোনো অসুবিধা নেই। সে আলোচনা ইতোপূর্বেই করা হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. ও ‘ফাতহুল মাজীদ’ গ্রন্থে শেখ আবদুর রহমান ইবন হাসান রহ. এবং আরও অনেক আলিম এ ধরনের কথাই বলেছেন।

পরিশেষে আল্লাহর কছে প্রার্থনা জানাই মুসলিমদেরকে যেন প্রত্যেক মন্দ ও খারাপি থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দেন এবং তাদের দীনকে হিফাযত করেন, তাদেরকে দীনের জ্ঞান দান করেন এবং শরী‘আত বিরোধী প্রত্যেক বস্তু থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।

ওয়া সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামা ‘আলা ‘আবদিহী ওয়া রাসূলিহী মুহাম্মাদ, ওয়া ‘আলা আলিহী ওয়াসাল্লাম॥