বাংলাদেশ ইসলামের মূল ভূখণ্ড মাক্কাহ মুকাররামাহ ও মদীনা মুনাওয়ারাহ হতে অনেক দূরে অবস্থিত। ইসলাম এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করার পূর্বে এই উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত এই ভূখণ্ডও বহু ঈশ্বরবাদী আকীদার লালনভূমি ছিল। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মূলত তাওহীদবাদী জীবন ব্যবস্থা। একত্ববাদকে কেন্দ্র করেই ইসলামী সংস্কৃতি আবর্তিত হয়। এই ভূখণ্ডের যারা এই জীবন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছিলেন, মূলতঃ তারা ছিলেন অন্য ধর্মাবলম্বী। নিষ্কলুষ একত্ববাদ কেন্দ্রিক ইসলাম এই ভূখণ্ডের জনসাধারণ যখন গ্রহণ করেছিলেন তখন তারা সরাসরি বহু ঈশ্বরবাদী দর্শনকে নিজেদের মন-মস্তিস্ক থেকে সম্পূর্ণভাবে ঝেড়ে ফেললেও তাদের সমাজ-সামাজিকতা, আচার অনুষ্ঠান, কৃষ্টি-সভ্যতার সবকিছু বহু ঈশ্বরবাদী দর্শন মুক্ত হতে পারেনি।[1]
তাছাড়া এ ভূখণ্ডের অনেকেই তাদের পূর্ব পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে মুসলিমও হয়নি। সেজন্য তাদের বহু ঈশ্বরবাদী শির্ক এ ভূখণ্ডে ছিল বেশ জোরদার। সে জন্য বলা যায়, এখানের অনেকেই মুসলিম হলেও এ ভূখণ্ড শির্ক ও বিদআতী আকীদা বিশ্বাসের অক্টোপাশ হতে কখনো পরিপূর্ণ মুক্ত হয়নি। আমাদের সমাজে যে শির্কের ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ আমাদের আশেপাশে বিদ্যমান এই বহু ঈশ্বরবাদ ও শির্কের প্রভাবেরই ফল। পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ও হিমালয় উপমহাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত শির্কের প্রভাবও এ অঞ্চলের মুসলিম সংস্কৃতিতে লক্ষণীয়। এক দিকে চারিপার্শ্বে বহু ঈশ্বরবাদী শির্ক আকিদা বিশ্বাস প্রভাবিত আচার আচরণ, সমাজ সামাজিকতা, নিয়ম পদ্ধতি; অপরদিকে মুসলিম বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় পুরাতন যুগ থেকে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের একটা বড় স্থান শির্ক দখল করে নিয়েছে।[2]
বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞানের স্বল্পতা, মানুষ হিসাবে স্বীয় মর্যাদার ব্যাপারে উদাসীনতা, পূর্ব পুরুষদের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের প্রতি অন্ধ অনুকরণ, ধর্মীয় ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অতিরঞ্জন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল, ভ্রান্ত ধারণার প্রতি অসচেতনতা প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই শির্কের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিস্তারিত এ বিষয়টির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক সংক্ষেপে আলোচিত হল:
>[2] . বাংলার তদানীন্তন মুসলিম শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (মৃত. ১৫১৯ খৃ.) এবং দীনে ইলাহি নমে অনৈসলামী জীবন বিধান প্রবর্তক বাদশাহ আকরব (মৃত ১৬০৫ খৃ.) এর সরাসরি সহযোগিতায় মুসলমানদের মধ্যে মূর্তিপুজা ও অগ্নিপূজার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। বিস্তারিত দেখুন, আকরাম খাঁ, মাওলানা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬ ও ৯৮।