আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রমযানের শেষ দিন রাতে ডেকে বলতেন, হায় আফসোস! আমি তো জানি না, কার আমল কবুল হয়েছে যাকে আমি অভিনন্দন জানাবো, আর কার আমল কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে যাকে আমি সমবেদনা জানাব। হে যার আমল গ্রহণ করা হয়েছে, তোমার জন্য সুসংবাদ, আর হে যার আমল কবুল না হয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, দো‘আ করছি আল্লাহর তোমার মুসিবত দূর করে দিন।

রমযান মাসে ক্ষমা ও মাগফিরাতের অনেক উপকরণ রয়েছে। ক্ষমার অন্যতম উপায় হচ্ছে, রমযানের সাওম পালন করা ও কিয়াম তথা তারাবীহর সালাত আদায় করা, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে সালাত আদায়।

ক্ষমার আরেকটি উপায় হচ্ছে, সাওম পালনকারীদেরকে ইফতার করানো এবং দাস-দাসী ও কর্মচারীর কাজের চাপ কমানো।

তাছাড়া ক্ষমার আরেকটি উপায় হলো, আল্লাহর যিকির করা। কেননা হাদীসে এসেছে, আল্লাহর যিকিরকারী ক্ষমাপ্রাপ্ত এবং তাঁর কাছে প্রার্থনাকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।

ক্ষমার আরেকটি উপায় হলো, আল্লাহর কাছে ইসতিগফার করা, তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করা, আর সাওম পালনকারীর সিয়াম অবস্থায় ও ইফতারির মুহূর্তে করা দো‘আ কবুল করা হয়। ...

ক্ষমার আরেকটি উপায় হলো, সাওম পালনকারীর জন্য ফিরিশতাগণ ইফতার করার আগ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। রমযানে যেহেতু ক্ষমার অনেক উপায় রয়েছে, তাই এত উপায় থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি ক্ষমা পেল না সে প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত। কা‘ব ইবন উজরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বললেন,

«احْضَرُوا الْمِنْبَرَ فَحَضَرْنَا فَلَمَّا ارْتَقَى دَرَجَةً قَالَ: آمِينَ ، فَلَمَّا ارْتَقَى الدَّرَجَةَ الثَّانِيَةَ قَالَ: «آمِينَ» فَلَمَّا ارْتَقَى الدَّرَجَةَ الثَّالِثَةَ قَالَ: آمِينَ، فَلَمَّا نَزَلَ قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَقَدْ سَمِعْنَا مِنْكَ الْيَوْمَ شَيْئًا مَا كُنَّا نَسْمَعُهُ قَالَ: إِنَّ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَرَضَ لِي فَقَالَ: بُعْدًا لِمَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يَغْفَرْ لَهُ قُلْتُ: آمِينَ، فَلَمَّا رَقِيتُ الثَّانِيَةَ قَالَ: بُعْدًا لِمَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ قُلْتُ: آمِينَ، فَلَمَّا رَقِيتُ الثَّالِثَةَ قَالَ: بُعْدًا لِمَنْ أَدْرَكَ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ عِنْدَهُ أَوْ أَحَدُهُمَا فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ قُلْتُ: آمِينَ».

“তোমরা মিম্বার নিয়ে আসো, ফলে আমরা মিম্বার নিয়ে আসলাম। যখন তিনি মিম্বারের প্রথম সিঁড়িতে উঠলেন, বললেন, আমীন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠে আবার বললেন, আমীন। অনুরূপভাবে তৃতীয় সিঁড়িতে উঠে বললেন, আমীন। তিনি মিম্বার থেকে নেমে আসলে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আমরা আজ যা শুনলাম ইতোপূর্বে কখনও এরূপ শুনি নি। তিনি বললেন, জিবরীল আলাইহিস সালাম আমার কাছে আসলেন, তিনি বললেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে রমযান পেলো অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না, আমি বললাম, আমীন। আমি যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠলাম জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যার কাছে আপনার নাম উল্লেখ করা হলো অথচ সে আপনার ওপর দুরুদ ও সালাম পেশ করল না। আমি বললাম, আমীন। আবার আমি যখন তৃতীয় সিঁড়িতে উঠলাম তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে বৃদ্ধ অবস্থায় তার পিতামাতা দু’জনকে বা একজনকে পেল অথচ তাদের সেবা যত্ন করে জান্নাতে যেতে পারল না। আমি বললাম, আমীন।”[1]

কাতাদা রহ. বলেন, বলা হয়ে থাকে যে ব্যক্তি রমযানে ক্ষমা পেল না সে এরপরে আর ক্ষমা পাবে না।... কেননা যে ব্যক্তি রমযানে ক্ষমা পেল না সে কখন ক্ষমা পাবে? যার লাইলাতুল কদরে তাওবা ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার তাওবা কখন কবুল করা হবে? রমযানে সংশোধন না হলে সে কখন সংশোধিত হবে? যার অজ্ঞতা ও অলসতার রোগ রয়েছে সে কখন সে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করবে? কবি বলেছেন:

واختصَّ بالفوزِ بالجنات مَنْ خَدَما
    

رحَّلَ الشَّهرُ وَا لهْفَاهُ وانــــصرمَا

مثلي، فيا ويْحهُ، ياعُظْمَ ما حُــرِما
    

وأصبح الغافلُ المسكينُ منكسرا

تراهُ يحصد إلاّ الهمّ والنَّـــــدَمَـا
    

من فاته الزرعُ في وقت البذارِ فما

রমযান চলে যাচ্ছে, সে শেষ হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যে ব্যক্তি রমযানকে কাজে লাগিয়েছে তার জন্য জান্নাত অবধারিত। আমার মত গাফিল, মিসকীন ভেঙ্গে পড়ছে। তার জন্য আফসোস, সে কত বড় জিনিস থেকে বঞ্চিত। চারা বপনের সময়ই যদি সেটি বপন না করা যায়, তাহলে ফসল তোলার সময় তো দুঃখ-দুশ্চিন্তা আর অনুশোচনা ব্যতীত কিছুই পাবে না।

রমযান মাসের প্রথমে রহমত, মাঝে মাগফিরাত আর শেষে আছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। হাদীসে এসেছে,

«إِذَا كَانَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ».

“রমযান মাস আসলে রহমাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়”।[2]

«وَلِلَّهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ، وَذَلكَ كُلُّ لَيْلَةٍ».

“আর বহু লোককে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ থেকে থাকে”।[3]

তবে রমযানের প্রথম ভাগে রহমতের অংশ বেশি, মধ্য ভাগে মাগফিরাত ও শেষ ভাগে রয়েছে সেসব লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি যারা গুনাহের ভারে জর্জরিত ও যাদের ওপর কবীরা গুনাহের কারণে জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে গেছে।

...

ফিতরের দিন মুসলিম উম্মাহর জন্য ঈদের দিন। কেননা সেদিন সাওম পালনকারী কবীরা গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সেদিন গুনাহগারগণ সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত হয়। এমনিভাবে ইয়াওমুন নাহর তথা কুরবানীর দিন হলো মুসলিমের জন্য বড় ঈদের দিন। কেননা এ ঈদের পূর্বে রয়েছে আরাফার দিন। আর ‘আরাফার দিনে দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু’দিনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে তার জন্য এ দিন দু’টি সত্যিকারের ঈদের দিন; কিন্তু যার মুক্তি মিলবে না তার জন্য এ দিন দু’টি শুধুই পরিতাপ আর শাস্তি ভোগ করার প্রতিশ্রুতির দিন।

ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি যেহেতু রমযানের সাওম পালন ও সালাত আদায়ের সাথে জড়িত, তাই আল্লাহ তাঁর তাকবীর ও শুকরিয়াস্বরূপ দিনগুলো পরিপূর্ণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ١٨٥﴾ [البقرة: ١٨٥]

“আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫] সুতরাং যিনি বান্দাকে সাওম পালন ও সালাত আদায়ে তাওফিক দান করেছেন, এসব কাজে যিনি তাদের সাহায্য করেছেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন তাঁর শুকরিয়া হচ্ছে, তাঁর যিকির করা, তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা এবং যথাযথ তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করা।

ওহে সে ব্যক্তি যাকে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সাবধান তুমি (গোনাহ থেকে) স্বাধীন হওয়ার পরে আবার (গোনাহের) গোলামীর কাতারে ফিরে যেওনা। তোমার মনিব তোমাকে জাহান্নামের কিনারা থেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছেন তুমি কি সেটার কিনারায় উপনীত হতে চাও? তোমার মাওলা তোমাকে সেখান থেকে রক্ষা করেছেন, তুমি কি সেটায় পড়তে চাও? তুমি কি তা থেকে পাশ কাটিয়ে চলবে না?

মুহসিনীন তথা সৎকর্মশীলদের জন্য তাঁর রহমতের অঙ্গিকার থাকলেও পাপীরা তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। তাঁর মাগফিরাত মুত্তাকিনদের জন্য হলেও যালিমগণ তাঁর মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হয় না। কবি বলেছেন:

فمن الذي يرجوُ ويدعو المذنبُ؟
    

إن كانَ لا يرجوكَ إلا مُحسنٌ

তোমার (আল্লাহর) কাছে যদি সৎকর্মশীলরাই পাওয়ার আশা করে, তাহলে গুনাহগাররা কার কাছে গুনাহ মাফের আশা করবে এবং কাকে ডাকবে?

কেন আমাদের রবের কাছে ক্ষমার আশা করে না? আর কেনই বা তাঁর সহিষ্ণুতার প্রত্যাশা করে না?

হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তাঁর বান্দার ব্যাপারে তার মায়ের চেয়েও অধিক দয়াশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًا٥٣﴾ [الزمر: ٥٢]

“বলুন ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫২]

[1] মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৭২৫৬, ইমাম হাকিম রহ. বলেছেন, হাদীসের সনদটি সহীহ, তবে বুখারী ও মুসলিম কেউ উল্লেখ করেননি। ইমাম যাহাবী রহ. সহীহ বলেছেন। আবূ হুরাইরা, আনাস ও জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে অনুরূপ বর্ণনা আছে। দেখুন, তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৪৫। ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৭৯।

[3] তিরমিযী, হাদীস নং ৬৮২, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, এ পরিচ্ছেদে আব্দুর রহমান ইবন ‘আউফ, ইবন মাস‘ঊদ ও সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। ইবন মাজাহ, ১৬৪২। আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। নাসাঈ, ২১০৭।