সব ধরণের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও স্বাধীন স্বেচ্ছামূলক কাজের মূলভিত্তি হলো মনের ইচ্ছা (ঝোঁক) ও চিন্তা-ভাবনা। কেননা এর থেকে কল্পনার সৃষ্টি হয় এবং কল্পনা ইচ্ছার প্রতি আহ্বান করে। ইচ্ছাশক্তি কাজ বাস্তবে সংঘটিত হওয়া কামনা করে। এভাবে বারবার হলে অভ্যাসে পরিণত হয়।
সুতরাং উপরোক্ত স্তরগুলোর সংশোধন মনের ঝোঁক ও চিন্তা-ভাবনা থেকেই শুরু হয়। মনের ঝোঁক ও চিন্তা-ভাবনা ঠিক হলে অবশিষ্ট স্তরগুলো সঠিক হয়। মনের ঝোঁক ও চিন্তা-ভাবনার সংশোধন সর্বদা এর মালিক আল্লাহ তা‘আলার দেখাশুনায় হয়ে থাকে। তাঁর সন্তুষ্ট ও ভালোবাসায় তা বাড়তে থাকে। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলার থেকেই সব কল্যাণ, তাঁর থেকেই সব হিদায়াত, তাঁর তাওফীকেই সব পথনির্দেশনা, তাঁর অভিভাবকত্বেই বান্দার সব সংরক্ষণ ও হিফাযত, তাঁর মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতেই সব ভ্রষ্টতা, দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা। অতএব, আল্লাহর নিদর্শন, নি‘আমত, তাওহীদ, তাঁকে জানার পন্থা, তাঁর ‘উবুদিয়্যাতের পন্থা বুঝা, তাঁকে হাযির (উপস্থিত), বান্দার কাজে সাক্ষ্য ও প্রত্যক্ষদর্শী মনে করা, তার ওপর আল্লাহর পর্যবেক্ষণ, তার মনের সব কামনা, বাসনা, ইচ্ছা ও চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আল্লাহ অবগত আছেন, এটি যখন সে বুঝবে তখন অন্যায় করতে আল্লাহর থেকে লজ্জাবোধ করবে এবং তিনি আবার তার দোষ-ত্রুটি সৃষ্টিকুলের কারো কাছে প্রকাশ করে দেয় কী না সে কারণে তাঁকে ভয় পাবে অথবা সে নিজের মনে লুকায়িত এসব দোষ-ত্রুটি নিয়ে ভাববে যে মানুষ জানতে পারলে তাকে ঘৃণা করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে বান্দার চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা অনুসারে সে কল্যাণ, হিদায়াত ও পথনির্দেশনাপ্রাপ্ত হবে।
জেনে রাখুন, মানুষের মনের কল্পনা ও ওয়াসওয়াসার আনুসঙ্গিকতা চিন্তা-ভাবনার দিকে নিয়ে যায়, অতঃপর চিন্তা-ভাবনা তাকে উপদেশের দিকে নিয়ে যায়, উপদেশ তখন তাকে ইরাদা তথা ইচ্ছার দিকে নিয়ে যায়, অতঃপর, ইচ্ছা তাকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কাজের দিকে নিয়ে যায়, অতঃপর তা দৃঢ় হয়, ফলে তা ‘আদা তথা অভ্যাসে পরিণত হয়। অতএব, মানুষের মনের কল্পনা ও ওয়াসওয়াসাকে দৃঢ় ও পরিপূর্ণ হওয়ার পরে তা বিচ্ছিন্ন না করে মূলের দিকে ফিরানো অধিক সহজ।
তোমার মনের বাসনাকে যদি তুমি তাড়িয়ে দাও তাহলে সে তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে, আর যদি মনের বাসনাকে গ্রহণ করো তখন তা মনের মধ্যে ঘূর্ণয়মান চিন্তা-ভাবনা হিসেবে দেখা দিবে। অতএব, ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করো, তাহলে তা (ইচ্ছাশক্তি) ও চিন্তাশক্তি তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। আর তুমি যদি তাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হও তাহলে তা অন্তরে আকাঙ্ক্ষা ও প্রবৃত্তির সাথে ফিরে যাবে।
সাবধান! শয়তানকে তোমার চিন্তা-ভাবনা ও ইচ্ছাশক্তির স্থানে কাজ করার ক্ষমতা দিওনা; কেননা সে তোমার চিন্তা-ভাবনা ও ইচ্ছাশক্তিকে এমনভাবে নষ্ট করবে যা বুঝা বড় কঠিন। সে তোমার অন্তরে নানা ধরণের ওয়াসওয়াসা দিবে এবং ধ্বংসাত্বক চিন্তা-ভাবনা ঢেলে দিবে। সে তোমার ও তোমার উপকারী চিন্তা-ভাবনার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তোমার অন্তরে প্রভাব বিস্তার করতে ও তোমার ইচ্ছাশক্তিতে মালিকানা বানাতে তুমিই তাকে সাহায্য করেছ।
যার অন্তরে শয়তান বাসা বাঁধে তার সবধরণের চিন্তা-ভাবনা থেকে শয়তান বের হয় না অথবা নানা ধরণের অশ্লীলতা ও হারাম জিনিসের চিন্তা-ভাবনার অধিকারী হয় অথবা এমনসব কাল্পনিক অনুমান করে যার কোনো ভিত্তি নেই অথবা ভ্রান্ত সব চিন্তা-ভাবনার অধিকারী হয় অথবা তার জ্ঞানের পরিধির বাইরে এমন সব জিনিসের চিন্তা করে যা অনুধাবন করা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়, তখন শয়তান তার অন্তরে সেসব কাল্পনিক চিন্তা ঢুকিয়ে দেয় যার কোন কূল-কিনারা নেই এবং সে এর শেষ সীমানায় পৌঁছতে পারে না। তখন তার চিন্তা-ভাবনার ময়দানে সেসব কাল্পনিক বিয়ষগুলো ঘূর্ণায়মান করতে থাকে।
এসব কিছু সংশোধনের উপায় হলো: তুমি তোমার চিন্তা শক্তিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উপকারী ভাবনার কাজে ব্যাপৃত রাখো, যেমন তাওহীদের অত্যাবশ্যকীয় উপাদানসমূহ, তার অধিকারসমূহ, মৃত্যু ও এর পরবর্তী জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশ, কাজের দোষ-ত্রুটি ও তা থেকে উত্তরণের উপায়, ইচ্ছাশক্তি ও প্রত্যয়েয় ক্ষেত্রে তোমার উপকারে আসে এমন সব চিন্তা-ভাবনা করো এবং যেসব জিনিস তোমাকে ক্ষতি করে সেসব জিনিসের ইচ্ছা ছুঁড়ে ফেলো।
‘আরেফীন তথা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী আলিমদের মতে, খিয়ানতের আশা করা ও মনের চিন্তা-ভাবনায় খিয়ানতের কাজ করা অন্তরের জন্য স্বয়ং খিয়ানত করার চেয়েও অধিক মারাত্মক ও ক্ষতিকর। বিশেষ করে অন্তর যখন খিয়ানতের কাজ করে তখন অন্তরে খিয়ানতের আকাঙ্খা করা মানে এ কাজে অন্তরকে ব্যাপৃত রাখা ও খিয়ানতের দ্বারা অন্তরকে ভরে রাখা এবং তার চিন্তা-ভাবনা ও ইচ্ছা সবকিছুই খিয়ানতের হবে।