এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসসমূহ থেকে এমন একটি হাদীস পেশ করব যার মধ্যে মানব জীবনের শেষ মুহূর্তের একটি সূক্ষ্ণ গুণাগুণের বর্ণনা করা হয়েছে। আত্মার স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম বা জান্নাত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আকাশ ও জমিনে একটি দীর্ঘ ও শেষ ভ্রমণের বর্ণনা করা হয়েছে, যতক্ষণ না তার স্থায়ী গন্তব্যস্থল হবে জাহান্নাম বা জান্নাত (শাস্তি অথবা শান্তি)। আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর অনুগ্রহ চাচ্ছি এবং কঠিন শাস্তি ও অসন্তুষ্টির কারণ থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। যে গুণাগুণ এখানে বর্ণনা করতে চাচ্ছি তা মুমিন, কাফির, পরহেজগার, ফাসিকসহ সকল প্রাপ্তবয়স্ক বান্দার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর এটিই সকল শব্দ ও দীর্ঘ বর্ণনাসহ বিস্তারিত তুলে ধরেছি।

বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক আনসারীর জানাযার সালাতের জন্য বের হয়ে কবর পর্যন্ত গেলাম, তখনও মাটি দেওয়া হয় নি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিবলামুখী হয়ে বসলে আমরাও তাঁর পাশে বসলাম। সকলেই এমন নীরবতা অবলম্বন করছে যেন তাদের মাথায় পাখি বসেছে (কোনো নড়াচড়া নেই) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে একটি কাঠি ছিল, যার দ্বারা তিনি মাটিতে দাগ ছিলেন। অতঃপর তিনি একবার আকাশের দিকে আবার মাটির দিকে তাকাতে লাগলেন এবং তাঁর দৃষ্টি একবার উপরের দিকে তুলেন আবার নিচের দিকে নামান, (এভাবে তিনবার করলেন) অতঃপর বললেন, তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। (এ কথাটি দু’বার বা তিনবার বললেন) তারপর বললেন, হে আল্লাহ! কবরের ‘আযাব থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, কথাটি তিনবার বললেন। তারপর বললেন, মুমিন বান্দা যখন ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের দিকে অগ্রসর হয়, তখন তার নিকট সূর্য্যসদৃশ শুভ্র বর্ণের মুখবিশিষ্ট ফিরিশতা জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি নিয়ে আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়ে চোখের শেষ দৃষ্টি দূরত্বে বসে থাকে। অতঃপর মালাকুল মাউত তার মাথার পাশে বসে বলতে থাকে হে পবিত্র আত্মা! অন্য বর্ণনায় হে শান্তিপ্রিয় আত্মা! আল্লাহর ক্ষমা এবং সন্তুষ্টির দিকে বের হয়ে আস। তিনি বলেন, তখন সে আত্মা কলসির মুখ থেকে পানি বের হওয়ার ন্যায় শরীর থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলে মৃত্যুর ফিরিশতা তা হাতে তুলে নেন।

অন্য বর্ণনায় আছে, যখন তার রূহ বের হয় তখন আকাশ ও জমিনসহ সকল ফিরিশতা তার জন্য দো’আ করতে থাকে, সেই সাথে তার জন্য আকাশের সকল দরজা খুলে দেওয়া হলে প্রত্যেক দরজার অধিবাসীগণ আল্লাহর নিকট দো‘আ করে যেন তার রূহটি তাদের নিকট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

মালাকুল মাউত রূহটি হাতে নিয়ে এক মুহুর্তের জন্যও তার হাতে রাখতে পারেন না; বরং সাথে সাথে সেই অপেক্ষাকারী ফিরিশতারা নিয়ে জান্নাতের সুগন্ধি সম্বলিত কাফনে তুলে নেয়। তাই তো আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿تَوَفَّتۡهُ رُسُلُنَا وَهُمۡ لَا يُفَرِّطُونَ﴾ [الانعام: ٦١]

“আমার ফিরিশতাগণ হস্তগত করে নেয়, বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৬১] এবং তা থেকে পৃথিবীতে পাওয়া যায় এমন সর্বোৎকৃষ্ট মিশকের সুগন্ধি বের হতে থাকে। তিনি বলেন, তারপর তা উপরে উঠতে থাকে, যখনই কোনো ফিরিশতার নিকট দিয়ে অতিক্রম করে তখনই সে বলে: এ পবিত্র আত্মাটি কার? তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর যে নামে তাকে ডাকা হতো সে নাম ধরে বলবে: এটি অমুকের ছেলে অমুক, যতক্ষণ না পৃথিবীর আকাশ পর্যন্ত যাবে। সেখানে পৌঁছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য বললে তা খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক আকাশের নৈকট্য লাভকারী ফিরিশতাগণ তার অনুসরণ করবে যতক্ষণ না সপ্তম আকাশ পর্যন্ত পৌঁছাবে। সেখানে পৌঁছার পর আল্লাহ বলবেন, আমার এ বান্দার ঠিকানা ইল্লিয়্যিনে লিখে দাও।

﴿وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا عِلِّيُّونَ ١٩ كِتَٰبٞ مَّرۡقُومٞ ٢٠ يَشۡهَدُهُ ٱلۡمُقَرَّبُونَ ٢١﴾ [المطففين: ١٩، ٢١]

“আপনি জানেন ইল্লিয়্যিন কী? এটি একটি লিপিবদ্ধ দফতর, আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী ফিরিশতাগণ একে প্রত্যক্ষ করবে।” [সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত: ১৯-২১]

তখন তার কিতাব ইল্লিয়্যিনে লেখা হয়। অতঃপর বলা হবে: তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দাও, কেননা আমি তাদেরকে অঙ্গিকার দিয়েছি যে, তা থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং তাতে ফিরিয়ে দিব আবার তা থেকেই পূনরায় উত্তোলন করব।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে তার শরীরে তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, তখন সে তার ফিরে যাওয়া সাথীদের জুতার আওয়াজ শুনতে পাবে। অতঃপর হুংকারকারী শক্তিশালী দু’জন ফিরিশতা এসে তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে প্রশ্ন করবে:

তোমার রব কে?

সে বলবে: আমার রব আল্লাহ।

তারা বলবে: তোমার দীন কি?

বলবে: আমার দীন ইসলাম।

তারা বলবে: তোমাদের নিকট প্রেরিত লোকটি কে?

সে বলবে: তিনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

তারা বলবে: তুমি কীভাবে জানলে?

সে বলবে: আল্লাহর কিতাব পড়েছি, এর ওপর ঈমান এনেছি এবং বিশ্বাস করেছি।

তাকে ধরে জিজ্ঞাসা করে বলবে: তোমার প্রভু কে? তোমার দীন কী? তোমার নবী কে? আর এটিই হবে মুমিন আত্মার ওপর অর্পিত শেষ ফিতনা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا﴾ [ابراهيم: ٢٧]

“আল্লাহ তা‘আলা মুমিন বান্দাদেরকে পার্থিব জীবনে মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত করেন।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৭]

সে বলবে আমার রব আল্লাহ, দীন ইসলাম এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তখন আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন যে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে জান্নাতের পোশাক পরিধান করিয়ে দাও। তিনি বলেন, তখন জান্নাত থেকে সুগন্ধির হাওয়া আসতে থাকবে এবং তার জন্য তার কবরকে চোখের শেষ দৃষ্টি পর্যন্ত প্রশস্ত করে দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন: তার নিকট সুশ্রী সুন্দর পোশাক পরিহিত একজন ফিরিশতা আসবে, অন্য বর্ণনায়: তার বেশ ধরে এসে বলবে: তোমাকে আনন্দিত করবে এমন একটি সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং অসীম শান্তি বিশিষ্ট জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর।

আজ সেই দিন, যেই দিনের অঙ্গিকার তোমাকে দেওয়া হয়েছিল। সে বলবে: আল্লাহ তোমাকে দিয়ে যে সুসংবাদ পাঠিয়েছেন তুমি কে? তোমার চেহারাতো সৌভাগ্যশালী চেহারা। তখন সে বলবে: আমি তোমার ভালো আমল। আল্লাহর কসম! তুমি ছিলে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি অত্যন্ত সজাগ এবং তাঁর নাফরমানীর প্রতি ছিলে নিশ্চল। কাজেই আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন।

অতঃপর তার জন্য জান্নাতের একটি দরজা ও জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দিয়ে বলা হবে: তুমি যদি আল্লাহর নাফরমানী করতে তাহলে তোমার ঠিকানা হতো জাহান্নামে; কিন্তু এর বদলায় তোমাকে জান্নাত দিয়েছেন। যখন সে জান্নাতের নি‘আমত দেখবে তখন বলবে: হে আল্লাহ তাড়াতাড়ি কিয়ামত সংঘটিত কর যেন আমি আমার পরিবার পরিজন এবং ঐশ্বর্য্যে ফিরে যেতে পারি। তাকে বলা হবে: এখানেই থাক, (এটাই তোমার স্থান)।

এ ছিল মুমিন আত্মার বিচরণ, যা আল্লাহ তা‘আলা অনুগ্রহ করে গুরুত্বসহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন, যেন রূহ হাসি খুসিতে আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে পারে; যাকে পৃথিবীতে চিনেছিল এবং যার ইবাদত করেছিল।

এখন আমরা অন্য একটি ভয়ানক ভ্রমণের দিকে যাব, যা হবে খারাপ আত্মার ভ্রমণ বা বিচরণ।