২- রিবা তথা সুদ-এর বিধান, প্রকারভেদ; সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থায় ইসলামের পদ্ধতিসমূহ

ক. রিবা তথা সুদের পরিচিতি:

الربا শব্দটি সাধারণত অতিরিক্ত ও বৃদ্ধি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বলা হয়, ربا المال إذا زاد ونما সম্পদ যখন বৃদ্ধি পায় ও বাড়ে। আবার বলা হয়, أربى على الخمسين زاد পঞ্চাশের বেশি বেড়েছে। তবে সাধারণত সব ধরণের হারাম বেচাকেনাকে রিবা বা সুদ বলা হয়।

ফিকহবিদদের পরিভাষায়:

الزيادة في أشياء مخصوصة.

“নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের মধ্যে অতিরিক্ত গ্রহণ করাকে রিবা বলা হয়”।

অথবা

هو عقد على عوض مخصوص غير معلوم التماثل في معيار الشرع حالة العقد، أو مع تأخير في البدلين أو أحدهما.

“তা এমন এক বিশেষ বিনিময় চুক্তি; যা সংঘটিত হওয়ার সময় শরী‘আতের মাপকাঠি অনুযায়ী সমতা বিধান করা হয় নি। অথবা তা এমন এক বিশেষ বিনিময় চুক্তি; যাতে উভয় জিনিস বাকীতে বা একটি জিনিস বাকীতে বিনিময় করা হয়েছে”।

খ. সুদ হারাম হওয়ার তাৎপর্য:

নিম্নোক্ত অনেক কারণে ইসলাম সুদকে হারাম করেছে:

১- প্রচেষ্টা ও ফলাফলের মধ্যে সামঞ্জস্যতা না থাকা। কেননা সুদ বিনিয়োগকারী যা অর্জন করে ও লাভ করে তা কোনো প্রকার প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও কাজ না করেই পেয়ে থাকে এবং সে ব্যবসায় ক্ষতির ভাগও বহন করে না।

২- সুদ গ্রহীতারা কর্ম বিমুখ হওয়ার কারণে সমাজে অর্থনীতি ধ্বংস হওয়া এবং তারা অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশায় নিজেরা আরাম আয়েশ ও অলসতায় জীবন যাপন করবে এবং ঋণ গ্রহীতাদের ওপর আরো ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিবে।

৩- মানুষের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা না থাকার কারণে সমাজে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী নিঃশেষ হয়ে যাবে। যা সমাজে আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও অন্যকে প্রধান্য দেওয়ার পরিবর্তে সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে, মানুষের মাঝে আমিত্ব তথা অহংকার ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিবে।

৪- সমাজকে উঁচু-নিচু দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত করে দিবে। এক শ্রেণি হবে তাদের সম্পদের দ্বারা সুবিধাভোগী ও নির্যাতনকারী শাসকগোষ্ঠি; অন্যদিকে আরেক শ্রেণি হবে নিতান্ত গরীব-মিসকীন ও দুর্বল, যাদের পরিশ্রম ও কষ্ট অন্যায়ভাবে অন্যরা ভোগ করবে।

গ. রিবা বা সুদের প্রকারভেদ:

আলেমদের কাছে রিবা বা সুদ দু’ধরণের। তা হলো:

১- রিবা নাসীয়া: ‘নাসীয়া’ শব্দের অর্থ বাকী ও বিলম্বের সুদ। সুদসহ ঋণ ফেরত দিতে বিলম্বের বিনিময়ে ঋণ ও ঋণের সুদের ওপর অতিরিক্ত সুদ গ্রহণ করা। একে সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ (রিবা বিল-আজাল) বলা হয়।

২- রিবা ফদল: শাব্দিক অর্থে ফদল (অতিরিক্ত) শব্দটি নকস (কমতি) এর বিপরীত।

পারিভাষিক অর্থে, একই জাতীয় দু’টি জিনিসের মধ্যে একটির বিনিময়ে অতিরিক্ত নেওয়া। যেমন, স্বর্ণের পরিবর্তে সমপরিমাণ স্বর্ণ না নিয়ে অতিরিক্ত স্বর্ণ গ্রহণ করা, এমনিভাবে গমের পরিবর্তে অতিরিক্ত গম নেওয়া ইত্যাদি যেসব জিনিসে প্রচলিতভাবে সুদ হয়ে থাকে। একে বেচাকেনার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ (রিবা আল-বাই‘) বা গোপন সুদ (রিবা আল-খফী) ও বলা হয়।

  • শাফে‘ঈ মাযহাবের লোকেরা তৃতীয় আরেক প্রকারের সুদের কথা বলেছেন, তা হলো ‘হস্তগত করার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ’ (রিবা আলইয়াদ)। অর্থাৎ মূল্য ও বস্তু অথবা দু’টির যেকোনো একটি নগদ গ্রহণ না করে বিলম্বে গ্রহণ করা।
  • কেউ কেউ চতুর্থ আরেক প্রকারের সুদের কথা বলেছেন, তা হলো ঋণ সম্পৃক্ত সুদ (রিবা আলকারদ্ব)। আর তা হলো, বেচাকেনার মধ্যে কোনো উপকারের শর্তারোপ করা।
  • তবে এসব (তৃতীয় ও চতুর্থ) প্রকার সুদ প্রকৃতপক্ষে আলেমদের বর্ণিত উপরোক্ত প্রকারভেদের বাইরে নয়। কেননা তারা যাকে ‘হস্তগত করার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ’ (রিবা আলইয়াদ) বা ‘ঋণ সম্পৃক্ত সুদ’ (রিবা আলকারদ্ব) বলা হয়েছে তা উপরোক্ত দু’প্রকারের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
  • আধুনিক অর্থনীতিবিদরা সুদকে ‘ক্ষয়িষ্ণু সুদ’ (ইসতিহলাকি) ও ‘উৎপাদনশীল বর্ধিষ্ণু সুদ’ (ইনতাজি) এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন।

১- ‘ক্ষয়িষ্ণু সুদ’ (ইসতিহলাকি) হচ্ছে, খাদ্য-দ্রব্য ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় ধ্বংসশীল খাদ্য-দ্রব্য ও ঔষধপত্র ইত্যাদি ক্রয় করতে নেওয়া ঋণের ওপর প্রদত্ত অতিরিক্ত সুদ।

২- ‘উৎপাদনশীল বর্ধিষ্ণু সুদ’ (ইনতাজি) হচ্ছে: উৎপাদন কাজে ঋণের ওপর নেওয়া অতিরিক্ত সুদ। যেমন, ফ্যাক্টরি বানানো বা চাষাবাদ বা ব্যবসায়িক কাজে ঋণ নেওয়া।

  • অর্থনীতিবিদরা সুদকে আরও দু’প্রকারে ভাগ করেছেন। তা হলো:

১- দ্বিগুণ সুদ (মুদ্বা‘আফ): যে লেনদেনে সুদের পরিমাণ অনেক বেশি।

২- সামান্য সুদ (বাসীত): যে লেনদেনে সুদের পরিমাণ অনেক কম থাকে।

ইসলাম সব ধরণের সুদের কারবার হারাম করেছে, চাই তা রিবাল ফদল বা রিবা নাসীয়া হোক, এতে সুদের পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক, ক্ষয়প্রাপ্ত খাদ্য-দ্রব্যে হোক বা উৎপদনশীল কাজে নিয়োজিত হোক। উপরোক্ত সব প্রকারের সুদ আল্লাহর নিম্নোক্ত আয়াতে হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْ﴾ [البقرة: ٢٧٥]

“অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]

ঘ. সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনে ইসলামের পদ্ধতিসমূহ:

সুদের লেনদের থেকে পরিত্রাণ পেতে ইসলাম বিকল্প কিছু পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। সেগুলো নিম্নরূপ:

১- ইসলাম মুদারাবা লেনদেন বৈধ করেছে: ইসলাম সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থা প্রচলনে মুদারাবা তথা অংশীদারিত্ব ব্যবসা জায়েয করেছে। এতে একজনের মূলধন থাকবে এবং অন্যজন ব্যবসায়ে কাজ করবে। আর এভাবে অর্জিত লভ্যাংশ উভয়ের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে পাবে। তবে ব্যবসায়ে ক্ষতি হলে মূলধন বিনিয়োগকারীর ওপর বর্তাবে। আর শ্রমদাতার ওপর ক্ষতির ভাগ বর্তাবে না, যেহেতু তার কষ্ট ও শ্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই সে অর্থের ক্ষতির অংশীদার হবে না।

২- ইসলাম বাই‘য়ে সালাম তথা মূল্য নগদ পরিশোধ আর বস্তু বাকীতে বেচাকেনা বৈধ করেছে: অর্থাৎ কারো নগদ অর্থের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিলে সে উক্ত জিনিসের উৎপাদনের সময় আসার আগে উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে এবং ফিকহশাস্ত্রে বর্ণিত শর্তানুযায়ী বেচাকেনা করা বৈধ।

৩- ইসলাম বাকীতে বেচাকেনা বৈধ করেছে: নগদ বিক্রি মূল্যের চেয়ে বাকীতে বেশি মূল্যে বিক্রি করা জায়েয। মানুষের সুবিধার্থে এবং সুদের লেনদেন থেকে মুক্ত হতে ইসলাম এ বেচাকেনা বৈধ করেছে।

৪- ইসলাম কর্যে হাসানা তথা বিনা লাভে ঋণ প্রদানের জন্য নানা ধরনের সংস্থা হওয়াকে উৎসাহিত করেছে। ব্যক্তি বা সমষ্টি বা সরকারী বা বেসরকারী যেকোনো ধরণের সংস্থাকে এ ঋণের জন্য ইসলাম উৎসাহিত করেছে; যাতে উম্মাতের মধ্যে পরস্পর সামাজিক সহযোগিতা ও দায়ভার বাস্তবায়িত হয়।

৫- ইসলাম ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে, অভাবী ফকীরকে, বিপদগ্রস্ত পথিক প্রভৃতি অভাবী মানুষের প্রয়োজন মিটাতে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে যাকাতের বিধান প্রচলন করেছে।

সমাজে ব্যক্তির প্রয়োজন মিটাতে ও মানুষের সম্মান সংরক্ষণে ইসলাম উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহ খুলে দিয়েছে। এভাবে তার অভাব মিটাতে সে সুউচ্চ উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়, তার প্রয়োজনের সুরক্ষা হয়, কর্ম ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

ব্যাংকের লাভ ও এর হুকুম:

ফায়েদা অর্থ লাভ, বহুবচনে ফাওয়ায়েদ। অর্থনীতিবিদদের মতে ব্যাংকের ফায়েদা বা লাভ মানে নগদ অর্থ। বস্তুত: ব্যাংক ও সমবায়ী বাক্সগুলো আমানত বা জমার অর্থ রাখার বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে বা ঋণ নিলে তার ওপর যে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করে, তাই ব্যংকের দৃষ্টিতে লাভ হিসেবে তারা বর্ণনা করে থাকে।

এটা মূলত রিবা বা সুদ। বরং এটিই আসল সুদ, যদিও ব্যাংক একে লাভ বলে থাকে। নিঃসন্দেহে এ ধরণের লাভ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা কর্তৃক হারাম সুদের অন্তর্ভুক্ত।

ঋণের বিনিময়ে উল্লিখিত অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ হারাম হওয়া সম্পর্কে আলেমদের ইজমা বর্ণিত আছে। তারা যেটাকে কর্জ বা ঋণ বলে থাকে তা আসলে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ.-এর মতে ঋণ নয়। কেননা কর্জের উদ্দেশ্য হলো ইহসান, হৃদ্যতা ও সহযোগিতা করা। অথচ এ ধরণের লেনদেন প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকার বেচাকেনা করা ও শর্তের ভিত্তিকে নির্দিষ্ট মেয়াদে লাভ করা। অতএব, বুঝা গেল ব্যাংক কর্জের বিনিময়ে বা জমাকৃত অর্থের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত লাভ দেওয়া ও নেওয়া করে তাকে পুরোপুরি সুদই বলে। সুদ ও ব্যাংকের লাভ একটি অপরটির নাম মাত্র।