আমরা এখানে তরবিয়তী জ্ঞান সম্পর্কে উদাহরণ স্বরূপ কিছু অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করব, যাতে একজন অভিভাবক, বাবা-মা, মুরব্বী কীভাবে তাদের সন্তানদেরকে বাস্তব কোনো শিক্ষা প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তা‘লীম ও তরবিয়ত প্রদান করতে পারেন। এমন কি তাদের নিজেদের মাঝে যদি এমন কোনো অভ্যাস বা মন্দ স্বভাব থাকে, যা তারা পছন্দ করেন না, তাহলে তা এড়িয়ে কীভাবে তাদের সন্তান ও শিশুদের উত্তম আখলাক চরিত্র শিক্ষা দিতে পারেন। অথবা এমন কোনো গুণ যা অভিভাবকের মধ্যে নেই, অথচ তাদের সন্তানদের তা শিক্ষা দিয়ে উত্তম ও সুন্দর চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে পারেন।
সাধারণতঃ শিশুরা তাদের চতুষ্পার্শ্বের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে অনুসরণ করে থাকে, বিশেষ করে তার পরিবার ও বাবা-মা এবং অভিভাবকদেরকে অনুসরণ করে। কারণ, বাবা-মায়ের ও অভিভাবকের তত্ত্বাবধানেই তারা বড় হতে থাকে। সেখানে যদি বাবা-মা বা অভিভাবকের কোনো খারাপ অভ্যাস থাকে, তাহলে তার সন্তানকে কীভাবে তা এড়িয়ে বা না শিখিয়ে ভালো চরিত্র ও অভ্যাস শিখাতে পারে, সেখানেই তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। যেমন কোনো বাবা-মা যদি ধূমপায়ী হয়ে থাকে, আর সে যদি চুপচাপ বসে ধূমপান করতে থাকে, তাহলে তার সন্তানও অবশ্যই বাবা-মায়ের অনুসরণ করে ধূমপান করতে শুরু করে দিবে। আর যদি শিশুকে শুধুমাত্র এমনিতেই অথবা ধমক দিয়ে নিষেধ করে, তাহলে সেই শিশু সন্তানের ধূমপান বা নিষেধ-কৃত অভ্যাসের প্রতি আরও আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, সে চুপে চুপে গোপনে হলেও ধূমপান করার চেষ্টা করবে। এমনকি এক পর্যায় তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ধূমপান থেকে বিরত রাখা যাবে না। আর যদি বাবা-মা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে, তাকে সঠিকভাবে আদর যত্ন আর স্নেহ-মমতার মধ্য দিয়ে তার সামনেই সিগারেট বা হিক্কা নিয়ে বসে আর তার ছোট শিশুকে এই ধূমপানের ক্ষতিকারক দিকগুলো তার সামনে তুলে ধরে এবং নিজের ভুল স্বীকার করে অনুশোচনার প্রমাণ করে এবং অচিরেই ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করে। আর তার শিশু যদি এ সকল অনুতাপ, ভুলের স্বীকার ও ছেড়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি শুনতে থাকে, তাহলে ঐ শিশু আর ধূমপান করতে যাবে না। তারপরও যদি কাজ না হয়, সুফল না পাওয়া যায় তাহলে সময় সুযোগে সিগারেট অথবা হুক্কার তামাক বা ধোঁয়ার কালো দু’ একটি স্পট বা দাগ তার শরীরে বা সাদা কাপড়ে লাগিয়ে তাকে দেখানোর চেষ্টা করেন আর তাকে বলেন যে এ ধরণের কালো কালো অসংখ্য দাগ ধূমপায়ীদের ভেতরে বুকে ফুসফুসে ইত্যাদিতে লেগে থাকে। দাগ পড়তে পড়তে এগুলোর কার্যক্ষমতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সর্দিকাশি, বুক ব্যথা, যক্ষ্মাসহ নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে। অবশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাহলে ঐ শিশু আর কখনো ধূমপানের কাছে যাবে না। এভাবেই একজন বাবা-মা, অভিভাবক তার সন্তানকে খারাপ ও বদ অভ্যাস থেকে অনায়াসে বিরত রাখতে পারেন।
একজন বাবা-মা, অভিভাবক ও মুরব্বী হচ্ছে সন্তানদের জন্য বা শিশুদের আদর্শ এবং অনুসরণযোগ্য। অনেক সময় বাবা-মা ও অভিভাবক কিছু কিছু আত্মিক ও বাহ্যিক আখলাক চরিত্র নিয়ে অবহেলা করে থাকেন, যা ঠিক নয়। কারণ, এর জন্যই একটি সন্তানের আদর্শ চরিত্র নষ্ট হয়ে ভবিষ্যৎ জীবন হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। যাকে পরবর্তী সময়ে সংশোধন করা বা সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নাও হতে পারে। এজন্য বাবা-মা ও অভিভাবকদেরকে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের উত্তম চরিত্র ও সৎ অভ্যাসে তা‘লীম-তরবিয়ত যথাযথভাবে প্রদান করতে হবে।
এ জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিৎ তাদের সন্তানদের যথোপযুক্ত, আদর-সোহাগ, স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে নিজের কাছে রাখা এবং উত্তম চরিত্র শিক্ষা দেওয়া, বুঝিয়ে সমঝিয়ে খারাপ চরিত্র থেকে বিরত রাখা। সবসময় নিজেদের কাছে রাখা, যাতে তারা খারাপ ও অভদ্র স্বভাবের লোকদের সাথে মিশতে না পারে। তাহলেই তাদেরকে আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে, টিভি বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রোগ্রাম ও অনুষ্ঠান অবলোকন করা। আমরা অনেক সময় পর্যবেক্ষণ করেছি যে, আধুনিক টিভি চ্যানেলগুলোতে অনেক সময় কু-রুচিপূর্ণ ও অশালীন প্রোগ্রাম ও বার্তা প্রচার করে, এমনকি কোনো কোনো সময় আমল-আখলাক চরিত্র বিধ্বংসী প্রোগ্রাম পর্যন্ত প্রচার করে থাকে। আবার কোনো কোনো সময় ভালো প্রোগ্রামের ভেতর দিয়েও মাঝে মাঝে খারাপ প্রোগ্রাম ও কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যা খুব সহজেই ছোটদেরকে প্রভাবিত করে ফেলে। এমতাবস্থায় শিশুদেরকে কীভাবে সঠিক তা‘লীম-তরবিয়ত ও সৎচরিত্র শিক্ষা দেওয়া যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।। একদিকে যেমন টিভি বা টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলো বাদ দেওয়া বা ত্যাগ করা যাচ্ছে না, কারণ আজকের আধুনিক যুগে টেলিভিশন মানুষের জীবনের সাথে মিশে গেছে এবং যুগের চাহিদা-নুযায়ী চ্যানেলগুলোতে, এমন কিছু শিক্ষা, বিনোদন ও সভ্যতা, সংস্কৃতিমূলক প্রোগ্রাম প্রচার করে থাকে যা থেকে দূরে থাকাও কঠিন। অপরদিকে খারাপ ও আসল চরিত্র ধ্বংসকারী প্রোগ্রামগুলো থেকে বেঁচে থাকা যায় না, তাহলে শিশুদেরকে কীভাবে ভালো ও সৎচরিত্রবান রাখা যাবে।
এমতাবস্থায় বাবা, বা অভিভাবকের উচিৎ ও কর্তব্য হচ্ছে প্রোগ্রামের ফাঁকে ফাঁকে শিশুদের ভালো দিকগুলো বুঝিয়ে দেওয়া এবং ভালো দিকগুলোর দিকে ধাবিত করে দেওয়া। প্রোগ্রামের ফাঁকে ফাঁকে তা সম্ভব না হলে প্রোগ্রামের পর তাকে উত্তম চরিত্রের আলোকে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে খারাপ চরিত্রের প্রভাব তার থেকে দূর হয়ে যায়। কারণ, সাধারণত শিশুরা কি দেখল যেটি বড় বিষয় নয়। বরং তাকে কি বুঝানো হলো সেটি বড় বিষয়। তেমনিভাবে শিশুরা বাবা-মা ও অভিভাবকদেরকে অনুকরণ প্রিয় হয়ে থাকে। তাদের কাছে থাকে ও তাদের কথানুযায়ী চলতে ভালোবাসে। এজন্য তাদের কথাই তারা মানে।
আর যে সকল প্রোগ্রামে শুধু খারাপ দিকই রয়েছে সেগুলো থেকে তাদেরকে বিরত রাখতে হবে। তাদেরকে নসিহত উপদেশের মাধ্যমে বুঝিয়ে সুজিয়ে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বিশেষ খারাপ প্রোগ্রাম থেকে বিরত রাখতে হবে। তাদের সঠিক তা‘লীম-তরবিয়তের মাধ্যমে সকল প্রতিকূল ও নেতিবাচক প্রভাবের মোকাবেলা করার যোগ্যতা তৈরি করতে হবে। তাহলে তারা নিজেরাই সে সকল খারাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
তা‘লীম-তরবিয়তের ব্যাপারে আমার এ লেখাটি যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ও গুরুত্ব পাচ্ছে, সে বিষয়টি হচ্ছে ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, গবেষক, মুরব্বী ও পরিশোধকদের চেষ্টা প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রম যা মুসলিম উম্মাহ ও জাতির বাবা মা, অভিভাবকদেরকে সঠিক ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি, মূল্যবোধের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে ও ইসলামী বক্তব্য তুলে ধরার জন্য উৎসর্গ করছে, তাদের সামনে কুসংস্কার, সত্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেছে। তাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সঠিকভাবে তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা প্রদান করতে এবং তাদের চরিত্রবান হিসেবে এবং তাদের আত্মিক ও মানসিক গঠন ও উন্নয়ন করতে সাহায্য-সহায়তা করেছেন। সে দিকটি এ লিখনিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। এ সহায়তার প্রভাব তাদের সন্তানদের মধ্যে পড়েছে তথা গোটা জাতির মধ্যে পড়েছে। তাদের মধ্যে আদল-ইনসাফ, ন্যায়-নীতি, সঠিক ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, ধৈর্য ও ত্যাগ তিতিক্ষা এবং একে অন্যের কল্যাণ কামনার প্রবণতা ইত্যাদি তৈরি হয়েছে।
তবে এখানে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, এ পৃথিবীতে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর লাইব্রেরিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সেখানে শত শত হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ বই পুস্তক তা‘লীম-তরবিয়তের বিষয়ে রয়েছে, যে বই পুস্তকগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের তথাকথিত আদর্শ সম্পর্কে প্রত্যেক বাবা-মা, অভিভাবকদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা ও তা‘লীম-তরবিয়তের পদ্ধতি নিয়ম-নীতি ইত্যাদি শিক্ষা দিচ্ছেন। যার ফলে বাবা মা ও অভিভাবকরা তাদের সন্তান সন্ততি ও শিশুদেরকে সঠিকভাবে তা‘লীম- তরবিয়ত প্রদান করতে পারছেন, তাদের ডাকে ও প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারছেন। কিন্তু আমাদের মুসলিম উম্মাহ ও জাতির ইসলামিক লাইব্রেরিগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে অধিকাংশ লাইব্রেরিতে তা‘লীম-তরবিয়ত বিষয়ক এবং সঠিকভাবে পরিবার গঠন বিষয়ক বই, নেই বললেই চলে। সেখানে দু’ একটি পাওয়া গেলেও তা উল্লেখ করার মত নয়। সেখানে রয়েছে ওয়াজ নসিহত আর উপদেশ ইত্যাদি। অথবা সেখানে রয়েছে সে সকল কিতাব ও বই-পুস্তক, যেগুলো বিবাহ বন্ধন, বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক, অসিয়ত সম্পত্তি বণ্টন ইত্যাদি সম্পর্কীয় ফিকহ ও আইন-কানূন বিষয়ক। সেখানে মানবিক সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্ক তা‘লীম-তরবিয়ত বিষয়ক বই পাওয়া যায় না। অথচ এগুলোর প্রতি উম্মাহ-জাতি ও সকল মানুষ অধিক মুখাপেক্ষী। আইন-কানূন বিষয়ক বই পুস্তকের প্রতি সাধারণ মানুষ এত মুখাপেক্ষী নয়। তাদের যেগুলোর প্রয়োজন নেই, সেগুলো কাজী, বিচারক, হাকিম ও উকিল মুখতারদের জন্য প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ প্রয়োজনে তাদের কাছে যাবে এবং সেখান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সমাধান নিয়ে আসবে।
এজন্য তা‘লীম-তরবিয়ত ও সভ্যতা সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং পরিবার গঠন ও পারিবারিক সম্পর্কের অগ্রগতি সাধনসহ ইত্যাদি নানা বিষয় ও সমস্যাবলীর একটি ইসলামিক সমাজতাত্ত্বিক কার্যকরী সমাধানের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে দিক- দিগন্তের মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সকল চ্যালেঞ্জ আর প্রতিরোধের মোকাবেলা করে ইসলামী তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা দীক্ষা, সভ্যতা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।