এ উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান কতিপয় জাহিলী স্বভাব

 (৮৭) বংশের গৌরব (الفَخْرُ بالأحساب), (৮৮) অন্যকে বংশের ব্যাপারে খোঁটা দেয়া ও নিন্দা করা (الطعن في الأنساب), (৮৯) নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা (الاستسقاء بالأنواء) ও (৯০) মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা (النياحة على الميت)
 

ব্যাখ্যা: এ চারটি জাহিলী সমস্যা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أربع في أمتي من أمر الجاهلية لا يتركونهن: الفخر بالأحساب، والطعن في الأنساب، والاستسقاء بالنجوم، والنياحة على الميت

আমার উম্মতের মাঝে চারটি জাহিলী সমস্যা বিদ্যমান থাকবে যা তারা বর্জন করবে না। বংশের গৌরব, অন্যকে বংশের খোঁটা দেয়া, নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা ও মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা।[1]

৮৭. বংশের গৌরব: পূর্ব পুরুষ ও বাপদাদার মর্যাদা নিয়ে মানুষের অহংকার করা। এটাই জাহিলী দীন। কেননা, জাহিলরা মিনায় একত্রিত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার নাম স্মরণ করার পরিবর্তে পূর্বপুরুষদের মর্যাদা নিয়ে অহংকারী আলোচনা করতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْراً) [البقرة: 200]

তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ। আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যে বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিয়ে দিন। বস্তুত আখিরাতে তার জন্য কোন অংশ নেই (সূরা আল-বাক্বারাহ ২ : ২০০)।

তাই পূর্ব পুরুষ ও বাপদাদার যিকির (স্মরণ) নয়, আল্লাহ তা‘আলার যিকির করাই আবশ্যক।

৮৮. অন্যকে বংশের খোঁটা দেয়া: এভাবে বলা যে, অমুকের কোন মূলই নেই, মূলহীন গোত্রের অমুক। এটাই হচ্ছে অন্যদেরকে নিন্দা করার অর্থ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ) [الحجرات: 13]

হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত (সূরা হুজরাত ৪৯:১৩)।

তাই বংশের গৌরব নয়, কেবল তাক্বওয়ার গৌরব ধর্তব্য। তাক্বওয়া বিনষ্ট হলে বংশের গৌরব কোন কাজে আসবে না। রসূল বলেন,

من بطّأ به عمله لم يسرع به نسبه

যে লোককে তার আমলে পিছনে সরিয়ে দিবে তার বংশ মর্যাদা তাকে অগ্রসর করে দিবে না।[2]

কুরাইশ ও বনী হাশিম বংশে জন্ম গ্রহণ করা এবং রসূল এর পরিবারের সদস্য হওয়া সৎ আমল ব্যতীত কারো জন্য কাজে আসবে না। সৎআমল ও আল্লাহভীতিই কিয়ামতের দিন কাজে আসবে।

৮৯. নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা: নক্ষত্রের উদয় ও অস্ত যাওয়ার প্রভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হয় বলে বিশ্বাস করা। এটাই জাহিলী দীন। কেবল আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় বৃষ্টি হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَهُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ الْغَيْثَ مِنْ بَعْدِ مَا قَنَطُوا وَيَنْشُرُ رَحْمَتَهُ) [الشورى: 28]

আর তারা নিরাশ হয়ে পড়লে তিনিই তখন বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন (সূরা শুরা ৪২:২৮)।

‏তিনিই আল্লাহ যার ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও হিক্বমতের কারণে বৃষ্টি বর্ষণ হয়। যেভাবে ইচ্ছা তিনি যমীনে বৃষ্টি বর্ষণ করেন অথবা যমীনের কোন জায়গায় বৃষ্টি বর্ষণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‏

(وَلَقَدْ صَرَّفْنَاهُ بَيْنَهُمْ لِيَذَّكَّرُوا فَأَبَى أَكْثَرُ النَّاسِ إِلَّا كُفُوراً) [الفرقان: 50]

আর আমি তা তাদের মধ্যে বণ্টন করি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে; তারপর অধিকাংশ লোক শুধু অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে (সূরা ফুরক্বান ২৫:৫০ )।

তাই যে বিশ্বাস করে নক্ষত্রের উদয় অথবা অসেত্ম যাওয়ার প্রভাবে বৃষ্টি বর্ষণ হয়, তার এ বিশ্বাস শিরক। এজন্য তাকে তাওবা করতে হবে। আর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই বৃষ্টি বর্ষণের সম্বোধন করা ওয়াজীব।

৯০. মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করা: এর দ্বারা উদ্দেশ্যে হলো মৃত্যুর সময় উৎকন্ঠিত হয়ে কর্কশভাবে উচ্চ আওয়াজ করা অথবা মৃতের ভাল কর্ম উল্লেখ করে বিলাপ করা। তাই বিলাপ করে কান্নাকাটি করা কাবীরাহ গুনাহ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

النائحة إذا لم تتب قبل موتها، تقام يوم القيامة وعليها سربال من قطران، ودرع من جرب

বিলাপকারী যদি মৃত্যুর পূর্বে তাওবাহ না করে তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তাকে এভাবে উঠানো হবে যে, তার গায়ে আলকাতরার (চাদর) খসখসে চামড়ার ওড়না থাকবে।[3]

তাই বিলাপ করা কাবীরাহ গুনাহ যা জাহিলী কর্ম। এ জন্য ধৈর্য ধারণ ও ছাওয়াবের প্রত্যাশা করা আবশ্যক। তাই কেউ মৃতের জন্য কান্নাকাটিতে অংশ গ্রহণ করবে না। কেননা, মানুষ কান্না দমিয়ে রাখতে সক্ষম নয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুত্র ইবরাহীমের ওফাতের পর তিনি কেঁদে বলেন,

إن العين تدمع، والقلب يحزن، ولا نقول إلا ما يرضي الرب، وإنا بفراقك يا إبراهيم لمحزونون

অশ্রু প্রবাহিত হয় আর হৃদয় হয় ব্যথিত। তবে আমরা মুখে তাই বলি যা আমাদের রব পছন্দ করেন। আর হে ইবরাহীম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা অবশ্যই শোক সন্তপ্ত।[4]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إن الله لا يعذب بدمع العين ولا بحزن القلب، ولكن يعذب بهذا – يعني اللسان – أو يرحم

আল্লাহ তা‘আলা চোখের পানি ও অন্তরের শোক ব্যথার কারণে আযাব দিবেন না। তিনি আযাব দিবেন এর কারণে, (এ বলে) তিনি জিহ্বার দিকে ইঙ্গিত করলেন অথবা এর কারণেই তিনি দয়া করেন।[5]

তাই বিপদগ্রস্থ হলে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কথা বলবে, সে বলবে,

(إنا لله وإنا إليه راجعون)

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। অর্থাৎ আমরা সবাই আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।

আর আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করবে। আর দু‘আ করবে, আল্লাহ যেন ক্ষমা করে দেন এবং বিপদে সাহায্য করেন।উল্লেখিত চারটি বিষয় জাহিলী কর্ম। মানুষের মাঝে এসব জাহিলী কর্ম বিদ্যমান আছে। তাই এ থেকে তাওবাহ করা আবশ্যক। হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় যার মাঝে এসব কর্ম বিদ্যমান থাকবে সে কাফির বলে গণ্য হবে। এসব জাহিলী কর্মকান্ডের কিছু কুফরী আর কিছু অবাধ্যতা হিসাবে গণ্য।

[1]. ছ্বহীহ মুসলিম ৯৩৪।

[2]. ছ্বহীহ মুসলিম ২৬৯৯।

[3]. ছ্বহীহ মুসলিম হা/৯৩৪।

[4]. ছ্বহীহ বুখারী হা/১৩০৩, ছ্বহীহ মুসলিম হা/২৩১৫।

[5]. ছ্বহীহ বুখারী হা/১৩০৪, ছ্বহীহ মুসলিম হা/৯২৪।