আল্লাহ তা‘আলার তাক্বদীরকে অস্বীকার করা

ব্যাখ্যা: সকল বিষয়-বস্তু সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞানই হলো ক্ষমতা। কোন বিষয় বা বস্তুর অস্তিত্ব লাভের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেন। আর লাওহে মাহফুযে তা লেখা থাকে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তা সৃষ্টি করেন। ঈমানের ছয়টি রুকুনের একটি হলো ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখা। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

الإيمان أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر، وتؤمن بالقدر خيره وشره

আল্লাহ, ফেরেশতামন্ডলী, কিতাবসমূহ, রসূলগণ, আখেরাত এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখা হচ্ছে ঈমান।[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ) [القمر:49]

নিশ্চয় আমি সব কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাণ অনুযায়ী (সূরা ক্বামার ৫৪:৪৯)।

ভাগ্য নির্ধারণ আল্লাহ তা‘আলার কর্মসমূহের একটি। মহান আল্লাহ যা নির্ধারণ করেন ও যা চান তার রাজত্বে কেবল তাই ঘটে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাই জানেন, যা ঘটেছে ও ঘটবে। তিনি তার চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে সর্বদা গুণান্বিত। যা কিছু ঘটবে এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা তা লাওহে মাহফুযে লিখে রাখেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا) [الحديد: 22]

যমীনে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে এমন কোন মুসীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। (সূরা হাদীদ ৫৭:২২)। অর্থাৎ আমি তা সৃষ্টি করি।

(إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ) [الحديد: 22]

নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ (সূরা হাদীদ ৫৭:২২)।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

واعلم أن ما أصابك لم يكن ليخطأك لم يكن ليصيبك

তুমি জেনে রাখো তোমার ব্যাপারে যা কিছু ঘটে তা তোমার ভুল কিংবা সঠিকতার কারণে নয়।[2] তিনি আরোও বলেন,

"رفعت الأقلام وجفت الصحف"

কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং ছহীফা লিপিবদ্ধ বন্ধ হয়েছে।[3]

তাই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই ঘটে না। আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু সৃষ্টি করেন কেবল তাই ঘটে। তার বাণী:

(اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ) [الزمر: 62]

আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা (সূরা যুমার ৩৯:৬২)।

তিনি ভাল-মন্দ উভয়ই সৃষ্টি করেন এবং তার ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন নাম করা হয়, এর কতিপয় পর্যায় রয়েছে।

প্রথম: আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু জানেন এ ব্যাপারে বিশ্বাস রাখা।

দ্বিতীয়: আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন।

তৃতীয়: আল্লাহ তা‘আলা যা কিছু ইচ্ছা করেন তা এ জগতে ঘটে। তার ইচ্ছা ব্যতীরেকে কোন কিছুই ঘটে না

চতুর্থ: আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুর স্রষ্টা এবং কর্মবিধায়ক।

এটাকেই বলা হয়, ভাগ্যের প্রতি ঈমান। জাহিলরা ভাগ্য বিশ্বাস করতো না।

জাহিলদের ভাগ্য অস্বীকার করার ব্যাপারে কুরআনের তিনটি আয়াত রয়েছে।

প্রথমত সূরা আন‘আমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلا آبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ) [الأنعام: 148]

অচিরেই মুশরিকরা বলবে, আল্লাহ যদি চাইতেন, আমরা শিরক করতাম না এবং আমাদের পিতৃ-পুরুষরাও না এবং আমরা কোন কিছু হারাম করতাম না (সূরা আন‘আম ৬:১৪৮)। তিনি সূরা নাহলে বলেন,

(وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ نَحْنُ وَلا آبَاؤُنَا وَلا حَرَّمْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ) [النحل: 35]

আর যারা শির্ক করেছে, তারা বলল, যদি আল্লাহ চাইতেন তবে আমরা তাকে ছাড়া কোন কিছুর ইবাদত করতাম না এবং আমাদের পিতৃ-পুরুষরাও না (সূরা নাহাল ১৬:৩৫)। তিনি সূরা যুখরুফে আরোও বলেন,

(وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ)

তারা আরো বলে, পরম করুণাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের ইবাদত করতাম না, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই (সূরা যুখরূফ ৪৩:২০)।

দু’টি কথার উপর ভিত্তি করে আলিমগণ এ আয়াত তিনটির তাফসির করেছেন।

প্রথমত: জাহিলদের এ কথার উদ্দেশ্য হলো ভাগ্য অস্বীকার করা। তারা বলতো, আল্লাহ তা‘আলার যদি ইচ্ছাই থাকতো, তাহলে আমরা এসব কর্ম ছেড়ে দিতাম। তাদের উদ্দেশ্যেই হলো ভাগ্যকে অস্বীকার করা। আর যারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতিরেকে এসব কর্ম করে তারা ভাগ্যকে অস্বীকার করে। তারা নিজেদেরকে এ কর্মসমূহের দিকে সম্পৃক্ত করে এবং নিজেদেরকে স্বাধীন মনে করে। এটা সম্পূর্ণরূপে মু’তাযিলা মতের দৃষ্টান্ত। কেননা তারা বলে: কুফরী, ঈমান, ভাল ও মন্দের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার কোন ইচ্ছা নেই, এসব বান্দারই কর্ম। সুতরাং মু’তাযিলারা জাহিলদের মতই কথা বলে।

দ্বিতীয়ত: তাদের কথা (لو شاء الله ما أشركنا) অর্থ আল্লাহ তা‘আলা চাইলে আমরা শিরক করতাম না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের এসব কর্মের ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছেন। তিনি যদি সন্তুষ্ট না হতেন তাহলে এসব শিরকী আমল করার জন্য তিনি আমাদেরকে ছেড়ে দিতেন না। এভাবে তারা ভাগ্যে বিশ্বাস করে। তাদের কুফরীকে সঠিক বলে প্রমাণ করার জন্য তারা ভাগ্যে বিশ্বাস প্রয়োজন মনে করে।

তাদের ভাগ্যে বিশ্বাস এমন পর্যায় পৌছেছে; যার কারণে তারা বলে, এ শিরকী কর্ম আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য সমতুল্য। কেননা, তিনি চান যে, আমরা তার ইচ্ছার আনুগত্য করি ও ভাগ্যকে মেনে নেই।

দ্বিতীয় কথায় তাদের মন্দ কর্মের উপর তারা ভাগ্যকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করে। আর জাবরিয়্যাদের কথা হলো তাদের মধ্যে থেকে আল্লাহ তা‘আলা এ মন্দ কর্ম চান। আর তাদের মন্দ কর্মকে ভাল সাব্যস্ত করার উপর ভাগ্যকে তারা দলীল হিসাবে পেশ করে বলে, বান্দা তার কর্মের জন্য বাধ্য। এ ব্যাপারে তারাও জাহিলদের উত্তরসূরী। (তাদের কথা) ভাগ্যকে অস্বীকার অথবা বিশ্বাস করা দু’টি অর্থের কোন একটির উপর আয়াতটি প্রমাণ করে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহ তা‘আলার কথাকে দলীল হিসাবে পেশ করে। মহান আল্লাহ তাদের কথাকে প্রত্যাখান করে বলেন,

(قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا) [الأنعام: 148]

বল, তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে ? (সূরা আন‘আম ৬:১৪৮)।

আল্লাহ তা‘আলা কুফরীর ইচ্ছা করেননি এ কথার প্রমাণ কি?

দ্বিতীয় ব্যাখ্যার কথা: আল্লাহ তা‘আলা জাহিলদের এসব মন্দ কর্ম, কুফরী, শিরক ও অশ্লীলতার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন এ কথার দলীল কি? কোথাও কি দলীল আছে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ) [الأنعام: 148، 149] ،

তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে ? তোমরা তো শুধু ধারণার অনুসরণ করছ এবং তোমরা তো কেবল অনুমান করছ। বল, ‘চূড়ান্ত প্রমাণ আল্লাহরই। সুতরাং যদি তিনি চান অবশ্যই তোমাদের সবাইকে হিদায়াত দেবেন (সূরা আন‘আম ৬:১৪৮, ১৪৯)।

আল্লাহ তা‘আলা যাকে চান হেদায়াত দান করেন এবং যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত রয়েছে, তিনি জানেন কে হেদায়াত লাভের উপযুক্ত আর কে উপযুক্ত নয়। অধিক উপযুক্ত ব্যক্তিকেই তিনি হেদায়াত দান করেন। আর জাহিলদের কথাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এভাবে যে, তিনি যদি তাদের মন্দ কর্মের প্রতি সন্তুষ্টই হতেন, তাহলে শিরক অস্বীকার করা ও তাওহীদ মেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি রসূলগণকে পাঠাতেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولاً أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ) [النحل: 36]

আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে (সূরা নাহাল ১৬:৩৬)।

ত্বাগুতের ইবাদত, শিরক ও কুফরী যা তারা ধারণা অনুযায়ী করে যদি তিনি এসবের প্রতি সন্তুষ্ট হতেন তাহলে তা নিষেধ করার জন্য তিনি রসূলগণকে পাঠাতেন না। তাই এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি যদি কুফরী, শিরক, অবাধ্যতা ও মতানৈক্য পছন্দ করতেন তাহলে রসূলগণকে পাঠাতেন না। বরং এসবের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা শত্রুতা পোষণ করেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। সূরা যুখরূফে আল্লাহ তা‘আলা জাহিলদেরকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন,

(مَا لَهُمْ بِذَلِكَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ) [الزخرف: 20]

তারা আরো বলে, পরম করুনাময় আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমরা এদের ইবাদাত করতাম না, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। তারা শুধু মনগড়া কথা বলছে (সূরা যুখরুফ ৪৩:২০)।

(هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا) [الأنعام: 148]

বল, তোমাদের কাছে কি কোন জ্ঞান আছে, যা তোমরা আমাদের জন্য প্রকাশ করবে ? (সূরা আন‘আম ৬:১৪৮)।তারা যা জানে না সে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি তারা মিথ্যা আরোপ করে। এসব ব্যাপারে শরী‘আত, কিতাব ও সুন্নাহর দলীল ছাড়া কথা বলা ঠিক নয়। এ বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ও রায়ের (সিন্ধান্তের) উপর নির্ভর করাও যাবে না।

>
[1]. ছ্বহীহ বুখারী ৫০, ছ্বহীহ মুসলিম ১০।

[2]. আবূ দাউদ, হা/৪৬৯৯-৪৭০০, ইবনে মাজাহ, হা/৭৭।

[3]. ছ্বহীহ: মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৬৯, ছ্বহীহ জামে, হা/৭৯৫৭।