রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (৩) শয়নের যিকর

যিকরের একটি বিশেষ সময় ঘুমানের পূবে বিছানায় শুয়ে। আমরা ইতঃপূর্বে হাদীস শরীফে দেখেছি যে, কেউ যদি কখনো শয়ন করে সেই শয়নের মধ্যে আল্লাহর যিকর না করে তাহলে সেই শয়ন তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إن الرجل إذا آوى إلى فراشه ابتدره ملك وشيطان، فيقول الملك اللهم اختم بخير فقال الشيطان اختم بشر. فإن ذكر الله تعالى ثم نام بات الملك يكلؤه


যখন কোনো মানুষ বিছানায় শয়ন করে তখন একজন ফিরিশতা ও একজন শয়তান তার নিকট আসে। ফিরিশতা বলে, হে আল্লাহ, কল্যাণ ও মঙ্গল দিয়ে এর দিনের সমাপ্তি করুন। আর শয়তান বলে, অমঙ্গলের সাথে এর সমাপ্তি হোক। যদি ঐ ব্যক্তি আল্লাহর যিকর করে নিদ্রা যায় তাহলে সারারাত ঐ ফিরিশাত তাঁকে দেখাশুনা ও হেফাযত করেন।” হাদীসটি সহীহ।[1]

এই সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন প্রকারের যিকর করতেন এবং তিনি উম্মতকে বিভিন্ন যিকর ও দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। দু‘আগুলি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কিন্তু আমাদের জন্য মুখস্থ করা বা পালন করা কষ্ট হবে মনে করে এখানে অল্প কয়েকটি দু‘আ উল্লেখ করছি। এছাড়া কিছু মাসনূন যিকর এখানে উল্লেখ করা হলো।


(১) যিকর নং ১২১ : ১০০ তাসবীহ

৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ , ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’, ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’:

ফাতেমা (রাঃ) নিজের হাতে যাতা ঘুরিয়ে ও সংসারের সকল কর্ম একা করতে কষ্ট পেতেন। আলী (রাঃ) তাঁকে পরামর্শ দেন যে, তোমার আব্বার নিকট যুদ্ধলব্ধ একটি দাসী চাও, যে তোমাকে সংসার কর্মে সাহায্য করবে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে দেখা করতে এসে তাঁকে না পেয়ে ফিরে যান। রাত্রে তাঁরা বিছানায় শুয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের কাছে আসেন। তিনি বলেন, “আমার আসহাবে সুফফার দরিদ্র সাহাবীগণকে বাদ দিয়ে তোমাকে কোনো দাসী দিতে পারব না। তবে দাসীর চেয়েও উত্তম বিষয় তোমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমরা যখন বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ , ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ এবং ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে।”[2]

অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো মুসলিম যদি দু’টি কাজ নিয়মিত করতে পারে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কাজ দু’টি খুবই সহজ কিন্তু করার মানুষ খুব কম। প্রথমত, প্রত্যেক সালাতের পরে ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ ও ১০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে ১৫০ বার জিহ্বার যিকর হবে এবং আল্লাহর কাছে আমলনামায় বা মীযানে ১৫০০ সাওয়াব হবে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় শয়ন করার পরে ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ ও ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এতে মুখে ১০০ বার ও মীযানে ১০০০ বার হবে।” রাসূলুল্লাহ (সা.) আঙ্গুলে

গুণে গুণে তা দেখান। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, “এই দু’টি কর্ম সহজ হওয়া সত্ত্বেও পালনকারী কম কেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “কেউ শুয়ে পড়লে শয়তান এসে এগুলি বলার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সালাতের পরে এগুলি বলার আগেই তাকে তার বিভিন্ন কথা মনে করিয়ে দেয়।” হাদীসটি সহীহ।[3]


(২) যিকর নং ১২২ : আয়াতুল কুরসী

আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কেউ রাতে বিছানায় শয়ন করার পরে আয়াতুল কুরসী পাঠ করলে সারারাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হেফাযত করা হবে এবং কোনো শয়তান তাঁর নিকট আসতে পারবে না।[4]


(৩) যিকর নং ১২৩ : সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত

আবু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কেউ রাতে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করে তাহলে তা তাঁর জন্য যথেষ্ট হবে।[5]


(৪) যিকর নং ১২৪ : সূরা কাফিরূন

নাওফাল আল-আশজায়ী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি সূরা ‘কাফিরূন’ পড়ে ঘুমাবে, এ শির্ক থেকে তোমার বিমুক্তি। হাদীসটি হাসান। এই অর্থে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে আরেকটি হাদীস হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে।[6]


(৫) যিকর নং ১২৫ : সূরা ইখলাস

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নবীজী (সা.) তাঁর সাহাবীগণকে বললেন: তোমরা কি পারবে না রাতে কুরআনের একতৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে? বিষয়টি তাঁদের কাছে কষ্টকর মনে হলো। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কে-ই বা তা পারবে? তখন তিনি বলেনঃ ‘কুল হুআল্লাহু আহাদ্’ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ।’ আবু দারদা (রাঃ) থেকে একই অর্থে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[7]


(৬) যিকর নং ১২৬ :

সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস একত্রে (তিন বার)

দুই হাত একত্র করে এই সূরাগুলি পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে হাত দু’টি যথাসম্ভব শরীরের সর্বত্র বুলানো। - এভাবে ৩ বার।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় গমনের পরে তাঁর মুবারক দু’টি হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন এবং তাতে উপরের তিনটি সূরা পাঠ করতেন। এরপর শরীরের যতটুকু সম্ভব স্থান দুই হাত দিয়ে মোছেহ করতেন। মাথা, মুখ ও শরীরের সামনের দিক থেকে শুরু করতেন। - এভাবে ৩ বার করতেন।”[8]


(৭) যিকর নং ১২৭ :

সূরা বনী ইসরাঈল (কুরআন কারীমের ১৭ নং সূরা)


(৮) যিকর নং ১২৮ :

সূরা সাজদা, (কুরআন কারীমের ৩২ নং সূরা)


(৯) যিকর নং ১২৯ :

সূরা যুমার (কুরআন কারীমের ৩৯ নং সূরা)


(১০) যিকর নং ১৩০ :

সূরা মুলক (কুরআন কারীমের ৬৭ নং সূরা)

জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা সাজদাহ ও সূরা মুলক তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা বানী ইসরাঈল ও সূরা যুমার তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। অন্য হাদীসে আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রাতে সূরা সাজদাহ ও সূরা যুমার পাঠ করতেন। হাদীসগুলি সহীহ।[9]


(১১) ১৩১ নং যিকর : বিশেষ মুনাজাত

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ وَرَبَّ الأَرْضِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْفُرْقَانُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, রাব্বাস সামা-ওয়া-তি ওয়ারাব্বাল আরদ্বি ওয়ারাব্বাল ‘আরশিল ‘আযীম। রাব্বানা- ওয়ারাব্বা কুল্লি শাইয়িন, ফা-লিকিল হাবিব ওয়ান নাওয়া-। ওয়া মুনযিলাত তাওরা-তি ওয়াল ইনজীলি ওয়াল ফুরকা-ন। আ‘ঊযু বিকা মিন শার্রি কুল্লি শাইয়িন আনতা আ-খিযুম বিনা-সিয়্যাতিহী। আল্লা-হুম্মা, আনতাল আউআলু, ফালাইসা ক্বাবলাকা শাইউন। ওয়া আনতাল আ- খিরু ফালাইসা বা’দাকা শাইউন। ওয়া আনতায যা-হিরু ফালাইসা ফাউক্বাকা শাইউন। ওয়া আনতাল বা-তিনু ফালাইসা দূনাকা শাইউন। ইকদ্বি আন্নাদ দাইনা ওয়া আগনিনা- মিনাল ফাক্বর।


অর্থ: “হে আল্লাহ, আসমানসমূহ ও জমিনের প্রভু এবং মহান আরশের প্রভু, আমাদের প্রভু এবং সবকিছুর প্রভু, যিনি অঙ্কুরিত করেন শস্য বীজ ও আঁটি, যিনি নাযিল করেছেন তাওরাত, ইঞ্জিল ও ফুরকান; আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি আপনার কাছে আপনার নিয়ন্ত্রণে যা কিছু রয়েছে সবকিছুর অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে। হে আল্লাহ, আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই শেষ, আপনার পরে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই প্রকাশ্য, আপনার উপরে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই গোপন, আপনার নিম্নে আর কিছুই নেই। আপনি আমাদের ঋণমুক্ত করুন এবং আমাদেরকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছলতা প্রদান করুন।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বিছানায় শয়ন করার পরে (ডান কাতে শুয়ে) এই মুনাজাতটি পাঠ করতে শিক্ষা দিতেন। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, ফাতিমা (রাঃ) তাঁর কাছে খাদিমা চাইলে তিনি তাঁকে দু‘আটি শিখিয়ে দেন।[10]


(১২) যিকর নং ১৩২ :

باسمك ربي وضعت جنبي وبك أرفعه، إن أمسكت نفسي فأرحمها، وإن أرسلتها فاحفظها بما تحفظ به عبادك الصالحين


উচ্চারণঃ বিসমিকা রাব্বী ওয়াদ্বা‘তু জানবী ওয়াবিকা আরফা‘উহু। ইন আমসাকতা নাফসী ফার‘হামহা-। ওয়াইন আরসালতাহা- ফা‘হফাযহা বিমা- তা‘হফাযু বিহী ‘ইবা-দাকাস সালিহীন।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনার নাম নিয়ে আমার পার্শ (বিছানায়) রাখলাম এবং আপনার নামেই তাকে উঠাব। আপনি যদি আমার আত্মাকে রেখে দেন (মৃত্যু দান করেন) তাহলে তাকে রহমত করবেন। আর যদি তাকে ছেড়ে দেন (ঘুমের পরে আবার জেগে উঠি) তাহলে আপনি তাকে হেফাযত করবেন যেভাবে আপনার নেককার বান্দাগণকে হেফাযত করেন।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন বিছানায় শয়ন করতে যাবে তখন নিজের পোশাক দিয়ে হলেও বিছানাটি ঝেড়ে নেবে ... এরপর বলবে : (উপরের দু‘আ)।[11]


(১৩) যিকর নং ১৩৩ : পূর্বোক্ত ৭৮ নং যিকর (তিন বার)

اللهم قني عذابك يوم تبعث عبادك


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ক্বিনী ‘আযা-বাকা ইয়াওমা তাব’আসু ইবা-দাকা।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমাকে রক্ষা করুন আপনার শাস্তি থেকে যেদিন আপনি পুনরুত্থিত করবেন আপনার বান্দাগণকে।”

উম্মুল মমিনীন হাফসা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানর ইচ্ছা করলে তাঁর ডান হাত গালের নিচে রাখতেন। এরপর দু’আটি ৩ বার বলতেন। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) থেকে একই অর্থে আরো হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসগুলির কোনোটি সহীহ কোনোটি হাসান।[12] ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরয সালাতের পরেও এই দু’আটি বলতেন।


(১৪) যিকর নং ১৩৪ :

باسمك ربي وضعت جنبي فاغفرلي ذنبي


উচ্চারণঃ বিসমিকা রাব্বী, ওয়াদ্বা‘অ্তু জানবী, ফাগফির লী যাম্বী।

অর্থঃ “হে আমার প্রভু, আপনারই নামে শয়ন করলাম। আপনি আমার গোনাহ ক্ষমা করে দিন।”

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, নবীজী (সা.) যখন বিছানায় ঘুমের জন্য শয়ন করতেন, তখন উপরোল্লেখিত দু‘আটি বলতেন। হাদীসটি হাসান।[13]


(১৫) যিকর নং ১৩৫ :

باسمك اللهم أموت وأحيا


উচ্চারণঃ বিসমিকা, আল্লা-হুম্মা, আমূতু ওয়া আ‘হইয়া-।

অর্থ: “আপনারই নামে, হে আল্লাহ, আমি মৃত্যু বরণ করি এবং জীবিত হই।”

হুযাইফা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর এরাদা করলে এই যিকরটি বলতেন।[14]


(১৬) যিকর নং ১৩৬

الحمد لله الذي أطعمنا وسقانا وكفانا وآوانا فكم ممن لا كافي له ولا مؤوي


উচ্চারণঃ আল‘হামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্ব‘আমানা- ওয়া সাকা- না-, ওয়াকাফা-না- ওয়া আ-ওয়া- না-। ফাকাম মিম্মান লা- কা-ফিয়া লাহু ওয়ালা- মু‘ওয়ী।

অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে খাদ্য দান করেছেন, পানীয় দান করেছেন, সকল অভাব মিটিয়েছেন এবং আশ্রয় প্রদান করেছেন। কত মানুষ আছে, যাদের অভাব মেটানোর বা আশ্রয় প্রদানের কেউ নেই।”

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বিছানায় শয়ন করতেন তখন এই দু‘আটি বলতেন।[15]


(১৭) যিকর নং ১৩৭ :

(পূর্বোক্ত ১১৫ নং যিকর, সকাল-সন্ধ্যা ১৬ নং)

اللهم عالم الغيب والشهادة فاطر السموات والأرض


আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু বকরকে (রাঃ) উপরের মুনাজাতটি সকালে, সন্ধ্যায় ও বিছানয় শোয়ার পরে পাঠের জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন।


(১৮) যিকর নং ১৩৮ :

اللَّهُمَّ امتِعْنِي بِسَمْعِي، وَبَصَرِي، وَاجْعَلْهُمَا الْوَارِثَ مِنِّي، اللَّهُمَّ انْصُرْنِي عَلَى مَنْ يَظْلِمُنِي، وَخُذْ مِنْهُ بِثَأْرِي اللَّهُمَّ إنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَمِن الْجُوعِ فَإنَّهُ بِئسَ الضَّجيع


উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা, আমতি‘অ্নী বিসমা‘ঈ, ওয়াবাসারী, ওয়াজ্-‘আলহুমাল ওয়া-রিসা মিন্নী। আল্লা-হুমান্-সুরনী ‘আলা- ‘আদুও্ঈ, ওয়া আরিনী ফীহি সা’রী। আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিন গালাবাতিদ দাইনি, ওয়া মিনাল জূ’ই, ফাইন্নাহু বি‘সাদ্দ্বাজী‘য়।


অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমরণ আমার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণ্ণ ও নিরাপদ রাখুন। হে আল্লাহ, আমাকে আমার শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করুন এবং তার জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করে আমাকে দেখান। হে আল্লাহ, আমি ঋণের বোঝা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং ক্ষুধা থেকে ; নিশ্চয় ক্ষুধা অত্যন্ত বাজে সঙ্গী।”

এই দু’আর বাক্যগুলি বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে মুনাজাত করতেন বলে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নববী একটি বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বিছানায় শয়ন করার পরেও এই মুনাজাতটি বলতেন।[16]


(১৯) যিকর নং ১৩৯ : (পূর্বোক্ত ১৮ নং যিকর): ৩ বার

استغفر الله العظيم الذي لا إله إلا هو الحي القيوم وأتوب إليه


উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল্ ‘আযীম, আল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা- হুআল ‘হাইউল কাইঊমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।

অর্থঃ “আমি মহান আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও সর্ব সংরক্ষক, এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি।”


আমরা এই বাক্যটির সাধারণ মর্যাদা ও গুরুত্ব আগেই জেনেছি। সাধারণভাবে সর্বদা এই যিকরটি পালনীয়। ইমাম তিরমিযী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি বিছানায় শয়ন করার সময় এই কথাগুলি ৩ বার বলবে আল্লাহ তাঁর গোনাহসমূহকে ক্ষমা করবেন, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমতুল্য হয়।” আল্লামা ইরাকীর বিবরণ অনুযায়ী হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[17]


(২০) যিকর নং ১৪০ : ঘুমের আগে সর্বশেষ মুনাজাত :

اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ لا مَلْجَأَ وَلا مَنْجَا مِنْكَ إِلا إِلَيْكَ آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, আসলামতু নাফসী ইলাইকা, ওয়াফাওআদ্বতু আমরী ইলাইকা,ওয়া আলজা’তু যাহরী ইলাইকা, রাগবাতান ওয়ারাহবাতান ইলাইকা, লা- মালজাআ ওয়ালা- মানজা- মিনকা ইল্লা- ইলাইকা। আ-মানতু বিকিতা-বিকাল্লাযী আনযালতা, ওয়াবি নাবিয়্যিকাল্লাযী আরসালতা।


অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি সমর্পণ করলাম আমাকে আপনার নিকট, দায়িত্বার্পণ করলাম আপনাকে আমার যাবতীয় কর্মের, আমার পৃষ্ঠকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পিত করলাম, আপনার প্রতি আশা ও ভয়ের সাথে। আপনার নিকট থেকে আপনি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই ও কোনো মুক্তির স্থান নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনি যে কিতাব নাযিল করেছেন তার উপর এবং আপনি যে নবী (সা.) প্রেরণ করেছেন তার উপর।”


বারা ইবনুল আযিব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, “যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন সালাতের ওযুর মতো ওযু করবে। এরপর ডান কাতে শুয়ে বলবেঃ (উপরের বাক্যগুলি)। এই বাক্যগুলি তোমার শেষ কথা হবে (এর পরে আর কোনো কথাবার্তা বলবে না)। যে ব্যক্তি এই দু‘আ পাঠের পরে সেই রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করবে সেই ব্যক্তি ফিতরাতের উপরে (নিষ্পাপভাবে) মৃত্যু বরণ করবে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে কল্যাণময় দিবস শুরু করবে।”[18]


তাহাজ্জুদের নিয়্যাতসহ ঘুমাতে যাওয়া

ঘুমানোর সময় রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায়ের দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে ঘুমাতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ তাহাজ্জুদ আদায়ের নিয়্যাতসহ ঘুমায় কিন্তু রাত্রে ঘুম থেকে উঠতে না পারে, তাহলেও সে তাহাজ্জুদের সাওয়াব লাভ করবে। এসকল হাদীসের একটি হাদীসে আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَنْ أَتَى فِرَاشَهُ، وَهُوَ يَنْوِي أَنْ يَقُومَ فَيُصَلِّيَ مِنَ اللَّيْلِ، فَغَلَبَتْهُ عَيْنُهُ حَتَّى يُصْبِحَ، كُتِبَ لَهُ مَا نَوَى، وَكَانَ نَوْمُهُ صَدَقَةً عَلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ


“যদি কেউ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করবে বলে নিয়্যাত করে ঘুমায়, কিন্তু তার ঘুমের আধিক্যের কারণে ভোরের আগে (ফজরের আগে) উঠতে না পারে, তাহলে তাঁর নিয়্যাত অনুসারে সাওয়াব তাঁর জন্য লিখা হবে, আর তাঁর ঘুম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর জন্য দান হিসাবে গণ্য হবে।” হাদীসটি সহীহ।[19]


রাত্রে ঘুম না হলে বা ঘুম ভেঙ্গে গেলে যিকর

রাত্রে যে কোনো সময় ঘুম ভাঙ্গলে তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়, তবে শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদ আদায় উত্তম। রাতে ঘুম ভাঙ্গলে শোয়া অবস্থায় উপরে উল্লেখিত ৩৫ নং যিকরটি (সকালের প্রথম যিকর) পাঠ করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে নিজের জাগতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে প্রার্থনা করতে হবে। এভাবে শুয়ে শুয়ে যিকর ও মুনাজাত করতে করতে আবার ঘুম এসে যাবে। আর তাহাজ্জুদের ইচ্ছা হলে তাহলে নিম্নলিখিতভাবে তাহাজ্জুদ আদায় করতে হবে।

1] সহীহ ইবনু হিব্বান ২/৩৪৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২০, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৮০-৩৯০, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৪১।

[2] সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩, ৩/১৩৫৮, ৫/২০৫১, ৫/২৩২৯, নং ২৯৪৫, ৩৫০২, ৫০৪৬, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৯১, নং ২৭২৭, ফাতহুল বারী ১১/১২০।

[3] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১৬, নং ৫০৬৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/৩৫৪, সহীহুত তারগীব ১/৩২১-৩২২।

[4] সহীহ বুখারী ২/৮১২, ৩/১১৯৪, ৪/১৯১৪, নং ২১৮৭, ৩১০১, ৪৭২৩।

[5] সহীহ বুখারী ৪/১৪৭২, ১৯১৪, ১৯২৩, ১৯২৬, নং ৩৭৮৬, ৪৭২২, ৪৭৫৩, ৪৭৬৪, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৪-৫৫৫, নং ৮০৭।

[6] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭৪, নং ৩৪০৩, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১৩, নং ৫০৫৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৭০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২১, নাবাবী আল-আযকার, পৃ. ১৩৯।

[7] সহীহ বুখারী ৪/১৯১৬, ৪৭২৭, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৬, নং ৮১১।

[8] সহীহ বুখারী ৪/১৯১৬, নং ৪৭২৯, ৫/২১৬৫, ২১৬৯, ২১৭০।

[9] সুনানুত তিরমিযী ৫/১৮১, নং ২৯২০, নাসাঈ, আমালুল ইয়াওম, পৃ. ৪৩১, মুসনাদ আহমাদ ৩/৩৪০, মুসনাদ আবী ইয়ালা ৮/১০৬, ২০৩, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ২/৮৭৯, নং ৪৮৭৩, ৪৮৭৪।

[10] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৩।

[11] সহীহ বুখারী ৫/২৩২৯, নং. ৫৯৬১, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৪।

[12] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১০, নং ৫০৪৫, সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭১, নং ৩৩৯৮, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৭০-৩৭১, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৩৭।

[13] মুসনাদ আহমাদ ২/১৭৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২৩।

[14] সহীহ বুখারী ৫/২৩৩০, নং ৫৯৬৫।

[15] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৫, নং ২৭১৫।

[16] মুসতাদরাক হাকিম ২/১৫৪, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৭২, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৪২।

[17] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭০, নং ৩৩৯৭, আল-আযকার, পৃ. ১৩৯-১৪০, ইমাম গাযালী, এহইয়াউ উলূমুদ্দিন ২/৩৬৯।

[18] সহীহ বুখারী ১/৯৭, নং ২৪৪, ৫/২৩২৬, নং ৫৯৫২, ৫/২৩২৭, নং ৫৯৫৬, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮২, নং ২৭১০।

[19] সুনানুন নাসাঈ ৩/২৫৮, নং ১৭৮৭, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪২৬, নং ১৩৪৪, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ২/১৯৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪৫৫, সহীহুত তারগীব ১/৩১৮।