রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
তৃতীয় প্রকার যিকর - দ্বিতীয় পর্ব : দিবসের যিকর-ওযীফা - (১) কর্মব্যস্ত অবস্থার যিকর

উপরে আমরা সকালের যিকরের আলোচনা করেছি। একজন মুমিন এভাবে আল্লাহর যিকর ও দু‘আর মাধ্যমে তার দিনের শুভ সূচনা করবেন। এরপর স্বভাবতই তাকে কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। সারাদিন ও রাত্রের কিছু অংশ আমাদের বিভিন্ন কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ অনুসারে আমাদের চেষ্টা করতে হবে, সকল ব্যস্ততার মধ্যেও যেন আমাদের জিহ্বা আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত থাকে।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা সর্বদা পালনের জন্য বিভিন্ন প্রকার মাসনূন যিকর আলোচনা করেছি, যে সকল যিকর বেশি বেশি পালনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) উৎসাহ প্রদান করেছেন। যেমন,- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘সুব‘হানাল্লাহ’, ‘আল-‘হামদু লিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা- হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ’, ‘আল্লাহুম্মা আস’আলুকাল আফিয়্যাহ’ ইত্যাদি বাক্য।

সকল কাজের ফাঁকে, বিশেষত যখন মুখের কোনো কাজ থাকে না তখন যথাসম্ভব মনোযোগ দিয়ে চুপি চুপি এ সকল যিকরে আমাদের জিহ্বাগুলিকে আর্দ্র রাখা প্রয়োজন। এছাড়া নিজের জীবনে আল্লাহর অশেষ রহমতের ও নিয়ামতের কথা স্মরণ করা, মনের মধ্যে কৃতজ্ঞতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলা, মনকে আল্লাহর দিকে রুজু করে মনে মনে আল্লাহর কাছে নিজের দুনিয়া বা আখেরাতের জন্য প্রার্থনা করা, আল্লাহর বিধান, জান্নাত, জাহান্নাম, মৃত্যু, আখিরাত, আল্লাহর মহান রাসূল (সা.), তাঁর সাহাবীগণ ও অন্যান্য নেককার বুজুর্গগণের কথা মনে মনে চিন্তা করাও আল্লাহর যিকরের অন্তর্ভুক্ত। অযথা নীরবে বসে আকাশ-কুসুম কল্পনা করা, মনের বিরক্তি, কষ্ট বা ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি উদ্দীপক চিন্তা করা, অন্যান্য মানুষের দোষত্রুটি নিয়ে চিন্তা করে নিজের মন, আত্মা ও আখেরাত নষ্ট করার চেয়ে এগুলি অনেক ভালো।


প্রিয় পাঠক, আমাদের মুখ ও বিশেষ করে মন কখনই চুপ থাকে না। কোনো না কোনো কিছু নিয়ে মন ব্যস্ত থাকে। সাধারণত ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা অবসর সময়ে, কখনো কখানো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস চিন্তা করে থাকি। আর একটু সুযোগ পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ সকল বিষয় নিয়ে গল্প, আলোচনা বা বিতর্ক করে সময় নষ্ট করি। আমরা একটু ভেবে দেখি না যে, আমাদের এই অলস চিন্তা বা অর্থহীন আলোচনা, বিতর্ক আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক বা জাতীয় জীবনে কোনো উপকারেই লাগছে না। বরং এগুলি আমাদের প্রভূত ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি অপ্রয়োজনীয় চিন্তা, ব্যথা, বিরক্তি, ক্রোধ, জিদ, হিংসা ইত্যাদি আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত ও কলুষিত করে। সাথে সাথে আমরা আল্লাহর যিকর করে অগণিত সাওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই।


একটু চেষ্টা করলেই আমরা এই ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। মুখ বা মনের অবসর হলেই তাকে আল্লাহর যিকরে রত করি। অনেক সময় বেখেয়ালে মন বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অলস চিন্তায় মেতে উঠে। যখনই খেয়াল হবে তখনই সেগুলিকে মন থেকে বের করে আল্লাহর যিকরে মুখ ও মনকে বা শুধু মনকে নিয়োজিত করুন। যেমন, আপনি সকালে সংবাদ শুনেছেন বা পড়েছেন - অমুক স্থানে বোমাবর্ষণ হয়েছে বা অমুক ব্যক্তির মৃত্যু, শাস্তি, পদোন্নতি বা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার চিন্তা বা আলোচনা উক্ত বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনবে না। তবুও ভাবতে ভালো লাগে। আপনি অফিসে, দোকানে, গাড়িতে, বাড়িতে বা পথে-ঘাটে নিজের অজান্তে ঐ বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে থাকবেন। এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় সাঁতার কাটতে থাকবেন। অর্থহীন সময় নষ্ট করবেন। একটু অভ্যাস করুন। বারবার মনকে আল্লাহর যিকরের দিকে ফিরিয়ে আনুন। ইনশা আল্লাহ, এক সময় আপনি আল্লাহর প্রিয় যাকিরে পরিণত হবেন।


একটি উদাহারণ বিবেচনা করুন - এক ব্যক্তি ঢাকায় থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি খুলনা। গ্রামের বাড়িতে তার কোনো নিকট আত্মীয়ের কঠিন অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। ঢাকা থেকে খুলনা পৌঁছাতে তার ৮/৯ ঘণ্টা সময় লাগবে। এই দীর্ঘ সময় তিনি স্বভাবতই অত্যন্ত উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটাবেন। সারা সময় তার মনে বিভিন্ন অমঙ্গল-চিন্তা ঘুরপাক খাবে। কথা বললেও তিনি এই বিষয়ে বিভিন্ন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে কথা বলবেন।

কিন্তু তার এই উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, অমঙ্গল চিন্তা কি তার বা তার অসুস্থ আপনজনের কোনো উপকারে লাগবে? কখনোই না। তিনি মূলত পুরো সময়টি নেতিবাচক চিন্তা করে নষ্ট করছেন। তিনি নিজের মনকে নষ্ট করছেন। সর্বোপরি আল্লাহর যিকরের অমূল্য সুযোগ তিনি নষ্ট করছেন। এই সময় যদি তিনি সকল দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আল্লাহর যিকরে কাটাতেন, অথবা দু‘আর মধ্যে সময় অতিবাহিত করতেন, তাহলে তিনি সকলদিক থেকে লাভবান হতেন।


আসলে আমরা অধিকাংশ সময় অলস বা অপ্রয়োজনীয় চিন্তা অথবা ভিত্তিহীন দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা বা অমঙ্গল-চিন্তা করে সময় নষ্ট করি। একটু অভ্যাস করলে আমরা এসকল মূল্যবান সময় আল্লাহর যিকরে ব্যয় করে জাগতিক, মানসিক ও পারলৌকিকভাবে অশেষ লাভবান হতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক প্রদান করেন ; আমীন।


মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বারংবার বেশি বেশি আল্লাহর যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (الذاكرين الله كثيرا والذكرات) বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারী পুরুষ ও নারীগণের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও পুরস্কারের ঘোষণা প্রদান করেছেন। দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর করা মুমিনগণের বিশেষ পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বেপরোয়াভাবে বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারীগণকে সবচেয়ে অগ্রগামী মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষ বলে ঘোষণা করেছেন। আসুন আমরা সকলেই চেষ্টা করি এদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার।

মহান আল্লাহর পবিত্র দরবারে আমাদের সকাতর আরজি যে, তিনি দয়া করে আমাদের অলসতা, অবহেলা ও দুর্বলতা ক্ষমা করেন এবং আমাদেরকে তাঁর নবীর (সা.) সুন্নাত অনুসারে বেশি বেশি যিকর করার তাওফীক দান করেন; আমীন।