রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
তৃতীয় প্রকার যিকর : সকাল-বিকাল বা সকাল-সন্ধ্যার যিকর - (৪) যিকর নং ১০৩ হইতে (১৫) যিকর নং ১১৪ পর্যন্ত

(৪) যিকর নং ১০৩: (সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ৩ বার করে)

মু’আয ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ وَالمُعَوِّذَتَيْنِ حِينَ تُمْسِي وَتُصْبِحُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ تَكْفِيكَ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ


“তুমি যদি সকালে ও সন্ধ্যায় তিন বার করে এই তিনটি সূরা পাঠ কর তবে তোমার আর কিছুরই দরকার হবে না।” হাদীসটি সহীহ।[1]

(৫). যিকর নং ১০৪ : (পূর্বোক্ত ৫ ও ৭ নং যিকর) ১০০/ ১০০০ বার

‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ অথবা ‘সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী’।

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কেউ সকালে ও সন্ধ্যায় ১০০ বার করে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ বলে, তাহলে তার চেয়ে বেশি না বলে কেউ তার চেয়ে বেশি আমল নিয়ে কিয়ামতের দিন উপস্থিত হতে পারবে না।” অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, “ঐ ব্যক্তির গোনাহ যদি সমুদ্রের ফেনার চেয়েও বেশি হয়, তাহলেও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।” কোনো কোনো বর্ণনায় যিকরের শব্দটি ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’-র পরিবর্তে ‘সুবহানাল্লাহিল আযীম ওয়া বিহামদিহী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটি সহীহ।[2]

একটি যয়ীফ হাদীসে সকালে ১০০০ বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ পড়ার কথা আছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এই যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ১০০০ বার এই যিকর পাঠ করবে সে ঐদিনের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে নিজেকে কিনে নিল। দিনের শেষ পর্যন্ত সে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি লাভ করল।[3]


(৬) যিকর নং ১০৫ : (তিন বার)

سبحان الله وبحمده ، عدد خلقه ، ورضا نفسه ، وزنة عرشه ، ومداد كلماته


উচ্চারণঃ সুব‘হা-নাল্লা-হি ওয়াবি‘হামদিহী, ‘আদাদা খালক্বিহী, ওয়ারিদ্বা-নাফসীহী, ওয়া যিনাতা ‘আরশিহী ওয়া মিদা-দা কালিমাতিহী।

অর্থ: “পবিত্রতা আল্লাহর এবং প্রশংসা তাঁরই, তাঁর সৃষ্টির সম সংখ্যক, তার নিজের সন্তুষ্টি পরিমাণে, তাঁর আরশের ওজন পরিমাণে এবং তাঁর বাক্যের কালির সমপরিমাণ।”

উম্মুল মুমিনীন জুআইরিয়্যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজরের সালাতের পরে তাঁকে তাঁর সালাতের স্থানে যিকর রত অবস্থায় দেখে বেরিয়ে যান। এরপর তিনি অনেক বেলা হলে দুপুরের আগে ফিরে এসে দেখেন তিনি তখনও ঐ অবস্থায় তাসবিহ তাহলীলে রত রয়েছেন। তিনি বলেন, “তুমি কি আমার যাওয়ার সময় থেকে এই পর্যন্ত এভাবেই যিকরে রত রয়েছ?” তিনি বললেন: “হ্যাঁ।” তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ “আমি তোমার কাছ থেকে বেরিয়ে চারটি বাক্য তিন বার করে বলেছি (উপরের বাক্যগুলি)। তুমি সকাল থেকে এই পর্যন্ত যত কিছু বলেছ সবকিছু একত্রে যে সাওয়াব হবে, এই বাক্যগুলির সাওয়াব সেই একই পরিমাণ হবে।”[4]


ইমাম তিরমিযী অনুরূপ ঘটনা উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেছেন। উক্ত বর্ণনায় সাফিয়্যাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে এসে দেখেন আমার সামনে চার হাজার বিচি রয়েছে যা দিয়ে আমি তাসবীহ বা সুবহানাল্লাহর যিকর করছি। তিনি বললেনঃ তুমি কি এতগুলির সব তাসবীহ পাঠ করেছ? আমি বললামঃ “হাঁ।” তখন তিনি তাকে উপরের যিকরের অনুরূপ বাক্য শিখিয়ে দেন।[5]

এ সকল হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, উপরের বাক্য চারটি তিনবার বলা এই দীর্ঘ সময়ব্যপী তাসবীহ, দু‘আ ও কিরাআতের সমান সাওয়াবের। যিকরের অর্থের প্রশস্ততা, ব্যপকতা ও গভীরতার কারণে এই সাওয়াব বৃদ্ধি। সর্বাবস্থায় মুমিনের অবসর ও ক্বালবী প্রস্তুতি থাকলে এ সকল যিকরের সাথে সাথে অন্য সকল যিকর এই সময় করবেন। এতে অতিরিক্ত সাওয়াব ছাড়াও মানসিক প্রশান্তি, বরকত ও সংঘাতময় কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় রাগ, হিংসা ও পাপের মধ্যে নিপতিত হওয়ার বিরুদ্ধে আত্মিক শক্তি অর্জিত হয়। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করে নিন।


(৭) যিকর নং ১০৬ : দরুদ শরীফ ১০ বার

উম্মু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

من صلى عليَّ حين يصبح عشرا وحين يمسي عشرا أدركته شفاعتي يوم القيامة


“যে ব্যক্তি সকালে দশ বার ও সন্ধ্যায় দশ বার আমার উপর সালাত পাঠ করবে, সে কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত লাভ করবে। হাদীসটি সহীহ।”[6]

যে কোনো শব্দে সালাত আদায় করা যেতে পারে। যেমন, -

اللهم صل على محمد النبي الأمي واله وسلم


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্ম সাল্লি ‘আলা- মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্ম্যিয়্যি ওয়া আ-লিহী ওয়া সাল্লিম।

অর্থঃ “হে আল্লাহ আপনি সালাত প্রদান করুন উম্মী নবী মুহাম্মাদের উপর ও তাঁর বংশধর-অনুসারীদের উপর এবং আপনি সালামও প্রেরণ করুন।”

রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক শেখানো সর্বোত্তম দরুদ ‘দরুদে ইবরাহীমী’। আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, প্রায় ১০ জন সাহাবী থেকে সহীহ সনদে ‘দরুদে ইবরাহীমী’ বর্ণিত হয়েছে। (২৩ নং যিকর)


(৮) যিকর নং ১০৭ : (সকাল-সন্ধ্যার যিকর: ৩ বার)

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ


উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হিল লাযী লা- ইয়াদুর্‌রু মা‘আ ইসমিহী শাইউন ফিল আরদি ওয়া লা- ফিস সামা-ই, ওয়া হুআস সামীউল আলীম।

অর্থঃ “আল্লাহর নামে (আরম্ভ করছি), যাঁর নামের সাথে জমিনে বা আসমানে কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারে না।”


উসমান (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কোনো বান্দা সকালে ও সন্ধ্যায় তিন বার করে এই দু’আটি পাঠ করে তবে ঐ দিনে ও ঐ রাতে কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না।” হাদীসটি সহীহ।[7]


(৯) যিকর নং ১০৮ : (সকাল-সন্ধ্যার যিকর: ৭ বার)

حَسْبِيَ اللَّهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ


উচ্চারণঃ হাসবিয়াল্লা-হু, লা- ইলাহা ইল্লা- হুআ, ‘আলাইহি তাওয়াক্কালতু, ওয়া হুআ রাব্বুল ‘আরশিল আযীম।

অর্থ: “আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, আমি তাঁরই উপর নির্ভর করেছি, তিনি মহান আরশের প্রভু।”


উম্মু দারদা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় ৭ বার এই আয়াতটি পাঠ করবে আল্লাহ তাঁর সকল চিন্তা, উৎকণ্ঠা ও সমস্যা মিটিয়ে দেবেন।” হাদীসটির সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।[8]


(১০) যিকর নং ১০৯ : (সকাল-সন্ধ্যার যিকর: ৩ বার)

رَضِيتُ بِاللهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا


উচ্চারণঃ রাদীতু বিল্লা-হি রাব্বান, ওয়া বিল ইসলা-মি দীনান, ওয়া বিমুহাম্মাদিন নাবিয়্যান।

অর্থ: “আমি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে ও মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসাবে গ্রহণ করে আমি সন্তুষ্ট ও খুশি হয়েছি।”


মুনাইযির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালে এই বাক্যগুলি বলবে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করছি যে, তাঁর হাত ধরে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাব।” হাফিয হাইসামী হাদীসটির সনদকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন।[9]


অন্য হাদীসে আবু সাল্লাম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কোনো ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় এই বাক্যগুলি বলে, তাহলে আল্লাহর উপর হক্ক (নিশ্চিত) হয়ে যায় যে, তিনি উক্ত ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট ও খুশি করবেন।” মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় এই দু‘আটি সকালে ৩ বার এবং বিকালে ৩ বার বলার নির্দেশ রয়েছে। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। ইবনু আব্দিল বার, বুসীরী, হাইসামী প্রমুখ মুহাদ্দিস সনদটিকে সহীহ বলেছেন, বিশেষত মুসনাদে আহমাদের সনদ। কোনো কোনো আধুনিক মুহাদ্দিস ইবনু মাজাহর সনদকে যয়ীফ বলেছেন।[10]

একটি সহীহ হাদীসে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

من قال رضيت ... نبيا وجبت له الجنة


“যে ব্যক্তি (রাদীতু বিল্লাহি ... ) বলবে তাঁর জন্য জান্নাত পাওনা হয়ে যাবে।” অন্য বর্ণনাযঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে ও মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসাবে তুষ্ট থাকবে তাঁর জন্য জান্নাত পাওনা হয়ে যাবে।” এই হাদীসে এই বাক্যগুলি বলার জন্য কোনো সময় নির্ধারণ করা হয়নি। সর্বদা বা যে কোনো সময় আমরা এই দু‘আ পাঠ করতে পারব। যাকিরের উচিত সকালে ৩ বার এবং অন্যান্য সময়ে এই বাক্যগুলি বলা।[11]


আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, এই বাক্যগুলি বলার আরেকটি মাসনূন সময় আযানের সময়। প্রিয় পাঠক, উপরের এই বাক্যগুলি এখন মুমিনের সর্বদা বলা প্রয়োজন। একদিকে কাদীয়ানী, বাহাঈ ও অন্যান্য ভন্ড নবীর কাফির উম্মতগণ - যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নবী হিসাবে পেয়ে তুষ্ট নয় - এরা উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে ঈমান বিধ্বংসী ফিতনা ছড়াচ্ছে। অপরদিকে পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমগুলি আমাদের দেশের মানুষকে ইসলামকে দ্বীন হিসাবে যথেষ্ট নয় বলে শেখাতে চেষ্টা করছে, অথবা অন্তত সব ধর্মই ঠিক এ কথা গেলাতে চেষ্টা করছে। এসময়ে আমাদের সর্বদা মুখে ও মনে এই বাক্যগুলি বলতে হবে।


(১১) যিকর নং ১১০: (সকালের যিকর-১ বার)

اللهم اني قد تصدقت بعرضي على عبادتك


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, ইন্নী কাদ তাসাদ্দাকতু বি ‘ইরদী ‘আলা- ‘ইবাদিকা।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমি আমার সম্মানকে আপনার বান্দাগণের জন্য দান করে দিলাম।” সকালে ১ বার।


তাবেয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু আজলান অথবা সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা কি আবু দামদামের মতো হতে পার না?” সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: “আবু দামদাম কে?” তিনি বলেন: “তোমাদের পূর্বের যুগের একজন মানুষ। তিনি প্রতিদিন সকালে এই বাক্যটি বলতেন।” অন্য বর্ণনায় : “তিনি বলতেন, আমাকে যে গালি দেয় আমি আমার সম্মান তাকে দান করে দিলাম।” (অর্থাৎ আমার সম্মান ইচ্ছামতো নষ্ট করার অধিকার আমি তাকে দিলাম) এরপর কেউ তাঁকে গালি দিলে তিনি তাকে কিছু বলতেন না। কেউ তাঁকে জুলুম করলে বা আঘাত করলে তিনি প্রতিশোধ নিতেন না। হাদীসটির সনদ সহীহ, তবে হাদীসটি মুরসাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।[12]

প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা সবাই আবু দামদামের মতো হতে চেষ্টা করি। যারা আমাদের গীবত করছেন, নিন্দা করছেন, গালি দিচ্ছেন তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দি। কী লাভ এগুলির প্রতিশোধ নিয়ে? অনেক অনেক ক্ষতি এগুলির জন্য রাগ বা হিংসা পুষে হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রাখলে। আমরা ক্ষমা করি। তাহলে আমরা মহান প্রভুর ক্ষমা লাভ করব। মহান আল্লাহ কুরআনে আমাদের হৃদয়কে সকল বিদ্বেষ ও হিংসা থেকে মুক্ত রাখতে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন। ইরশাদ করা হয়েছে:

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ


“হে আমাদের প্রভু, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং ঈমানের ক্ষেত্রে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন। আর আপনি আমাদের অন্তরে মুমিনগণের বিরুদ্ধে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল ইচ্ছা রাখবেন না। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয় আপনি মহা করুণাময় ও পরম দয়ার্দ্র।”


আসুন আমরা সবাই আল্লাহর দরবারে এভাবে বারবার প্রার্থনা করে নিজেদের অন্তরগুলিকে সকল হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার থেকে পবিত্র করি।


প্রিয় পাঠক, নিজ অন্তরকে বিদ্বেষমুক্ত করলে আমরাই লাভবান হব। অন্তর হিংসার কঠিন ভার থেকে মুক্ত হবে, প্রশান্তি অনুভূত হবে, আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দিতে পারব, আল্লাহর রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভ করব এবং সর্বোপরি কম আমলেই জান্নাতের সুসংবাদ পেতে পারব। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে হৃদয়কে হিংসা, বিদ্বেষ ও অন্যের অকল্যাণ চিন্ত থেকে পবিত্র রাখার অভাবনীয় সাওয়াবের কথা জানতে পেরেছি। আমরা দেখেছি যে, এভাবে হৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণামুক্ত রাখা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম সুন্নাত যা তিনি বিশেষভাবে পালন করার নিদের্শ দিয়েছেন।


একটু চেষ্টা করলে আল্লাহর রহমতে আমরাও এই গুণ অর্জন করতে পারব। গালি শুনে, গীবতের কথা শুনে বা অন্য কোনো কারণে কারো বিরুদ্ধে মনের মধ্যে ক্রোধ, হিংসা বা বিদ্বেষ সঞ্চিত হলে বেশি বেশি আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে মনকে যথাশীঘ্র শান্ত করার চেষ্টা করুন। কিছুটা শান্ত হওয়ার পরে নিজের জন্য ও উক্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণখুলে দোওয়া করুন, যেন আল্লাহ আপনাকে ও তাকে ক্ষমা করে দেন ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দেন। যেন আল্লাহ আপনাকে ও তাকে জান্নাতে একত্রিত করেন। যার বিরুদ্ধে রাগ বা বিদ্বেষ হয় তার জন্য দু‘আ করুন অথবা তার বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে নিজের অন্তরকে পবিত্র করুন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করুন ; আমীন।

(১২) যিকর নং ১১১ : সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত (১ বার )

একটি দুর্বল সনদের অনির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মা’কিল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন: “যে ব্যক্তি তিন বার বলবেঃ

أعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم


“আমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাচিছ” - এবং এরপর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পাঠ করবে আল্লাহ তাঁর জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতাকে নিয়োজিত করবেন যারা তাঁর জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত দু‘আ করবে। যদি সে ঐ দিনে মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে শহীদ হিসাবে মৃত্যুবরণ করবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তা বলবে সেও উপরিউক্ত মর্যাদা লাভ করবে।”

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি সংকলিত করে হাদীসটির সনদ যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম নববীও দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন।[13]

রাসূলুল্লাহ (সা.) সকাল-সন্ধ্যার যিকরের মধ্যে অনেক দু‘আ-মুনাজাত শিখিয়েছেন, যদ্দ্বারা মুমিন আল্লাহর কাছে নিজের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ প্রার্থনা করবে। এগুলি সবই ১ বা ৩ বার করে পাঠ করার জন্য। তবে মুমিনের মনে আবেগ থাকলে এগুলি বারবার আউড়াতে পারেন। এই জাতীয় যিকরের মধ্যে রয়েছে :


(১৩) যিকর নং ১১২ : (সকাল-সন্ধ্যার দু‘আ : ১ বার)

يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغيثُ أَصْلِحْ لِي شَأْنِيَ كُلَّهُ وَلاَ تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ


উচ্চারণ : ইয়া- হাইউ ইয়া কাইঊমু, বিরাহমাতিকা আসতাগীসু, আসলিহ লী শা‘নী কুল্লাহু, ওয়া লা- তাকিলনী ইলা- নাফসী তারফাতা ‘আইন।

অর্থঃ “হে চিরঞ্জীব, হে মহারক্ষক ও অমুখাপেক্ষী তত্ত্বাবধায়ক, আপনার রহমতের ওসীলা দিয়ে ত্রাণ প্রর্থনা করছি। আপনি আমার সকল বিষয়কে সুন্দর ও সাফল্যমন্ডিত করুন। আর আমাকে একটি মুহূর্তের জন্যও, চোখের পলকের জন্যও আমার নিজের দায়িত্বে ছেড়ে দিবেন না (সর্বদা আপনার তত্ত্বাবধানে আমাকে রাখুন)।”

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফাতেমা (রাঃ)-কে বলেন, “আমি তোমাকে যে ওসীয়ত করছি তা গ্রহণ করতে তোমার অসুবিধা কি? আমি ওসীয়ত করছি যে, তুমি সকালে ও সন্ধ্যায় এই কথা বলবে।” হাদীসটি সহীহ।[14]


(১৪) যিকর নং ১১৩ : (সকাল-সন্ধ্যার দু‘আ : ৩ বার)

اللهمّ عافني في بدني اللهم عافني في سمعي اللهم عافني في بصري لا إله إلا أنت اللهم إني أعوذ بك من الكفر والفقر اللهم إني أعوذ بك من عذاب القبر لا إله إلا أنت


উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা- ‘আফিনী ফী বাদানী, আল্লাহুম্মা- ‘আফিনী ফী সাম‘য়ী, আল্লাহুম্মা-, ‘আফিনী ফী বাসারী, লা- ইলাহা ইল্লা- আনতা। আল্লাহুম্মা- ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফাকরি, আল্লাহুম্মা-, ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিন আযা-বিল কাবরি। লা- ইলা-হা ইল্লা- আনতা।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমার দেহে আমাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা-নিরাপত্তা দান করুন। হে আল্লাহ, আমার শ্রবণযন্ত্রে আমাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা- নিরাপত্তা দান করুন। হে আল্লাহ, আমার দৃষ্টি শক্তিতে আমাকে পরিপূর্ণ সুস্থতা-নিরাপত্তা দান করুন। আপনি ছাড়া কোনো মুা’বুদ নেই। হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট অবিশ্বাস ও দারিদ্র থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।”

আবু বাকরা (রাঃ) প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় উপরের দু‘আগুলি ৩ বার করে পাঠ করতেন। তাঁর পুত্র আব্দুর রহমান তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেনঃ

إني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يدعو بهن فأنا أجب أن أستن بسنته


“আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দু‘আগুলি বলতে শুনেছি। আমি তাঁরই সুন্নাত অনুসরণ করে চলতে পছনদ করি।” হাদীসটি হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[15]


(১৫) যিকর নং ১১৪ : (সকাল-সন্ধ্যার দু‘আ : ১ বার)

أَصْبَحْنَا وَأَصْبَحَ الْمُلْكُ لِلَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ رَبِّ أَسْأَلُكَ خَيْرَ مَا فِي هَذِاِ اليَوم وَخَيْرَ مَا بَعْدَهُ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ هَذِاِ اليَوم وَشَرِّ مَا بَعْدَهُ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَسُوءِ الْكِبَرِ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابٍ فِي النَّارِ وَعَذَابٍ فِي الْقَبْرِ


উচ্চারণ: আসবা‘হনা- ওয়া আসবা‘হাল মুলকু লিল্লা-হ। আল‘হামদু লিল্লা-হ। লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু, লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল ‘হামদু, ওয়া হুআ ‘আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। রাব্বি, আসআলুকা খাইরা মা- ফী হা-যাল ইয়াওমি, ওয়া খাইরা মা- বা‘দাহু। ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন শার্রি মা- ফী হা-যাল ইয়াওমি, ওয়া শার্রি মা- বা‘দাহু। রাব্বি, আ‘ঊযু বিকা মিনাল কাসালি, ওয়া সূইল কিবার। ওয়া আ‘ঊযু বিকা মিন ‘আযা-বিন ফিন্না-রি, ওয়া ‘আযা-বিন ফিল ক্বাবর।


অর্থ: “সকাল হলো, আমাদের জীবনে, আমরা ও সকল বিশ্বরাজ্যে সবকিছু আল্লাহর জন্যই দিনের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সকল প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্বময়

ক্ষমতার অধিকারী। হে আমার প্রভু, আমি আপনার কাছে চাইছি এই দিবসের মধ্যে যত কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে এবং এই দিবসের পরে যত কল্যাণ রয়েছে তা সবই। এবং আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি সকল অমঙ্গল ও অকল্যাণ থেকে যা এই দিবসের মধ্যে রয়েছে এবং এই দিবসের পরে রয়েছে। হে আমার প্রভু, আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি অলসতা থেকে ও বার্ধক্যের খারাপি থেকে। হে আমার প্রভু, আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি জাহান্নামের শাস্তি থেকে এবং কবরের শাস্তি থেকে।”


আব্দুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সকালে ও সন্ধ্যায় উপরের দু‘আটি বলতেন। সকালে উপরের মতো বলতেন। সন্ধ্যা (আসবাহনা) বা (সকাল হলো)-র স্থলে (আমসাইনা) বা (সন্ধ্যা হলো) বলতেন।[16]

[1] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৬৭, নং ৩৫৭৫, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩২১, নং ৫০৮২, সহীহুত তারগীব ১/৩৩৯।

[2] সহীহ মুসলিম ৪/২০৭১, নং ২৬৯২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১৪১, সুনানুত তিরমিযী ৫/৫১১, নং ৩৪৬৬, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩২৪, নং ৫০৯১, সুনানু ইবনি মাজাহ ২/১২৫৩, নং ৩৮১২, সহীহুত তারগীব ১/৩৪০-৩৪১।

[3] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১১৩, ১১৪।

[4] সহীহ মুসলিম ৪/২০৯০-২০৯১, নং ২৭২৬, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১১০, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪০২, ৬/৪৮, ৪৯।

[5] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫৫৫, নং ৩৫৫৪। ইমাম তিরমিযী যদিও এই বর্ণনাটির দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তবে ইমাম হাকিম ও যাহাবী সাফিয়্যার হাদীসের সনদ আলোচনা করে তা সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩২।

[6] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২০, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৫, যাকারিয়্যা, আল-ইখবার, পৃ. ১৫৪।

[7] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬৫, নং ৩৩৮৮, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩২৩, নং ৫০৮৮, সুনানু ইবনি মাজাহ ২/১২৭৩, নং ৩৮৬৯, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৯৫, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৭২-৩৭৭।

[8] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩২১, নং ৫০৮১, তারগীব ১/২৫৫, নাবাবী, আল-আযকার পৃ. ১২৭-১২৮, হিসনুল মুসলিম পৃ. ৬১।

[9] মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১১৬, যাকারিয়্যা, আল-ইখবার ফীমা লা ইয়াসিহহু, পৃ. ১৫১।

[10] মুসনাদু আহমাদ ৪/৩৩৭, সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬৫, নং ৩৩৮৯, সুনানু ইবনু মাজাহ ২/১২৭৩, নং ৩৮৭০, বুসীরী, যাওয়াইদু ইবনি মাজাহ, পৃ. ৪৯৯, আলবানী, যয়ীফু সুনানি ইবনু মাজাহ, পৃ. ৩১৬, মাজমাউজ যাওয়াইদ ১০/১১৬।

[11] সহীহ মুসলিম ৩/১৫০১, নং ১৮৮৪, সুনানু আবী দাউদ ২/৮৭, নং ১৫২৯, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৯৯, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৯৮-৪০০।

[12] সুনানু আবী দাউদ ৪/২৭২, নং ৪৮৮৬, ৪৮৮৭, আল-মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৫/১৪৯, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১২৭।

[13] সুনানুত তিরমিযী ৫/১৮২, নং ২৯২২, মুসনাদু আহমাদ ৫/২৬, ১২৮, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১২৫।

[14] মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১১৭, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৫।

[15] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩২৪, নং ৫০৯০, সহীহুল আদাবিল মুফরাদ লিল বুখারী, পৃ. ২৬০-২৬১, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১২৩, যাকারিয়্যা, আল-ইখবার, পৃ. ১৪০।

[16] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৯, নং ২৭২৩।