পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা যিকরের পরিচয়, গুরুত্ব, প্রকারভেদ, আদব ইত্যাদি বিষয় জানতে পেরেছি। এ অধ্যায়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো ও আচরিত ‘যিকর’গুলি বিস্তারিত আলোচনা করব। যিকরের মধ্যে আমরা ইসতিগফার, দু‘আ, সালাত, সালাম সবই উল্লেখ করব। কারণ আমরা দেখেছি যে, এগুলি সবই যিকর। দু‘আ, ইসতিগফার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার যিকর রাসূলুল্লাহ (সা.) কখন কিভাবে পালন করেছেন বা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তা আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।
মুমিনের জীবন যিকর কেন্দ্রিক হবে। সে তার সাধ্যমতো সদা সর্বদা আল্লাহর যিকরে নিজের জিহ্বা ও হৃদয়কে আর্দ্র রাখবে। এছাড়াও যিকরের জন্য কুরআন ও হাদীসে বিশেষ ৬ টি দৈননিদন সময় উল্লেখ করা হয়েছে: (১). সকাল, (২). বিকাল, (৩). সন্ধ্যা, (৪). ঘুমানোর আগে, (৫). শেষ রাত্রে ও (৬). পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সময় সকাল। মুমিনের জীবনের প্রতিদিন শুরু হবে আল্লাহর যিকররের মধ্য দিয়ে। সকালেই সে তার প্রভুর যিকরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় রুহানী খাদ্য ও শক্তি সংগ্রহ করবে, যা তাকে সারাদিন সকল প্রতিকূলতার মধ্যে পবিত্র হৃদয়ে আল্লাহর সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।
সকালের সময়কে আমরা দুভাগে ভাগ করছি - প্রথমত, ফজরের ফরয সালাত আদায় পর্যন্ত ও দ্বিতীয়ত, ফজরের সালাতের পর থেকে ‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের নামায পর্যন্ত। প্রথম সময়ে সাধারণত মুমিন ঘুম থেকে উঠে ওযু করে সালাতের প্রস্তুতি নেন। ফজরের আযান হলে তিনি সুন্নাত সালাত আদায় করেন এবং পরে মসজিদে যেয়ে ফরয সালাত আদায় করেন। এই পর্যায়ে আমি ঘুম ভাঙ্গার যিকর, ওযুর যিকর, আযানের যিকর, ঘর থেকে বাহির হওয়া, মসজিদে গমন, সুন্নাত ও ফরয সালাত আদায়ের কিছু নিয়মাবলী আলোচনা করব। এগুলি মূলত সাধারণ বিষয়। মুমিন সকল সময়ে ওযু, গোসল, আযান ও সালাতে এগুলির দ্বারা উপকৃত হবেন বলে আশা রাখি। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি সেই সকল যিকর আলোচনা করব যা মুমিন ফজরের সালাতের পর থেকে ‘দোহা’-র সালাত বা চাশতের নামায পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে পালন করবেন।
সকালের যিকর: প্রথম পর্যায়
১. ঘুম ভাঙ্গার যিকর
রাতে ঘুম থেকে উঠা দুই প্রকার হতে পারে, রাতের বেলায় কোনো কারণে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং স্বাভাবিকভাবে ভোরে ঘুম থেকে উঠা।
যিকর নং ৩৫ : রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে পালনীয় যিকর
(২, ৯, ৪, ১, ১০ ও ১৩ নং যিকর একত্রে) :
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ
উচ্চারণঃ লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল ‘হামদ, ওয়া হুআ ‘আলা- কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর, ‘আল-‘হামদু লিল্লাহ’, ওয়া ‘সুব‘হা-নাল্লা-হ’, ওয়া লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া ‘আল্লা-হু আকবার’, লা- ‘হাওলা ওয়া লা- ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ।
অর্থঃ “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, এবং প্রশংসা তাঁরই। এবং তিনি সর্বোপরি ক্ষমতাবান। সকল প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। কোনো অবলম্বন নেই, কোনো ক্ষমতা নেই আল্লাহর (সাহায্য) ছাড়া।”
উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছে‘ন, “যদি কারো রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় অতঃপর সে উপরের যিকরের বাক্যগুলি পাঠ করে এবং এরপর সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় অথবা কোনো প্রকার দু‘আ করে বা কিছু চায় তাহলে তার দু‘আ কবুল করা হবে। আর যদি সে এরপর উঠে ওযু করে (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করে তাহলে তার সালাত কবুল করা হবে।”[1]
সুবহানাল্লাহ ! বিছানায় থাকা অবস্থাতেই, কোনোরূপ ওযু বা পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই এই বাক্যগুলি পাঠ করলে এতবড় পুরস্কার!! এই যিকরের মধ্যে অতি পরিচিত যিকরের ৬ টি বাক্য রয়েছে, যা প্রায় সকল মুসলমানেরই মুখস্থ রয়েছে।
যিকর নং ৩৬ : স্বাভাবিকভাবে ভোরে ঘুম থেকে উঠার যিকর :
বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর যিকরের মধ্য দিয়ে দিনের শুভ ও কল্যাণময় সূচনা করতে ও যিকরের মধ্য দিয়ে দিনের কল্যাণময় সমাপ্তি করতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভোরে ঘুম থকে উঠে বিভিন্ন যিকর রাসূলুল্লাহ (সা.) পালন করতেন ও করতে শিখিয়েছেন। এখানে একটি যিকর উল্লেখ করছি:
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
উচ্চারণঃ আল-‘হামদু লিল্লা-হিল লাযী আ‘হইয়া-না- বা‘দা মা- আমা-তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর।
অর্থঃ “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে জীবিত করেছেন মৃত্যুর (ঘুমের) পরে, আর তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।”হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) ও আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুম থেকে উঠে উপরের যিকরটি বলতেন।[2]
[2] সহীহ বুখারি ৫/২৩৬, ২৩২৭, ২৩৩০, ৬/২৬৯২, নং ৫৯৫৩, ৫৯৫৫, ৫৯৬৫, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১।