(ঙ) কুরআন আলোচনা ও গবেষণার অতিরিক্ত ফযীলত
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
“যখনই কিছু মানুষ আল্লাহর কোনো একটি ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করতে ও পরস্পরে তা শিক্ষা ও আলোচনা করতে থাকে, তখনই তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল হতে থাকে, আল্লাহর রহমত তাদের আবৃত করে নেয়, ফিরিশতাগণ তাদের ঘিরে ধরে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটস্থদের নিকট তাদের যিকর করেন।”[1]
(চ) কুরআন শ্রবণের অতিরিক্ত ফযীলত
আল্লাহর মহান বাণী কুরআন কারীম তিলাওয়াতের ন্যায় মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাও একটি বড় ইবাদত ও আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম ওসীলা। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“এবং যখন কুরআন পাঠ করা হবে, তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করবে এবং চুপ করে থাকবে, তাহলে হয়ত তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।”[2]
ইমাম তাবারী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ প্রদান করলেন যে, হে মুমিনগণ, যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ কর, যেন তা ভালোভাবে বুঝতে পার এবং তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পার। আর কুরআন পাঠের সময় চুপ করে থাকবে, যেন তা বুঝতে, হৃদয়ঙ্গম করতে ও তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পার। কুরআন পাঠের সময় কথা বলবে না, তাহলে তা বুঝতে অসুবিধা হবে। আর এভাবে কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারলে, তার নির্দেশ মতো চলতে পারলে এবং কুরআনের আলোয় নিজের জীবন আলোকিত করতে পারলে তোমরা আল্লাহর রহমত অর্জন করতে পারবে।[3]
কুরআন শ্রবণের ফযীলত ও বরকত প্রমাণের জন্য এই আয়াতই যথেষ্ট। তবে এ বিষয়ে দুই একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
من استمع إلى آية من كتاب الله تعالى كتب له حسنة مضاعفة ، ومن تلاها كانت له نوراً يوم القيامة
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি আয়াত মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে, তার জন্য বহুগুণ বর্ধিত সাওয়াব লিখা হবে। আর যে ব্যক্তি তা তিলাওয়াত করবে, তার জন্য এই আয়াতটি কিয়ামতের দিন নূরে পরিণত হবে।” হাদীসটির সনদে কিছু দুর্বলতা আছে বলে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন।[4] কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক সানআনী হাদীসটি দ্বিতীয় আরেকটি সনদে বর্ণনা করেছেন। এতে হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়।[5]
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :
من استمع إلى آية من كتاب الله كانت له نوراً
“যদি কেউ আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াতও শ্রবণ করে, তাহলে তা কিয়ামতের দিন তার জন্য নূরে পরিণত হবে।”[6]
অনেক তাবেয়ী বুজুর্গ মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাকে তিলাওয়াতের চেয়েও বেশি সাওয়াবের বলে মনে করতেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী খালিদ ইবনু মা’দান (১০৩ হি) বলেনঃ
ان الذي يقرأ القران له أجر وان الذى يستمع له أجران
যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করেন, তার জন্য রয়েছে একটি পুরস্কার। আর যিনি তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করেন, তার জন্য রয়েছে দুটি পুরস্কার।”[7]
(ছ) কুরআনের মানুষ হওয়ার ফযীলত
(আহলুল কুরআন) অর্থাৎ কুরআনের অধিকারী বা কুরআনের মানুষ হওয়ার অর্থ জীবনকে কুরআন কেন্দ্রিক ও কুরআন অনুযায়ী করে ফেলা। আর এ মুমিনের জীবনের মহত্তম পর্যায়। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إن لله أهلين من الناس قالوا يا رسول الله من هم قال هم أهل القرآن أهل الله وخاصته
“মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু পরিবার পরিজন রয়েছে। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, তাদের পরিচয় কি? তিনি বলেনঃ
তারা কুরআনের মানুষ। তারাই আল্লাহর পরিজন ও আল্লাহর বিশেষ ঘনিষ্ট খাস মানুষ।” হাদীসটি সহীহ।[8]
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া কুরআন কেন্দ্রিক হতে পারা। যাকে আল্লাহ রাতদিন কুরআন চর্চা ও কুরআন পালন নিয়ে ব্যস্ত থাকার তাওফীক প্রদান করেছেন তিনিই সবচেয়ে বড় নিয়ামত পেয়েছেন। দুনিয়াতে কিছু চাওয়ার থাকলে এই ধরনের নিয়ামতই চাওয়া যায়। হিংসা করার মতো কোনো নিয়ামত থাকলে তা এই নিয়ামত।
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
لا حَسَدَ إِلا فِي اثْنَتَيْنِ رَجُلٍ أَتَاهُ اللَّهُ الْقُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ (وفي رواية أخري: قُومُ بِهِ) آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
“শুধুমাত্র দুই ব্যক্তিকেই হিংসা করা যায় (শুধুমাত্র এই দুই ব্যক্তি নিয়ামতের মতো নিয়ামত কামনা করা যায়) : প্রথম ব্যক্তি, যাঁকে আল্লাহ কুরআন দান করেছেন আর সে রাত-দিন শুধু কুরআন তিলাওয়াত বা কুরআন পালন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি, যাঁকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন আর সে রাতদিন সম্পদ দান করতে থাকে।”[9]
কুরআনের মানুষ হলে, জীবনকে কুরআন অনুসারে পরিচালিত করলে এবং সকল কাজে কুরআনকে সামনে রাখলে কুরআন তাঁকে জান্নাতে নিয়ে যাবেই। জাবের (রাঃ) নবীয়ে আকরাম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন :
الْقُرْآن شَافِع مُشَفع وَمَاحِل مُصَدَّقٌ مَنْ جَعَلَهُ إِمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ سَاقَهُ إِلَى النَّارِ
“কুরআন এমন একজন শাফা’আতকারী যার শাফা’আত অবশ্যই কবুল করা হবে। আবার কুরআন এমন একজন বিবাদী অভিযোগকারী যার অভিযোগ সত্য বলে মেনে নেয়া হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে নিজের জীবনে সামনে রেখে চলবে কুরআন তাঁকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি কুরআনকে নিজের পিছে রেখে দেবে কুরআন তাঁকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।” হাদীসটি সহীহ।[10]
কুরআনের মানুষ হতে পারলে শুধু ঐ মানুষ নিজেই লাভবান হবেন না, উপরন্তু তার পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। মু’আয ইবনু আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যয়ীফ হাদসে বলা হয়েছেঃ
من قرأ القرآن وعمل به ألبس والداه تاجا يوم القيامة ضوؤه أحسن من ضوء الشمس في بيوت الدنيا فما ظنكم بالذي عمل بهذا
“যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে এবং কুরআন অনুসারে কর্ম করবে তার পিতা-মাতাকে কিয়ামতের দিন এমন একটি মুকুট পরানো হবে যার জ্যোতি হবে পৃথিবীর সূর্যের জ্যোতির চেয়েও সুন্দরতর। তাহলে যে ব্যক্তি নিজে কর্ম করবে তার পুরস্কার কত হবে তা ভেবে দেখ!” হাদীসটির সনদ দুর্বল বা যয়ীফ।[11]
বুরাইদা আসলামী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
من قرأ القرآن وتعلمه وعمل به ألبس والداه يوم القيامة تاجاً من نور ضوءه مثل ضوء الشمس، ويكسى والداه حلتان لا تقوم لهما الدنيا، فيقولان: بم اكتسينا هذا؟ فيقال: بأخذ ولدكما القرآن
“যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, কুরআনের ইলম অর্জন করবে ও সে অনুসারে কর্ম করবে, কিয়ামতের দিন তাঁর পিতা-মাতাকে নূরের মুকুট পরানো হবে, যার আলো সূর্যের আলোর মতো এবং তাঁর পিতা-মাতকে দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে মূল্যবান একপ্রস্ত পোশাক পরানো হবে। তারা বলবেন, কিসের জন্য আমাদের এসব পরানো হচেছ? তাঁদেরকে বলা হবেঃ তোমাদের সন্তান কুরআন গ্রহণ করেছে এজন্য তোমাদেরকে এভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে।” হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।[12]
আলী (রাঃ) থেকে খুবই দর্বুল সনদে বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ
من قرأ القرآن واستظهره فأحل حلاله وحرم حرامه أدخله الله الجنة وشفعه في عشرة من أهل بيته كلهم قد وجبت له النار
যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, মুখস্থ করবে, কুরআনের বিধান মেনে কুরআনের হালালকে হালাল হিসাবে পালন করবে ও কুরআনের হারামকে হারাম হিসাবে বর্জন করবে আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাঁর পরিবারের দশ ব্যক্তির জন্য তাঁর শাফা’আত কবুল করবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম পাওনা হয়ে গিয়েছিল।”
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি সংকলন করে বলেন যে, হাদীসটি দুর্বল, কারণ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী রাবী হাফস ইবনু সুলাইমান হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। এই হাদীস তিনি যার থেকে শুনেছেন বলে বর্ণনা করেছেন সেই কাসীর ইবনু যাযান অপরিচিত ব্যক্তি, মুহাদ্দিসগণ তার পরিচয় ও সততা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এধরনের রাবীর হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।[13]
(জ) কুরআন তিলাওয়াতের আদব ও নিয়ম
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর আল্লাহর কালাম। কুরআনই যাকিরের অন্যতম সম্পদ ও সম্বল। কুরআন তিলাওয়াত, গবেষণা, আলোচনা ইত্যাদির অনেক মাসনূন বা সুন্নাত-সম্মত নিয়ম ও আদব আছে, যা হাদীস ও সাহাবীগণের মতামতের আলোকে আলিমগণ বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় লিখছিঃ
১. যথাসম্ভব ওযু-সহ আদবের সাথে তিলাওয়াত করা। ওযু ছাড়াও তিলাওয়াত করা যায়। তবে কুরআন স্পর্শ করা যায় না। গোসল ফরয থাকলে তিলাওয়াত করা যায় না।
২. সম্ভব হলে মিসওয়াক করে সুন্দর পোশাকে বসে তিলাওয়াত করা। তবে বসে শুয়ে দাঁড়িয়ে, হাঁটতে চলতে সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা যায়।
৩. বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করা।
৪. তিলাওয়াতের সময় অর্থের দিকে খেয়াল রাখা এবং যথা সম্ভব অর্থকে হৃদয়ে জাগরুক করে হৃদয়কে নাড়া দেওয়া।
৫. তিলাওয়াতের সময় সাজদার আয়াতে সাজদা করা, তাসবীহের আয়াতে তাসবীহ পড়া, পুরস্কারের আয়াতে পুরস্কার চাওয়া ও আযাবের আয়াতে আযাব থেকে আশ্রয় চাওয়া।
৬. তিলাওয়াতের সময় মনকে যথাসম্ভব বিনীত ও আল্লাহর রহমতের জন্য ব্যাকুল রাখা।
৭. তিলাওয়াতের সাথে সাথে সাধ্যমত বিনীত হৃদয়ে ক্রন্দন করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরআন তিলাওয়াতের সময় চোখের পানি বইয়ে
ক্রন্দন করতেন। মুখচাপা ক্রন্দনে তার বুকের মধ্যে শব্দ উঠত। আবু বকর (রাঃ), উমার (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামও সালাতে ও সালাতের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতের সময় ক্রন্দন ঠেকাতে পারতেন না।
৮. একান্ত প্রয়োজন ছাড়া তিলাওয়াতের সময় কারো সাথে কথা বলার জন্য তিলাওয়াত কেটে না দেওয়া। যথাসম্ভব মনোযোগের সাথে তিলাওয়াত শেষ করে কথা বলা।
৯. তিন দিনের কমে কুরআন খতম না করা। যথসম্ভব প্রতি মাসে বা ২/৩ মাসে একবার খতম করা।
১০.ঘরের কুরআনকে ফেলে না রাখা। প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় তা দেখে পাঠ করা।
১১. রমযান মাসে বেশি বেশি তিলাওয়াত করা।
১২. মুখস্থ থাকলেও যথাসম্ভব দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াত করা; কারণ কুরআন শরীফের (মুসহাফের) পৃষ্ঠায় নজর বুলানোই একটি ইবাদত।
১৩. প্রতি বৎসর অন্তত একবার উত্তম তিলাওয়াত করতে পারেন এমন কাউকে তিলাওয়াত করে শুনান।[14]
(ঝ) যিকর গণনা প্রসঙ্গ
আমরা ৯ প্রকার যিকরের আলোচনা শেষ করেছি। পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশের পূর্বে আমরা তাসবীহ বা হাতে যিকর গণনা করা সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। উপরের হাদীসগুলি থেকে জানতে পারলাম যে , যিকর দুইভাবে আদায় করা যায় : বেশি বেশি পাঠ করে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠ করে। নির্দিষ্ট সংখ্যক যিকরের জন্য গণনার প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখি যে, কোনো কোনো সাহাবী ও পরবর্তী ইমামগণ যিকর গণনা করতে নিষেধ করেছেন। তারা বলতেন, আল্লাহই তো গণনা করছেন, তুমি কেন গণনা করবে। তুমি কি আল্লাহর কাছে যেয়ে গুণে হিসাব বুঝে নেবে?
ইমাম আবু হানীফা (রহ) ও তার মাযহাবের ইমামগণ যিকর ও তাসবীহ-তাহলীল গণনা মাকরূহ বলে জেনেছেন। ইমাম তাহাবী ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আবু ইউসূফের সনদে ইমাম আবু হানীফা থেকে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।[15]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) যিকর গণনা করতে দেখলে বলতেন, তোমাদের গোনাহগুলি গণনা করে হিসাব করে রাখ, সাওয়াব গণনার প্রয়োজন নেই।[16]
উকবা ইবনু সুবহান নামাক একজন তাবেয়ী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমারকে প্রশ্ন করলাম, যদি কেউ যিকরের সময় তার তাসবীহ-তাহলীল হিসাব করে রাখে তাহলে কী হবে? তিনি বললেনঃ (سبحان الله أتحاسبون الله) সুব‘হানাল্লাহ! তোমরা কি আল্লাহর হিসাব নেবে?[17]
এ সকল হাদীসের আলোকেই ইমাম আবু হানীফা (রহ) তাসবীহ তাহলীল গণনা মাকরূহ মনে করেছেন। তবে ইমাম তাহাবী (রহঃ) এ
বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যে, যেসকল যিকর হাদীস শরীফে নির্দিষ্ট সংখ্যায় আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যার জন্য নির্দিষ্ট সাওয়াব উল্লেখ করা হয়েছে, সে সকল যিকরের ক্ষেত্রে মুমিনের উচিত তা গণনা করে পাঠ করা। কারণ গণনা ছাড়া নির্দিষ্ট সংখ্যা পূরণ হয়েছে কিনা এবং আল্লাহর ওয়াদাকৃত সাওয়াবের পরিমাণ যিকর পালিত হয়েছে কিনা তা জানার উপায় নেই। এজন্য এ সকল যিকর গণনা করে পালন করতে হবে।
আর যেসকল যিকর সাধারণভাবে পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিশেষ সংখ্যার জন্য বিশেষ সাওয়াব বর্ণনা করা হয়নি, সেসকল যিকর গণনা করা বাতুলতা। সেক্ষেত্রেই আল্লাহর হিসাব গ্রহণের প্রশ্ন আসে। নির্ধারিত সংখ্যক যিকরের অতিরিক্ত সকল সাধারণ যিকরের ক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব কোনো রকম গণনা বা হিসাব ছাড়া যথাসম্ভব বেশি বেশি এবং যথাসম্ভব মনোযোগ সহকারে এসকল যিকরের বাক্য উচ্চারণ করবেন। হিসাবপত্রের দায়িত্ব রাব্বুল আলামীনের উপর ছেড়ে দেবেন।
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কর্ম থেকে জানা যায় যে, সালাত, সালাম, তাসবীহ, তাকবীর, তাহলীল, তাহমীদ ইত্যাদি যিকর, যা সাধারণভাবে বেশি বেশি আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা অনেকে নিজের সুবিধামতো নির্দিষ্ট সংখ্যায় ওযীফা হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছেন। যেমন, কেউ কেউ সারাদিনে ১০০০ বার সালাত বা তাসবীহ বা তাহলীল করবেন বলে নিজের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছেন। এগুলি তাঁরা গুণে আদায় করতেন। এর অতিরিক্ত অগণিত যিকর তাঁরা আদায় করতেন।[18]
এখানে অনেকে প্রশ্ন করেন, সংখ্যা নির্ধারিত যিকর কিভাবে গণনা করব? প্রচলিত ‘তাসবীহ’ ব্যবহার করে? না হাতের কর গণনা করে? কেউ কেউ বলেন, তাসবীহ ব্যবহার বিদ‘আত কি না?
এই প্রশ্নের উত্তর, যিকর গণনার ক্ষেত্রে হাতের আঙ্গুল ব্যবহার করা সুন্নাত ও উত্তম, তবে গণনার জন্য দানা বা তাসবীহ ব্যবহার না-জায়েয নয়, বিদ‘আতও নয়। তবে হাতের আঙ্গুল দ্বারা গণনা করা উত্তম, কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে তাসবীহ তাহলীল ও যিকর আযকার হাতে গণনা করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন:
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يعقد التسبيح بيده - بيمينه
“আমি নবীজী (সা.)-কে দেখলাম তিনি নিজের হাতে [দ্বিতীয় বর্ণনা : ডান হাতে] তাসবীহের গিঠ দিচ্ছেন (হাতের আঙ্গুলে তাসবীহ গণনা করছেন)।” হাদীসটির সনদ সহীহ।[19]
হাতের আঙ্গুল দ্বারা গণনা করা উত্তম হওয়ার দ্বিতীয় কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) হাতে গণনা করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন। ইউসাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বলেছেনঃ
عَلَيْكُنَّ بِالتَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ وَالتَّقْدِيسِ وَاعْقِدْنَ بِالْأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْئُولَاتٌ مُسْتَنْطَقَاتٌ
“তোমরা মহিলাগণ অবশ্যই তাসবীহ (সুব‘হানাল্লাহ), তাহলীল (লা- ইলাহা ইললল্লাহ), তাকদীস (সুববুহুন ক্বুদ্দূসুন) করবে এবং আঙ্গুলের গিটে গণনা করবে; কারণ এদেরকে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে এবং কথা বলানো হবে। (এরা যিকরের সাক্ষ্য প্রদান করবে।)” হাদীসটির সনদ সহীহ।[20]
দানা বা তাসবীহ দ্বারা যিকর গণনা জায়েয ও সাহাবীগণ ও তাবেয়ীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত। বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো কোনো সাহাবী/সাহাবীয়াকে দানা বা বীচির দ্বারা তাসবীহ তাহলীল বা যিকর গণনা করতে দেখেছেন। তিনি তাঁদেরকে এভাবে গণনা করতে নিষেধ করেননি, তবে সংক্ষিপ্ত ও উত্তম যিকরের উপদেশ প্রদান করেছেন। এ সকল হাদীস থেকে
স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, কাঁকর, দানা, বীচি ইত্যাদির মাধ্যমে যিকর গণনা জায়েয।
পরবর্তী যুগে কোনো কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে জমা করা কাঁকর, দানা, বীচি, গিরা দেওয়া সুতা বা ‘তাসবীহ’ ব্যবহারের কথা জানা যায়। আবু সাফিয়্যা নামক একজন সাহাবী পাত্র ভর্তি কাঁকর রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তিনি এগুলি দিয়ে যিকর করতেন। আবার বিকালেও অনুরূপ করতেন। সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস কাঁকর দিয়ে তাসবীহ তাহলীল ও যিকর করতেন। ইমাম হুসাইনের কন্যা ফাতিমা গিঠ দেওয়া সুতা (তাসবীহের মতো) দ্বারা গণনা করে তাসবীহ তাহলীল করতেন। আবু হুরাইরা (রাঃ)-এর ১০০০ টি গিরা দেওয়া একটি সুতা ছিল। তিনি এই সংখ্যক তাসবিহ-তাহলীল পাঠ না করে ঘুমাতেন না। এছাড়া তিনি কাঁকর জমা করে তা দিয়ে যিকর করতেন বলে বর্ণিত আছে। আবু দারদা (রাঃ) খেজুরের বীচি একটি থলের মধ্যে রাখতেন। ফজরের সালাতের পরে সেগুলি বাহির করে যিকরের মাধ্যমে গণনা করে শেষ করতেন।
আল্লামা শাওকানী, সয়ূতী আব্দুর রাউফ মুনাবী প্রমুখের আলোচনায় মনে হয় ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও তার সঙ্গীগণ বা মাযহাবের ইমামগণ ছাড়া পূর্বযুগের অধিকাংশ ফকীহ ও ইমাম যিকর গণনা বা তাসবীহ ব্যবহার করতে নিষেধ করেননি। ইমাম সুয়ূতী এ বিষয়ে একটি ছোট্ট বই লিখেছেন।[21] সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সুন্নাত ও নির্দেশনা সংখ্যা নির্ধারিত যিকর হাতের আঙ্গুলে গণনা করা। প্রয়োজনে, বিশেষত যারা ওযীফা হিসাবে দৈনিক বেশি সংখ্যক যিকর নিজের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছেন তারা তাসবীহ, কাঁকর, বীচি, ছোলা, ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন।
(ঞ) সর্বদা আল্লাহর যিকর করতে হবে
সম্মানিত পাঠক, আমরা যিকরের প্রকারভেদ ও ফযীলত আলোচনা শেষ করেছি। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা মুমিনের জীবনের যিকরের প্রয়োগ ও বিভিন্ন সময়ে কিভাবে কী যিকর পালন করবেন তার বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। এখানে যে বিষয়টি আমাদের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, মুমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যিকর। যিকরের এমন কোনো সময় নেই বা অবস্থা নেই যে, সে সময়ে বা অবস্থায় যিকর করতে হবে, অন্য সময় করতে হবে না। মুমিন সদা সর্বদা আল্লাহর যিকরে রত থাকে। আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ
كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَذْكُرُ الله عَلَى كُلِّ أَحْيَانِهِ
“নবীজী (সা.) সকল অবস্থায় আল্লাহর যিকর করতেন।”[22]
এখানে যিকর বলতে মুখের উচ্চারণের মাধ্যমে যিকর বুঝানো হয়েছে। মনের স্মরণ তো সর্বদায়ই থাকে। সকল অবস্থায় কোনো না কোনো কর্ম মুমিন করে। কিন্তু সকল অবস্থায় আল্লাহর যিকর করা যাবে কিনা? নাপাক অবস্থায়? শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হাঁটতে, চলতে? এই প্রশ্নের উত্তরেই আয়েশা (রাঃ) এ কথা বলেছেন। আর এ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ এ কথাই বুঝেছেন। এজন্য তাঁরা এই হাদীস থেকে প্রমাণিত করেছেন যে, নাপাক অবস্থায়, শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, রাস্তাঘাটে, মাঠে এবং সর্বাবস্থায় মুমিন বান্দা মুখে মাসনূন বাক্যাদি উচ্চারণ করে আল্লাহর যিকর করতে পারবেন। সালাত, সালাম, তাসবীহ, তাহলীল, দু‘আ ও সকল প্রকার যিকরের বিষয়েই একথা প্রযোজ্য।[23] শুধুমাত্র ইস্তিঞ্জা রত অবস্থায় ও স্বামী-স্ত্রী একান্ত অবস্থায় ছাড়া সর্বদা সকল অবস্থায় মুমিনের জিহ্বা বেপরোয়াভাবে আল্লাহর যিকরে আর্দ্র থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ এটি এবং এটিই তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনের আদর্শ ও কর্ম।[24]
[2] সূরা আল-আ’রাফঃ ২০৪।
[3] তাফসীরে তাবারী ৯/১৬২।
[4] মুসনাদে আহমাদ ২/৩৪১, নং ৮৪৭৫, হাইসামী মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/১৬২, মুনযিরী, আত-তারগীব ২/৩১৯, মানাবী ফায়যুল কাদীর ৬/৫৯, আলবানী যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ৭৮০, তাফসীরে ইবনু কাসীর ২/২৮২।
[5] মুসান্নাফু আব্দুর রাজ্জাক ৩/৩৭৩। মুসনাদে আহমাদ এর বর্ণনায় আব্বাদ ইবনু মাইসারাহ হাসান বসরী থেকে বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। আব্বাদ কিছুটা দুর্বল রাবী। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাকের বর্ণনায় আবান ইবনু সালেহ হাসান বাসরী থেকে মুরসালভাবে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এতে আব্বাদের বর্ণনার সমর্থন হয়।
[6] সুনানুদ দারিমী ২/৫৩৬, মুসান্নাফু আব্দুর রাজ্জাক ৩/৩৭৩।
[7] সুনানুদ দারিমী ২/৫৩৬।
[8] সুনানু ইবনু মাজাহ ১/৭৮, নং ২১৫, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৭, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৪৩, তারগীব ২/৩২৭,-৩২৮।
[9] সহীহ বুখারী ৪/১৯১৯, ৪৭৩৭, ৬/২৭৩৭, নং ৭০৯১, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৮, নং ৮১৫।
[10] হাকিম, আল-মুসতাদরাক হাকিম ২/৪১৩, মাওয়ারিদুয যামআন ৬/২০, মাজমাউল যাওয়াইদ ১/১৭১।
[11] আবু দাউদ ২/৭০, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৫৬।
[12] মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৫৬-৭৫৭।
[13] সুনানে তিরমিযী ৫/১৭১, নং ২৯০৫, সুনানে ইবনু মাজাহ ১/৭৮, নং ২১৬, আত-তারগীব ২/৩২৮-৩২৯।
[14] বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ২/৩১৯-৫৫৭।
[15] ইমাম তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ২০/২৯১।
[16] বিস্তারিত দেখুনঃ লেখকের এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৬৬-৬৭।
[17] হাদিসটির সনদ সহীহ। ইমাম তাহাবী, শারহু মুশকিলিল আসার ১০/২৯১।
[18] আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী, আল-মুসান্নাফ ২/২৩৮, ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ১/৪৪৬, মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, মানাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫।
[19] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫২১, নং ৩৪৮৬, সুনানু আবী দাউদ ২/৮০, নং ১৫০২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩১, ৭৩২, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪০৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১২৩, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৪০-৩৪১।
[20] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫২১, ৫৭১, নং ৩৪৮৬, ৩৫৮৩, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১২২, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭৩২, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২৫/৭৪, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৯৯।
[21] বিস্তারিত দেখুনঃ মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/৩২২, শাওকানী, নাইলুল আউতার ২/৩৫৯, মানাবী, ফাইদুল কাদীর ৪/৩৫৫, ইবনু রাজাব, জামিইল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৪৪৬।
[22] সহীহ মুসলিম, ১/২৮২, নং ৩৭৩, সহীহ বুখারী ১/১১৬, ২২৭।
[23] গোসল ফরয থাকা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতের যিকর করা নিষেধ।
[24] নাবাবী, শারহু সাহীহিল মুসলিম ৪/৬৮, আযকার পৃ. ৩৪, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৪০৮, ৪৩১।