রমযান মাসের ৩০ আসর ষষ্ঠবিংশ আসর শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ১ টি

মুনাফিকদের অনেকগুলি আলামত বা নিদর্শন আছে:

আল্লাহর যা নাযিল করেছেন তাতে সন্দেহ করা, যদিও সে নিজেকে ঈমানদার বলে প্রকাশ করে। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّمَا يَسۡتَ‍ٔۡذِنُكَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱرۡتَابَتۡ قُلُوبُهُمۡ فَهُمۡ فِي رَيۡبِهِمۡ يَتَرَدَّدُونَ ٤٥ ﴾ [التوبة: ٤٥]

‘নিঃসন্দেহে তারাই আপনার কাছে অব্যাহতি চায় যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং তাদের অন্তর সন্দেহ বাতিক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সন্দেহের অবর্তে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৪৫)

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেওয়া হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান অপছন্দ করা। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يَزۡعُمُونَ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓاْ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ وَقَدۡ أُمِرُوٓاْ أَن يَكۡفُرُواْ بِهِۦۖ وَيُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمۡ ضَلَٰلَۢا بَعِيدٗا ٦٠ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ رَأَيۡتَ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودٗا ٦١ ﴾ [النساء: ٦٠، ٦١]

‘আপনি কি তাদের দেখেন নি যারা দাবি করে যে, তারা আপনার এবং আপনার পূর্ববর্তীদের ওপর অবতীর্ণ বিষয়ে ঈমান এনেছে, তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ত্বাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায় (মীমাংসার জন্য)। অথচ তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা যেন ত্বাগুতকে অমান্য করে। আর শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্টতায় বহু দূর নিয়ে যেতে চায়। আর যখন আপনি তাদের বলেন, যা আল্লাহ নাযিল করেছে এবং তিনি যা রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন সে দিকে আস, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাচ্ছে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬০-৬১)

ইসলামের বিজয় এবং মুসলিমদের সাহায্য করাকে অপছন্দ করা এবং মুসলিমদের অপমান-লাঞ্ছনায় খুশি হওয়া। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِن تُصِبۡكَ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡۖ وَإِن تُصِبۡكَ مُصِيبَةٞ يَقُولُواْ قَدۡ أَخَذۡنَآ أَمۡرَنَا مِن قَبۡلُ وَيَتَوَلَّواْ وَّهُمۡ فَرِحُونَ ٥٠ ﴾ [التوبة: ٥٠]

‘আপনাকে কোনো কল্যাণ স্পর্শ করলে তাদের তা মন্দ লাগে, পক্ষান্তরে আপনার কোনো বিপদ এলে তারা বলে, আমরা পূর্ব থেকেই নিজেদের কাজ সামলে নিয়েছি এবং তারা উল্লাসিত মনে ফিরে যায়।’ (সূরা আত-তওবা, আয়াত: ৫০)

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَإِذَا لَقُوكُمۡ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ عَضُّواْ عَلَيۡكُمُ ٱلۡأَنَامِلَ مِنَ ٱلۡغَيۡظِۚ قُلۡ مُوتُواْ بِغَيۡظِكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ١١٩ إِن تَمۡسَسۡكُمۡ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡ وَإِن تُصِبۡكُمۡ سَيِّئَةٞ يَفۡرَحُواْ بِهَاۖ وَإِن تَصۡبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لَا يَضُرُّكُمۡ كَيۡدُهُمۡ شَيۡ‍ًٔاۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ١٢٠ ﴾ [ال عمران: ١١٩، ١٢٠]

‘যখন তারা তোমাদের সঙ্গে মিশে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয় তখন তোমাদের ওপর আক্রোশবশত আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, তোমরা নিজ আক্রোশেই মরতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের কথা সম্পর্কে সবিশেষ অবগত। তোমাদের যদি কোনো ক্যল্যাণ হয়, তাহলে তাদের মন্দ লাগে আর তোমাদের যদি কোনো অকল্যাণ হয়, তাহলে তারা আনন্দিত হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনোই ক্ষতি হবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে সে সবই আল্লাহর আয়ত্বে রয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৯-১২০)

মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ ও ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা এবং মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য তৈরী করা এবং এটা করতে পছন্দ করা। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗا وَلَأَوۡضَعُواْ خِلَٰلَكُمۡ يَبۡغُونَكُمُ ٱلۡفِتۡنَةَ وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡ﴾ [التوبة: ٤٧]

‘যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৪৭)

ইসলামের দুশমন ও কাফের নেতৃবৃন্দকে ভালোবাসা, তাদের প্রশংসা করা এবং তাদের ইসলাম বিরোধী মতাদর্শ প্রচার-প্রসার করা। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ تَوَلَّوۡاْ قَوۡمًا غَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِم مَّا هُم مِّنكُمۡ وَلَا مِنۡهُمۡ وَيَحۡلِفُونَ عَلَى ٱلۡكَذِبِ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٤ ﴾ [المجادلة: ١٤]

‘আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেন নি যারা আল্লাহর গজবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারা মুসলিমদের দলভুক্ত নয় অনুরূপভাবে তারা তাদেরও দলভুক্ত নয়; আর তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।’ (সূরা আল-মুজাদালাহ্‌, আয়াত: ১৪)

মুমিনদের নিয়ে টিপ্পনী কাটা, তাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে দোষ খুঁজে বেড়ানো। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهۡدَهُمۡ فَيَسۡخَرُونَ مِنۡهُمۡ سَخِرَ ٱللَّهُ مِنۡهُمۡ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٧٩ ﴾ [التوبة: ٧٩]

‘মুমিনদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ছাড়া কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে। অতঃপর তারা তাদের নিয়ে উপহাস করে, আল্লাহ্ তাদেরকে নিয়ে উপহাস করেন; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৭৯)

অর্থাৎ যারা অধিক ইবাদত করতে তাদেরকে মুনাফিকরা রিয়াকারী বা প্রদর্শনকারী বলত। আর যারা অক্ষম ছিল তাদেরকে শৈথিল্যকারী বলে দোষ দিত।

ঘৃণা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুমিনদের ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ يَسۡتَغۡفِرۡ لَكُمۡ رَسُولُ ٱللَّهِ لَوَّوۡاْ رُءُوسَهُمۡ وَرَأَيۡتَهُمۡ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسۡتَكۡبِرُونَ ٥ ﴾ [المنافقون: ٥]

‘যখন তাদের বলা হয় তোমরা এসো! আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর আপনি তাদের দেখবেন তারা দম্ভভরে ফিরে যায়।’ (সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৫)

সালাতকে ভারী মনে করা ও তা থেকে অলসতা। যেমন,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمۡ وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٤٢ ﴾ [النساء: ١٤٢]

‘অবশ্যই মুনাফিকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সঙ্গে। বস্তুত তারা নিজেরা নিজেদের প্রতারিত করে। তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায়; আর তারা আল্লাহকে খুব অল্পই স্মরণ করে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২)

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ، وَصَلَاةُ الْفَجْرِ»

‘মুনাফিকদের পক্ষে ইশা ও ফজরের সালাত আদায় করা বড় কঠিন।’[1]

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছে এমন মুমিনদের কষ্ট দেওয়া।

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمِنۡهُمُ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلنَّبِيَّ﴾ [التوبة: ٦١]

‘আর তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয়।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬১)

* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمۡ عَذَابٗا مُّهِينٗا ٥٧ وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٥٨ ﴾ [الاحزاب: ٥٧، ٥٨]

‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে ইহকাল ও পরকালে অভিশপ্ত করেন আর তাদের জন্য রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। আর যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহণ করে।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৭-৫৮)

এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুনাফিকের নিদর্শনাবলী আলোচিত হলো, আমরা এগুলো উল্লেখ করেছি; যাতে এগুলো থেকে সাবধান করা যায় এবং এ পথের পথিক হওয়া থেকে নিজের অন্তরকে পবিত্র রাখা যায়।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে নিফাক থেকে আপনার কাছে আশ্রয় দিন। আমাদেরকে যেরূপ ঈমান থাকলে আপনি সন্তুষ্ট হোন সেরূপ ঈমান নসীব করুন।

হে সৃষ্টিকুলের রব! আপনি আমাদের, আমাদের পিতা-মাতা এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সাহাবীগণের ওপর।

[1] বুখারী: ৬৫৭; মুসলিম: ৬৫১।