সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি শক্তিশালী সুদৃঢ়, পদানতকারী বিজয়ী কর্তৃত্বশীল, প্রকাশ্য সত্য, মৃদু কান্নার শব্দও যার শ্রবণ থেকে গোপন থাকে না, যার মহত্বের কাছে ক্ষমতাধর নরপতিরা হীন হয়ে গেছে। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী ফয়সালা করেন, আর তিনি মহাবিচারক।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি পূর্বের ও পরের সবার ইলাহ। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তিনি সকল সৃষ্টিকুল থেকে বেঁছে নিয়েছেন, বদর প্রান্তরে ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, অনুরূপ তার পরিবার-পরিজন, সকল সাহাবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুন্দরভাবে তাদের অনুসারীদের সবার উপর। আর তিনি তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রদান করুন।
সম্মানিত ভাইয়েরা! এ পবিত্র মাসেই আল্লাহ তা‘আলা মহান বদর যুদ্ধে মুসলিমদেরকে তাদের শত্রু মুশরিকদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা এ দিবসকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণের দিন বলে নাম রেখেছেন; কেননা আল্লাহ তা‘আলা সেদিন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের বিজয়ী এবং কাফির ও মুশরিকদের পরাজিত করার মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের পার্থক্য সূচিত করেছেন।
এ মহা বিজয়ের ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে।
এ যুদ্ধের কারণ ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মর্মে সংবাদ পেলেন যে, আবূ সুফিয়ান কুরাইশ কাফিরদের একটি বানিজ্য দল নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরাইশদের বানিজ্য কাফেলার গতিরোধের জন্য বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। কেননা কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের মাঝে কোনো প্রকার চুক্তি ছিল না। আর কাফির কুরাইশরা মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ হতে বের করে দিয়েছিল এবং ইসলামের সত্যবাণীর দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ বানিজ্য কাফেলার সাথে যা করার ইচ্ছা করেছিলেন তা ছিল যথার্থ।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩১০ এর বেশি কিছু সাহাবীকে নিয়ে বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। তাদের ছিল কেবলমাত্র দুটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট; যাতে তারা পালাক্রমে চড়ছিলেন। এ যুদ্ধে ৭০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। তারা বানিজ্য কাফেলা ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চান নি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা অনির্ধারিত সময়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ও শত্রুদের মাঝে মুখোমুখি দাঁড় করালেন।
আবূ সুফিয়ান মুসলিমদের অবস্থা জানতে পেরে কুরাইশদের কাছে এ মর্মে একজন চিৎকারকারী সংবাদবাহক পাঠায় যেন কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই আবূ সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমুদ্র উপকূল ধরে রওয়ানা দিল এবং নিরাপদে পৌঁছে গেল।
কিন্তু কুরাইশ সম্প্রদায়; তাদের কাছে চিৎকারকারীর মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছা মাত্রই তাদের নেতৃস্থানীয় একহাজার লোক সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। তাদের ছিল ১০০টি অশ্ব ও ৭০০ উষ্ট্র। তারা বের হয়েছিল
﴿بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ٤٧ ﴾ [الانفال: ٤٧]
‘অহঙ্কার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে বাধা প্রদান করতে, আর তারা যা করছিল, আল্লাহ তা পরিবেষ্টনকারী।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৭)
তাদের সঙ্গে ছিলো নর্তকী দল, যারা মুসলিমদের বদনামি ও বিদ্রূপ করে গান গাইছিলো। আবূ সুফিয়ান যখন কুরাইশদের যাত্রার কথা জানতে পারল, তখন সে নিজের নিরাপদে ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে কুরাইশদের যুদ্ধ ছাড়াই ফিরে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধ ছাড়া পিছু ফিরে যেতে অস্বীকার করল।
আবূ জেহেল বলল, “আল্লাহর শপথ, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বদর প্রান্তরে না পৌঁছব ততক্ষণ ফিরে যাব না। আমরা বদর প্রান্তরে তিনদিন অবস্থান করব। তথায় উট জবাই করব, খাদ্য খাব, মদ পান করব আর তাতে আরব জাতি আমাদের গৌবরগাথা শুনে সর্বদা ভয় পাবে”।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরাইশদের বের হবার খবর জানতে পারলেন, সাহাবীদের একত্র করে পরামর্শে বসলেন। তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছেন দু’টি দলের একটি (মুসলিমদের মাধ্যমে পদানত হবে) হয়তো ব্যবসায়ী কাফেলা অথবা অন্যটি সৈন্যবাহিনী।’
* অতঃপর মুহাজির সাহাবী মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হোন। আল্লাহর শপথ! আমরা আপনাকে এমন কথা বলব না, যেমন মুসা (‘আলাইহিস সালাম) কে তাঁর জাতি বনী ইসরাইল বলেছিল:
﴿ٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَٰتِلَآ إِنَّا هَٰهُنَا قَٰعِدُونَ ٢٤ ﴾ [المائدة: ٢٤]
‘হে মুসা! তুমি ও তোমার রব যাও এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হও। আমরা এখানে বসে থাকলাম।’ (সূরা আল-মায়িদাহ্, আয়াত: ২৪) বরং আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে এবং পিছনে যুদ্ধ করব।
* এ কথা শুনে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ ইবন মু‘আয আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবত আপনি আনসারদের ব্যাপারে এ আশংকা করছেন যে, তাদের অধিকার আছে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে দূরে আপনাকে সাহায্য না করার। তাই আমি আনসারদের পক্ষ থেকে বলছি এবং তাদের পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছি, যে দিকে আপনি চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা আপনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন, যার থেকে ইচ্ছা সম্পর্ক কর্তন করুন, আমাদের সম্পদ হতে যা ইচ্ছা গ্রহণ করুন, তন্মধ্য হতে যা ইচ্ছা আমাদের দান করুন, আপনি যা আমাদের জন্য ছেড়ে যাবেন তার চেয়ে যা আমাদের থেকে গ্রহণ করবেন তা-ই আমাদের নিকট অধিক প্রিয়। আপনি আমাদের যা নির্দেশ দেবেন আমাদের নির্দেশ সেখানে আপনার নির্দেশের অনুগামী হবে। আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাদের নিয়ে গামদান হতে বুরাক পর্যন্ত চলেন, তাহলে অবশ্যই আমরা আপনার সঙ্গে চলব। আর যদি আপনি আমাদের এ সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা তাই করব। আমরা এটা পছন্দ করি না যে, আপনি আগামী দিন আমাদের নিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করবেন। নিশ্চয় আমরা যুদ্ধে অত্যন্ত ধৈর্যশীল, শত্রুদের মোকাবিলায় সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানকারী। আমরা আশা রাখি আল্লাহ আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে এমন কিছু দেখাবেন যদ্বারা আপনার চক্ষু শীতল হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কথা শুনে খুশি হয়ে সুসংবাদ দিয়ে বললেন:
«سَيْرُوا وأبْشِرُوا فَوالله لَكَأنِّي أنْظُرَ إلى مَصارِعِ القومِ»
‘তোমরা চলতে থাক আর সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহর শপথ, আমি যেন (মুশরিক) গোষ্ঠীর মৃত দেহ পড়ে থাকার জায়গাগুলো দেখতে পাচ্ছি।’[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সৈন্যদল সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং বদর কূপসমূহের কাছের পানির কূপের সম্মুখে যাত্রাবিরতি দিলেন। হুবাব ইবনুল মুনযির ইবন ‘আমর ইবনুল জুমুহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি এমন স্থান যেখানে অবস্থানের জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে আমাদের এদিক-সেদিক যাওয়ার সুযোগ নেই; নাকি এটা যুদ্ধ সংক্রান্ত কর্মকৌশল ও অভিমত?
উত্তরে তিনি বললেন, বরং এটা যুদ্ধ সংক্রান্ত কৌশল ও সিদ্ধান্ত। হুবাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু পুনরায় বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা তো ভালো স্থান নয়, তাই আমাদেরকে কুরায়েশের নিকটবর্তী কূপের নিকট নিয়ে চলুন। সেখানে আমরা অবস্থান করব এবং এর পিছনের কূপগুলো নষ্ট করব। অতঃপর সে কূপের কাছে হাওজ বানিয়ে তা পানি দিয়ে পূর্ণ করে রাখব, ফলে আমরা পানি পান করব অথচ তারা পানি পান করতে পারবে না।[2]
এ মতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করলেন। এরপর তারা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনার দিক থেকে নিকটবর্তী ‘উদওয়াতুদ দুনিয়া’তে (উপত্যকার নিকটবর্তী অংশে) অবতরণ করলেন, অন্য দিকে কুরাইশরা মক্কার দিক থেকে ‘উদওয়াতুল কুসওয়া’তে (উপত্যকা থেকে দূরের অংশে) অবস্থান করল। ওই রাতেই আল্লাহ তা‘আলা এমন মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন যা কাফিরদের জন্য বিরাট বিপদ ও দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাদের মাটি কাদা ও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। ফলে তারা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারেনি। অপরদিকে বৃষ্টি মুসলিমদের জন্য খুব হাল্কা ছিল ফলে তা তাদেরকে পবিত্র করল এবং তাদের যমীনকে চলাচল উপযোগী করে দিল, বালুকে শক্ত করল, অবস্থানকে অনুকুল করল এবং পদসমূহে স্থিরতা প্রদান করল।
আর মুসলিমরা যুদ্ধের মাঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য উঁচু স্থানে একটি তাঁবু বানালেন, যেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান দেখা যায়, তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে নামলেন, সাহাবীগণের কাতার সুন্দর করে সাজালেন, যুদ্ধের ময়দানে চলতে থাকলেন এবং মুশরিকদের পতনের স্থল ও হত্যার স্থানসমূহের দিকে ইঙ্গিত করতে থাকলেন, আর তিনি বলছিলেন, “আল্লাহ চাহেত এটা অমুকের পতিত হওয়ার জায়গা, এটা অমুকের মৃত্যুস্থান।” পরবর্তীতে দেখা গেল যে, রাসূলের ইঙ্গিতের জায়গা থেকে ঐ লোকদের মৃত্যু সামান্যও হেরফের হয়নি।[3] ।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবী মুসলিম মুজাহিদ এবং কাফির কুরাইশদের দিকে তাকালেন। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দো‘আ করে বললেন, “হে আল্লাহ! এ কাফির কুরাইশ দল অহংকার ও গর্বোদ্ধত হয়ে এখানে এসেছে তাদের যাবতীয় সৈন্য-সামন্ত নিয়ে, আপনার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করছে এবং আপনার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। হে আল্লাহ! এ কঠিন মুহূর্তে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, যার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আপনি আমাকে দিয়েছেন। হে আল্লাহ! আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তাবায়ন করুন। হে আল্লাহ আমি আপনার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গিকারের বাস্তবায়ণ চাই। হে আল্লাহ, আপনি যদি চান তো আপনার ইবাদত করা হবে না। হে আল্লাহ! যদি এ মুসলিম দলকে আপনি ধ্বংস করে দেন, তাহলে আজ থেকে আপনার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।”[4]
মুসলিমগণ স্বীয় রবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন এবং তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা করলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের ডাকে সাড়া দিলেন।
﴿إِذۡ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمۡ فَثَبِّتُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ سَأُلۡقِي فِي قُلُوبِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلرُّعۡبَ فَٱضۡرِبُواْ فَوۡقَ ٱلۡأَعۡنَاقِ وَٱضۡرِبُواْ مِنۡهُمۡ كُلَّ بَنَانٖ ١٢ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ شَآقُّواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ وَمَن يُشَاقِقِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١٣ ذَٰلِكُمۡ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٤﴾ [الانفال: ١٢، ١٤]
‘স্মরণ কর, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করেন যে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তোমরা তাদেরকে অনড় রাখ। অচিরেই আমি ভীতি ঢেলে দেব তাদের হৃদয়ে যারা কুফরী করেছে। অতএব তোমরা আঘাত কর ঘাড়ের উপরে এবং আঘাত কর তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে। এটি এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। এটি আযাব, সুতরাং তোমরা তা আস্বাদন কর। আর নিশ্চয় কাফিরদের জন্য রয়েছে আগুনের আযাব।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১২-১৪)
অতঃপর দু’টি দল (মুসলিম ও মুশরিক) পরস্পর মুখোমুখি হল এবং যুদ্ধ চলতে থাকল এবং প্রচণ্ড রূপ লাভ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুতে অবস্থান করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। তারা দু’জনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাহারা দিচ্ছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবের নিকট দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাতর প্রার্থনা জানালেন, সাহায্য ও বিজয়ের প্রার্থনা করলেন, উদ্ধার চাইলেন। তারপর রাসূল সামান্যতম সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন, তারপর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে বললেন, “অবশ্যই কাফিররা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে পলায়ন করবে।” [সূরা আল-কামার: ৪৫][5]
আর তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, ধৈর্যধারণ করে সওয়াবের আশায় সামনে অগ্রসর হয়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন না করে যুদ্ধ করে মারা যাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” এ কথা শুনে ‘উমাইর ইবনুল হুমাম আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়ালেন, আর তার হাতে ছিল কিছু খেজুর; যা তিনি খাচ্ছিলেন; তিনি বলতে লাগলেন: হে আল্লাহর রাসূল! জান্নাত কি আকাশ ও জমিন পরিমাণ প্রশস্ত? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তখন ‘উমাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, বিরাট ব্যাপার, বিরাট ব্যাপার, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মাঝে আর জান্নাতে প্রবেশের মাঝে পার্থক্য এতটুকুই যে, ওই কাফিররা আমাকে হত্যা করবে। আমি যদি এ খেজুরগুলো খাওয়া শেষ করা পরিমান সময় জীবিত থাকি তাহলে তো অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে, এ কথা বলেই তিনি খেজুরগুলো নিক্ষেপ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন এবং নিহত হলেন, আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হোন।[6]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি মাটি বা পাথর নিয়ে কাফির দলের প্রতি ছুঁড়ে মারলেন, রাসূলের নিক্ষিপ্ত পাথর তাদের সকলের চোখে বিদ্ধ হল। তাদের সকলের চোখেই সেটা পূর্ণ করে দিল, তারা তাদের চোখের মাটি ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল; যা ছিল আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি নিদর্শন। ফলে মুশরিক সৈন্যদের পরাজয় হল এবং তারা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করে পলায়ন করল। আর মুসলিমগণ তাদের পিছু নিয়ে তাদের হত্যা ও বন্দি করা অব্যাহত রাখল। এভাবে তাদের ৭০ জন কাফির নিহত ও ৭০ জন বন্দি হল। নিহতের মধ্যকার ২৪ জন কাফির কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বদরের একটি নর্দমাক্ত কূপে নিক্ষেপ করা হলো। এদের মধ্যে ছিল আবূ জাহল, শায়বা ইবন রবী‘আ ও তার ভাই ‘উতবা এবং তার ছেলে অলীদ ইবন ‘উতবা।
* সহীহ বুখারীতে ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলামুখী হয়ে কাফির কুরাইশদের এ চারজনের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছিলেন”। ইবন মাস‘উদ বলেন, আমি আল্লাহর সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, নিশ্চয়ই আমি এ কাফির কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে মৃত দেখতে পেয়েছি; সূর্য তাদের চেহারাগুলোকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আর সেদিন খুব গরম ছিল।”[7]
* অনুরূপভাবে বুখারীতে আবূ তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের দিন ২৪ জন কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বদরের নিকৃষ্ট কূপের মধ্যে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ম ছিল যে, তিনি কারও উপর বিজয়ী হলে সেখানে তিন দিন অবস্থান করতেন। সে অনুসারে বদরের তৃতীয় দিনে তিনি তাঁর বাহন প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন, তা বাঁধা হলে তিনি চলতে লাগলেন সাহাবীগণ তাঁর পিছু নিলেন। অবশেষে তিনি কূপের পার্শ্বদেশে দাঁড়ালেন এবং প্রত্যেকের নাম ও পিতার নাম ধরে ডাকলেন এবং বলতে লাগলেন, হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক, আজ তোমাদের জন্য কি এটা আন্দদায়ক হত না, যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে? আমাদের রব আমাদের বিজয় দান করার ব্যাপারে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা যথার্থ পেয়েছি। তোমরা কি তোমাদের রবের ওয়াদা পেয়েছ? ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন লোকদের সঙ্গে কি কথা বলছেন যাদের দেহ আছে কিন্তু আত্মা নেই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ
ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আমি তাদের সঙ্গে যা বলছি, তোমরা তা তাদের চেয়ে বেশি শুনতে পাচ্ছ না।”[8]
আর বন্দীদের ব্যাপার: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ব্যাপারে সাহাবীদের পরামর্শ চাইলেন। সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে তাদের বিষয়টি খুবই মারাত্মক ও খারাপ মনে হয়েছে, তাই তিনি বললেন, এটাই সর্বপ্রথম ঘটনা যা আল্লাহ মুশরিকদের উপর ঘটিয়েছেন। আর যুদ্ধে রক্ত প্রবাহিত করে দেওয়া আমার কাছে তাদেরকে জীবিত রাখার চেয়েও বেশি প্রিয়।
* ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি মনে করি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার অনুমতি থাকলে আমরা কাফিরদের ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা করব। অতএব আলীকে (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আকীলের ব্যাপারে নির্দেশ দিন, তিনি যেন তাকে হত্যা করেন। আর আমাকে অমুকের (যিনি তার আত্মীয় ছিলেন তার) ব্যাপারে অনুমতি দিন তার ঘাড়ে আমি এখনিই আঘাত হানব। কেননা এরা সকলেই কাফির নেতৃবৃন্দ ও প্রধান ব্যক্তিবর্গ।”
* আর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, “এরা তো আমাদেরই চাচাতো ভাই, আমাদেরই গোষ্ঠীর লোক। তাই আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হোক। এতে করে কাফিরদের উপর আমাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তাছাড়া হতে পারে তাদেরকে আল্লাহ ইসলামের প্রতি হেদায়াত করবেন।”[9]
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিনিময় (মুক্তিপণ) গ্রহণ করলেন। তাদের সর্বোচ্চ বিনিময়ের পরিমাণ ছিল ৪০০০ দিরহাম থেকে শুরু করে ১০০০ দিরহাম পর্যন্ত।
আর তাদের কেউ কেউ মদীনায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা করানোর মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করল।
কেউ মুক্তি পেল কুরাইশের কাছে বন্দি মুসলিমের মুক্তির বিনিময়ে।
আবার কাউকে মুসলিমদের প্রতি কঠিন কষ্টদায়ক আচরনের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যা করলেন।
আবার কাউকে তিনি বিশেষ স্বার্থের কারণে দয়া করে বিনা বিনিময়েই মুক্ত করে দিলেন।
এ হচ্ছে বদর যুদ্ধ। যে যুদ্ধে অল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনী বেশি সংখ্যক সৈন্যবাহিনীর ওপর বিজয় অর্জন করেছিল।
﴿ فِئَةٞ تُقَٰتِلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَأُخۡرَىٰ كَافِرَةٞ ﴾ [ال عمران: ١٣]
‘একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি কাফির। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩)
অল্প সংখ্যক লোকের দলটি বিজয় অর্জন করেছিল। কেননা তারা আল্লাহর দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা আল্লাহর দ্বীনের কালেমা বুলন্দ করার জন্য ও আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধ করেছিল। ফলে মহান আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছিলেন। অতএব হে মুসলিম ভাইসব! আপনারা দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুন; যাতে আপনাদের শত্রুদের ওপর বিজয়ী হতে পারেন এবং ধৈর্য ধারণ করুন, অপরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিন, স্থির থাকুন এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন। আশা করা যায় আপনারা সফল হবেন।
হে আল্লাহ! আমাদের ইসলাম দিয়ে আমাদেরকে বিজয় দান করুন, আমাদেরকে আপনার দ্বীনের সাহায্যকারী এবং আপনার দ্বীনের দা‘ঈ হিসেবে কবুল করুন আর আপনার সাক্ষাতের সময় পর্যন্ত আপনি আমাদেরকে এ দ্বীনের ওপর অটল রাখুন।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
[2] সীরাতে ইবন হিশাম: ১/৬২০; বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/১৬৭; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৫।
[3] আহমাদ ১/১১৭; অনুরূপ মুসলিম: ১৭৭৯।
[4] মুসলিম : ১৭৬৩।
[5] দেখুন, বুখারী: ৩৯৫৩।
[6] মুসলিম: ১৯০১।
[7] বুখারী: ৩৯৬০।
[8] বুখারী: ৩৯৭৬।
[9] দেখুন, মুসলিম: ১৭৬৩।