সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহের অন্যতম হলো, সিয়াম পালনকারী সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কথা সর্বদা স্মরণ করবে; যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাকে সিয়াম পালনের তাওফীক দিয়েছেন, তার জন্য সহজ করে দিয়েছেন, ফলে সে এ দিনের সিয়াম পূর্ণ করতে পেরেছে, এ মাসের সিয়াম পুরোপুরিভাবে আদয় করতে পেরেছে। কারণ, এমন অনেক লোক রয়েছে যারা সিয়াম পালনের নে‘আমত থেকে মাহরূম হয়েছে, তাদের কেউ কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পূর্বে মারা গেছে, আবার কেউ ছিল সিয়াম পালনে অক্ষম, আবার তাদের কেউ পথভ্রষ্টতা ও দ্বীন বিমুখিতার ফলে সিয়াম পালন করতে পারেনি।
তাই সিয়াম পালনকারীর উচিত হলো এ নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করা; যা গোনাহের ক্ষমা, মন্দ-পাপাচার থেকে মুক্তি, স্থায়ী নে‘আমতপূর্ণ দারুন না‘ঈম জান্নাতে মহান সম্মানিত রবের পাশে থাকার মত সুউচ্চ মর্যাদা লাভের মাধ্যম।
ভাইয়েরা আমার! সিয়ামের আদবগুলো রক্ষা করুন। আর (আল্লাহর) গযব (ক্রোধ) ও শাস্তির কারণগুলো থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখুন। সালাফে সালেহীন তথা সৎকর্মশীল পূর্বসুরীদের গুণে গুণান্বিত হোন, কেননা পূর্ববর্তীরা যেভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং পাপাচার থেকে বিরত থেকে সংশোধিত হয়েছিলেন, শেষ যামানার উম্মতদেরও সে একই পদ্ধতিতে সংশোধিত হতে হবে।
* ইবন রজব রহ. বলেন, সিয়াম পালনকারীরা দুস্তরে বিভক্ত:
প্রথম স্তর: ওই সকল লোক, যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় পানাহার ও কামপ্রবৃত্তি ত্যাগ করে এবং জান্নাতে তার বিনিময় আশা করে। তিনি তো আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন ও লেন-দেন করেছেন। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান কখনও নষ্ট করেন না, যে তাঁর সাথে লেনদেন করবে সে কখনও আশাহত হবে না বরং সবচেয়ে বড় ধরনের লাভে ধন্য হবে।
* একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে উদ্দেশ করে বললেন:
«إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءً لِلَّهِ، إِلَّا آتَاكَ اللَّهُ خَيْرًا مِنْهُ»
‘নিশ্চয় তুমি যা কিছুই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের কারণে পরিত্যাগ করবে, তার চেয়েও উত্তম বস্তু তিনি তোমাকে প্রদান করবেন।’[1]
এ ধরনের সিয়াম পালনকারীর চাহিদা মত আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তাকে শ্রেষ্ঠতম খাদ্য-পানীয় ও স্ত্রী দান করবেন।
* আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيَٓٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ ٢٤ ﴾ [الحاقة: ٢٤]
‘(বলা হবে) ‘বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান কর।’ (সূরা আল-হাক্কাহ্, আয়াত: ২৪)
* মুজাহিদ রহ. সহ আরো অনেকে বলেন, এ আয়াত সিয়াম পালনকারীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
* আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেছেন:
« وَرَأَيْتُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي يَلْهَثُ عَطَشًا كُلَّمَا دَنَا مِن حَوْضٍ مُنِعَ وطُرِدَ، فَجَاءَهُ صِيَامُ رَمَضَانَ فَسَقَاهُ وَأَرْوَاهُ»
‘আর আমি আমার উম্মতের এক লোককে দেখতে পেলাম সে পিপাসায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। যখন সে পানি পানের জন্য হাউজের কাছে যায়, তখন তাকে সেখানে বাধা দেয়া হয় এবং সে ওখান থেকে বিতাড়িত হয়। অতঃপর তার কাছে রমযানের সিয়াম এসে উপস্থিত হলো এবং তাকে পানি পান করিয়ে তৃপ্ত করালো।’[2]
হে আমার জাতি! এ রমযানে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে (কুরআন তিলাওয়াত ও নফল সালাতের মাধ্যমে) কথা বলার কি কেউ নেই?
তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য জান্নাতে সংরক্ষিত নেয়ামতরাজির প্রতি আগ্রহী কি কেউ নেই?
কবির ভাষায় বলতে হয়:
مَنْ يُرِدْ مُلْكَ الْجِنَانِ فلْيَدعْ عنه التواني
ولْيَقْم في ظُلمةِ اللي لِ إلى نورِ القُرآنِ
ولْيَصِلْ صوماًبصومٍ إن هذا العَيشَ فَانِ
إنَّما العيشُ جِوارُ الله في دارِ الأمانِ
যে হতে চায় জান্নাতের মালিক সে যেন ছাড়ে অবহেলা
সে যেন দাঁড়ায় রাতের আঁধারে কুরআনের আলো নিয়ে
সে যেন পর্যায়ক্রমে পালন করে সিয়াম নিশ্চয় এ জীবন নশ্বর
প্রকৃত জীবন হলো আল্লাহর প্রতিবেশীত্বে জান্নাতের বাড়ীতে।
সিয়াম পালনকারীদের দ্বিতীয় স্তর: এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত পার্থিব সব কিছু ছেড়ে বিরত থাকার সাওম পালন করে। তারা মস্তিষ্ককে মন্দ চিন্তা থেকে এবং উদরকে পূর্ণ খাবার মুক্ত রাখে। মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পঁচে-গলে যাবার কথা স্মরণ করে এবং আখিরাতের উদ্দেশে দুনিয়ার সৌন্দর্য ত্যাগ করে। এমন লোকের জন্যই তো তার রবের সাথে সাক্ষাত ও তাঁর দর্শন লাভ হবে প্রকৃত ‘ঈদুল ফিতর’।
কবি বলেন,
‘বিশেষ (প্রকৃত) সিয়াম পালনকারীদের সিয়াম হলো, জিহ্বাকে মিথ্যা বলা ও অপবাদ দেয়া থেকে বিরত রাখা।
আল্লাহর সাধক ও সান্নিধ্যে ধন্য ব্যক্তিদের সিয়াম হলো, অন্তরকে অন্য কারো অনুপ্রবেশ ও তাঁর পর্দা থেকে হেফাযত করা।
আল্লাহর পরিচয় প্রাপ্তগণকে পার্থিব জগতের সুরম্য অট্টালিকা স্বীয় রবের দর্শনের বিপরীতে প্রশান্তি দিতে পারে না। তাঁর দর্শন ছাড়া কোনো ঝর্ণাধারা তাদের পরিতৃপ্ত করতে পারে না। তাদের চিন্তা-চেতনা চাওয়া-পাওয়া এগুলো থেকে অনেক মহৎ।
যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালনার্থে আজ দুনিয়াতে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, আগামীকাল জান্নাতে সে ঐসব চাহিদা লাভ করবে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অপর সব কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, তার ঈদ বা খুশী তো সেদিন হবে যে দিন সে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করবে।
﴿مَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ ٱللَّهِ فَإِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ لَأٓتٖۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٥ ﴾ [العنكبوت: ٥]
‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহর নির্ধারিত কাল আসবে। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ (সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫)
তাই হে তাওবাকারীগণ! আজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সিয়াম পালন করুন, তাহলে প্রতিপালকের সাক্ষাতের দিন ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।[3]
হে আল্লাহ! আপনার প্রতি নিষ্ঠা সৃষ্টি করে আমাদের অন্তরলোককে সৌন্দর্যমণ্ডিত করুন এবং আমাদের আমলগুলোকে আপনার রাসূলের আনুগত্য আর তাঁর আদব অনুকরণের মাধ্যমে সুষমামণ্ডিত করুন।হে আল্লাহ! আমাদের আলস্যের নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিন, অধঃপতন থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অপরাধ ও পাপরাশি ক্ষমা করুন। হে শ্রেষ্ঠ দয়াময়! আপনার দয়ায় আমাদেরকে, আমাদের পিতামাতা ও জীবিত-মৃত সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন। আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
[2] তাবারানী তাঁর মু‘জামুল কাবীর গ্রন্থে হাদিসটি সংকলন করেন, দেখুন, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/১৭৯। তবে হাদীসটি দুর্বল।
[3] ইবন রাজাব, লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃ. ২৯৫, ৩০০।