সিয়াম পালনের রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা ও হিকমত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা করা হলো।
প্রথম হিকমত: ঈমানে নিষ্ঠা ও দাসত্বের পূর্ণতা লাভ
সিয়াম আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম ইবাদত। বান্দা পানাহার, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি লোভনীয় ও প্রিয় বস্তু ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হয়। এর দ্বারা তার ঈমানের সততা, দাসত্বের পূর্ণতা, আল্লাহ তা‘আলাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা ও তাঁর কাছে যা কিছু আছে এগুলোর ব্যাপারে তাঁর ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা প্রকাশ পায়। কেননা মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বস্তু ত্যাগ করেনা, যতক্ষণ তার কাছে এর চেয়েও বড় বস্তু না থাকে। যখন মুমিন এটা জানল যে, আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও লোভনীয় কামবৃত্তি ত্যাগ করে সিয়াম পালন করার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি নিহিত, তখন সে তার প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়। ফলে অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে তা ত্যাগ করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্য তা ছেড়ে দেয়ার মাঝে সে আত্মপ্রশান্তি ও স্বাদ অনুভব করে। এজন্যই এমন অনেক মুমিন রয়েছে যদি তাদেরকে বিনা ওজরে রমযানের একটি সিয়াম ভাঙ্গার জন্য প্রহার করা হয় বা বন্দি করা হয়, তবুও সে সিয়াম ত্যাগ করবে না। এটাই হলো সিয়ামের বড় হিকমত।
দ্বিতীয় হিকমত: তাকওয়া অর্জন
সিয়াম পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা যায় এটা সিয়ামের অন্যতম হিকমত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
কারণ, সিয়াম পালনকারীকে ভালো কাজ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
* যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ والجهلَ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ»
‘যে সিয়াম অবস্থায় মিথ্যা বলা ও তদনুযায়ী আমল করা এবং মূর্খতা ত্যাগ করতে পারলো না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’[1]
যখন কোনো ব্যক্তি সিয়াম অবস্থায় কোনো পাপাচারের ইচ্ছা করে তৎক্ষণাৎ সে যেন স্মরণ করে যে, সে সিয়াম পালনকারী। তাহলে তার জন্য পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা সহজ হবে।
* এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামরত ব্যক্তিকে এ কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে বলে “আমি সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি।” এটা সাওম পালনকারীকে সাবধান করার জন্য যে, তাকে গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আর তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, সে সাওম পালনরত অবস্থায় আছে সুতরাং তাকে কটূক্তি ও গালাগালির জবাব প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
তৃতীয় হিকমত: আল্লাহর স্মরণ ও তার সৃষ্টিতে চিন্তার জন্য একান্ত হওয়া।
এটাও সিয়ামের হিকমত যে, সিয়াম পালনকারীর হৃদয় আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ ও ধ্যানে মগ্ন থাকে। কেননা প্রবৃত্তির দাসত্ব ও অধিক ভোজন উদাসীনতাকে অবধারিত করে। আর ক্ষেত্রবিশেষ অন্তরকে কঠোর করে ও চোখকে সত্য দর্শনে অন্ধ বানিয়ে দেয়।
* এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানাহার কমানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন:
«مَا مَلَأَ ابْنُ آدَمَ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ، حَسْبُ ابْنِ آدَمَ أُكُلَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ، فَإِنْ كَانَ لَا مَحَالَةَ، فَثُلُثُ طَعَامٍ، وَثُلُثُ شَرَابٍ، وَثُلُثٌ لِنَفْسِهِ»
‘আদম সন্তান পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। অথচ আদম সন্তানের জন্য মেরুদণ্ড সোজা থাকে এমন কয়েক লোকমা খাদ্যই যথেষ্ট। অগত্যা যদি খেতেই হয়, তাহলে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, অপর তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং বাকী তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’[2]
* সহীহ মুসলিমে এসেছে, হানযালাহ্ আল-উসাইদী রাদিয়াল্লাহু আনহু, তিনি ছিলেন ওহী লিখকদের একজন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একদিন বললেন, হানযালাহ মুনাফেকী করেছে। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন:
«وَمَا ذَاكَ؟» قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ «نَكُونُ عِنْدَكَ تُذَكِّرُنَا بِالنَّارِ وَالْجَنَّة حَتَّى كَأَنَّا رَأْيُ عَيْنٍ، فَإِذَا خَرَجْنَا مِنْ عِنْدِكَ عَافَسْنَا الْأَزْوَاجَ وَالْأَوْلَادَ وَالضَّيْعَاتِ فنَسِينَا كَثِيرًا» ... الحديث
অর্থাৎ হে হানযালা! সেটা কী রকম? তিনি উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন আপনার নিকট থাকি আপনি আমাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের স্মরণ করিয়ে দেন যেন আমরা তা স্বচক্ষে দেখি। অতঃপর যখন আপনার নিকট থেকে বের হয়ে চলে যাই তখন স্ত্রী-সন্তানাদি ও জমি-জমা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি; তখন অনেক কিছু-ই (আখেরাতের কথা) ভুলে যাই।’
এ হাদীসে রয়েছে, “হে হানযালা! এক ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও এক ঘণ্টা।” তিন বার বললেন।”[3]
* আবূ সুলাইমান আদ-দারানী রহ. বলেন-
أن النفس إذا جاعت وعطشت صفا القلب ورق وإذا شبعت عمي القلب
“যখন নফস ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকে তখন অন্তর স্বচ্ছ এবং কোমল থাকে। আর যখন খাবারে পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্ত থাকে তখন অন্তর অন্ধ থাকে।”
চতুর্থ হিকমত: ধনী ব্যক্তি কর্তৃক নেয়ামত উপলব্ধি
সিয়ামের অন্যতম একটি হিকমত হলো, এর মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহর দেয়া ধন সম্পদের মর্যাদা বুঝতে পারে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাকে খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রীর মত নেয়ামত প্রদান করেছেন, যা থেকে সৃষ্টি জগতের অনেকেই বঞ্চিত রয়েছে। ফলে সে এসব নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে, সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য শুকরিয়া আদায় করে এবং এর মাধ্যমে সে তার ওই সকল ভাইদের কথা স্মরণ করে যারা ক্ষুধার্ত ও অসহায় অবস্থায় রাত যাপন করে। ফলে সে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, যদ্বারা তারা নিজেদের লজ্জা নিবারণ করবে ও ক্ষুধা মিটাবে।
* এজন্যই “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব সমাজের বড় দানশীল। তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন যখন রমযান আসত আর জিব্রাইল ‘আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন ও তাঁর সাথে কুরআন পাঠ করতেন।”[4]
পঞ্চম হিকমত: আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ লাভ
সিয়ামের অন্যতম হিকমত হলো এর মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন, তার ওপর কর্তৃত্ব অর্জন এবং তা দমনের মাধ্যম; যাতে করে নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাসহ তাকে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। এটা নিশ্চিত যে, নফস মন্দ কাজেরই পথ নির্দেশ করে। তবে আল্লাহ যাকে দয়া করেন সে ব্যতিত। সুতরাং মানুষ যখন আত্মাকে লাগামমুক্ত করে দেয়, তখন তাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। পক্ষান্তরে যখন সে তার ওপর কর্তৃত্ববান হয় ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন সুউচ্চ স্থানে ও অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে সক্ষম হয়।
ষষ্ঠ হিকমত: কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও অহংকার থেকে মুক্তি
সিয়ামের অন্যতম হিকমত হচ্ছে, কুপ্রবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় ও অহংকার থেকে মুক্ত করা; যাতে সে সত্যের প্রতি বিনয়ী ও সৃষ্টির প্রতি কোমল হয়। কেননা পরিতৃপ্ত হওয়া, আনন্দ উল্লাস করা ও নারীর সঙ্গে অধিক মেলামেশা করা, এর প্রত্যেকটিই মানুষদেরকে মন্দ, গর্ব, অহংকার, সৃষ্টির উপর দাম্ভিকতা ও হক গ্রহণ না করার দিকে ধাবিত করে। কেননা নফস যখন মনে করে যে তার এগুলো প্রয়োজন তখন সে এগুলো অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর সে যখন সেটা অর্জনে সমর্থ হয় তখন সে মনে করে যে সে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে গেছে, ফলে সে গর্হিত আনন্দ পায় ও তা নিয়ে অহংকার করে, যা পরবর্তীতে তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে এ অবস্থা থেকে সে-ই নিরাপদ থাকতে পারে, আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন।
সপ্তম হিকমত: রক্ত চলাচলের পথ সংকুচিত হওয়া
সিয়ামের আরও হিকমত হলো, ক্ষুধা তৃষ্ণার কারণে মানুষের রক্ত চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে দেহের অভ্যন্তরে শয়তানের চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়।
* কেননা “শয়তান আদম সন্তানের রক্তের সঙ্গে শিরা উপশিরা দিয়ে চলাচল করে।” যেমনটি বুখারী ও মুসলিমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
«إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنَ الإِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ »
‘নিশ্চয় শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় বিচরণ করে।’[5]
মূলত সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ শয়তানের প্ররোচনা থেকে নিরাপদ থাকে এবং ক্রোধ ও কামপ্রবৃত্তির উন্মত্ততা হ্রাস পায়। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
«يا مَعْشَرَ الشَّبَاب! مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ»
‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে, ব্যক্তি বিবাহ করতে সক্ষম, সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখে ও লজ্জাস্থান হেফাজত করে। আর যে বিবাহ করতে সক্ষম নয়, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম তাকে কামভাব থেকে বিরত রাখবে।’[6]
অষ্টম হিকমত: বহুবিধ স্বাস্থ্যগত উপকার
সিয়ামের আরও একটি হিকমত হলো এর দ্বারা বহুবিধ স্বাস্থ্যগত উপকার হয়, যা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আহার নিয়ন্ত্রণ ও পরিপাকতন্ত্রের বিশ্রাম দানের মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং শরীরের অন্যান্য বাড়তি ক্ষতিকর বস্তু ও জলীয় পদার্থ হ্রাস করে।
আহ সিয়াম সাধনার মাঝে আল্লাহ তা‘আলার কত মহান ও চমৎকার হিকমত বিদ্যমান! আর তাঁর বিধি-বিধান সৃষ্টিকূলের জন্য কতই না উপযোগী, উপকারী এবং বাস্তবসম্মত।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের দীনের গভীর প্রজ্ঞা ও শরীয়তের রহস্যাবলির জ্ঞান দান করুন। দ্বীন- দুনিয়ার যাবতীয় কাজ বিশুদ্ধ করে দিন। হে দয়াময়! স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতাকে ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
[2] আহমাদ ৪/১৩২; নাসাঈ, আল-কুবরা, ৮/৫০৯; তিরমিযী ২৩৮০; ইবন মাজাহ: ৩৩৪৯। মু্স্তাদরাকে হাকিম ৪/১২১। আর যাহাবী তা সমর্থন করেছেন।
[3] মুসলিম: ২৭৫০। (অর্থাৎ কিছু সময় আল্লাহর জন্য অবশ্যই থাকবে, হ্যাঁ কিছু সময় তোমার দুনিয়ার জন্যও ব্যয় হবে।) [অনুবাদক]
[4] বুখারী: ৬; মুসলিম: ২৩০৮।
[5] বুখারী: ২০২৩; মুসলিম: ২১৭৫।
[6] বুখারী: ১৯০৫, ৪০৬৬; মুসলিম: ১৪০০।