আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বৈশিষ্ট, কেনই বা তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলা হয়?

 فصل في صفات أهل السنة والجماعة ولم سموا بذلك

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বৈশিষ্ট, কেনই বা তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলা হয়?

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

ثُمَّ مِنْ طَرِيقَةِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ اتِّبَاعُ آثَارِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَاطِنًا وَظَاهِرًا وَاتِّبَاعُ سَبِيلِ السَّابِقِينَ الْأَوَّلِينَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِوَاتِّبَاعُ وَصِيَّةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيْثُ قَالَ عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ مِنْ بَعْدِي ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَيَعْلَمُونَ أَنَّ أَصْدَقَ الْكَلَامِ كَلَامُ اللَّهِ وَخَيْرَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيُؤْثِرُونَ كَلَامَ اللَّهِ عَلَى غَيْرِهِ مِنْ كَلَامِ أَصْنَافِ النَّاسِ وَيُقَدِّمُونَ هَدْيَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى هَدْيِ كُلِّ أَحَدٍ وَلِهَذَا سُمُّوا أَهْلَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَسُمُّوا أَهْلَ الْجَمَاعَةِ لِأَنَّ الْجَمَاعَةَ هِيَ الِاجْتِمَاعُ وَضِدُّها الْفُرْقَةُ وَإِنْ كَانَ لَفْظُ الْجَمَاعَةِ قَدْ صَارَ اسْمًا لِنَفْسِ الْقَوْمِ الْمُجْتَمِعِينَ وَالْإِجْمَاعُ هُوَ الْأَصْلُ الثَّالِثُ الَّذِي يُعْتَمَدُ عَلَيْهِ فِي الْعِلْمِ وَالدِّينِ وَهُمْ يَزِنُونَ بِهَذِهِ الْأُصُولِ الثَّلَاثَةِ جَمِيعَ مَا عَلَيْهِ النَّاسُ مِنْ أَقْوَالٍ وَأَعْمَالٍ بَاطِنَةٍ أَوْ ظَاهِرَةٍ مِمَّا لَهُ تَعَلُّقٌ بِالدِّينِ وَالْإِجْمَاعُ الَّذِي يَنْضَبِطُ هُوَ مَا كَانَ عَلَيْهِ السَّلَفُ الصَّالِحُ ؛ إِذْ بَعْدَهُمْ كَثُرَ الِاخْتِلَافُ وَانْتَشَرَ فِي الْأُمَّةِ

অতঃপর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম তরীকা হলো তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করে, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মুহাজির ও আনসারদের পথে চলে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐ অসীয়ত মেনে চলে, যেখানে তিনি বলেছেন, তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার পরবর্তীতে হেদায়াতপ্রাপ্ত খেলাফায়ে রাশেদীনের পথ ধরে চলবে। তোমরা উহাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং উহার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয়াদি উদ্ভাবন করা থেকে দূরে থাকবে। কেননা দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক নতুন রীতিই ভ্রষ্টতা। তারা জানে যে, সর্বাধিক সত্য কথা হলো আল্লাহর কালাম এবং সর্বোত্তম হেদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াত।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা আল্লাহর কালামকে সকল প্রকার মানুষের কালামের উপর প্রাধান্য দেয় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াতকে মানুষের সকল মতাদর্শের উপর অগ্রাধিকার দেয়। এ জন্যই তাদেরকে আহলুল কিতাব ওয়াস্ সুন্নাহ হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। তাদেরকে আহলুল জামাআতও বলা হয়। কেননা জামাআত অর্থ হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা।[1] এর বিপরীত হলো ফির্কাবন্দী হওয়া বা দলাদলি করা। যদিও জামাআত শব্দটি এক্যবদ্ধ একদল মানুষের পরিচয় সূচক নামে পরিণত হয়েছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের তৃতীয় মূলনীতি হলো ইজমা। ইলম অর্জন এবং দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে এই ইজমার উপর নির্ভর করা হয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা এই তিনটি মূলনীতির মাধ্যমে মানুষের দ্বীন সম্পর্কিত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত কথা ও আমল ওজন করে থাকে। উম্মতের সালাফে সালেহীনের ইজমাই কেবল দ্বীনের মূলনীতি হিসাবে গণ্য। কেননা তাদের পরে প্রচুর মতভেদ হয়েছে এবং উম্মত দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

ব্যাখ্যা: পূর্বের অধ্যায়সমূহে আকীদাহর মাসআলাগুলোতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের তরীকা আলোচনা করার পর এই অধ্যায় এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে শাইখুল ইসলাম দ্বীনের সমস্ত মূলনীতি এবং শাখা-প্রশাখাগুলোর ক্ষেত্রে তাদের তরীকা বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে আহলে সুন্নাতের লোকদের ঐসব বৈশিষ্টও বর্ণনা করেছেন, যার মাধ্যমে তারা বিদআতী এবং কুরআন-সুন্নাহর বিরোধিতাকারীদের থেকে আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী হয়েছে। সুতরাং তাদের বৈশিষ্টগুলো হচ্ছেঃ

(১) প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের অনুসরণ করাঃ অর্থাৎ তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারীকা অবলম্বন করে এবং তাঁর মানহাজের উপরেই চলে। এতে করে তারা ঐসব মুনাফেক থেকে আলাদা হয়ে যায়, যারা শুধু প্রকাশ্যভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে থাকে; তারা গোপনে তাঁর অনুসরণ করেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে আছার বলা হয়। আছার দ্বারা বাহ্যিক আছার তথা তাঁর বাহ্যিক স্মৃতি ও রেখে যাওয়া জিনিষগুলো উদ্দেশ্য নয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বসার স্থানসমূহ, তাঁর ঘুমানোর স্থানসমূহ ইত্যাদি। এগুলো খুঁজে বেড়ানো হলে শির্কে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন অবস্থা হয়েছিল পূর্বের জাতিসমূহের। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেই কথা, কাজ অথবা সমর্থন বর্ণিত হয়েছে, তাকেই সুন্নাত বলা হয়।

(২) সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী মুহাজির ও আনসারদের পথ অবলম্বন করাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো তারা ইসলামের প্রথম যুগের এবং সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আনসার ও মুহাজিরদের পথেই চলে। কেননা আল্লাহ তাআলা খাসভাবে তাদেরকে দ্বীনের জ্ঞান ও বোধশক্তি দিয়েছিলেন। তারা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানীতে ইহার ব্যাখ্যা শ্রবণ করেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তারা সত্যের সর্বাধিক নিকটবর্তী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে তারাই সর্বাধিক অনুসরণীয়। সুতরাং রাসূলের পরে অনুসরণের দিক থেকে তাদের স্থান দ্বিতীয় স্তরে। ফলে দ্বীনের কোন মাসআলায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দলীল না পাওয়া গেলে সাহাবীদের কথাই ঐ বিষয়ে প্রমাণ হিসাবে গণ্য হবে এবং তার অনুসরণ করা আবশ্যক হবে। কেননা তাদের পথ হলো সর্বাধিক নিরাপদ, সর্বাধিক জ্ঞান সম্পন্ন, অত্যাধিক সুস্পষ্ট এবং খুব মজবুত। পরবর্তী যুগের কতিপয় লোকের ন্যায় এই কথা বলা ঠিক হবেনা যে, সালাফদের পথ সর্বাধিক নিরাপদ হলেও পরবর্তীদের পথ সর্বাধিক প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং সুদৃঢ়। এতে করে তারা সালাফদের পথ পরিহার করে খালাফ তথা পরবর্তীদের পথেই চলে।

(৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসীয়ত মেনে চলাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেই অসীয়ত মেনে চলে যেখানে তিনি বলেছেন,

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ»

‘‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং উহার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতের পরিণাম গোমরাহী’’।[2]

এখানে শাইখের উদ্দেশ্য হলো এই কথা বর্ণনা করা যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ও সৎকর্মে অগ্রগামী সকল আনসার ও মুহাজিরদের পথ অনুসরণ করার সাথে সাথে বিশেষভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনেরও অনুসরণ করে থাকে। কেননা এই হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাসভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন। এখানে তিনি তাঁর সুন্নাতকে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বুঝা গেল, খোলাফায়ে রাশেদীন বা তাদের কারো একজনের সুন্নাত পরিত্যাগ করা যাবেনা।

খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে চারজন খলীফা উদ্দেশ্য। আবু বকর, উমার, উছমান ও আলী (রাঃ)। তাদেরকে রাশেদীন তথা সুপথগামী বলার কারণ হলো তারা সত্যকে চিনতে পেরেছেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করেছেন। যে ব্যক্তি সত্যকে চিনতে পেরেছে এবং অনুসরণ করেছে, সেই রাশেদ বা সুপথপ্রাপ্ত। এর বিপরীত হলো, পথভ্রষ্ট। অর্থাৎ সত্যের সন্ধান পেয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী আমল করেনি, সেই হলো পথভ্রষ্ট।

المهديين হেদায়াতপ্রাপ্তঃ অর্থাৎ যাদেরকে আল্লাহ তাআলা সত্যের দিকে হেদায়াত করেছেন। تمسكوا بها তোমরা উহাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে। وعضوا عليها بالنواجذ অর্থাৎ এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে শক্তভাবে ধারণ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মাড়ির শেষপ্রান্তের দাঁতগুলোকে আযরাস বলা হয়।

محدثات الأمور নতুন বিষয়সমূহঃ অর্থাৎ তোমরা সকল প্রকার বিদআত পরিহার করবে। কেননা প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। বিদআত শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ماليس له مثال سابق ‘‘যার কোন পূর্ব নমুনা নেই’’। আর শরীয়তের পরিভাষায় বিদআতের পরিচয় হলো, যার পক্ষে শরীয়তের দলীল নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি নতুন কিছু তৈরী করে দ্বীনের দিকে সম্বন্ধ করবে, যার পক্ষে কোন দলীল নেই, তাই বিদআত ও গোমরাহী। চাই তা আকীদাহর ক্ষেত্রে হোক কিংবা কথা ও কাজের মধ্যে হোক।

(৪) আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের চতুর্থ বৈশিষ্ট হলো, তারা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে, দলীল উপস্থাপন করার সময় মানুষের কথা ও কর্মের উপর এই দু’টিকে প্রাধান্য দেয় এবং তার অনুসরণ করে। কেননা তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর কালামই হলো সর্বাধিক সত্য। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ مِنَ اللَّهِ قِيلًا وَمَنْ أَصْدَقُ ‘‘আল্লাহর কথার চেয়ে অধিক সত্য আর কার কথা হতে পারে’’? (সূরা নিসাঃ ১২২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا وَمَنْ أَصْدَقُ ‘‘আল্লাহর কথার চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কে হতে পারে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াত হলো সর্বোত্তম হেদায়াত। الهدي শব্দের ‘হা’ বর্ণে যবর ও ‘দাল’ বর্ণে সাকীন দিয়ে পড়া হয়েছে। এর অর্থ হলো পন্থা, পথ, জীবন পদ্ধতি। الهدى শব্দটির هاء বর্ণে পেশ এবং دال বর্ণে যবর দিয়ে পড়াও জায়েয আছে। তখন অর্থ হবে রাস্তা দেখানো বা সঠিক পথ প্রদর্শন করা।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা মানুষের কথার উপর আল্লাহ তাআলার কালামকে প্রাধান্য দেয়। অর্থাৎ তারা আল্লাহর কালামকে প্রাধান্য দেয় এবং উহাকেই গ্রহণ করে। মানুষের কথা আল্লাহর কালামের বিরোধী হলে তারা মানুষদের কথা বাদ দিয়ে আল্লাহর কথাকেই গ্রহণ করে। তাদের মর্যাদা ও পদবী যত বড়ই হোক না কেন। রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা আলেম অথবা আবেদ, যেই হন না কেন, আল্লাহর কথার মোকাবেলায় তারা কারো কথা গ্রহণ করেনা।

সেই সাথে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াতকে সকল মানুষের মত ও পথের উপর প্রাধান্য দেয়। অর্থাৎ তারা তাঁর সুন্নাত, জীবন চরিত, শিক্ষা ও উপদেশকে মানুষের আচরণের উপর প্রাধান্য দেয়। সেই সাথে মানুষের পদমর্যাদা যত বড়ই হোক না কেন। বিশেষ করে যখন সেই মানুষের আচরণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। আল্লাহ তাআলার এই বাণীর উপর আমল করতে গিয়েই তারা তা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক (কতৃত্বশীল ও বিদ্বান) তাদেরও। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে যাও, তাহলে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ্ ও কিয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’’ (সূরা নিসাঃ ৫৯)

وَلِهَذَا سُمُّوا أَهْلَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ এই জন্যই তাদেরকে আহলুল কিতাব ওয়াস্ সুন্নাত হিসাবে নামকরণ করা হয়েছেঃ আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার কারণে, মানুষের কথা ও আচরণের উপর উহাকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে এবং আল্লাহর রাসূলের হেদায়াতকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার কারণে ও সমস্ত মানুষের আচরণের উপর উহাকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে তাদেরকে আহলুল কিতাব ওয়াস্ সুন্নাত বলা হয়। এ কারণেই তাদেরকে এই সম্মানজনক উপাধী দেয়া হয়েছে। এই সম্মানজনক উপাধী থেকে বুঝা যায়, যারা কুরআন ও সুন্নাহর পথ থেকে সরে গিয়ে পথভ্রষ্ট মুতাযেলা, খারেজী, রাফেযী এবং অন্যান্য গোমরাহ লোকদের মতামতকে বা উহার অংশ বিশেষকে সমর্থন করে, তারা ব্যতীত শুধু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের লোকেরাই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণের বিশেষণে বিশেষিত।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদেরকে যেমন আহলুল কিতাব ওয়াস্ সুন্নাত বলা হয় তেমনি আহলুল জামাআতও বলা হয়। الجماعة শব্দটি الفُرْقَة (ফির্কাবন্দী, বিভেদ ও দলাদলি) শব্দের বিপরীত। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরলে ঐক্য ও সংহতি তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে জামাআতবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়ে বলেনঃ

﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا َذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾

‘‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জুকে মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করোনা৷ আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রেখো৷ তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র৷ তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন৷ ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাইয়ে পরিণত হয়েছো৷ তোমরা একটি অগ্নিকুন্ডের কিনারায় ছিলে৷ আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছেন৷ এভাবেই আল্লাহ নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন৷ যাতে তোমরা এর মাধ্যমে সোজা সরল পথ দেখতে পারো’’। (সূরা আলইমরানঃ ১০৩) সুতরাং এখানে জামাআত বলতে হকের উপর ঐক্যবদ্ধ লোকদেরকে বুঝায়।

(৫) আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে দলীল গ্রহণ করাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো, তারা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে দলীল গ্রহণ করে, হকের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং কল্যাণ ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা করে। এর ফলেই ইসলামী শরীয়তে তৃতীয় মূলনীতি ইজমার উৎপত্তি হয়েছে। দ্বীনি ইলম অর্জন ও আমলের ক্ষেত্রে এই তৃতীয় মূলনীতি ইজমাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। উসূলবিদগণ ইজমার সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন যে,الأجماع هو اتفاق علماء العصر على أمر ديني দ্বীনের কোন বিষয়ে একই যুগের আলেমদের ঐক্যমত পোষণ করাকে ইজমা বলা হয়। ইজমা একটি অকাট্য দলীল। ইহার উপর আমল করা জরুরী। ইজমার স্থান যেহেতু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের পরে, তাই ইহাকে তৃতীয় মূলনীতি বলা হয়।

(৬) আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং আলেমদের ইজমা দ্বারা মানুষের কথাসমূহকে যাচাই করাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা এই তিনটি মূলনীতির মাধ্যমে মানুষের দ্বীন সম্পর্কিত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত কথা ও আমল ওজন করে থাকে। তারা এই তিনটি মূলনীতিকে হক ও বাতিলের মাঝে এবং হেদায়াত ও গোমরাহীর মাঝে পার্থক্য করার মানদন্ড হিসাবে নির্ধারণ করে। সুতরাং তাদের থেকে আকীদাহ কিংবা আমল সম্পর্কিত যেসব কথা, কাজ ও আচরণ প্রকাশিত হয়, সেগুলোকে তারা এই দাড়িপাল্লায় রেখে ওজন করে। দ্বীন সম্পর্কিত সকল বিষয়ই তারা এই তুলাদন্ডের সাহায্যে যাচাই করে। যেমন সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত এবং অন্যান্য আচার-ব্যবহার। আর জাগতিক যেসব বিষয়ের সাথে দ্বীনের কোন সম্পর্ক নেই, যেমন মানুষের সাধারণ অভ্যাসসমূহ এবং দুনিয়াবী বিষয়াবলী, সেগুলোর ব্যাপারে মূলনীতি হলো ঐ সমস্ত কিছুই বৈধ।

অতঃপর যেই ইজমাকে দ্বীনি বিষয়ে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে মূলনীতি হিসাবে ধরা হবে, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ উহার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ বাস্তবে যেসব বিষয়ে ইজমা সংঘটিত হয়েছে, উহা দ্বারা কেবল ঐসব বিষয় উদ্দেশ্য, যার উপর ছিলেন উম্মতের সালাফে সালেহীনগণ। অর্থাৎ সালাফে সালেহীনদের ইজমাই কেবল দ্বীনের মূলনীতি হিসাবে গণ্য। কেননা তারা ছিলেন আরব উপদ্বীপের হিজায অঞ্চলের একস্থানে একত্রিত অবস্থায়। তাদের সকলকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং দ্বীনি বিষয়ে তাদের সকলের মতামত জানা সম্ভব ছিলনা। তাদের পরে প্রচুর মতভেদ হয়েছে এবং উম্মত দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং সালাফে সালেহীনের পরে দুই কারণে ইজমাকে নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়।

(ক) সালাফে সালেহীনের যুগের পরে এখতেলাফ এত বেশী হয়েছে যে, আলেমদের সকল কথা আয়ত্তে আনয়ন ও সংরক্ষণ করা অসম্ভব।

(খ) ইসলামী বিজয় অভিযানের পর মুসলিম জাতির আলেমগণ পৃথিবীর সর্বত্র এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছেন যে, কোন বিষয় তাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছা এবং তাদের সকলের পক্ষে উহা অবগত হওয়া সম্ভব ছিলনা। দৃঢ়তার সাথে ইহা বলা সম্ভব নয় যে, তারা সকলেই উক্ত বিষয়ে এক ও অভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।একটি সতর্কতাঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া দ্বীনের মূলনীতি তিনটিকেই উল্লেখ করেছেন। চতুর্থ মূলনীতি কিয়াস উল্লেখ করেন নি। কেননা কিয়াস শরীয়তের মূলনীতি হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। যেমন মতভেদ রয়েছে দ্বীনের অন্যান্য মূলনীতির ব্যাপারে। এ বিষয়ে উসূলে ফিকাহর কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে সেগুলো পড়তে হবে।[3]

[1] - তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলার কারণ হলো, তারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং দলে দলে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়না। তাদের সংখ্যা কম হলেও তারা একটি জামাআত। মূলতঃ জামাআত বলতে হকের উপর এক্যবদ্ধ লোকদেরকে বুঝায়। সংখ্যা কম হোক বা বেশী হোক, তাতে কিছু যায় আসেনা। সংখ্যা বেশী হলেও যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত থেকে দূরে তাদেরকে শরীয়তের পরিভাষায় জামাআত বলা হয়না।

[2] - আবু দাউদ, তিরমিজী, হাদীছ নং- ২৮৯১।

[3] - মূলতঃ আকীদাহ বিষয়ে মূলনীতি উক্ত তিনটিই মাত্র। কিয়াস দ্বারা আকীদাহ সাব্যস্ত হয়না। তাই এখানে চতুর্থটির উল্লেখ করা হয়নি।