সাহাবীদের ফযীলত সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান এবং তাদের ফযীলতের তারতম্য

فضل الصحابة وموقف أهل السنة والجماعة منه وبيان تفاضلهم

সাহাবীদের ফযীলত সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান এবং তাদের ফযীলতের তারতম্য:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَيَقْبَلُونَ مَا جَاءَ بِهِ الْكِتَابُ وَالسَّنَّةُ وَالإِجْمَاعُ مِنْ فَضَائِلِهِمْ وَمَرَاتِبِهِمْ وَيُفَضِّلُونَ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَهُوَ صُلْحُ الْحُدَيْبِيَةِ وَقَاتَلَ عَلَى مَنْ أَنْفَقَ مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلَ وَيُقَدِّمُونَ الْمُهَاجِرِينَ عَلَى الأَنْصَارِ وَيُؤْمِنُونَ بِأَنَّ اللهَ قَالَ لأَهْلِ بَدْرٍ وَكَانُوا ثَلاثَ مِائَةٍ وَبِضْعَةَ عَشَرَ "اعْمَلُوا مَا شِئْتُم، فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ" وَبِأَنَّهُ لاَ يَدْخُلُ النَّارَ أَحَدٌ بَايَعَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ؛ كَمَا أَخْبَرَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّىْ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، بَلْ لَقَدْ رَضَيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ، وَكَانُوا أَكْثَرَ مِنْ أَلْفٍ وَأَرْبَعِ ماِئَة. وَيَشْهَدُونَ بِالْجَنَّةِ لِمَنْ شَهِدَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّىْ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ، كَالْعَشَرَةِ، وَثَابِتِ بْنِ قِيْسِ بنِ شَمَّاسٍ، وَغَيْرِهِم مِنَ الصَّحَابَةِ وَيُقِرُّونَ بِمَا تَوَاتَرَ بِهِ النَّقْلُ عَنْ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ وَغَيْرِهِ مِنْ أَنَّ خَيْرَ هَذِهِ الأُمَّةِ بَعْدَ نَبِيِّهَا: أَبُو بَكْرٍ، ثُمَّ عُمَرُ. وَيُثَلِّثُونَ بِعُثْمَانَ وَيُرَبِّعُونَ بِعَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ كَمَا دَلَّتْ عَلَيْهِ الآثَارُ وَكَمَا أَجْمَعَ الصَّحَابَةُ عَلَى تَقْدِيمِ عُثْمَانُ فِي الْبَيْعَةِ مَعَ أَنَّ بَعْضَ أَهْلِ السُّنَّةِ كَانُوا قَدِ اخْتَلَفُوا فِي عُثْمَانَ وَعَلِيٍّ رَضَيَ اللهُ عَنْهُمَا بَعْدَ اتِّفَاقِهِمْ عَلَى تَقْدِيمِ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ أَيُّهُمَا أَفْضَلُ؟ فَقَدَّمَ قَوْمٌ عُثْمَانَ: وَسَكَتُوا أَوْ رَبَّعُوا بِعَلِيٍّ وَقَدَّم قَوْمٌ عَلِيًّا وَقَوْمٌ تَوَقَّفُوا لَكِنِ اسْتَقَرَّ أَمْرُ أَهْلِ السُّنَّةِ عَلَى تَقْدِيمِ عُثْمَانَ، ثُمَّ عَلِيٍّ

সাহাবীদের ফযীলতে আল্লাহ তাআলার কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এবং মুসলিমদের ঐক্যমতে সাহাবীদের যেসব ফযীলত এবং মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তা কবুল করে নেন। যারা বিজয় তথা হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে খরচ করেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করেছেন তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা ঐসব লোকের উপর প্রাধান্য দেন, যারা উক্ত ঘটনার পরেও খরচ করেছে এবং লড়াই করেছে। তারা মর্যাদার ক্ষেত্রে মুহাজিরদেরকে আনসারদের উপর প্রাধান্য দেন। তারা আরো বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৩১৩ জন সাহাবীর ব্যাপারে বলেছেনঃ اعْمَلُوا مَا شِئْتُم، فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ ‘‘তোমরা যা ইচ্ছা করতে থাকো। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’’।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদ অনুসারে আরো বিশ্বাস করে, যারা হুদায়বিয়ার দিন বৃক্ষের নীচে বাইআত করেছে, তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা। শুধু তাই নয়; বরং আল্লাহ তাআলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের সংখ্যা ছিল ১৪০০ জন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তারা তাদেরকে জান্নাতবাসী বলে। যেমন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী, ছাবিত বিন কাইস বিন শাম্মাস এবং আরো যাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতী বলেছেন, তাদেরকেও তারা জান্নাতী বলে।

আমীরুল মুমিনীন আলী বিন আবু তালেব এবং অন্যান্য সাহাবী থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে মর্মে বর্ণিত হাদীছকে স্বীকৃতি দেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাতে বলেছেন, নবীর পরে এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি হচ্ছে আবু বকর, অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব। আবু বকর ও উমারের পরে তারা উছমান বিন আফফানকে তৃতীয় খলীফা এবং আলী (রাঃ)কে চতুর্থ খলীফা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এ বিষয়ে একাধিক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে এবং হুদায়বিয়ার দিন বাইআতের ক্ষেত্রে উছমানকে আলী (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দেয়ার উপর সাহাবীদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। যদিও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কতিপয় আলেম উছমান ও আলী (রাঃ)এর মধ্যে কে অধিক উত্তম, এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। তবে তাদের দুইজনের চেয়ে আবু বকর ও উমার (রাঃ) উত্তম ছিলেন। এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল আলেমের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।

একদল আলেম উছমানকে প্রাধান্য দিয়ে নিরবতা পালন করেছে এবং আলী (রাঃ) চতুর্থ খলীফা গণ্য করেছে।

আরেক দল আলেম আলী (রাঃ)কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আরেকদল নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের অধিকাংশের মতে উছমানকে আলী (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।


ব্যাখ্যাঃ প্রথমে সকল সাহাবীর ফযীলত একসাথে বর্ণনা করার পর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই অধ্যায়ে সাহাবীদের ফযীলতের তারতম্য বর্ণনা করেছেন এবং সে ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেনঃ কুরআন, হাদীছ এবং মুসলিমদের ইজমাতে সাহাবীদের যেসব ফযীলত এবং মর্যাদার স্তরভেদ এসেছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তা মেনে নেয়। সাহাবীদের ফযীলত সাব্যস্ত করার জন্য উপরোক্ত তিনটি উৎসের দলীলই যথেষ্ট।

সকল সাহাবীই মর্যাদা ও ফযীলতের ক্ষেত্রে সমান নয়। বরং ইসলাম কবুলে অগ্রণী হওয়া, আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করা, হিজরত করা এবং তাদের নবী ও দ্বীনের হেফাযতের জন্য তারা যা করেছেন, সেই অনুপাতে তাদের ফযীলতের তারতম্য রয়েছে।

এ জন্যই শাইখুল ইসলাম বলেছেনঃ যারা বিজয় তথা হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে খরচ করেছে এবং আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করেছে তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা ঐসব লোকের উপর প্রাধান্য দেয়, যারা উক্ত ঘটনার পরে খরচ করেছে এবং লড়াই করেছে। কেননা আল্লাহ তাআলা হুদায়বিয়ার ঘটনাকে মহান বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতাহর ১নং আয়াতে বলেনঃإِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا ‘‘হে নবী, আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি’’। প্রসিদ্ধ মতে এখানে সুস্পষ্ট বিজয় বলতে হুদায়বিয়ার সন্ধি উদ্দেশ্য। কেননা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরপরই সূরা ফাতাহ নাযিল হয়েছে।

হুদায়বিয়া মক্কার নিকটস্থ একটি কূপের নাম। এই কূপের কাছে একটি বৃক্ষ ছিল। মক্কার মুশরেকরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাঁধা দিল, তখন এই বৃক্ষের ছায়াতলেই বায়আতুর্ রিযওয়ান সংঘটিত হয়। তারা মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করার উপর বাইআত গ্রহণ করে। এই বাইআতকে সুস্পষ্ট বিজয় বলার কারণ হলো এই বাইআতের কারণেই মুসলিমদের জন্য প্রচুর কল্যাণ বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই বাইআতে যারা শরীক ছিল, অন্যদের উপর তাদের ফযীলতের দলীল হলো যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنْ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ﴾

‘‘তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা বড় তাদের অপেক্ষা, যারা পরে ব্যয় করেছে ও জেহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত আছেন’’। (সূরা হাদীদঃ ১০)[1] এই মুসলিমগণই হলো সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মুহাজির ও আনসার। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾

‘‘যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রণী এবং যারা উত্তমভাবে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে নদীসমূহ। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এটাই হল মহান সফলতা’’। (সূরা তাওবাঃ ১০০)

শাইখুল ইসলাম বলেনঃ وَيُقَدِّمُونَ الْمُهَاجِرِينَ عَلَى الأَنْصَارِ তারা আনসারদের উপর মুহাজিরদেরকে প্রাধান্য দেয়ঃ অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা আনসারদের উপর মুহাজিরদের ফযীলত সাব্যস্ত করে। المهاجرون শব্দটি المهاجر এর বহুবচন। এখানে মুহাজির বলতে ঐসব মুসলিম উদ্দেশ্য, যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিল। হিজরত শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিত্যাগ করা। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কুফরীর দেশ ছেড়ে ইসলামের দেশে চলে যাওয়াকে হিজরত বলা হয়। আর আনসার বলতে মদীনার ঐসব মুসলিম বুঝায়, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহায্য করেছিল। তারা ছিল আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই নামে নামকরণ করেছেন।

ফযীলতের ক্ষেত্রে আনসারদের উপর মুহাজিরদের প্রাধান্যের দলীল হলো আল্লাহ তাআলা কুরআনে আনসারদের পূর্বে মুহাজিরদেরকে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ﴾

‘‘যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রণী এবং যারা উত্তমভাবে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত রয়েছে নদীসমূহ। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এটাই হল মহান সফলতা’’। (সূরা তাওবাঃ ১০০) আল্লাহ তাআলা সূরা তাওবার ১১৭ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

﴿لَّقَد تَّابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِن بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِّنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّهُ بِهِمْ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾

‘‘আল্লাহ নবীকে মাফ করে দিয়েছেন এবং অত্যন্ত কঠিন সময়ে যেসব মুহাজির ও আনসারগণ নবীর আনুগত্য করেছে তাদেরকেও মাফ করে দিয়েছেন৷ যদিও তাদের মধ্য থেকে কিছু লোকের অন্তর বক্রতার দিকে আকৃষ্ট হতে যাচ্ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছেন৷ নিঃসন্দেহে এ লোকদের প্রতি তিনি স্নেহশীল ও দয়ালু’’। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنْ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَئِكَ هُمْ الصَّادِقُونَ وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ﴾

‘‘এই ধন-সম্পদ ঐসব ফকীর মুহাজিরদের জন্য, যাদেরকে তাদের বসত-ভিটা থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের আশা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তারাই সত্যবাদী। আর যারা মুহাজিরদের আগমণের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদেরকে ভালবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করেনা এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’’। (সূরা হাশরঃ ৮-৯)

উপরের আয়াতগুলো একদিকে যেমন মুহাজির ও আনসারদের ফযীলত সাব্যস্ত করে, অন্যদিকে আনসারদের উপর মুহাজিরদের প্রাধান্য সাব্যস্ত করে। কেননা আল্লাহ তাআলা আনসারদের আগে মুহাজিরদের কথা উল্লেখ করেছেন। আনসারদের উপর মুহাজিরদের প্রাধান্যের আরো কারণ হলো, তারা বিনিময়ের আশায় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করার জন্য নিজেদের দেশ ছেড়েছে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মায়া ত্যাগ করেছে। এসব কাজে তারা ছিলো সত্যনিষ্ঠ। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর সন্তুষ্ট থাকুন। আমীন

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা আরো বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ৩১৩ জন সাহাবীর ব্যাপারে বলেছেন, «اعْمَلُوا مَا شِئْتُم فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ » ‘‘তোমরা যা ইচ্ছা করতে থাকো। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’’ঃ যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হাতেব বিন আবু বালতাআর ঘটনায় বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।

মদীনা থেকে চার মারহালা (ষ্টেশন) দূরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম বদর। এই গ্রামের নিকট এমন একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে আল্লাহ তাআলা ইসলামকে সম্মানিত করেছেন। বদরের এই ঐতিহাসিক দিনকে ইয়াওমুল ফুরকান তথা সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করার দিন হিসাবেও নামকরণ করা হয়েছে।

তাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। সহীহ বুখারীতে তাদের সংখ্যা এটিই বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ তোমরা যা ইচ্ছা করতে থাকো। আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) তার ‘ফাওয়ায়েদ’ নামক কিতাবে বলেনঃ অনেক লোকের পক্ষে এই হাদীছের অর্থ বুঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতঃপর তিনি এ বিষয়ে আলেমদের বক্তব্যগুলো উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ এ বিষয়ে আমাদের ধারণা হলো, -বাস্তবে আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন-, এখানে আল্লাহ তাআলা এমন একটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে কথাটি বলেছেন, যাদের ব্যাপারে তিনি অবগত রয়েছেন যে, তারা কখনো দ্বীন ছাড়বেনা; বরং তারা ইসলামের উপর মরবে। কিন্তু অন্যরা যেমন গুনাহ্য় লিপ্ত হয়, তারাও কখনো সেরকম গুনাহয় লিপ্ত হতে পারে। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদেরকে গুনাহর উপর অবিচল রাখবেন না; বরং তিনি তাদেরকে তাওবায়ে নাসুহা (খাঁটি তাওবা) এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার তাওফীক দিবেন। সেই সাথে তিনি তাদেরকে এমন সৎ আমল করার তাওফীক দিবেন, যা তাদের গুনাহর চি‎হ্নগুলোকে সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দিবে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আরো বলেনঃ অন্যদেরকে বাদ দিয়ে তাদের ব্যাপারে খাস করে এই কথা বলার কারণ হলো, তাদের দ্বারা গুনাহ হতে পারে। তবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। তারা এমন কাজ করবে, যদ্বারা তাদের ক্ষমা পাওয়া অসম্ভব নয়। এতে এটিও আবশ্যক হয়না যে, তারা মাগফিরাতের ওয়াদার উপর নির্ভর করে ফরয এবাদত বর্জন করবে। শরীয়তের আদেশ পালন করা অব্যাহত রাখা ছাড়াই যদি মাগফিরাতের ওয়াদা অর্জিত হতো, তাহলে তারা মাগফিরাতের এই ওয়াদা পাওয়ার পর নামায, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ ইত্যাদি কিছুই করতেন না। সুতরাং এবাদত বর্জন করে ওয়াদার উপর নির্ভর করার ধারণা হতেই পারেনা। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদ অনুসারে আরো বিশ্বাস করে, যারা হুদায়বিয়ার দিন বৃক্ষের নীচে বাইআত করেছে, তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা। শুধু তাই নয়; বরং আল্লাহ তাআলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হয়েছে। তাদের সংখ্যা ছিল ১৪০০ জন। বাইআতুর রিযওয়ানে অংশ গ্রহণকারীদের ব্যাপারে এই ওয়াদা করা হয়েছে। মুশরেকরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল, তখন হুদায়বিয়া নামক স্থানে এই বাইআতটি সংঘটিত হয়েছিল। পূর্বে এর বর্ণনা অতিক্রান্ত হয়েছে। এই বাইআতে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’টি বৈশিষ্ট বর্ণনা করেছেন।

প্রথম বৈশিষ্টঃ যারা হুদায়বিয়ার বৃক্ষের নীচে বাইআত করেছে, তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা। সহীহ সনদে জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছে এর দলীল রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«لَا يَدْخُلُ النَّارَ أَحَدٌ مِمَّنْ بَايَعَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ»

‘‘হুদায়বিয়ার দিন বৃক্ষের নীচে যারা বাইআত করেছে তাদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা’’।[2]

দ্বিতীয় বৈশিষ্টঃ আল্লাহ তাআলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। কুরআনে সুস্পষ্ট করেই এ কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا﴾

‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা বৃক্ষের নীচে তোমার কাছে বাইআত করছিলো৷ তিনি তাদের মনের অবস্থা জেনেছেন৷ তাই তিনি তাদের উপর প্রশান্তি নাযিল করেছেন, পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন’’। (সূরা ফাতাহঃ ১৮) তাদের সংখ্যা ছিল ১৪০০ জন। বিশুদ্ধ বর্ণনার ভিত্তিতে এটিই ছিল তাদের সংখ্যা। আল্লাহ তাআলাই অধিক অবগত আছেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তারা তাদেরকে জান্নাতী বলে। যেমন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী, ছাবেত বিন কাইসবিন শাম্মাস এবং আরো অন্যান্য সাহাবীঃ অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে জান্নাতী বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরাও তাকে জান্নাতী বলে সাক্ষ্য দেয়। আর তিনি যাকে জান্নাতের অধিবাসী বলে সাক্ষ্য দেন নি, তারা তার জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করেনা। কেননা তাকে জান্নাতী বলে সাক্ষ্য দেয়া আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যা রচনা করার শামিল। তবে তারা সৎ লোকদের জন্য মঙ্গল কামনা করে এবং অসৎ লোকদের উপর আযাবের আশঙ্কা করে। এটিই আকীদাহর অন্যতম একটি মূলনীতি।

জান্নাতের সুখবর প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর নামঃ তারা হলেন (১) আবু বকর ছিদ্দিক (২) উমার ইবনুল খাত্তাব (৩) উসমান বিন আফ্ফান (৪) আলী বিন আবু তালিব (৫) যুবাইর ইবনুল আওয়াম (৬) তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (৭) সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (৮) আব্দুর রাহমান বিন আউফ (৯) আবু উবায়দাহ বিন যাররাহ এবং (১০) সাঈদ বিন যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহুম। এই সমস্ত সাহাবীদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা একাধিক সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। ছাবিত ইবনে কাইসকেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতী বলেছেন। সুস্পষ্টভাষী হওয়ার কারণে তাঁকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তা বলে ডাকা হতো। তাঁর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ সহীহ বুখারীর হাদীছ দ্বারা সুসাব্যস্ত।

উপরে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদেরকে ছাড়াও আরো কতিপয় সাহাবীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতী বলেছেন। যেমন উক্কাশা বিন মিহসান, আব্দুল্লাহ বিন সালাম এবং আরো অনেকেই।

তারা আমীরুল মুমিনীন আলী বিন আবু তালেব এবং অন্যান্য সাহাবী থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীছকে স্বীকৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি হচ্ছে আবু বকর, অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাবঃ অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব হওয়ার ব্যাপারে মুতাওয়াতির সনদে আলী এবং অন্যান্য সাহাবী (রাঃ) থেকে যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা তা বিশ্বাস করে। কেননা মুতাওয়াতির সনদ সর্বাধিক শক্তিশালী। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা উছমান বিন আফফান (রাঃ)কে খেলাফতের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় খলীফা হিসাবে গণ্য করে এবং আলী (রাঃ)কে গণ্য করে চতুর্থ স্থানে। আল্লাহ তাআলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট থাকুন। আমীন।

আলী (রাঃ) হতে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীছে ঐসব রাফেযীদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা তাঁকে আবু বকর ও উমার (রাঃ)এর চেয়ে উত্তম মনে করে এবং খেলাফাতের স্তর পরিক্রমায় তাঁকে আবু বকর এবং উমার (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দেয়। অতঃপর তারা তাদের খেলাফতের সমালোচনা করে। মূলতঃ এই আলোচনায় দু’টি মাসআলা রয়েছে।

প্রথম মাসআলাটি হচ্ছে খেলাফত সম্পর্কে। আর দ্বিতীয় মাসআলাটি হচ্ছে সাহাবীদের মর্যাদার তারতম্য সম্পর্কে।

খেলাফতের ব্যাপারে কথা হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইজমা অনুসারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর আবু বকর হচ্ছেন সর্বপ্রথম খলীফা[3], অতঃপর উমার অতঃপর উছমান, অতঃপর আলী (রাঃ)। খলীফাদের এই স্তর পরিক্রমায় ঐক্যমত পোষণকারীদের মধ্যে সাহাবীগণও শামিল ছিলেন।

আর সাহাবীদের ফযীলতের তারতম্যের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ইজমা অনুসারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে আবু বকর, অতঃপর উমার (রাঃ) এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি। যেমন আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদীছে এই কথা বর্ণিত হয়েছে।

উছমান ও আলী (রাঃ)এর ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা মতভেদ করেছে। তাদের দুইজনের মধ্যে কে অধিক উত্তম?

শাইখুল ইসলাম এখানে তিনটি মত উল্লেখ করেছেন। (১) একদল আলেম উছমানকে প্রাধান্য দিয়ে নিরবতা পালন করেছে এবং আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে চতুর্থ খলীফা গণ্য করেছে।

(২) আরেক দল আলেম আলী (রাঃ)কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। (৩) আরেকদল নিরেপক্ষতা অবলম্বন করেছেন। এই হচ্ছে মতভেদের সারকথা। মর্যাদার ক্ষেত্রে উছমানকে আলীর উপর প্রাধান্য দেয়া, আলীকে উছমানের উপর প্রাধান্য দেয়া এবং তাদের দুইজনের একজনকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দেয়া থেকে বিরত থাকা।

তবে শাইখুল ইসলাম প্রথম মতকে প্রাধান্য দেয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তা হলো একাধিক কারণে উছমানকে আলী (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দেয়া। (১) উছমান (রাঃ)এর ফযীলত বর্ণনার হাদীছগুলো এই মতকেই সমর্থন করে। (২) বাইআতুর রিযওয়ানের সময় উছমানের বাইআত আগে নেয়ার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, উছমান আলীর চেয়ে উত্তম ছিলেন। সুতরাং ফযীলতের মধ্যে তাদের ধারাবাহিকতা খেলাফতের মধ্যে তাদের স্তরপরিক্রমা ও ধারাবাহিকতার মতই। (৩) উছমানকে আলীর উপর প্রাধান্য দেয়াই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের মত হিসাবে স্থির হয়েছে। যেমন আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে, সাহাবীগণ উছমানকে বাইআতের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন।আব্দুর রাহমান বিন আওফ একদা আলী (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আমি লোকদের প্রতি খুব গভীরভাবে দৃষ্টি দিলাম। দেখলাম তারা আলীকে উছমানের উর্দ্ধে স্থান দেয়নি। আবু আইয়্যুব বলেনঃ যে ব্যক্তি উছমানকে আলী (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দিলনা, সে মুহাজির এবং আনসারদেরকে অবজ্ঞা করলো। সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, উছমান আলী থেকে উত্তম। কেননা তারা পরস্পর পরামর্শ করে তাঁকে আলী (রাঃ)এর উপর প্রাধান্য দিয়েছে। যারা উছমান (রাঃ)এর কাছে বাইআত করেছে, তাদের মধ্যে আলীও শামিল ছিলেন। উছমান (রাঃ)এর হুকুমে এবং তাঁর সামনেই আলী (রাঃ) শরীয়তের হদ তথা দন্ডবিধি কায়েম করতেন।

[1] - তাদের ফযীলতের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আরো সুস্পষ্ট করে বলেনঃ

﴿لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنْ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا﴾

‘‘আল্লাহ ঐ সমস্ত মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন যারা বৃক্ষের নীচে তোমার কাছে বায়আত করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন’’। (সূরা ফাতহঃ ১৮)

[2] - তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মানাকিব।

[3] - সুতরাং আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর পরে আবু বকরকে খেলাফতের অধিক হকদার মনে করি। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহর নবীর পরে এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তা ছাড়া আবু বকরের খেলাফতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উক্তি রয়েছে। বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

«أَتَتِ امْرَأَةٌ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَمَرَهَا أَنْ تَرْجِعَ إِلَيْهِ قَالَتْ أَرَأَيْتَ إِنْ جِئْتُ وَلَمْ أَجِدْكَ كَأَنَّهَا تَقُولُ الْمَوْتَ قَالَ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنْ لَمْ تَجِدِينِي فَأْتِي أَبَا بَكْر»ٍ

‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে একজন মহিলা আগমণ করল। তিনি তাকে পুনরায় আসতে বললেন। মহিলাটি বললঃ আমি এসে যদি আপনাকে না পাই তাহলে কার কাছে যাব? মনে হচ্ছে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর মাওতকে উদ্দেশ্য করেছিল। তিনি তখন বললেনঃ তুমি এসে যদি আমাকে না পাও তাহলে আবু বকরের কাছে যাবে’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মানাকিব) এখানে আবু বকর (রাঃ)এর খেলাফতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল বর্তমান।[3] হুযায়ফা বিন ইয়ামান হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«اقْتَدُوا بِاللَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ»

‘‘আমার পরে তোমরা আবু বকর ও উমার- এই দু’জনের অনুসরণ করবে’’। (তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল মানাকিব। সিলসিলায়ে সাহীহা হাদীছ নং- ১২৩৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবদ্দশায় তাঁর ইমামতি করার হাদীছগুলো অতি প্রসিদ্ধ। মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় তিনি বলেছেন, «مُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» ‘‘তোমরা আবু বকরকে নামাযের ইমামতি করতে বল’’। (বুখারী, অধ্যায়ঃ আহাদীছুল আম্বীয়া) মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন,

«قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَرَضِهِ ادْعِي لِي أَبَا بَكْرٍ أَبَاكِ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ كِتَابًا فَإِنِّي أَخَافُ أَنْ يَتَمَنَّى مُتَمَنٍّ وَيَقُولُ قَائِلٌ أَنَا أَوْلَى وَيَأْبَى اللَّهُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلَّا أَبَا بَكْرٍ»

‘‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যু রোগে আক্রান্ত হয়ে বললেনঃ তোমার পিতা আবু বকর ও তোমার ভাইকে ডাক। আবু বকরের জন্য একটি চিঠি লিখে যাব। আমার আশঙ্কা হচ্ছে অন্য কেউ এই বিষয়ে লালসা করবে এবং কেউ বলতে পারে আমি এব্যাপারে অধিক হকদার। আল্লাহ তা’আলা ও মুসলমানগণ আবু বকর ছাড়া অন্য কেউ খলীফা হওয়াকে অস্বীকার করেন’’। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ ফাযায়িলুস সাহাবাহ)

ইমাম তাহাবী বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে লিখিতভাবে খলীফা নিযুক্ত করে যান নি। যদি লিখতেন, তবে আবু বকরের জন্যই লিখতেন। তিনি লিখার ইচ্ছা পোষণ করেও লিখেন নি। তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা ও মুসলমানগণ আবু বকর ছাড়া অন্য কেউ খলীফা হওয়াকে অস্বীকার করেন। লিখে দেয়ার চেয়ে একথাটি অধিক সুস্পষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরকে খলীফা নিযুক্ত করার জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। কথা ও কাজের মাধ্যমে ইঙ্গিতও দিয়েছেন। লিখে দিতে চেয়েও তা করেন নি। কারণ তিনি জানতে পেরেছেন যে, মুসলমানগণ তাঁর ব্যাপারে একমত হবে।

আনসার ও মুহাজিরগণ আবু বকর (রা)এর হাতে বায়আত করেছেন। সা’দ বিন উবাদাহ ব্যতীত কেউ বায়আত থেকে বিরত হন নি। সুতরাং কোন সাহাবীই একথা বলেন নি যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবু বকর ছাড়া আলী বা অন্য কারো জন্য খেলাফতের অঙ্গীকার করেছেন। যেমনটি বলে থাকে বিদআতী সম্প্রদায়। (শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, পৃষ্ঠা নং- ৪৮৪)