لا تعارض بين القدر والشرع ولا بين تقديره للمعاصي وبغضه لها
তাকদীর ও শরীয়ত পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক নয় এবং পাপাচার নির্ধারণ করা এবং সেগুলোকে অপছন্দ ও ঘৃণা করাও পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক নয়:
وَمَعَ ذَلِكَ فَقَدْ أَمَرَ الْعِبَادَ بِطَاعَتِهِ وَطَاعَةِ رُسُلِهِ وَنَهَاهُمْ عَنْ مَعْصِيَتِهِ وَهُوَ سُبْحَانَهُ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ وَالْمُحْسِنِينَ وَالْمُقْسِطِينَ وَيَرْضَى عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَلَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ وَلَا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ وَلَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَلَا يَرْضَى لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ وَلَا يُحِبُّ الْفَسَادَ
উহা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে তাঁর এবং তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি তাঁর আদেশ অমান্য করতে এবং পাপাচারে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুত্তাকী, সৎকর্মশীল এবং ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন। যারা ঈমান আনয়ন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। তিনি কাফেরদেরকে ভালবাসেন না এবং ফাসেক সম্প্রদায়ের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট হন না। তিনি অশ্লীলতার আদেশ করেন না, তাঁর বান্দাদের কুফরী করাকে পছন্দ করেন না[1] এবং ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি করাকে ভালবাসেন না।
ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম যখন তাকদীরের চারটি স্তর যথাক্রমেঃ ইলম, লিখা, ইচ্ছা করা ও সৃষ্টি করা, এই চারটি বিষয় সাব্যস্ত করলেন এবং আরো সাব্যস্ত করলেন যে, সৃষ্টিজগতে যা কিছু সৃষ্টি ও সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে ও হবে, আল্লাহ তাআলা উহা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত রয়েছেন, তিনি তা আগেই লিখে রেখেছেন, উহা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন ও ইচ্ছা করেছেন এবং তিনি উহা সৃষ্টি করেছেন, -পূর্বোক্ত বক্তব্যে ইহা সাব্যস্ত করার পর এখানে বর্ণনা করছেন যে, উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে এবং আল্লাহ তাআলা যে তাঁর বান্দাদেরকে আনুগত্যের আদেশ দিয়েছেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেছেন, তাঁর মধ্যে কোন বৈপরিত্য, পারস্পরিক বিরোধ ও সংঘর্ষ নেই। পাপাচার সংঘটিত হওয়ার নির্ধারণ করা এবং উহাকে ঘৃণা করার মধ্যে কোন পারস্পরিক সংঘর্ষ, বিরোধ ও বৈপরিত্য নেই।
শাইখুল ইসলামের উক্তিঃ ومع ذلك উহা সত্ত্বেওঃ অর্থাৎ সকল বস্ত্ত সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অবগতি, সবকিছু নির্ধারণ, সবকিছু লিখা এবং সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা ও সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তিনি তাঁর বান্দাদেরকে তাঁর ও তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করার হুকুম করেছেন এবং তাঁর নাফরমানি করতে নিষেধ করেছেন। যেমন আল্লাহর কিতাব রাসূলের সুন্নাহতে এ বিষয়ে বহু দলীল রয়েছে। এগুলোতে তিনি তাঁর আনুগত্য করার আদেশ এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের (শরীয়তের) বিরোধীতা করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা শরীয়ত ও হুকুম-আহকাম প্রেরণ করেছেন এবং সবকিছু সৃষ্টি ও নির্ধারণ করেছেন। এগুলোর মাঝে কোন প্রকার পারস্পরিক সংঘর্ষ, অসংগতি ও বিরোধ নেই। যেমন ধারণা করে থাকে ঐ সমস্ত গোমরাহ সম্প্রদায়, যারা শরীয়তকে তাকদীরের বিপরীত মনে করে।
শাইখুল ইসলাম এ বিষয়ে তাঁর লিখিত অন্যতম একটি রেসালা ‘তাদমুরিয়াতে’ বলেনঃ গোমরাহ ফির্কার লোকেরা তাকদীরের বিষয়ে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। অগ্নিপূজক, মুশরেক এবং ইবলীসের দল।
ক) যারা আল্লাহ তাআলার তাকদীরকে অস্বীকার করে, তারা এই উম্মতের মাজুসী। যদিও তারা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধে বিশ্বাস করে। এই দলের সীমালংঘনকারীরা আল্লাহ তাআলার ইলম ও ইলম অনুযায়ী সবকিছু লিখে রাখাকে অস্বীকার করেছে। আর মধ্যমপন্থীরা ইলম ও লিখাকে স্বীকার করলেও তারা এই কথা স্বীকার করেনা যে, সবকিছুর উপর রয়েছে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা, সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি এবং কুদরতের অধীন।[2] এরাই হলো মুতাযেলা এবং যারা তাদের অনুসরণ করে থাকে।
খ) আর যারা তাকদীর ও আল্লাহ তাআলার ফয়সালায় বিশ্বাসী, কিন্তু শরীয়তের আদেশ ও নিষেধকে অস্বীকার করেছে, তারা হলো মুশরিক। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ حَتَّىٰ ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ﴾
‘‘এ মুশরিকরা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে আমরা শির্ক করতামনা, আমাদের বাপ-দাদারাও শির্ক করতোনা৷ আর আমরা কোন জিনিষকে হারামও গণ্য করতামনা৷ এ ধরনের উদ্ভট কথা তৈরী করে এদের পূর্ববর্তী লোকেরাও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।[3] তারা অবশেষে আমার আযাবের স্বাদ গ্রহণ করেছে৷ এদেরকে বলে দাও, তোমাদের কাছে কোন জ্ঞান আছে কি? থাকলে আমার কাছে পেশ করো৷ তোমরা তো নিছক ধারণার অনুসরণ করে চলছো। শুধু আন্দাজ করা ব্যতীত তোমাদের কাছে আর কিছুই নেই’’। যারা তাকদীর দিয়ে দলীল পেশ করে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ বাতিল করে দেয়, তারা এই শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত।
গ) এ বিষয়ে তৃতীয় দলটি হচ্ছে ইবলীসের দল। তারা তাকদীর ও শরীয়ত উভয়কেই স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার শরীয়ত ও তাকদীরকে পরস্পর সাংঘর্ষিক ও বিরোধী মনে করেছে। এর মাধ্যমে তারা হিকমত ও আদালতে ইলাহীয়ার মধ্যে আপত্তি করেছে। যেমন তাদের প্রথম উস্তাদ ইবলীস থেকে উহা উল্লেখ করা হয়েছে।[4]
মোটকথা আহলে বাতিলরা নিজেদের পক্ষ হতে বানিয়ে উপরোক্ত কথা বলে থাকে। হেদায়াতপ্রাপ্ত এবং সফলকাম লোকেরা তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস করে এবং শরীয়তকেও বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জিনিষের স্রষ্টা, প্রত্যেক জিনিষের প্রভু ও মালিক। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই হয়। তিনি যা ইচ্ছা করেন না, তা কখনো হয়না এবং তিনি প্রত্যেক জিনিষের উপর ক্ষমতাবান। ইলমের মাধ্যমে তিনি সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং প্রত্যেক জিনিষকে একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখে সংরক্ষিত করে রেখেছেন।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ وَهُوَ سُبْحَانَهُ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ وَالْمُحْسِنِينَ وَالْمُقْسِطِينَ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মুত্তাকী, সৎকর্মশীল এবং ইনসাফ কারীদেরকে ভালবাসেনঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি প্রশংসনীয় গুণে গুণান্বিত হয়, যেমন তাকওয়া, সৎকর্ম ন্যায়বিচার-ইনসাফ ইত্যাদি ভাল গুণে বিশেষিত হয়, তাকে ভালোবাসেন।
وَيَرْضَى عَنِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ যারা ঈমান আনয়ন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেনঃ যেমন অনেক আয়াতে সংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা ঈমান আনয়ন করে এবং সৎ আমল করে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন ও তাদেরকে ভালবাসেন।
وَلَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ وَلَا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না এবং ফাসেক সম্প্রদায়ের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট হন নাঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেসব স্বভাব ও বৈশিষ্টকে ঘৃণা করেন যেমন কুফরী, পাপাচার এবং অন্যান্য নিকৃষ্ট স্বভাব, যারা এ জাতিয় স্বভাব ও বৈশিষ্ট দ্বারা বিশেষিত হয়, তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন না।
وَلَا يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ তিনি অশ্লীলতার আদেশ করেন নাঃ অশ্লীলতা বলতে ঐসব গুনাহ ও পাপের কথা ও কাজ বুঝায়, যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত।
وَلَا يَرْضَى لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ وَلَا يُحِبُّ الْفَسَادَ তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফুরী পছন্দ করেন না এবং ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি করাকে ভালবাসেন নাঃ কেননা কুফরী ও ফাসাদ অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ এবং তাতে রয়েছে দেশ ও জাতির জন্য অনেক ক্ষতি।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা ঐসব লোকদের প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন, যারা মনে করে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও ভালবাসা পরস্পর সম্পৃক্ত এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং আল্লাহ তাআলা যখন কোন জিনিষের ইচ্ছা করেন তখন উহাকে ভালবাসেন বলেই উহার ইচ্ছা করেন এবং কোন জিনিষকে যখন ভালবাসেন তখন উহার অর্থ এই যে, তিনি উহার ইচ্ছা পোষণ করেন। এই কথা একদম বাতিল।
সঠিক কথা হলো আল্লাহ তাআলার الإرادة (ইচ্ছা) এবং المحبة (ভালবাসা) পরস্পর সম্পৃক্ত নয়। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও তাঁর ভালোবাসা পরস্পর সম্পৃক্ত এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয়। এ দু’টির একটি অন্যটিকে আবশ্যক করেনা। আল্লাহ তাআলা কখনো এমন জিনিষের ইচ্ছা করেন, যা তিনি পছন্দ করেন না এবং এমন জিনিষ পছন্দ করেন, যা সংঘটিত করার ইচ্ছা করেন না। প্রথমটির উদাহরণ হলো যেমন ইবলীস ও তার সৈনিকদেরকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা এবং আল্লাহ তাআলার ঐ ব্যাপক ইচ্ছা, যা রয়েছে সৃষ্টিজগতের কিছু কিছু জিনিষের মধ্যে। যদিও তিনি উহাকে ঘৃণা করেন এবং অপছন্দ করেন।
আর দ্বিতীয়টির উদাহরণ হলো, যেমন তিনি কাফেরদের ঈমান আনয়ন করাকে ভালবাসেন এবং তাদের থেকে আনুগত্যের কাজ সংঘটিত হওয়া পছন্দ করেন, কিন্তু তিনি তাদের থেকে উহা বাস্তবায়ন হওয়ার ইচ্ছা করেন নি।[5] তিনি যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে অবশ্যই তাদের দ্বারা উহা বাস্তবায়ন হতো।
[1] - আল্লাহ তাআলা কুফরী ও পাপাচার সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তিনি তা পছন্দ করেন না; বরং কুফরী করাকে তিনি ঘৃণা করেন। তিনি কুফরী করতে নিষেধ করেছেন। কুফরী ও পাপাচার সৃষ্টি করা এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিষেধ করার মধ্যে কোন বৈপরিত্য ও পারস্পরিক সংঘর্ষ ও বিরোধ নেই। তিনি উহা সৃষ্টি করেছেন বিশেষ এক উদ্দেশ্যে। যাতে করে মুমিনগণ অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তিনি মানুষের শত্রু ইবলীসকেও সৃষ্টি করেছেন। যাতে করে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন, কে ইবলীসের অনুসরণ করে আর কে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করে। সুতরাং কুফরী ও অন্যান্য পাপাচার সৃষ্টি করার পিছনে হিকমতে ইলাহী হচ্ছে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। কুফরী করার জন্যই কুফরী, পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্যই পাপাচার সৃষ্টি করেন নি এবং অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়ার জন্যই উহা সৃষ্টি করেন নি। বরং অন্য এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তা সৃষ্টি করেছেন, যা আমরা ইতিপূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করেছি। কুফরী সৃষ্টি না করলে পৃথিবীর সকল মানুষই মুমিন হয়ে যেতো। তাতে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হতোনা। সুতরাং পাপাচার সৃষ্টির মধ্যেও রয়েছে আল্লাহ তাআলার বিশেষ এক হিকমত। তিনি পাপাচার সৃষ্টি করেছেন, যাতে এর মাধ্যমে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা যায়।
কুফরী ও পাপাচার সৃষ্টি করার পিছনে আরো হিকমত হলো, যাতে করে আল্লাহ তাআলার সকল অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ সিফাতের প্রভাবই তাঁর বান্দাদের উপর গিয়ে পড়ে। তাঁর অন্যতম নাম হচ্ছে الغفار এবং الغفور (ক্ষমাকারী বা ক্ষমাশীল)। এই অর্থে আরো নাম রয়েছে। আল্লাহ তাআলার এই প্রকার নাম ও বিশেষণের দাবী হচ্ছে তাঁর কিছু বান্দা গুনাহতে লিপ্ত হবে। অতঃপর তারা অনুতপ্ত হবে ও তাওবা করবে। আল্লাহ তাআলা তাদের সেই তাওবা কবুল করবেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করবেন। মূলতঃ এর মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলার এবাদতই বাস্তবায়িত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿قُلْ ياَ عِباَدِيَ الَّذِيْنَ أسْرَفُوْا عَلىَ أنْفُسِهِمْ لاَتَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ﴾
‘‘হে নবী! বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু’’। (সূরা যুমারঃ ৫৩) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
‘‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে, তখন তিনি তোমাদের ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশী হন, যে তার বাহনে আরোহন করে সফরে বের হল। বাহনের উপরেই ছিল তার খাদ্য-পানীয় ও সফর সামগ্রী। মরুভূমির উপর দিয়ে সফর করার সময় বিশ্রামার্থে সে একটি বৃক্ষের নীচে অবতরণ করল। অতঃপর মাটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখল তার বাহন কোথায় যেন চলে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের নীচে এসে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেলো, তার হারানো বাহনটি সমুদয় খাদ্য-পানীয়সহ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহনটির লাগাম ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো, হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা, আমি আপনার প্রভু। অতি আনন্দের কারণেই সে এত বড় ভুল করে বসেছে।[1] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ
كَانَ فِيمَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ رَجُلٌ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَسَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الْأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَاهِبٍ فَأَتَاهُ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ نَفْسًا فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ فَقَالَ لَا فَقَتَلَهُ فَكَمَّلَ بِهِ مِائَةً ثُمَّ سَأَلَ عَنْ أَعْلَمِ أَهْلِ الْأَرْضِ فَدُلَّ عَلَى رَجُلٍ عَالِمٍ فَقَالَ إِنَّهُ قَتَلَ مِائَةَ نَفْسٍ فَهَلْ لَهُ مِنْ تَوْبَةٍ فَقَالَ نَعَمْ وَمَنْ يَحُولُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ التَّوْبَةِ انْطَلِقْ إِلَى أَرْضِ كَذَا وَكَذَا فَإِنَّ بِهَا أُنَاسًا يَعْبُدُونَ اللَّهَ فَاعْبُدِ اللَّهَ مَعَهُمْ وَلَا تَرْجِعْ إِلَى أَرْضِكَ فَإِنَّهَا أَرْضُ سَوْءٍ فَانْطَلَقَ حَتَّى إِذَا نَصَفَ الطَّرِيقَ أَتَاهُ الْمَوْتُ فَاخْتَصَمَتْ فِيهِ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ وَمَلَائِكَةُ الْعَذَابِ فَقَالَتْ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ جَاءَ تَائِبًا مُقْبِلًا بِقَلْبِهِ إِلَى اللَّهِ وَقَالَتْ مَلَائِكَةُ الْعَذَابِ إِنَّهُ لَمْ يَعْمَلْ خَيْرًا قَطُّ فَأَتَاهُمْ مَلَكٌ فِي صُورَةِ آدَمِيٍّ فَجَعَلُوهُ بَيْنَهُمْ فَقَالَ قِيسُوا مَا بَيْنَ الْأَرْضَيْنِ فَإِلَى أَيَّتِهِمَا كَانَ أَدْنَى فَهُوَ لَهُ فَقَاسُوهُ فَوَجَدُوهُ أَدْنَى إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي أَرَادَ فَقَبَضَتْهُ مَلَائِكَةُ الرَّحْمَةِ
‘‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে জনৈক ব্যক্তি নিরানববই জন লোককে হত্যা করল। অতঃপর লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলোঃ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আলেম কে? বলা হলো অমুক পাদ্রী। সে পাদ্রীর নিকট গিয়ে বলল যে, সে নিরানববই জন মানুষকে হত্যা করেছে। তার তাওবা করার সুযোগ আছে কি? পাদ্রী বললঃ তোমার কোন তাওবা নেই। এই কথা শুনে লোকটি সেই পাদ্রীকেও হত্যা করে একশ পূর্ণ করল। অতঃপর লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলোঃ এ যুগের সবচেয়ে বড় আলেম কে? এবার তাকে একজন আলেমের সন্ধান দেয়া হলো। আলেমের কাছে গিয়ে বলল যে, সে একশটি প্রাণ হত্যা করেছে। তার কোন তাওবা আছে কি? আলেম বললেনঃ হ্যাঁ, তাওবা আছে তো। তাওবার মাঝে এবং তোমার মাঝে কে বাধা সৃষ্টি করলো? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে একদল লোক পাবে। তারা আল্লাহর এবাদতে রত আছে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর এবাদত করতে থাকো। আর নিজের এলাকায় কখনো ফিরে এসোনা। সে তথায় রওয়ানা হয়ে গেল।
অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর তার মৃত্যু উপস্থিত হয়ে গেল। তখন রহমতের ফেরেশতা এবং আযাবের ফেরেশতা এসে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হয়ে গেলেন। রহমতের ফেরেশতাগণ বললেনঃ সে তাওবা করে আল্লাহর কাছে ফেরত এসেছে। সুতরাং আমরা তার জান কবজ করে আল্লাহর রহমতের দিকে নিয়ে যাবো। আযাবের ফেরেশতাগণ বললেনঃ সে কখনও ভাল কাজ করেনি। বরং সে একশটি প্রাণ হত্যা করেছে। আমরা তার জান কবজ করে আল্লাহর আযাবের দিকে নিয়ে যাবো। এমতাবস্থায় মানুষের আকৃতিতে একজন ফেরেশতা আগমণ করলেন। তারা তাকে উভয় দলের মাঝে ফয়সালাকারী নির্ধারণ করলেন। তিনি ফয়সালা দিলেন যে, তোমরা এই স্থান থেকে দু’দিকের রাস্তা মেপে দেখ। তারা দু’দিকের রাস্তা মেপে দেখলেন, যে এলাকার দিকে সে রওনা হয়েছিল, সেই স্থানের অধিক নিকটবর্তী। তাই রহমতের ফেরেশতাগণ তার জান কবজ করলেন। (বুখারী, অধ্যায়ঃ আহাদীছুল আম্বীয়া)
পাপ কাজ সৃষ্টি করার পিছনে এটিই হচ্ছে হিকমতে ইলাহী। আল্লাহ তাআলার গাফুর, গাফ্ফার, التواب (তাওবা কবুলকারী) ইত্যাদি নাম দ্বারা আল্লাহকে ডাকা হবে, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সেই ডাক শুনবেন এবং এই নামগুলোর প্রভাব বান্দাদের উপর পড়বে। সুতরাং পাপাচার না থাকলে কিভাবে আল্লাহ তাআলার এই নামগুলোর প্রভাব হতো? (আল্লাহ অধিক অবগত আছেন)
[2] - অর্থাৎ তারা বলেছে যে, বান্দার কর্ম আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ও সৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত নয়; বরং বান্দা তার কাজ-কর্ম নিজেই সৃষ্টি করে। এই কথার মাধ্যমে তারা একাধিক সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করেছে বলেই তাদেরকে অগ্নিপূজকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
[3] - আল্লাহ তাআলা সূরা নাহলের ৩৫ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
﴿وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ نَّحْنُ وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ ۚ كَذَٰلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۚ فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾
‘‘এ মুশরিকরা বলে, ‘‘আল্লাহ চাইলে তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত আমরাও করতামনা, আমাদের বাপ-দাদারাও করতোনা এবং তাঁর হুকুম ছাড়া কোনো জিনিষকে হারামও গণ্য করতো না৷ এদের আগের লোকেরাও এমনি ধরনের বাহানাবাজীই চালিয়ে গেছে৷ তাহলে কি রাসূলদের উপর সুস্পষ্ট বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব আছে? এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের একটি ধারণা ও ভুলের খন্ডন করেছেন। তারা বলেছিল, আমরা আল্লাহকে ছাড়া অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করছি কিংবা তাঁর হুকুম ছাড়াই যেসব জিনিষকে নিজেদের জন্য হারাম করে নিচ্ছি, তা যদি ভুল ও বাতিল হতো, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরতে কামেলা প্রয়োগ করে তা থেকে বিরত রাখলেন না কেন? তিনি না চাইলে তো আমরা সেগুলো করতেই পারতামনা। তিনি যেহেতু আমাদেরকে বল প্রয়োগ করে বিরত রাখছেন না, তাতে বুঝা গেল আমরা এসবকিছু তার ইচ্ছা ও মর্জি মোতাবেক করছি!!।
তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার জবাবে আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, আল্লাহর দ্বীন পৌঁছিয়ে দেয়াই রাসূলদের দায়িত্ব ছিল। বল ও শক্তি প্রয়োগ করে তাদেরকে ঈমানের উপর বাধ্য করা তাদের কাজ ছিলনা। আসল কথা হলো, হে মুশরিক দল! তোমাদের এই ধারণা ঠিক নয় যে, আল্লাহ তোমাদেরকে শির্ক করা থেকে বাধা দেন নি; বরং তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তোমাদের শির্কী কাজ-কর্মের প্রতিবাদ করেছেন। এই জন্যই তিনি প্রত্যেক জাতির কাছেই রাসূল পাঠিয়েছেন, কিতাব নাযিল করেছেন। প্রত্যেক নবীই তাঁর কাওমকে সর্বপ্রথম এককভাবে আল্লাহ তাআলার এবাদত করার এবং শির্ক বর্জন করার দাওয়াত দিয়েছেন।
তাকদীর দিয়ে দলীল পেশ করে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য বর্জন করার প্রচেষ্টা নতুন কোন কথা নয়। আজও কিছু মানুষ আল্লাহর ইচ্ছাকে নিজেদের ভ্রষ্টতা ও অসৎকর্মের কারণ হিসেবে পেশ করছে। এটা অতি পুরাতন যুক্তি। বিভ্রান্ত লোকেরা যুগে যুগে নিজেদের বিবেককে ধোঁকা দেবার এবং উপদেশদাতাদের মুখ বন্ধ করার জন্য এ যুক্তি পেশ করছে। এটিই ছিল পূর্বযুগের মুশরিকদের যুক্তি। নূহ আলাইহিস সালামের প্লাবনের পর থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বার এ কথা বলা হয়েছে। এই যুক্তিতে কোন আধুনিকতা নেই এবং অভিনবত্বও নেই। এটি বহুকালের বস্তাপচা খোঁড়া যুক্তি। হাজার বছর থেকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্টরা একই সুর তুলে আসছে। এখনো সেই পচা সুর তুলে আসছে কিছু মানুষ।
[4] - আল্লাহ তাআলা যখন ফেরেশতাদেরকে আদেশ করলেন, ‘‘তোমরা আদমকে সেজদা করো’’। ইবলীসও এই আদেশের আওতায় ছিল। ফেরেশতারা সেজদা করলেন, কিন্তু ইবলীস স্বীয় উপাদান নিয়ে গর্ব-অহংকার করলো এবং আদেশের হিকমত উপলব্ধি করতে না পেরে আল্লাহ তাআলার আদালত ও হিকমতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেজদা করা হতে বিরত থাকলো। সে বলেছিল, أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ ‘‘আমি আদমের চেয়ে ভাল। তুমি তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে। আর আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে’’। (সূরা সোয়াদঃ ৭৬)
[5] - অর্থাৎ শরীয়তগত দিক থেকে তাদের থেকে ঈমান আনয়ন ও আনুগত্য পছন্দ করলেও সৃষ্টিগত দিক থেকে কুফরী ও পাপাচার সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেছেন। তাদের মধ্যে আল্লাহর শরীয়তগত পছন্দ ও ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়নি; বরং সৃষ্টিগত ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে। (আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন)