সর্বপ্রথম যিনি জান্নাতের দরজা খুলবেন, যিনি সর্বপ্রথম তাতে প্রবেশ করবেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআতের বর্ণনা

أول من يستفتح باب الجنة وأول من يدخلها وشفاعات النبي صلى الله عليه وسلم

সর্বপ্রথম যিনি জান্নাতের দরজা খুলবেন, যিনি সর্বপ্রথম তাতে প্রবেশ করবেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআতের বর্ণনা:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَأَوَّلُ مَنْ يَسْتَفْتِحُ بَابَ الْجَنَّةِ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنَ الْأُمَمِ أُمَّتُهُ وَلَهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْقِيَامَةِ ثَلَاثُ شَفَاعَاتٍ أَمَّا الشَّفَاعَةُ الْأُولَى فَيَشْفَعُ فِي أَهْلِ الْمَوْقِفِ حَتَّى يُقْضَى بَيْنَهُمْ بَعْدَ أَنْ يَتَرَاجَعَ الْأَنْبِيَاءُ آدَمُ ، وَنُوحٌ ، وَإِبْرَاهِيمُ ، وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ عَنِ الشَّفَاعَةِ حَتَّى تَنْتَهِيَ إِلَيْهِ وَأَمَّا الشَّفَاعَةُ الثَّانِيَةُ: فَيَشْفَعُ فِي أَهْلِ الْجَنَّةِ أَنْ يَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَهَاتَانِ الشَّفَاعَتَانِ خَاصَّتَانِ لَهُ وَأَمَّا الشَّفَاعَةُ الثَّالِثَةُ: فَيَشْفَعُ فِيمَنِ اسْتَحَقَّ النَّارَ وَهَذِهِ الشَّفَاعَةُ لَهُ وَلِسَائِرِ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِيقِينَ وَغَيْرِهِمْ ، فَيَشْفَعُ فِيمَنِ اسْتَحَقَّ النَّارَ أَلَّا يَدْخُلَهَا وَيَشْفَعُ فِيمَنْ دَخَلَهَا أَنْ يَخْرُجَ مِنْهَا

কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেহেশতের দরজা খুলবেন। সমস্ত উম্মতের মধ্য হতে তাঁর উম্মতই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তিনি কিয়ামতের দিন তিনটি শাফাআত করবেন।

প্রথম শাফাআতটি করবেন হাশরের মাঠে অবস্থানকারী সকল মানুষের জন্য। যাতে তাদের মধ্যে দ্রুত ফয়সালা করা হয়। আদম, নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা (আঃ) এবং সমস্ত নবীই সেদিন আল্লাহর নিকট শাফাআত করতে অক্ষমতা প্রকাশ করার পর শাফাআতের বিষয়টি পরিশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ফিরে আসবে।

দ্বিতীয় শাফাআতটি হবে জান্নাতীদের জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য। এ দু’টি শাফাআত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস।আর তৃতীয় শাফাআতটি হবে ঐসব লোকের ব্যাপারে, যাদের জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যাবে। এই শাফাআতটি হবে সমস্ত নবী, সিদ্দীক এবং অন্যান্যদের জন্য। সুতরাং যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদের জন্য তিনি সুপারিশ করবেন, তাদেরকে যেন জাহান্নামে প্রবেশ করানো না হয়। তিনি আরো সুপারিশ করবেন ঐ সব লোকের জন্য, যারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।


ব্যাখ্যাঃ (৮) কিয়ামত দিবসের যেসব অবস্থা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অতিক্রম করার পর সেদিন মুমিনদের সর্বশেষ অবস্থা কী হবে, শাইখুল ইসলাম এখানে তা বর্ণনা করেছেন। পূর্বোক্ত অধ্যায়ে তিনি বলেছেনঃ অতঃপর যখন তাদেরকে পারস্পরিক যুলুম থেকে পরিশুদ্ধ ও পরিস্কার করা হবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। সুতরাং আল্লাহ তাআলার অনুমতির পূর্বে এবং জান্নাতের দরজা খোলার আবেদন করার আগে কেউ তাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজা খুলবেন। যেমন সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«آتِى بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتَفْتِحُ فَيَقُولُ الْخَازِنُ مَنْ أَنْتَ فَأَقُولُ مُحَمَّدٌ. فَيَقُولُ بِكَ أُمِرْتُ لاَ أَفْتَحُ لأَحَدٍ قَبْلَكَ»

‘‘কিয়ামতের দিন আমি জান্নাতের দরজায় উপস্থিত হয়ে উহার দরজা খোলার আবেদন করবো। তখন জান্নাতের প্রহরী বলবেঃ আপনি কে? আমি বলবোঃ মুহাম্মাদ। প্রহরী তখন বলবেঃ আপনার জন্য দরজা খুলতে আমাকে আদেশ করা হয়েছে। আপনার পূর্বে অন্য কারো জন্য আমি জান্নাতের দরজা খুলবোনা’’।[1] الاستفتاح অর্থ হচ্ছে খোলার আবেদন করা। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও ফযীলত প্রকাশ করা হয়েছে।

সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেননা তাদের ফযীলত অন্যান্য সকল উম্মতের উপরে। মুসিলম শরীফে আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছে এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«نَحْنُ الآخِرُونَ الأَوَّلُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَنَحْنُ أَوَّلُ مَنْ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ»

‘‘আমরা সকলের পরে দুনিয়াতে আসলেও কিয়ামতের দিন সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবো’’।[2]

কিয়ামতের দিন খাসভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি শাফাআত করবেন। الشفاعات শব্দটি شفاعة এর বহুবচন। শাফাআত শব্দের আভিধানিক অর্থ মধ্যস্থতা করা, সুপারিশ করা। আর শরীয়াতের পরিভাষায় শাফাআত অর্থ হলো, سؤال الخير للغير অন্যের জন্য কল্যাণের আবেদন করা। الشفاعة শব্দটি الشفع থেকে নেওয়া হয়েছে। ইহা الوتر শব্দের বিপরীত। شفع অর্থ জোড় আর وتر অর্থ বে-জোড়। শাফাআতকারী তার আবেদনের সাথে সুপারিশকৃতের আবেদনকেও শামিল করে নেয় বলেই তাকে সুপারিশকারী বলা হয়। অথচ এর আগে সে ছিল একাকী।

শাইখুল ইসলাম বলেনঃ ‘‘কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তিনটি শাফাআত হবে’’। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার অনুমতিক্রমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব শাফাআত করবেন, তিনি এখানে ঐসব শাফাআতের আলোচনা করেছেন। শাইখুল ইসলাম এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে শাফাআতের প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। তবে অনুসন্ধানের পর মোট আট প্রকার শাফাআতের কথা জানা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্য হতে কতিপয় শাফাআত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খাস এবং আরো কিছু শাফাআতের কথা জানা যায়, যা তাঁর জন্য এবং অন্যদের জন্যও সাব্যস্ত।

১) শাফাআতে উয্মাঃ এই শাফাআত হবে মাকামে মাহমুদে। হাশরের মাঠে লোকদের দীর্ঘ অবস্থানের পর এবং আদম থেকে শুরু করে ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সবার কাছে সুপারিশের জন্য গমণ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট বান্দাদের মাঝে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার আবেদন করবেন। সকল নবীই যখন আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন, তখন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রভুর অনুমতি নিয়ে শাফাআত করবেন।

২) জান্নাতীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর শাফাআতঃ হিসাবের পর জান্নাতীদেরকে দ্রুত জান্নাতে প্রবেশের অনুমতির জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নিকট শাফাআত করবেন।

৩) আবু তালেবের জন্য শাফাআতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দিন তাঁর চাচা আবু তালেবের শাস্তি হালকা করার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন। এই শাফাআত তাঁর সাথেই খাস। কেননা আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কাফেরদের জন্য সুপারিশকারীদের সুপারিশ কোন কাজে আসবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর শাফাআত কেবল তাওহীদপন্থীদের জন্যই খাস। সুতরাং তাঁর কাফের চাচা আবু তালেবের জন্য যেই শাফাআত তিনি করবেন, তা কেবল তাঁর সাথেই এবং আবু তালেবের জন্যই খাস।[3] উপরের তিন প্রকার শাফাআত কেবল আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যই নির্দিষ্ট।

৪) তাওহীদপন্থীদের মধ্য হতে যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদেরকে তথায় না পাঠানোর শাফাআতঃ যেসব গুনাহগারদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে, তাদেরকে জাহান্নামে না পাঠানোর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবেন।

৫) তাওহীদপন্থী মুমিনদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার সুপারিশঃ জাহান্নামে প্রবেশকারী তাওহীদপন্থী একদল পাপী লোককে তা থেকে বের করার জন্য তিনি শাফাআত করবেন।[4]

৬) জান্নাতের ভিতরে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সুপারিশঃ জান্নাতবাসী কিছু লোকের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফাআত করবেন।[5]

৭) যাদের গুনাহর পাল্লা এবং নেকীর পাল্লা সমান সমান হবে, তাদের জন্য সুপারিশঃ কিয়ামতের দিন যাদের গুনাহর পাল্লা এবং নেকীর পাল্লা সমান সমান হবে, তাদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফাআত করবেন যে, তাদেরকে যেন জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। আলেমদের এক মত অনুযায়ী তারা হলেন আরাফবাসী।

৮) বিনা হিসাবে এবং বিনা আযাবে এক শ্রেণীর লোককে জান্নাতে প্রবেশ করানোর শাফাআতঃ যেমন উক্কাশা বিন মিহসানের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শাফাআত। উক্কাশা যখন শুনলেন, এই উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে যাবে, তখন তিনি আবেদন করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তাআলার নিকট আমার জন্য দু’আ করুন, তিনি যেন আমাকে সেই সত্তর হাজারের অন্তর্ভূক্ত করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন উক্কাশার জন্য উক্ত সত্তর হাজারের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়ার দু’আ করলেন।[6]

এই শেষোক্ত পাঁচ প্রকারের শাফাআত করার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আরো অনেকেই শরীক থাকবে। যেমন অন্যান্য নবীগণ, ফেরেশতাগণ, সিদ্দীকগণ এবং শহীদগণ।[7]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের লোকেরা উপরোক্ত সকল প্রকার শাফাআতেই বিশ্বাস করে। কেননা সহীহ সূত্রে বর্ণিত অনেক দলীল দ্বারা তা প্রমাণিত। তবে দু’টি শর্ত ছাড়া শাফাআত হবেনা। প্রথম শর্তঃ শাফআতকারীকে শাফাআত করার পূর্বে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে শাফাআতের অনুমতি লাভ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ﴿ مَنْ ذَاالَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ﴾ ‘‘কে আছে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?’’ (সূরা বাকারাঃ ২৫৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِن بَعْدِ إِذْنِهِ﴾ ‘‘কোন শাফায়াতকারী এমন নেই, যে তাঁর অনুমতি ছাড়া শাফায়াত করতে পারে৷ দ্বিতীয় শর্তঃ যার জন্য সুপারিশ করা হবে তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা অপরিহার্য। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنْ ارْتَضَ﴾

‘‘তারা কেবল তাদের জন্যই সুপারিশ করবেন, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট আছেন’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৮) এই দু’টি শর্ত সূরা নাজমের ২৬ নং আয়াতে একসাথে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِن بَعْدِ أَن يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَن يَشَاءُ وَيَرْضَىٰ﴾

‘‘আসমানে অনেক ফেরেশতা আছে, যাদের সুপারিশও কোন কাজে আসবেনা। যতক্ষণ না আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশী তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দান করেন’’।

কবীরা গুনাহয় লিপ্ত হয়ে যেসব মুমিন মৃত্যু বরণ করবে তাদের কেউ জাহান্নামের হকদার হলে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ না করানোর জন্য শাফাআতের ব্যাপারে মুতাযেলা সম্প্রদায় লোকেরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিরোধিতা করেছে। সেই সাথে যারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে, সেখান থেকে তাদের বের হওয়ার ব্যাপারেও শাফাআত হওয়াকে মুতাযেলারা অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ তারা শাফাআতের উপরোক্ত প্রকারসমূহ থেকে পঞ্চম ও ষষ্ট প্রকার শাফাআতকেও তারা অস্বীকার করেছে। তারা আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারা দলীল গ্রহণ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴾ فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ﴿ ‘‘সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কাজে আসবেনা৷

তাদের কথার জবাব হলো, আয়াতটি কাফেরদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সুপারিশকারীদের সুপারিশ কাফেরদের কোন কাজে আসবেনা। তবে মুমিনদের ব্যাপারে কথা হচ্ছে কতিপয় শর্তসাপেক্ষ সুপারিশ তাদের উপকার করবে।

মোটকথা শাফাআতের ব্যাপারে লোকেরা তিনভাগে বিভক্ত হয়েছে। (১) এক শ্রেণীর লোক শাফাআতকে সাব্যস্ত করতে গিয়ে সীমা লংঘন ও বাড়াবাড়ি করেছে। নাসারা, মুশরিক, সীমালংঘনকারী সুফী এবং কবর পূজারীরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরা যাদেরকে তা’যীম করে, আল্লাহ তাআলার নিকটে তাদের শাফাআতকে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের নিকট পরিচিত শাফাআতের মতই মনে করে থাকে। সুতরাং তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের কাছে শাফাআত প্রার্থনা করেছে। যেমন আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকদের জন্য সুপারিশকারীদের সুপারিশ কাজে আসবেনা।

(২) মুতাযেলা ও খারেজীরা শাফাআতকে একদম অস্বীকার করেও সীমা লংঘন করেছে। তারা কবীরা গুনাহকারীদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যদের শাফাআতকে অস্বীকার করেছে।(৩) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা কুরআনের আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত শাফাআতকে সাব্যস্ত করে। সুতরাং তারা শর্তসাপেক্ষ শাফাআতকে সাব্যস্ত করে।[8]

[1] - দেখুনঃ সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৫০৭।

[2] - দেখুনঃ সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২০১৭।

[3] - সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, একদা আববাস (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ

«يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَفَعْتَ أَبَا طَالِبٍ بِشَيْءٍ؟ فَإِنَّهُ كَانَ يَحُوطُكَ وَيَغْضَبُ لَكَ قَالَ نَعَمْ هُوَ فِي ضَحْضَاحٍ مِنْ نَارٍ وَلَوْلَا أَنَا لَكَانَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ»

‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আবু তালেবের কোন উপকার করতে পারলেন? সে তো আপনাকে শত্রুদের অনিষ্ট হতে হেফাজত করতো এবং আপনার জন্য মানুষের সাথে রাগান্বিত হতো। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, সে এখন জাহান্নামের আগুনের উপরিভাগে অবস্থান করছে। আমি না থাকলে সে জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করতো।

[4] - আমরা বিশ্বাস করি যে, যে সমস্ত তাওহীদপন্থী মুমিন আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি এবং তাদের মধ্যে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোন কারণও পাওয়া যায়নি কিন্তু তারা গুনাহ ও পাপের কাজে লিপ্ত হয়েছে তাদের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দিবেন অথবা ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ﴾

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে থাকেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮) কুরআন ও হাদীছে পাপী মুমিনদের এমন অনেক আমলের বর্ণনা এসেছে যাতে তাদের জন্য শাস্তির কথা এসেছে। তবে উহা তাদের চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া আবশ্যক করেনা। তাদের এক শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শাফাআতের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। তিনি বলেনঃ

«شَفَاعَتِي لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِي»

‘‘আমার উম্মতের কবীরা গুনায় লিপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আমার শাফাআত’’। (তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাহ, সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ৫৫৯৮) তিনি আরো বলেন,

«لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِيٍّ دَعْوَتَهُ وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللَّهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا»

‘‘সকল নবীর জন্য এমন একটি দু’আ রয়েছে, যা আল্লাহ কবুল করবেন। দুনিয়াতে সকল নবী আল্লাহর কাছে দু’আ করে নিয়েছেন। আর আমি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের সুপারিশের জন্য দু’আটি রেখে দিয়েছি। আমার উম্মতের যে ব্যক্তি শির্ক না করে মৃত্যু বরণ করবে সে ব্যক্তি ইনশা-আল্লাহ তা পাবে’’। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ঈমান)

[5] - এতে তারা তাদের আমলের তুলনায় অধিক বিনিময় লাভ করবেন। এমর্মে অনেক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। দেখুনঃ শরহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, পৃষ্ঠা নং- ২০৫।

[6] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবু বাদ্ইল খাল্ক।

[7] - মুসলিমদের যেসব শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায় তারা তাদের পিতামাতার জন্য সুপারিশ করবে এবং মুমিনগণও পরস্পরের জন্য সুপারিশ করবে। আল্লাহই অধিক অবগত আছেন।

[8] - নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শাফাআত চাওয়ার হুকুমঃ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের মাঠে সর্ব প্রথম সুপারিশ করবেন এবং তাঁর সুপারিশই সর্বপ্রথম গৃহীত হবে। কিন্তু তাঁর কাছে শাফাআত চাওয়া বৈধ নয়। কারণ কিয়ামতের মাঠে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে গিয়ে এ কথা বলা যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে দ্রুত ফয়সালা করার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করুন এবং দুনিয়াতে কেউ যদি বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছে শাফাআত প্রার্থনা করছি- উভয় কথা এক নয়। এমনিভাবে তিনি জীবিত থাকাবস্থায় তাঁর কাছে গিয়ে একথা বলা যে, হে আল্লাহর নবী! আমার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করুন এবং তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর উক্ত কথা বলা এক নয়। কারণ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর তিনি কারো জন্য দু’আ করতে সক্ষম নন। সুতরাং রাসূলের কাছে শাফাআত বা অন্য কিছু চাওয়া শির্কের অন্তর্ভূক্ত।

যদি কেউ বলেঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাফাআতের অধিকার দেয়া হয়েছে। সুতরাং আমি তাঁর কাছে এমন একটি জিনিষ চাচ্ছি, যা তাঁকে দেয়া হয়েছে এবং তাঁর মালিকানায় রয়েছে।

উত্তরে আমরা বলবো যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে শাফাআতের অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর কাছে শাফাআত চাইতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا﴾

‘‘মসজিদসমূহ আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকোনা’’। (সূরা জিনঃ ১৮) শাফাআত চাওয়া দু’আ চাওয়ার অন্তর্ভূক্ত। আর দু’আ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃالدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ অর্থাৎ দু’আ হচ্ছে এবাদতের মূল। অন্য বর্ণনায় আছে দু’আ হচ্ছে সর্বোত্তম ইবাদত। সুতরাং দু’আ যেহেতু এবাদত তাই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছেই দু’আ করতে হবে। রাসূল বা অন্য কোন মাখলূকের কাছে দু’আ করা সুস্পষ্ট শির্ক।

এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে আমরা রাসূলের শাফাআত লাভে ধন্য হতে পারি? রাসূলের শাফাআত পেতে হলে সকল প্রকার শির্ক থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে।

কেউ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে শাফাআত চাওয়ার পরিবর্তে এভাবে বলে যে, হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন আমাকে রাসূলের শাফাআত থেকে মাহরূম করোনা কিংবা যদি বলেঃ হে আল্লাহ! রোজ হাশরে আমার জন্য রাসূলের শাফাআত নসীব করো, তাহলে কতই না সুন্দর হবে সেই দু’আ!