এই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সৃষ্টির নিকটবর্তী। সেই সাথে আরো বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনি মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়া উপরে থাকার পরিপন্থী নয়

وجوب الإيمان بقربه من خلقه وأن ذلك لاينافي علوه وفوقيته

এই বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সৃষ্টির নিকটবর্তী। সেই সাথে আরো বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনি মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়া উপরে থাকার পরিপন্থী নয়:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَقَدْ دَخَلَ فِي ذَلِكَ الْإِيمَانُ بِأَنَّهُ قَرِيبٌ مُجِيبٌ كَمَا جَمَعَ بَيْنَ ذَلِكَ فِي قَوْلِهِ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ الْآيَةَ، وَقَوْلِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ الَّذِي تَدْعُونَهُ أَقْرَبُ إِلَى أَحَدِكُمْ مِنْ عُنُقِ رَاحِلَتِهِ وَمَا ذُكِرَ فِي الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ مِنْ قُرْبِهِ وَمَعِيَّتِهِ لَا يُنَافِي مَا ذُكِرَ مِنْ عُلُوِّهِ وَفَوْقِيَّتِهِ فَإِنَّهُ سُبْحَانَهُ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ فِي جَمِيعِ نُعُوتِهِ وَهُوَ عَلِيٌّ فِي دُنُوِّهِ قَرِيبٌ فِي عُلُوِّهِ

আল্লাহ তাআলা মাখলুকের অতি নিকটবর্তী হন এবং তিনি তাদের আহবানে সাড়া দেন। আল্লাহ তাআলার এই সিফাত দু’টির প্রতি বিশ্বাস করা আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তিনি নিজেকে যেসব সুউচ্চ গুণাবলী দ্বারা বিশেষিত করেছেন, সেগুলোর প্রতি ঈমান আনয়ন করার মধ্যে শামিল। যেমন আল্লাহ তাআলা ঐ দু’টি সিফাতকে অর্থাৎ মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের আহবানে সাড়া দেয়াকে একই আয়াতে একত্র করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ﴾

‘‘আর হে নবী! আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই৷ যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাকের জবাব দেই, কাজেই তাদের উচিৎ আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার উপর ঈমান আনয়ন করা। এতে আশা করা যায় যে, তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে’’। (সূরা বাকারাঃ ১৮৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

إِنَّ الَّذي تَدْعُونَهُ أَقْرَبُ إِلَى أَحَدِكُمْ مِنْ عُنُقِ رَاحِلَتِهِ

‘‘তোমাদের কেউ বাহনে আরোহন করা অবস্থায় তার বাহনের ঘাড়ের যত নিকটবর্তী থাকে, তোমরা যাকে আহবান করছো, তিনি তার চেয়েও অধিক নিকটে’’। আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটে ও সাথে থাকার বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহয় যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ঐসব আয়াত ও হাদীছের পরিপন্থী নয়, যাতে বলা হয়েছে যে, তিনি মাখলুকের উপরে রয়েছেন। কেননা আল্লাহর সমস্ত সুউচ্চ সিফাতের কোনো সদৃশ নেই। তিনি নিকটে থেকেও সৃষ্টির উপরে এবং উপরে থেকেও তাদের নিকটে।


ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সৃষ্টির উপরে এবং তিনি স্বীয় আরশের উপর সমুন্নত। পূর্বোক্ত অধ্যায়সমূহে শাইখুল ইসলাম দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে ইহা প্রমাণ করার পর এই অধ্যায়ে বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা উপরে, -এই বিশ্বাসের সাথে আরো বিশ্বাস করা জরুরী যে, তিনি মাখলুকের অতি নিকটে। আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটে, -এই কথা বিশ্বাস করাও আল্লাহ তাআলার প্রতি এবং আল্লাহর সুউচ্চ সিফাতসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের অন্তর্ভূক্ত। তিনি মাখলুকের অতি নিকটে এবং তিনি মাখলুকের দুআ শ্রবণ করেন। আল্লাহ তাআলা এই দু’টি বিশেষণকে একসাথে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ নিকটে থাকা ও দুআ শ্রবণ করা, -এই দু’টি বিশেষণ আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ﴾

‘‘আর হে নবী! আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই৷ যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের উচিৎ আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার উপর ঈমান আনয়ন করা। এতে আশা করা যায় যে, তারা সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে’’।

এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমণ করল। সে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ কি আমাদের নিকটে যে, আমরা তাঁকে নিরবে ডাকবো? না কি তিনি আমাদের থেকে অনেক দূরে যে, উঁচু আওয়াজে ডাকবো?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। তখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়।[1] আল্লাহ তাআলা বলেনঃ فإني قريب আমি আহবানকারীর অতি নিকটে। সে যখন আমাকে ডাকে, আমি তখন তার ডাকে সাড়া দেই।

এই আয়াত প্রমাণ করে যে, দু’আ চুপিসারেই করা উচিৎ। দু’আতে আওয়াজ উঁচু করার কোন প্রয়োজন নেই। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

إِنَّ الَّذي تَدْعُونَهُ أَقْرَبُ إِلَى أَحَدِكُمْ مِنْ عُنُقِ رَاحِلَتِهِ

‘‘তোমাদের কেউ বাহনে আরোহন করা অবস্থায় তার বাহনের ঘাড়ের যত নিকটবর্তী থাকে, তোমরা যাকে আহবান করছো, তিনি তার চেয়েও অধিক নিকটে’’। এই হাদীছের ব্যাখ্যা পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলার কাছে যে ব্যক্তি দুআ করে, তিনি জবাব দেয়ার মাধ্যমে তার নিকটবর্তী হন। এই নিকটবর্তী হওয়া আল্লাহ তাআলা উপরে থাকার পরিপন্থী নয়। এ জন্যই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটে ও সাথে থাকার বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ্য় যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ঐসব আয়াত ও হাদীছের পরিপন্থী নয়, যাতে বলা হয়েছে যে, তিনি মাখলুকের উপরে রয়েছেন। কেননা সবগুলোই সত্য। সত্য বিষয় কখনো পরস্পর বিরোধী হয়না। আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ সিফাতের কোন সদৃশ নেই।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সিফাতের ব্যাপারে এই কথা বলা যাবেনা যে, তিনি যখন সৃষ্টির উপরে থাকবেন, তখন মাখলুকের সাথে থাকেন কিভাবে? কেননা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণেই এই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ভুল ধারণাটি হচ্ছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে মাখলুকের সাথে কিয়াস করা। এই কিয়াস বাতিল। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কোন সদৃশ নেই।অতএব একই সাথে উপরে ও নিকটে থাকা আল্লাহ তাআলার সুমহান সিফাতের মধ্যে মিলিত হতে পারে। কেননা তিনি সর্বাধিক মহান, সবেচেয়ে বড়, মহামহিম এবং তিনি সমস্ত সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন। একজন বান্দার হাতে একটি সরিষার দানা যেমন, বিশাল বিশাল সাতটি আসমান আল্লাহ তাআলার হাতের মধ্যে ঠিক ঐ পরিমাণ স্থহান দখল করে। সুতরাং যার বড়ত্বের কিছু দিক এ রকমই, তিনি কত বড়!! যিনি এত বড়, তাঁর জন্য আরশের উপরে থাকা এবং যখন ইচ্ছা আরশের উপরে থেকেই মাখলুকের নিকবর্তী হওয়া কিভাবে অসম্ভব হতে পারে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা علي في دنوه قريب في علوه ‘‘নিকটে থেকেও উপরে এবং উপরে থেকেও নিকটে’’। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলগুলো এ কথারই প্রমাণ করে। এই কথার উপর মুসলিম মিল্লাতের আলেমগণের ইজমা সংঘটিত হয়েছে।[2] আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অন্যতম সুমহান সিফাত হচ্ছে عَلِيٌّ في دنوه ‘‘তিনি মাখলুকের নিকটে থাকা অবস্থায়ও উপরে থাকেন’’ এবং قريب في علوه ‘‘আরশের উপরে থাকা অবস্থায়ও মাখলুকের নিকটে থাকেন’’।[3]

[1] - দেখুন তাফসীরে ইবনে জারীর আত্ তাবারী, ইবনে আবী হাতিম এবং অন্যান্য।

[2] - তাদের এই কথার কোন বিরোধী না থাকাই ইজমা সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ। কেউ যদি বিরোধীতা করতো, তাহলে অবশ্যই আমরা তা জানতাম। আমরা যেহেতু কোন বিরোধী পাইনি, তাই বুঝা গেল এই কথা সকলেই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন এবং তাতে আলেমদের ইজমা হয়েছে।

[3] - যদিও আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত, তারপরও বলা যায় যে, বর্তমানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন এমন অত্যাধুনিক যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা উপরে থাকা এবং মাখলুকের সাথে ও নিকটে থাকার বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করে। আমরা প্রচারমাধ্যম কিংবা টেলিফোনের মাধ্যমে বহু দূরে অবস্থানকারী কারো কথা শুনতে পাই, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাকে একদম কাছে ও সামনে দেখতে পাই এবং তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতেও দেখি। মহান আল্লাহর কোন সৃষ্টি যদি বহু দূরে থেকেও অন্যের একদম কাছে ও সামনে ভাসতে পারে, তাহলে যেই মহান আল্লাহ সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা, তার ব্যাপারে কিভাবে এই ধারণা করা যেতে পারে যে, মাখলুকের বহু উপরে থেকে তাদের নিকটবর্তী হওয়া অসম্ভব? সাধারণ একটি সৃষ্টি হয়েও মানুষের পক্ষে যদি এতকিছু করা সম্ভব, দূরের বস্ত্তকে কাছে দেখা সম্ভব, তাহলে যেই মহান স্রষ্টার জন্য কোন কিছুই অসম্ভব নয়, তার জন্য দূরে থেকেও কাছে থাকা এবং নিকটে থেকেও উপরে থাকা মোটেই অসম্ভব নয়।