৮- মুমিনগণ কিয়ামতের দিন তাদের রবকে দেখতে পাবে

৮- إثبات رؤية المؤمنين لربهم يوم القيامة

৮- মুমিনগণ কিয়ামতের দিন তাদের রবকে দেখতে পাবে:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ ليلة البدر لا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ، فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لا تُغْلَبُوا عَلَى صَلاةٍ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا فَافْعَلُوا» (بخارى:554)

‘‘কোন অসুবিধা ছাড়াই তোমরা যেমন পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রকে দেখতে পাও, সেভাবেই তোমরা অচিরেই তোমাদের প্রভুকে দেখতে পাবে। সুতরাং তোমাদের যদি এই পরিমাণ সামর্থ থাকে, সূর্য উদয় এবং অস্তের পূর্বের নামায হতে কোন বস্তুই তোমাদেরকে পরাভুত করতে পারবেনা, তাহলে উক্ত নামাযদ্বয়কে তোমরা যথাসময়ে আদায় করো।


ব্যাখ্যাঃ এখানে إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ দ্বারা মুমিনদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। سترون এর মধ্যে যে سين অক্ষরটি প্রবেশ করেছে, তা ভবিষ্যৎকালের জন্য হলেও এখানে তা দ্বারা তাগিদ তথা বাক্যের বিষয়কে শক্তিশালী করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের চোখ দ্বারা আল্লাহ তাআলাকে দেখবে। মুমিনগণ তাদের রবকে দেখার বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে মুতাওয়াতির তথা ব্যাপক সংখ্যক বর্ণনাকারীর সূত্রে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[1]

كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ ليلة البدر তোমরা যেমন পূর্ণিমার রাতে এই চন্দ্রকে দেখতে পাওঃ অর্থাৎ চন্দ্র তার পরিপূর্ণ রূপ গ্রহণ করার রাতে। এটি হচ্ছে মাসের ১৪তম রাত। ঐ রাতে চন্দ্র আলোতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এখানে এই তাশবীহ তথা আল্লাহর দিদারকে পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখার সাথে তুলনা করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জোর দিয়ে আল্লাহর দিদারকে সত্য হিসাবে সাব্যস্ত করা এবং তার দ্বারা রূপকার্থ উদ্দেশ্য হওয়ার সন্দেহকে দূর করা। বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে যে, এখানে আল্লাহর দিদারকে পূর্ণিমার রাতের মেঘহীন আকাশে চাঁদ দেখার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলাকে চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়নি। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সদৃশ আর কিছুই নেই।

لا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ উহাকে দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয়নাঃ تا বর্ণে পেশ দিয়ে এবং ميم বর্ণে যবর দিয়ে পড়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের উপর এমন কোনো যুলুম হয়না যে, ভীড়ের কারণে কেউ দেখতে পাবে আবার কেউ দেখতে পাবেনা।

لاتضامون এর তা تا বর্ণে যবর দিয়ে এবং ميم বর্ণে তাশদীদ দিয়ে পড়া হয়েছে। এভাবে পড়া হলে এর মাসদার হবে التضامّ। অর্থাৎ পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখার জন্য তোমাদের একজনকে অন্যজনের কাছে গিয়ে মিশতে হয়না। এই বর্ণনা অনুসারে অর্থ হবে, চাঁদ দেখার জন্য তোমাদের সবাইকে এক স্থানে জড়ো হওয়ার প্রয়োজন হয়না। যাতে খুব ভীড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

উভয় বর্ণনার অর্থ একসাথে এই হবে যে, নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। এই দেখা সত্য। তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকেই দেখতে পাবে।

فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لا تُغْلَبُوا সুতরাং তোমাদের যদি সামর্থ থাকে যে, কোনো বস্ত্তই তোমাদেরকে পরাভুত করতে পারবেনাঃ অর্থাৎ সূর্যোদয়ের পূর্বের নামাযটি পড়া হতে তোমরা পরাজিত হয়ে যাবেনা। এটি হচ্ছে ফজরের নামায। আর সূর্য ডুবার পূর্বেও একটি নামায থেকে পরাভূত হবেনা। তা হচ্ছে আসরের নামায। তোমরা যদি উক্ত নামায দু’টি যথা সময়ে আদায়ের সামর্থ রাখো, তাহলে নামাযদ্বয় আদায় করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার ত্রুটি ও গাফেলতী করোনা। বরং জামাআতের সাথে এবং সঠিক সময়ে এই নামায দু’টি আদায়ে যত্নবান হও। এই দু’টি নামাযকে খাস করে উল্লেখ করার কারণ হলো, এতে ফেরেশতাগণ একসাথে মিলিত হয়।[2] সুতরাং আসর ও ফজরের নামায পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মধ্যে সর্বোত্তম। তাই যে ব্যক্তি এই নামায দু’টি যত্নসহকারে আদায় করবে, সে সর্বোত্তম পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হবে। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা।

হাদীছ থেকে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, কিয়ামতের দিন খোলাখুলিভাবে এবং কপালের চোখ দিয়ে প্রকাশ্যভাবেই মুমিনগণ তাদের রবকে দেখতে পাবে।[3] যে আয়াতগুলোতে আল্লাহর দিদার সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা করার সময় ঐসব লোকের আলোচনা ও প্রতিবাদ পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে, যারা এই মাসআলায় বিরোধীতা করেছে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহর দিদারকে অস্বীকার করেছে।


[1] - যারীর, সুহাইব, আনাস, আবু হুরায়রা, আবু মুসা, আবু সাঈদ ও অন্যান্য সাহাবী (রাঃ) হতে সহীহ এবং সুনানের কিতাবগুলোতে এসমস্ত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«أَنَّ النَّاسَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ نَرَى رَبَّنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَلْ تُضَارُّونَ فِي الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَهَلْ تُضَارُّونَ فِي الشَّمْسِ لَيْسَ دُونَهَا سَحَابٌ قَالُوا لَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ فَإِنَّكُمْ تَرَوْنَهُ كَذَلِكَ»

‘‘একদল লোক বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রভুকে দেখতে পাব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ পূর্ণিমার রাত্রিতে চন্দ্রকে দেখতে কি তোমাদের কোন অসুবিধা হয়? তারা বললঃ না কোন অসুবিধা হয়না। তিনি আবার বললেনঃ আকাশে মেঘ না থাকলে সূর্য দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয় কি? তারা বললঃ না কোন অসুবিধা হয়না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা কিয়ামতের দিন এরকম পরিস্কারভাবেই আল্লাহকে দেখতে পাবে’’। কাইস বিন আবু হাযেম বলেনঃ

«سَمِعْتُ جَرِيرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ وَهُوَ يَقُولُ كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ نَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ فَقَالَ أَمَا إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لَا تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ»

‘‘আমি জারির বিন আব্দুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ একদা পুর্ণিমার রাত্রিতে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর পাশে বসা ছিলাম। তিনি চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই তোমরা যেভাবে এই চন্দ্রটিকে দেখতে পাচ্ছ অচিরেই সেভাবে তোমরা তোমাদের প্রভুকে দেখতে পাবে’’।

সুতরাং প্রকাশ্যভাবেই মু’মিনগণ কিয়ামতের দিন আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে পাবে। এটিই হবে বেহেশতের ভিতরে মু’মিনদের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত। যারা এর বিরোধীতা করবে তাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। ‘‘যেমন কর্ম তেমন ফল’’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে তারা আল্লাহর দর্শন থেকে বঞ্চিত হবেন বলে আলেমদের যে বক্তব্য রয়েছে সেটাই প্রণিধানযোগ্য।

[2] - আসর ও ফজরের নামাযে ফেরেশতাদের মিলিত হওয়ার হাদীছটি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ وَصَلَاةِ الْعَصْرِ ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ فَيَسْأَلُهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي فَيَقُولُونَ تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ»

‘‘তোমাদের নিকট রাতে একদল ফেরেশতা এবং দিনে একদল ফেরেশতা পালাক্রমে আগমণ করে থাকেন। তারা ফজর ও আসরের নামাযের সময় একসাথে একত্রিত হয়। অতঃপর তোমাদের কাছে যে দলটি ছিল, তারা উপরে উঠে যায়। মহান আল্লাহ জানা সত্ত্বেও তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছো? তাঁরা বলেনঃ আমরা তাদেরকে নামায অবস্থায় ছেড়ে এসেছি এবং যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখন তারা নামাযেই ছিল’’। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং- ৫৩০)

[3] - এখান থেকে সুস্পষ্ট রূপেই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর আকার রয়েছে। তবে তা কেমন, তা আমরা জানিনা। কিন্তু যিনি তাঁর সৃষ্টিকে এত সৌন্দর্য দান করেছেন, তিনি অতি সুন্দর হবেন, - এটি যুক্তি ও বিবেক দ্বারা সমর্থিত। হাদীছে রয়েছে, إن الله جميل يحب الجمال অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা অতি সুন্দর। তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সুতরাং আল্লাহ নিরাকার এই কথা বলা মারাত্মক ভূল।