২২- تنزيل القرأن من الله تعالى
২২- কুরআন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে:
আল্লাহ তাআলা সূরা আনআমের ১৫৫ নং আয়াতে বলেন, ﴿وَهَٰذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ فَاتَّبِعُوهُ وَاتَّقُوالَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾ ‘‘আর এটি একটি বরকতপূর্ণ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি। কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং তোমরা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করো, হয়তো তোমাদের প্রতি রহম করা হবে’’। আল্লাহ তাআলা সূরা হাশরের ২১ নং আয়াতে বলেনঃ
﴿لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾
‘‘আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে৷ আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে’’। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿وَإِذَا بَدَّلْنَا آيَةً مَّكَانَ آيَةٍ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يُنَزِّلُ قَالُوا إِنَّمَا أَنتَ مُفْتَرٍ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِن رَّبِّكَ بِالْحَقِّ لِيُثَبِّتَ الَّذِينَ آمَنُوا وَهُدًى وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ لِّسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُّبِينٌ﴾
‘‘যখন আমি একটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াত দ্বারা বদল করি, আর আল্লাহ ভালো করেই জানেন তিনি কি নাযিল করবেন- তখন এরা বলে, তুমি নিজেই এ কুরআনের রচনাকারী৷ আসলে এদের অধিকাংশই জানেনা৷ এদেরকে বলো, একে তো রূহুল কুদুস সত্য সহকারে তোমার রবের পক্ষ থেকে নাযিল করেছে, যাতে মুমিনদের সুদৃঢ় করা যায়। আর এটি মুসলিমদের জন্য হেদায়াত ও সুসংবাদ স্বরূপ। আমি জানি এরা তোমার সম্পর্কে বলে, এ ব্যক্তিকে একজন লোক শিক্ষা দেয়৷ অথচ এরা যে ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে তার ভাষা তো আরবী নয়৷ আর এটি হচ্ছে পরিষ্কার আরবী ভাষা’’। (সূরা নাহালঃ ১০১-১০৩)
ব্যাখ্যা: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) যখন আল্লাহ তাআলার জন্য কালাম সাব্যস্ত করার দলীলগুলো উল্লেখ করলেন এবং এই কথা সাব্যস্ত করলেন যে, কুরআনুল কারীম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কালাম, তখন ঐসব দলীল বর্ণনা শুরু করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।
وَهَٰذَا এটিঃ এখানে কুরআনুল কারীমের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে ইসমে ইশারা মুবতাদা। তার খবর হচ্ছে كتاب। أنزلناه আমি অবতীর্ণ করেছি এবং مبارك (বরকত সম্পন্ন) এই দু’টি كتاب এর সিফাত। এখানে অবতীর্ণ করা সিফাতকে مبارك এর আগে উল্লেখ করার কারণ হলো কাফেররা মুহাম্মাদ সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কুরআন অবতীর্ণ হওয়াকে অস্বীকার করতো। প্রচুর বরকত ওয়ালা বস্ত্তকে مبارك বলা হয়। কুরআনকে বরকত ওয়ালা বলার কারণ হলো তাতে রয়েছে দ্বীন ও দুনিয়ার প্রচুর বরকত ও কল্যাণ।
لَوْ أَنزَلْنَا هَٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ‘‘আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছেঃ এখানে কুরআনের ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন শুনে এবং কুরআন তেলাওয়াতের সময় অন্তর ভীত হওয়া আবশ্যক। কেননা কুরআন যদি পাহাড়ের উপর নাযিল করা হতো, তাহলে পাহাড় এত কঠিন ও মজবুত হওয়া সত্ত্বেও কুরআন বুঝার পর আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হতো এবং আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ফেটে যেত। সুতরাং হে মানব! এটি কিভাবে সম্ভব যে, কুরআন শুনে তোমাদের অন্তর নরম হয়না এবং তা ভীতও হয়না? অথচ তোমরা আল্লাহর আদেশ বুঝতে সক্ষম হয়েছ এবং তাঁর কিতাব অনুধাবন করেছ।
وَإِذَا بَدَّلْنَا آيَةً مَّكَانَ آيَةٍ যখন আমি একটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াত দ্বারা বদল করিঃ এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনুল কারীম সম্পর্কে একটি কুফুরী শুবুহাত (সন্দেহের) বর্ণনা শুরু করেছেন এবং তার জবাব দিয়েছেন। বদল করার অর্থ হলো কোন জিনিষকে নিজ স্থান থেকে উঠিয়ে নিয়ে তার স্থলে অন্য জিনিষ স্থাপন করা। আয়াতকে বদল করার তাৎপর্য হচ্ছে তা উঠিয়ে নিয়ে তার স্থলে অন্য একটি আয়াত রাখা। এর নাম হচ্ছে এক আয়াতের মাধ্যমে অন্য আয়াত মানসুখ বা রহিত করা।
قالوا এরা বলেঃ অর্থাৎ কুরাইশ গোত্রের কাফেররা মানসুখ করার হিকমত সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে বলেঃ হে মুহাম্মাদ! নিশ্চয়ই তুমি মিথ্যা রচনাকারী। আল্লাহর উপর জবান লম্বা করছো। তোমার ধারণা এই যে, আল্লাহ তোমাকে একটি বিষয়ে আদেশ করেছেন। পুনরায় ধারণা করো যে, আল্লাহ তোমাকে প্রথম আদেশের বিপরীত অন্য এক আদেশ দিয়েছেন। তাই আল্লাহ তাআলা তাদের কথার এমন জবাব দিয়েছেন, যাতে তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ মিলে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ আসলে এদের অধিকাংশই জানেনাঃ অর্থাৎ মূলতঃ তারা কোন জ্ঞানই রাখেনা এবং নসখ বা রহিত হওয়ার হিকমত সম্পর্কেও তারা অবগত নয়। কুরআনের এক আয়াতকে অন্য আয়াত দ্বারা পরিবর্তন করার মধ্যে কী পরিমাণ উপকারিতা রয়েছে, তা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। কখনো একটি বিষয় শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশেষ একটি স্বার্থ থাকে। অতঃপর সেই সময় পার হওয়ার পর তার বদলে অন্য একটি বিষয় শরীয়তভূক্ত করার মধ্যেই উপকার লক্ষ্য করা যায়। এই কাফেরদের বিবেক-বুদ্ধির উপর থেকে যদি পর্দা উঠে যেত, তাহলে তারা বুঝতে সক্ষম হতো যে, মানসুখ করাই সঠিক, ইনসাফপূর্ণ এবং সহজ-সরল।
অতঃপর তারা যে ধারণা করেছিল, এই পরিবর্তন মুহাম্মাদের নিজের পক্ষ হতে এবং এর মাধ্যমে সে মিথ্যা রচনা করেছে, আল্লাহ তাআলা তাদের ধারণার প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ! তুমি বলো যে, এই কুরআন নাযিল করেছেন রূহুল কুদুস তথা জিবরীল। কুদুস অর্থ পবিত্র। আসল অর্থ হচ্ছে الروح المطهر (পবিত্র আত্মা) এটি নাযিল করেছে। روح القدسঃ এখানে মাওসুফকে (রূহকে) সিফাতের (কুদুসের) দিকে ইযাফত সম্বোধন করা হয়েছে।
من ربك তোমার রবের পক্ষ হতেঃ অর্থাৎ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ হতে।
بالحق সত্য সহকারেঃ এটি হাল হিসাবে নসবের স্থানে পতিত হয়েছে। অর্থাৎ মূল বাক্যটি এ রকম হতে পারে متصفا بكونه حقا সত্য অবস্থায় এই কুরআন নাযিল হয়েছে।
لِيُثَبِّتَ الَّذِينَ آمَنُوا যাতে মুমিনদের সুদৃঢ় করা যায়ঃ অর্থাৎ যাতে মুমিনদেরকে ঈমানের উপর মজবুত রাখা যায় সেই জন্য তোমার উপর জিবরীলের মাধ্যমে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। নাসেখ মানসুখও আল্লাহর পক্ষ হতেই এসেছে। যাতে মুমিনগণ বলতে পারে যে, নাসেখ এবং মানসুখের প্রত্যেকটিই আমাদের রব আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে। বিশেষ করে যখন তারা জানতে পারবে যে, নসখ (রহিত) করার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে, তখন তারা ঈমানের উপর সুদৃঢ় থাকবে।
وَهُدًى وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ আর এটি মুসলিমদের জন্য হেদায়াত ও সুসংবাদ স্বরূপঃ এখানে هدى এবং بشرى শব্দ দু’টি ليثبت এর অবস্থানের উপর আতফ (স্থাপন) করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল বাক্যটি এ রকম হতে পারেঃ تثبيتا لهم وهداية وبشرى।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা কাফেরদের সন্দেহগুলো থেকে আরেকটি সন্দেহ বর্ণনা করেছেন এবং জবাব দিয়েছেন।
نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ আমি জানি এরা তোমার সম্পর্কে বলে, এ ব্যক্তিকে একজন লোক শিক্ষা দেয়ঃ অর্থাৎ আমি অবশ্যই জানি যে, এই কাফেররা বলেঃ একজন মানুষ মুহাম্মাদকে কুরআন শিক্ষা দেয়। আসমানের কোন ফেরেশতা তাঁর নিকট কুরআন নিয়ে আসেনা। যেই মানুষটি তাকে কুরআন শিক্ষা দেয়, সে এর আগে তাওরাত, ইঞ্জিল এবং অনারবদের কিতাবাদি পাঠ করেছে। কারণ মুহাম্মাদ একজন অশিক্ষিত মানুষ। কুরআনে অতীতের যেসব খবর উল্লেখ করা হচ্ছে, মুহাম্মাদের দ্বারা তা রচনা করা সম্ভব নয়।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের কথার জবাব এইভাবে দিয়েছেন যে,لِّسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ অথচ এরা যে ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে তার ভাষা তো আরবী নয়ঃ অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! যেই ব্যক্তি তোমাকে কুরআন শিক্ষা দেয় বলে তারা ধারণা করছে, তার ভাষা আরবী নয়। সে আরবী বলতে পারেনা। আর এই কুরআন তো পরিষ্কার আরবী ভাষায়। অর্থাৎ এই কুরআন অলঙ্কারপূর্ণ আরবী ভাষায় এবং এর বর্ণনা সুস্পষ্ট। সুতরাং তোমরা কিভাবে ধারণা করছ যে, একজন অনারব লোক মুহাম্মাদকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছে? অথচ তোমরা কুরআনের মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়েছ, অক্ষম হয়েছ কুরআনের মত কয়েকটি বা একটি সূরা আনয়ন করতে। তোমরা আরবী ভাষার লোক, সুস্পষ্ট আরবী বলায় পারদর্শী এবং অলঙ্কারপূর্ণ বক্তব্য প্রদানকারীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় হওয়ার পরও তোমরা কুরআনের মোকাবেলা করতে অক্ষম হয়েছ।
উপরোক্ত আয়াতগুলোর শিক্ষাঃ উপরোক্ত আয়াতে কারীমাগুলো থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, কুরআন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআন আল্লাহরই কালাম। ফেরেশতা বা কোন মানুষের কালাম নয়। যারা বলে কুরআন আল্লাহর কালাম নয়; সৃষ্টির কালাম, এখানে তাদের কথারও প্রতিবাদ করা হয়েছে। এই আয়াতে আল্লাহর জন্য মাখলুকের উপর সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে। কেননা নাযিল কেবল উপর থেকেই হয়। (আল্লাহই সর্বাধিক জানেন)