২০- إثبات معية الله لخلقه
২০- আল্লাহ তাআলা তাঁর মাখলুকের সাথে:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنْ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾
‘‘তিনিই আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে এবং যা ভূমি থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা আকাশে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথেই, তোমরা যেখানেই থাকনা কেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন’’। (সূরা হাদীদঃ ৪) আল্লাহ আরো বলেন,
﴿أَلَمْ تَرَى أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
‘‘তুমি কি ভেবে দেখোনি যে, আসমান-যমীনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোনো পরামর্শ হয়না যাতে তিনি চতুর্থ হিসাবে না থাকেন এবং পাঁচ জনের হয় না, যাতে ষষ্ঠ না থাকেন। তাদের সংখ্যা এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক, তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথেই, তারা যা করে তিনি কিয়ামতের দিন তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’’। (সূরা মুজাদালাহঃ ৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا﴾
‘‘যদি তোমরা তাঁকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, যখন তাঁকে কাফেররা বহিস্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেনঃ বিষন্ন হয়োনা আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সূরা তাওবাঃ ৪০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ﴿قَالَ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ﴾ ‘‘ভয় করোনা, আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছি’’। (সূরা তোহাঃ ৪৬) আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ﴾
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, যারা মুত্তাকী হয়েছে এবং যারা সৎকর্ম করে’’। (সূরা নাহলঃ ১২৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾
‘‘তোমরা সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যই আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা আনফালঃ ৪৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾
‘‘আল্লাহর হুকুমে কতক ক্ষুদ্র দল অনেক বিরাট দলকে পরাজিত করেছে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৪৯)
ব্যাখ্যা: প্রথম আয়াতের هوالذي থেকে শুরু করে وما يعرج فيها পর্যন্ত ব্যাখ্যা পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। وَهُوَمَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ ﴾ ﴿ তিনি তোমাদের সাথেই, তোমরা যেখানেই থাকনা কেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তোমাদের সাথে আছেন, তোমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তোমরা যেখানে যে অবস্থাতেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের কাজ-কর্ম দেখছেন। তোমরা স্থলভাগে থাকাবস্থায় যা করো, জলভাগে থাকা কালে যা করো, রাতের অন্ধকারে যা করে থাকো, দিবাভাগে যা করো, গৃহাভ্যন্তরে যা করো এবং নির্জন মরুভূমিতে যা করো, তার সবই তিনি অবগত আছেন। তাঁর জ্ঞানে সবকিছুই সমান। অর্থাৎ তিনি সকল সৃষ্টির অবস্থা সম্পর্কে সমানভাবে অবগত আছেন। সবকিছুই তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টির অধীনে। তিনি তোমাদের কথা শ্রবণ করছেন এবং তোমাদের অবস্থান দেখছেন। আয়াতের এই স্থান থেকেই দলীল গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে দৃষ্টি রাখেন। তোমাদের আমলের কোন কিছুই তাঁর নিকট গোপন নয়।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয়না, যাতে তিনি চতুর্থ হিসাবে না থাকেন এবং পাঁচ জনের হয়না, যাতে ষষ্ঠ না থাকেনঃ পরামর্শ বলতে গোপন পরামর্শ উদ্দেশ্য। মোটকথা তিনজনের কোন পরামর্শ হয়না, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে এভাবে চারে পরিণত করে দেন এবং পাঁচজনের গোপন পরামর্শকে এভাবে ছয়জনের পরামর্শে পরিণত করেন যে, তিনি তাদের সেই গোপন পরামর্শে অংশ গ্রহণ করেন এবং তা জেনে ফেলেন। তিন এবং পাঁচ সংখ্যাদ্বয়কে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কারণ হলো অধিকাংশ গোপন পরামর্শকারীর সংখ্যা তিন অথবা পাঁচজন হয়ে থাকে। অথবা আয়াতটি তিনজনের কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং পাঁচজনের অন্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে। অন্যথায় আল্লাহ তাআলা কমবেশী প্রত্যেক সংখ্যার সাথে আছেন। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ﴿وَلَا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ﴾ ‘‘তাদের সংখ্যা এর চেয়ে কম হোক বা বেশী হোক, তিনি তাদের সাথেই আছেন’’। অর্থাৎ উল্লেখিত সংখ্যার কম হোক, যেমন একজন বা দুইজন এবং উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশী হোক, যেমন ছয়জন বা সাতজন। ইলমের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদের সাথেই আছেন। তারা গোপনে যেই পরামর্শ করে, আল্লাহ তাআলা তা অবগত হন। ফলে সেই গোপন পরামর্শের কোন কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন থাকেনা।
তাফসীরকারগণ বলেনঃ ইহুদী এবং মুনাফেকরা গোপনে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করতো। তারা এর মাধ্যমে মুমিনদের মধ্যে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিত যে, তারা এমন বিষয়ে পরামর্শ করছে, মুমিনদের জন্য কষ্টদায়ক। এতে করে মুমিনরা চিন্তায় পড়ে যেত। এ বিষয়টি দীর্ঘ দিন চলতে থাকলে এবং তা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অভিযোগ করল। তখন তিনি ইহুদী ও মুনাফেকদেরকে আদেশ দিলেন যে, তারা যেন মুসলিমদের বাদ দিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত না হয়। কিন্তু এতে তারা বিরত থাকলনা বরং তারা বারবার গোপন পরামর্শ করতেই থাকল। তখন আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করলেন।
هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا তারা যেখানেই থাকে না কেন, তিনি তাদের সাথে আছেনঃ এর অর্থ হচ্ছে যে স্থানেই তাদের গোপন পরামর্শ হয়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা স্বীয় ইলমের মাধ্যমে তা পরিবেষ্টন করে নেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদের আমল সম্পর্কে সংবাদ দিবেন এবং তাদেরকে সে অনুযায়ী বদলা দিবেন। এর মাধ্যমে তাদেরকে ভয় দেখানো হয়েছে এবং ধমক দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বিষয়ে পরিজ্ঞাত। তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন নয়।
এই আয়াত থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাথে আছেন। এটি হচ্ছে সাধারণ বা সার্বজনীন সাথে থাকা। এ অর্থে তিনি সকল সৃষ্টির সাথেই রয়েছেন। এই প্রকার সাথে থাকার অত্যাবশ্যকীয় দাবী হচ্ছে, তিনি ক্ষমতার মাধ্যমে এবং ইলমের মাধ্যমে সবকিছুকে ঘিরে আছেন। তিনি সকলের সব অবস্থা ও আমল সম্পর্কে অবগত আছেন। এই জন্যই ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেছেনঃ এই আয়াতটি আল্লাহর ইলমের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং ইলমের মাধ্যমে শেষ হয়েছে।
لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا বিষন্ন হয়োনা আল্লাহ আমাদের সাথে আছেনঃ হিজরতের পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আবু বকর (রাঃ) যখন গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর সাথী আবু বকরকে এই কথা বলেছিলেন। মক্কার মুশরেকরা তাদের নিকটে চলে এসেছিল। আবু বকর (রাঃ) তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কাফেরদের কষ্টের ভয় করছিলেন। তিনি তখন আবু বকরকে বলেছিলেনঃ তুমি বিষন্ন হয়োনা। অর্থাৎ তুমি দুঃশ্চিন্তা পরিহার করো। আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে রয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর সাহায্য, সমর্থন ও শক্তি আমাদের সাথে রয়েছে। সুতরাং যার সাথে আল্লাহ রয়েছেন, সে কখনো পরাজিত হবেনা। আর যাকে পরাজিত করা সম্ভব হবেনা, তার চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
উপরের আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, তাতে মুমিনদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ সান্নিধ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এহেন সাথে থাকার দাবী হচ্ছে মুমিনদেরকে সাহায্য, হেফাজত ও শক্তিশালী করা।
আল্লাহ তাআলা মুসা ও হারুন (আঃ)কে বলেছেনঃ إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَىٰ আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছিঃ সুতরাং ফেরাউনকে ভয় করোনা। ভয় করতে নিষেধ করার কারণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণীঃ إنني معكما ‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি’’। অর্থাৎ তোমাদের উভয়কে ফেরাউনের বিরুদ্ধে সাহায্য করার মাধ্যমে আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি তোমাদের উভয়ের এবং ফেরাউনের কথা শুনছি। তোমাদের উভয়ের অবস্থান এবং ফেরাউনের অবস্থান দেখছি। তোমাদের কারো কোন অবস্থা আমার কাছে গোপন নয়।
এই আয়াত থেকেও দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহর অলীদের জন্য আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ সান্নিধ্য রয়েছে। এটি হচ্ছে সাহায্য, সমর্থন ও শক্তিশালী করার সান্নিধ্য। সেই সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য শ্রবণ ও দৃষ্টি সাব্যস্ত করা হয়েছে।
إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেনঃ অর্থাৎ যারা হারাম ও সকল প্রকার গুনাহর কাজ ছেড়ে দেয় এবং এখলাসের সাথে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে রয়েছেন। সুতরাং যারা আনুগত্যের কাজগুলো সঠিকভাবে আদায় করে এবং আল্লাহর আদেশগুলো পালন করে, সহযোগিতা ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের সান্নিধ্যেই আছেন। এটি হচ্ছে বিশষ এক প্রকার সান্নিধ্য। আয়াতে কারীমা থেকে গ্রন্থকার এটিই সাব্যস্ত করেছেন।
وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ তোমরা সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যই আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেনঃ আল্লাহ তাআলা এখানে সবরের আদেশ দিয়েছেন। সবরের আসল অর্থ হচ্ছে নফসকে আটকিয়ে রাখা। তবে এখানে সবর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কাফের ও মুসলিমদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধকালে সবর করা ও দৃঢ়পদ থাকা। অতঃপর সবরের এই আদেশ করার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সবরকারীদের সাথে আছেন। সুতরাং যেসব কাজে সবর করা দরকার, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ঐসব কাজে সবরকারীদের সাথে আছেন।
এই আয়াতে কারীমা থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, এখানে ঐ সকল সবরকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিশেষ সান্নিধ্য রয়েছে, যারা আনুগত্যের কাজে সবর করে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।
ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেনঃ কতই না সুন্দর এই সান্নিধ্য! যাকে এটি দান করা হয়েছে, কোন শক্তি বা ব্যক্তিই তাকে পরাজিত করতে পারবেনা। কোন দিক থেকেই তার উপর চড়াও হওয়া যাবেনা। যদিও শত্রু বাহিনী হয় অগণিত।
كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِۗ আল্লাহর হুকুমে কতক ক্ষুদ্র দল অনেক বিরাট দলকে পরাজিত করেছেঃ [1] অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ও ফয়সালা অনুযায়ী অনেক ছোট দল অনেক বড় দলকে পরাজিত করেছে।
وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেনঃ এই অংশ থেকেই দলীল গ্রহণ করা হয়েছে। যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার সময় সবর করে, তাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সান্নিধ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটি হচ্ছে বিশেষ সান্নিধ্য। যার দাবী হচ্ছে সাহায্য ও শক্তিশালী করা।
উপরের সবগুলো আয়াতের অভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তাতে আল্লাহর সান্নিধ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এই সান্নিধ্য দুই প্রকার।
(১) সাধারণ ও ব্যাপক সান্নিধ্য। যেমন বলা হয়েছে প্রথম দুই আয়াতে। এই প্রকার সান্নিধ্যের তাৎপর্য হলো আল্লাহ তাআলা ক্ষমতার মাধ্যমে সকল সৃষ্টিকে ঘিরে আছেন। সমস্ত মানুষের ভাল-মন্দ সব আমল সম্পর্কেই তিনি অবগত আছেন এবং তাদেরকে আমল অনুযায়ী বিনিময়ও দিবেন।
(২) আল্লাহর মুমিন বান্দাদের জন্য রয়েছে এক বিশেষ সান্নিধ্য। এই প্রকার সান্নিধ্যের দাবী হচ্ছে মুমিন বান্দাদেরকে সাহায্য করা, শত্রুর মোকাবেলায় তাদেরকে শক্তিশালী করা এবং তাদেরকে হেফাযত করা। সম্মানিত লেখক এই অধ্যায়ে যেসব আয়াত উল্লেখ করেছেন, তার মধ্য হতে শেষের পাঁচটি আয়াতে এই প্রকার সান্নিধ্যের কথাই প্রমাণ করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মাখলুকের সান্নিধ্যে থাকা সৃষ্টির উপরে থাকা এবং আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার পরিপন্থী নয়। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মাখলুকের নিকটে ও সান্নিধ্যে থাকা এক মাখলুক অন্য মাখলুকের সাথে থাকার মত নয়। কেননা لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ ‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। কেননা সান্নিধ্য সাধারণত কাছে থাকার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। পরস্পর স্পর্শ করা কিংবা পরস্পর সমান হওয়া জরুরী নয়। আরবরা বলে থাকে, مازلنا نمشى والقمر معنا)) আমরা চলছিলাম। চলন্ত অবস্থায় চন্দ্র আমাদের সাথেই ছিল। অথচ চন্দ্র তাদের মাথার অনেক উপরে এবং তাদের মাঝে এবং চন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব অনেক। সুতরাং আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির উপরে হওয়া এবং তাদের সান্নিধ্যে হওয়ার পরিপন্থী নয়।[2] সামনে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে। ইনশা-আল্লাহ।
[2] - উল্লেখিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে জানা গেল যে, আল্লাহ সৃষ্টির সাথে আছেন। তবে অর্থ এ নয় যে, তিনি মাখলুকের সাথে মিশে সর্বত্র বিরাজমান; বরং এর অর্থ হলো আল্লাহ তাআলা আরশের উপর থেকে স্বীয় জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে সমস্ত মাখলুককে ঘিরে আছেন। কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়।
আর আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীল, মুত্তাকী ও সৎকর্মশীলদের সাথে থাকার অর্থ এই যে, সাহায্য ও হেফাযতের মাধ্যমে তিনি তাঁদের সাথে আছেন। আল্লাহ স্বীয় মাখলুকের নিকটে থাকা আরশের উপরে থাকার পরিপন্থী নয়। কেননা আল্লাহ মাখলুকের নিকটে বা সাথে থাকা এক মাখলুক অন্য মাখলুকের নিকটে বা সাথে থাকার মত নয়। আরশের উপরে সমুন্নত থেকে সমস্ত মাখলুকের যাবতীয় বিষয়ের খবর রাখার ভিতরেই আল্লাহর পূর্ণ ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি শুনেন এবং দেখেন। (সূরা শুরাঃ ১১)
মোটকথা আমরা জানি, কুরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের বিরোধী নয়। তাই আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। কারণ এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে অসংখ্য দলীল রয়েছে। এমনিভাবে অন্যান্য দলীলের মাধ্যমে জানা যায় যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। উভয় প্রকার দলীলের মাঝে সমন্বয় করতে গিয়ে আমরা বলিঃ যেখানে বলা হয়েছে আল্লাহ মানুষের সাথে আছেন তার অর্থ হচ্ছে জ্ঞানের মাধ্যমে, শক্তির মাধ্যমে এবং সমর্থনের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আর বাস্তবে তিনি স্বীয় সত্ত্বায় আরশের উপরে সমুন্নত। তবে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার উক্তি থেকে বুঝা যায়, তিনি এভাবে সকল ক্ষেত্রেই উভয় প্রকার দলীলের মধ্যে সমন্বয় করার পক্ষপাতী নন। তার কথার অর্থ হচ্ছে দলীলের মাধ্যমে যেহেতু প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টির উপরে এবং তিনি মহান আরশের উপর সমুন্নত, তাই আমরা তাতে বিশ্বাস করি। তিনি কিভাবে, কি অবস্থায় উপরে এবং কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত তা আল্লাহই জানেন। আমরা জানিনা। এই রকমই অন্যান্য দলীলের মাধ্যমে যেহেতু প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহ মাখলুকের অতি নিকটে ও সাথে, তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ মাখলুকের নিকটে এবং সাথেই। তবে তিনি কিভাবে মাখলুকের নিকটে ও সাথে, তার অবস্থা ও ধরণ আমরা জানিনা। এ ব্যাপারে তিনিই অবগত।
সকল মাখলুকের উপর তার ক্ষমতা। সে হিসাবে তিনি তাদের নিকটেই, কেউ তাঁর ক্ষমতার বাইরে নয়। তিনি যেহেতু মাখলুকের সকল অবস্থা ও আমল সম্পর্কে জানেন, সে হিসাবেও তিনি তাদের অতি নিকটে। কোন কিছুই তাঁর ইলমের বাইরে নয়।
আর তিনি তাঁর অলীদের সাথে রয়েছেন। এটি হচ্ছে বিশেষ ও সাধারণ সৃষ্টির চেয়ে অতিরিক্ত এক নৈকট্য ও সান্নিধ্য। তিনি তাঁর অলীদেরকে শত্রুদের উপর শক্তিশালী করেন এবং সাহায্য করেন।
তাছাড়া আমাদের কারো কথা, ‘‘আমি তোমার সাথে আছি’’ এর অর্থ এ নয় যে, আমি তার সাথে মিশে আছি। আমরা অন্যকে উদ্দেশ্য করে বলে থাকে, তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে। অথচ যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, সে থাকে এক শহরে। আর যাকে লক্ষ্য করে বলা হলো সে থাকে অন্য এক শহরে। (আল্লাহই সর্বাধিক জানেন)