আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদেরকে ঠিক সেভাবেই ভালবাসেন, যেভাবে তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়

৬- إثبات محبة الله ومودته لأوليائه على ما يليق بجلاله

৬- আল্লাহ তাআলা তাঁর অলীদেরকে ঠিক সেভাবেই ভালবাসেন, যেভাবে তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়:[1]

আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ وَأَحْسِنُوا ۛ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾

‘‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করোনা৷ আর তোমরা ইহসান (অনুগ্রহ) করো, কেননা আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন’’৷ (সূরা বাকারাঃ ১৯৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

﴿وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾

‘‘ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও৷ তারপরও যদি দু’টি দলের একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো৷ যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে৷ এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করে দাও এবং ইনসাফ করো৷ আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন’’। (সূরা হুজুরাতঃ ৯) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

‘‘কাজেই যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি রক্ষা করে চলবে ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য সোজা-সরল থাকো৷ কারণ আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন’’। (সূরা তাওবাঃ ৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ﴾

‘‘তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে? বলে দাওঃ এটি একটি অপরিচ্ছন্ন অবস্থা৷ এ সময় তোমরা স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকো এবং তারা পাক-সাফ না হওয়া পর্যন্ত (সহবাসের উদ্দেশ্যে) তাদের ধারেকাছেও যেয়োনা৷ তারপর যখন তারা পাক-পবিত্র হয়ে যায়, তাদের কাছে যাও যেভাবে যাবার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই যারা তাওবা করে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২২২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

‘‘বলো! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাকারী ও দয়ালু’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি তার দ্বীন থেকে ফিরে যায়, তাহলে আল্লাহ আরো এমন বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবেনা৷ এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি উহা দান করেন৷ আল্লাহ ব্যাপক অনুগ্রহ ও প্রাচুর্যের অধিকারী এবং সর্বজ্ঞ’’। (সূরা মায়িদাঃ ৫৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُم بُنْيَانٌ مَّرْصُوصٌ﴾

‘‘আল্লাহ সেসব লোকদের ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সিসা গলিয়ে ঢালাই করা এক মজবুত দেয়াল’’। (সূরা সাফঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَهُوَ الْغَفُورُ الْوَدُودُ ‘‘তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু’’। (সূরা বুরুজঃ ১৪)


ব্যাখ্যা: যেসব আয়াত আল্লাহ তাআলার অন্যতম সিফাত إراده (ইচ্ছা) সাব্যস্ত করেছে, তা উল্লেখ করার পর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে ঐসব আয়াত উল্লেখ করেছেন, যা আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার আরেকটি সিফাত المحبة (ভালবাসা) সাব্যস্ত করে। যারা বলে আল্লাহর ইচ্ছা ও ভালবাসা একই সমান এবং তারা এই উভয় সিফাতের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য করেনা, এই অধ্যায়ে শাইখুল ইসলাম তাদেরও প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলে থাকে, আল্লাহর ইচ্ছা ও ভালবাসা পরস্পর সম্পৃক্ত এবং উভয়ের প্রত্যেকটির জন্য অন্যটি আবশ্যক। সে হিসাবে আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা করেন, তা অবশ্যই ভালবাসেন। পূর্বে এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা এমন জিনিষেরও ইচ্ছা করেন, যা তিনি ভালবাসেন না এবং উহাকে পছন্দও করেন না। যেমন কাফেরের কুফরী এবং সমস্ত পাপাচার। এগুলোকে তিনি স্বীয় ইচ্ছায় বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তা বান্দার দ্বারা সংঘটিত হওয়া তিনি পছন্দ করেন না। আর তিনি এমন বিষয়েরও ইচ্ছা করেন, যা তিনি ভালবাসেন ও পছন্দ করেন। যেমন ঈমান আনয়ন করা এবং সকল প্রকার আনুগত্যের কাজকে তিনি ভালবাসেন

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وأحسنوا অর্থাৎ তোমরা ইহসান করো। এটি হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে আদেশ। তিনি তার বান্দাদেরকে ইহসান করার আদেশ করেছেন। পূর্ণরূপে এবং সর্বোত্তমভাবে কর্ম সম্পাদন করাকে ইহসান বলা হয়। ইহসান হচ্ছে আনুগত্যের সর্বোচ্চ পর্যায়।[2]

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসান কারীদেরকে ভালবাসেঃ এটি হচ্ছে ইহসানের আদেশ করার কারণ। আল্লাহ তাআলা ইহসান করার আদেশ করেছেন। কেননা তিনি ইহসান করাকে এবং যারা ইহসান করে, তাদেরকে ভালবাসেন। বান্দারা যখন জানতে পারবে যে, আল্লাহ তাআলা ইহসান কারীদেরকে ভালবাসেন, তখন তারা আদেশ পালনের জন্য উৎসাহ পাবে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وأقسطوا অর্থাৎ তোমরা ন্যায় বিচার করো। এখানে আল্লাহ তাআলা ইকসাত করার আদেশ দিয়েছেন। ইকসাত হচ্ছে লেনদেন ও বিচার-ফয়সালা করার সময় নিকটবর্তী ও দূরবর্তীর মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য না করে সকলের প্রতি ইনসাফ করার নাম।

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقسطين নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেনঃ এটি হচ্ছে ইনসাফের আদেশ করার কারণ। তিনি ইনসাফ করাকে ভালবাসেন বলেই বান্দাদেরকে তা করার আদেশ দিয়েছেন। বান্দাদের জন্য আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার ভালবাসার দাবী হচ্ছে তিনি তাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করবেন।

فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْকাজেই যতক্ষণ তারা তোমাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি রক্ষা করে চলবে ততক্ষণ তোমরাও তাদের জন্য সোজা-সরল থাকোঃ অর্থাৎ মুশরেকরা যতক্ষণ তোমাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করে চলবে এবং চুক্তির বরখেলাফ করবেনা, তোমরাও ততক্ষণ তাদের সাথে সম্পাদিত অঙ্গীকার পূর্ণ করে চলবে। এই সময়ের মধ্যে তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত হবেনা।

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتقين নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেনঃ এটি অঙ্গীকার ও চুক্তি ঠিক রাখার আদেশ করার কারণ। তিনি ওয়াদা-অঙ্গীকার ও চুক্তি রক্ষা করার আদেশ করেছেন। কেননা এটি ঐ সমস্ত মুত্তাকীদের আমলের অন্তর্ভূক্ত, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, চুক্তি রক্ষা করা এবং তা ঠিক রাখা মুত্তাকীদের কাজ। ছাওয়াবের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার সাথে সাথে পাপাচার থেকে বিরত থাকার নাম التقوى।

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْتَوَّابِيْنَ নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেনঃ تواب এর বহুবচন হচ্ছে التوابين। التوبة ক্রিয়ামূল থেকে এটি صيغة المبالغة তথা আধিক্য বাচক শব্দ। তাওবা শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। শরীয়তের পরিভাষায় পাপাচার থেকে ফিরে আসা এবং উহা বর্জন করাকে التوبة বলা হয়। তাওবা শব্দটি বান্দার পক্ষ হতে ব্যবহৃত হলে এই অর্থ হবে।

আর যখন উহা আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হবে, তখন التواب আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার অন্যতম নাম হিসাবে গণ্য হবে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ বান্দা تواب (অধিক তাওবাকারী) এবং আল্লাহ তাআলা التواب তথা অধিক হারে বান্দার তাওবা কবুলকারী।

বান্দার তাওবা হচ্ছে তার মালিক ও রবের দিকে ফিরে আসা। আল্লাহর তাওবা দুই প্রকার। (১) বান্দাকে তাওবা করার তাওফীক দেয়া। (২) বান্দার তাওবা কবুল করা।

ويحب المتطهرين আল্লাহ তাআলা পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালবাসেনঃ متطهر এর বহুবচন المتطهرين। এটি الطهارة ক্রিয়ামূল থেকে إسم فاعل। বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীন ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করাকে তাহারাত বলা হয়। এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি দুই প্রকার লোককে ভালবাসেন। তারা হচ্ছেন তাওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারী।

আল্লাহ তাআলা বলেন, قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّه বলোঃ যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেনঃ এই আয়াতে কারীমা নাযিল হওয়ার শানে নুযুল হচ্ছে, যেমন ইবনে কাছীর (রঃ) এবং অন্যরা বলেছেনঃ একদল লোক দাবী করলো যে, তারা আল্লাহকে ভালবাসে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই আয়াত দ্বারা পরীক্ষা করলেন। কেননা এই আয়াত প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির বিপক্ষে ফয়সালাকারী, যে আল্লাহকে ভালবাসার দাবী করে, কিন্তু সে মুহাম্মাদী তরীকার উপর নয়। বরং সে তার দাবীতে মিথ্যুক।

يححببكم الله আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেনঃ মুহাম্মাদী তরীকার অনুসরণ করলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহকে যে পরিমাণ ভালবাসতে চাচ্ছ, তার চেয়ে বেশী পরিমাণ আল্লাহর ভালবাসা তোমরা অর্জন করতে পারবে। তোমাদের জন্য আল্লাহর ভালবাসা আল্লাহর প্রতি তোমাদের ভালবাসার চেয়ে অনেক বেশী।

আল্লাহর বাণীঃ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ তাহলে আল্লাহ আরো বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালবাসবেঃ এটি পূর্বোক্ত বাক্যের মধ্যে যেই শর্ত রয়েছে, তার জবাব। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার দ্বীন থেকে সরে পড়বে, তাহলে সে সরে যাক। তার বদলে আল্লাহ তাআলা এমনসব লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালবাসবে। আল্লাহ তাআলা এখানে তার মহান কুদরতের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলছেন, যেসব লোক তার দ্বীনের সাহায্য করা হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং তাঁর শরীয়ত কায়েম করা হতে বিমুখ হবে, তিনি তাদের বদলে তাদের চেয়ে উত্তম লোক সৃষ্টি করবেন। তাদের চরিত্র, বৈশিষ্ট ও মর্যাদা হবে সুউচ্চ। তাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ভালবাসবেন। তারাও আল্লাহকে ভালবাসবে। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে আবু বকর (রাঃ) এবং তাঁর বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হয়ে যেসব সাহাবী ও তাবেয়ী রিদ্দার যুদ্ধে শরীক ছিলেন। অতঃপর তাদের পরে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যারা আগমণ করবে, তাদের মধ্য হতে যারা মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, তারাও আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করে ধন্য হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ আল্লাহ সেইসব লোকদের ভালবাসেন যারা তাঁর পথে লড়াই করেঃ এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দৃঢ়তার সাথে সংবাদ দিয়েছেন, যারা এই বৈশিষ্টের অধিকারী, তিনি তাদেরকে ভালবাসেন। যারা জান ও মাল দিয়ে কালেমায়ে তাওহীদকে বিজয়ী করার জন্য তাঁর রাস্তায় জিহাদ করে, তাদেরকে তিনি ভালবাসেন। صفاً অর্থাৎ তারা যুদ্ধের সময় নিজেদেরকে কাতারবন্দী করে নেয় এবং নিজেদের স্থান থেকে সরে যায়না।

كأنهم بنيان مرصوص তারা যেন সিসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় এক মজবুত প্রাচীরঃ তারা সীসা ঢালা এমন প্রাচীরের ন্যায় পরস্পর কাতারবন্দী থাকে, যার এক অংশ অন্য অংশের সাথে মিলিত থাকে। তাতে কোন প্রকার ছিদ্র এবং ত্রুটি থাকেনা।

وهو الغفور তিনি ক্ষমাশীলঃ আল্লাহ তাআলা অত্যাধিক ক্ষমাশীল। الغفر শব্দের অর্থ হচ্ছে الستر অর্থাৎ ঢেকে রাখা। গুনাহ করার পর যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট তাওবা করে আল্লাহ তাআলা তার সেই গুনাহ ক্ষমা করে দেন অর্থাৎ তার গুনাসমূহ ঢেকে রাখেন এবং তার অপরাধসমূহ মাফ করে দেন। আল্লাহর الودود নামটি الود থেকে নেওয়া হয়েছে। নির্ভেজাল ও পরিশুদ্ধ ভালবাসাকে ودٌّ বলা হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হচ্ছেন ওয়াদুদ। এর অর্থ হচ্ছে, যারা তাঁর আনুগত্য করে, তিনি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসেন।

আল্লাহ তাআলা তাঁর এ দু’টি সম্মানিত নাম الغفور এবং الودود-কে একসাথে উল্লেখ করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম তাৎপর্য রয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার গুনাহ মাফ করেই ক্ষ্যান্ত হন না; বরং তিনি প্রথমে বান্দাকে ক্ষমা করেন অতঃপর তাকে ভালবাসেন।

উপরোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলার জন্য ভালবাসা সাব্যস্ত করা হয়েছে। তিনি কোন কোন ব্যক্তিকে, কোন কোন আমলকে এবং কিছু কিছু স্বভাব-চরিত্রকে ভালবাসেন। তিনি কোন জিনিষকে ভালবাসেন আবার তাঁর হিকমতের দাবী অনুযায়ী কোন বিষয়কে ভালবাসেন না। তিনি ইখলাসের সাথে আমলকারী, মানুষের প্রতি অনুগ্রহকারী, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকারী, মুত্তাকী, তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী, আল্লাহর পথে জিহাদকারী, তাওবাকারী, পবিত্রতা অর্জনকারী এবং অন্যান্য সৎকর্ম সম্পাদনকারীদেরকে ভালবাসেন।

উপরের আয়াতগুলোতে উভয় পক্ষ হতেই ভালবাসা সংঘটিত হয় বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বান্দার পক্ষ হতে ভালবাসা হয় এবং আল্লাহর পক্ষ হতেও হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালবাসবে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّه বলোঃ যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন। এখানে ঐ সব লোকের প্রতিবাদ রয়েছে, যারা উভয় পক্ষ হতেই ভালবাসা সংঘটিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। যেমন জাহমীয়া ও মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা। তারা বলেছে, আল্লাহ ভালবাসেন না। বান্দার পক্ষ হতেও আল্লাহর জন্য ভালবাসা হয়না। আল্লাহর জন্য বান্দাদের ভালবাসার ব্যাখ্যা তারা এইভাবে করেছে যে, বান্দারা আল্লাহকে ভালবাসে, -এর মানে হচ্ছে আল্লাহর এবাদত ও আনুগত্য করাকে ভালবাসে এবং আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ভালবাসেন, -এর মানে হচ্ছে তিনি তাদের প্রতি অনু্গ্রহ করেন ও তাদেরকে ছাওয়াব প্রদান করেন। এমনি আরো অনেক অপব্যাখ্যাই তারা করে থাকে।

এই تأويل (অপব্যাখ্যা) সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রকৃতভাবেই তাঁর বান্দাদেরকে ভালবাসেন। তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে যেরকম ভালবাসা শোভনীয় হয়, তিনি সেভাবেই ভালবাসেন। আল্লাহর ভালবাসা তাঁর অন্যসব সিফাতের (বিশেষণের) মতই। আল্লাহর ভালবাসা মাখলুকের পরস্পরের ভালবাসার মত নয়।


[1]- আল্লাহ তাআলার অন্যতম সিফাত (বিশেষণ) হচ্ছে তিনি তাঁর বন্ধুদেরকে ভালবাসেন। অন্যান্য সিফাতের মতই ভালবাসাও আল্লাহর একটি সিফাত। আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদর জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এটি তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা আবশ্যক। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে যে কয়টি আয়াত উল্লেখ করেছেন, তা ছাড়াও এমর্মে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنْ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ﴾

‘‘জান্নাত তৈরী করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতা ও অভাবের সময় ব্যয় করে। যারা নিজেদের রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। মূলতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালবাসেন’’। (সূরা আল ইমরানঃ ১৩৩-১৩৪) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ﴾

‘‘যে লোক নিজ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং তাকওয়া অর্জন করবে, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালবাসেন। (সূরা আল-ইমরানঃ ৭৬)

উপরোক্ত আয়াতসমূহে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা কতিপয় ব্যক্তির কাজ এবং স্বভাবকে ভালবাসেন। যেমন তিনি মানুষের প্রতি অনুগ্রহকারী, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকারী, মুত্তাকী, আল্লাহর পথে জিহাদকারী, তাওবাকারী, পবিত্রতা অর্জনকারী এবং অন্যান্য সৎকর্ম সম্পাদন কারীদেরকে ভালবাসেন। তবে আল্লাহ তাআলার ভালবাসা বান্দার ভালবাসার মত নয়।

[2] - الإحسان এর একাধিক প্রকার রয়েছে। (১) দ্বীনের সর্বোচ্চ স্তরকে ইহসান বলা হয়। এটি বান্দা ও তার রবের মধ্যকার স্তর। এটি শুধু আল্লাহর জন্যই সাব্যস্ত। হাদীছে এসেছে, জিবরীল (আঃ) যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে ইহ্সান সম্পর্কে বলুনঃ তখন তিনি বললেনঃ

(أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ)

‘‘ইহসান হল, এমন ভাবে তুমি আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করবে যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁকে দেখতে না পাও তবে বিশ্বাস করবে যে, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন’’ (২) মানুষের পারস্পরিক অনুগ্রহ এবং অভাবগ্রস্তদের জন্য অর্থ ব্যয় করাকেও ইহসান বলা হয়। (৩) পরিপূর্ণ ও সর্বোত্তমভাবে কাজ করার নামও ইহসান।