যুগে যুগে যারা সত্য দ্বীনের খেদমতে নিজেদের জীবন ও যৌবন ব্যয় করেছেন, তাদের কেউই যুলুম-নির্যাতন থেকে রেহাই পান নি। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইসলামের নামে প্রচলিত ভ্রান্ত মতবাদের কঠোর প্রতিবাদ করার কারণে স্বার্থবাদী ও বিদ্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হন। সর্বেশ্বর ও অদ্বৈতবাদীদের লোকেরা তাদের মতবাদ প্রচার করার সাথে সাথে প্রকাশ্যে মদ পান এবং সমস্ত হারাম কাজেই লিপ্ত হতো। কারণ তাদের মতানুযায়ী অস্তিত্ব যখন মাত্র একটি তখন হালাল হারামের পার্থক্য থাকবে কেন? শরীয়তেরই বাধ্যবাধকতা থাকবে কেন? তাদেরকে যখন বলা হলো এই বক্তব্য তো কুরআন-হাদীছের বিরোধী, তখন তারা বলল, কুরআন-হাদীছের দলীলের মাধ্যমে নয়; বরং কাশফের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য প্রমাণিত। মোটকথা কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা, অলী-আওলীয়াদের উসীলা ধরা, তিন তালাকের মাসআলাসহ আরো অনেক কারণে ইমাম ইবনে তাইমিয়া হিংসুকদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। কুচক্রীরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। এক পর্যায়ে তারা সরকারের সহায়তা লাভে সমর্থ হয়। মিশরের তদানীন্তন শাসককে তারা ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। আর তখন সিরিয়া ও মিশর ছিল একই রাষ্ট্রভূক্ত। রাজধানী ছিল মিশরের কায়রোতে। সিরিয়া ছিল মিশরের অন্তর্ভূক্ত একটি প্রদেশ। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা সহজেই সরকারকে প্রভাবিত করে ফেলে। তাদের প্ররোচনার ফলে শাহী ফরমানের মাধ্যমে ইমামকে কায়রোতে চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। ২২ রামাযান জুমআর দিন তিনি মিশরে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছে কেল্লার জামে মসজিদে নামায পড়ার পর তিনি আলোচনা শুরু করতে চান। কিন্তু তাঁর কিছু কিছু আকীদাহ-চিন্তা ইসলাম বিরোধী হওয়ার অভিযোগে তাকে কথা বলার অনুমতি না দিয়ে জনতাকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর কাযী ইবনে মাখলুফের নির্দেশে তাঁকে কেল্লার বরুজে কয়েকদিন আটক রাখার পর ঈদের রাতে মিশরের বিখ্যাত জুব কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।
তাঁর কারাবরণের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ইতিহাসের কিতাবসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি বিভিন্ন মেয়াদে ২১বার কারা বরণ করেছেন। যতবারই তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করে অন্যায় স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই তিনি সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। শর্তসাপেক্ষ কারাগার থেকে বের হওয়ার সুযোগ তিনি একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জেলখানার ভিতরে তিনি দেখলেন কয়েদীরা নিজেদের মন ভুলাবার ও সময় কাটানোর জন্য আজে বাজে কাজ করছে। তাদের একদল তাস খেলছে। আরেকদল দাবা খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে। নামাযের দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। খেলার ঝোকে নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে। ইমাম এতে আপত্তি জানালেন, তাদেরকে নামাযের প্রতি আহবান জানালেন এবং আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশগুলো তাদের সামনে তুলে ধরলেন। তাদের পাপকাজগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার উপদেশ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই জেলখানার মধ্যে দ্বীনি ইলমের এমন চর্চা শুরু হয়ে গেল যে, সমগ্র জেলখানাটি একটি মাদরাসায় পরিণত হলো। অবস্থা এমন হলো অনেক কয়েদী মুক্তির ঘোষনা শুনেও আরো কিছুদিন শাইখের সংস্পর্শে থেকে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলো।
মূলতঃ সুফীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা, কবর ও মাযারের উদ্দেশ্যে সফর করা, তালাকের মাসআলা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি মাসআলা নিয়ে ইমামের সাথে বিরোধীদের দ্বন্ধের কারণেই তাকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।