কুরআন ও সুন্নাহ্য় আল্লাহর সত্তা, তাঁর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী, ফেরেশতা, আখেরাত ইত্যাদি গায়েবী বিষয়কে যে সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে, তা ইসলামের গৌরবময় যুগে মুসলিমদের বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তারা বিষয়গুলো শুনে তা সহজভাবেই বুঝে নিয়েছেন এবং বিশ্বাস করেছেন। আর এ বিষয়গুলো বোধশক্তি ও যুক্তির মাধ্যমে বুঝার কোন সুযোগ নেই। অহীর উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। সেই সাথে গায়েবী বিষয়গুলো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
কিন্তু পরবর্তীতে যখন গ্রীক দর্শনের কিতাবাদি আরবীতে অনুবাদ করা হলো, তখন থেকেই ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারের উপর গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়তে থাকে। আববাসী খেলাফতকালে সরকারীভাবে এ কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ফলে মুসলিমদের লাইব্রেরীগুলো গ্রীক দর্শনের কিতাবে ভরপুর হয়ে যায়। মুসলিম বিদ্বানগণের গ্রীক দর্শনের দিকে ঝুকে পড়ে। ইসলামী আকীদাহর উপরও গ্রীক দর্শনের প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী, তাঁর কার্যাবলী, সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তি, পরিণাম, কিয়ামত, হাশর-নশর, মানুষের আমলের ফলাফল এবং এ ধরণের অন্যান্য গায়েবী বিষয়গুলো জানার জন্য কুরআন-সুন্নাহর পথ ছাড়া আর কোন পথ নেই। চিন্তা-ভাবনা, আন্দাজ-অনুমান করে এ বিষয়গুলো জানা অসম্ভব। আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ধারে কাছে পৌঁছানো মানুষের বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে মানুষের কোন অভিজ্ঞতাও নেই। এসব চোখেও দেখা যায়না। কুরআন সুস্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, ليس كمثله شيئ وهو السميع البصير ‘‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। কাজেই এ বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলিম দার্শনিকরা কুরআন ও সুন্নাহর সহজ সরল উক্তিগুলো বাদ দিয়ে গায়েবী বিষয়গুলোর দার্শনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করে। তাদের জবাব দেয়ার জন্য আরেক শ্রেণীর মুসলিম আলেম দাঁড়িয়ে যান। তারাও দার্শনিকদের জবাবে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে থাকেন। কিন্তু তাদের উপস্থাপিত যুক্তি-তর্ক দার্শনিকদের জবাবে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তাদের যুক্তিগুলো ছিল দুর্বল। এগুলো সংশয় দূর করার বদলে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এমনসব জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যার জবাব কালামশাস্ত্রবিদগণ খুজেঁ না পেয়ে তারা নিজেরাই সংশয়ে পড়েছে।
ইমাম রাযী শেষ বয়সে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তিনি ইলেম কালাম দার্শন শাস্ত্রের উপর অনেক চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছেন। শেষে তিনি এ সিদ্বান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এর ফলে রোগীর রোগ নিরাময় হওয়ার চেয়ে আরো বৃদ্ধি পায়, এবং পিপাসার্তের পিপাসা মোটেই নিবারণ হয়না। তিনি বলেন, কুরআন-সুন্নাহর পদ্ধতিই আমি নিকটতর পেয়েছি।
আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর সত্তা ও গুনাবলী সম্পর্কে কালাম শাস্ত্রবিদ ও মুসলিম দার্শনিকগণ যে বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছেন, ইমাম ইবনে তাইমীয়া তাতে মোটেই সন্তুষ্টি ছিলেন না। কারণ তার মোকাবেলায় কুরআন-সুন্নাহর যুক্তি-প্রমাণ অনেক সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, দ্ব্যর্থহীন ও হৃদয়গ্রাহী। তাই ইমাম ইবনে তাইমীয়া আল্লাহর সত্তা ও গুনাবলী এবং ঈমানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মুসলিমদের উপর যা আবশ্যক, কুরআন-সুন্নাহর দলীলের আলোকে তিনি অত্যন্ত পরিস্কার ভাষায় উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয়ে তিনি একাধিক মূল্যবান কিতাব রচনা করেছেন এবং দার্শনিক কালামীদের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেন। ওয়াসেতীয়া, তাদমুরীয়া এবং হামুবীয়া এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।